প্রিয় দিও বিরহ,১৭,১৮,১৯
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
১৭.
রাত্রির মধ্যপ্রহর। উদরের কাছটায় কেমন অদ্ভুত স্পর্শ লাগছে মেহতিশার ৷ ঘুম হালকা হয়ে আসলো। চোখ মেলে উঠে বসলো। এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো দর্পণ ওর পেটের কাছটায় শুয়ে আছে। ওকে উঠতে দেখে মুচকি হাসলো। মেহতিশা মাথা ঝাকালো।
ঘড়িতে অনেক রাত হয়েছে। এতো রাত হলো কী করে!
সে তো দুপুরের খাবার রেডি করছিলো। বিছানায় আসলো কীভাবে! প্রশ্নবোধক চাহনিতে দর্পণের দিকে তাকালো। দর্পণ টেবিলসাইড থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে চামচ মুখের সামনে ধরে বললো,
‘সব পরে বলবো বউজান। আগে খাবারটা খেয়ে নিন৷ দুপুর থেকে না খাওয়া আপনি। ‘
মেহতিশা দ্বিরুক্তি করেনা। লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপটি করে খেয়ে নেয়। দর্পণ হাসে। পানি পান করিয়ে মুখটা মুছে দেয়। খাওয়া শেষ হওয়ার পর মেহতিশা দর্পণের হাত ঝাকায়। দর্পণ প্লেট রেখে মেহতিশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মেহতিশার হাতটা নিজের মাথার উপর রেখে বললো,
‘হাত বুলিয়ে দাও৷ ‘
মেহতিশা হেলান দিয়ে শুয়ে দর্পণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে ৷ দর্পণ দুই হাতে মেহতিশার কোমড় জড়িয়ে রেখে উদরে মুখ গুঁজে রেখে বললো,
‘আমি কদিন ধরে আপনাকে ঘুম থেকে উঠে বলতাম,
একটা মায়াবী পুতুলের মতো বাচ্চা আমাকে রোজ বাবাই বলে ডাকে। মনে আছে বউজান?’
মেহতিশা বললো,
‘হ্যা, থাকবেনা কেনো! গতকালই তো বললেন।’
দর্পণ তাকালো। মেহতিশা তার চোখের দিকে তাকিয়ে
দেখে দর্পণের চোখ বেয়ে উষ্ণ জলের কণা গড়িয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে। মেহতিশা ঘাবড়ে গেলো। দর্পণের গালে দুই হাত রেখে বললো,
‘হুশ! এভাবে বাচ্চাদের মতো কেউ কাঁদে দর্পণ! ‘
দর্পণ চোখ বুজলো। মেহতিশাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত করে বললো,
‘আমার স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে বউজান। আই এম গোয়িং টু বি এ ফাদার। আই ওয়ান্ট টু বি এ বেস্ট ফাদার ইন দা ওয়ার্ল্ড। ‘
–
শীতের ভাপা পিঠার মনমাতানো সুঘ্রাণ ভেসে আসছে।
কুয়াশা ভেদ করে দূরের বিশাল রাক্ষসী বিল্ডিং গুলো দেখা মুশকিল হয়ে গেছে। তালগাছ গুলো সুবিশাল মাটি জুড়ে সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাবুই পাখির সুদর্শন বাসাটা অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। দুইটা বাবুই পাখি বসে মাথা ঘষাঘষি করছে।
পেটের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখেই মেহতিশা হাসলো। সবে মাত্র দুই মাস। এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি। মেহতিশা আলতো পায়ে হেঁটে খাটে বসলো। রিং বাজছে মোবাইলে। এই নিয়ে দশম বার। কলটা রিসিভ করতে ইচ্ছে না করলেও কলটা উঠালো সে। প্রতি বারের চেয়েও উর্ধ্বে রাগত স্বর শোনা গেলো-
‘তোমার মাথা কী পুরোপুরি গেছে মেয়ে! আমি তোমাকে বারবার বলেছি তুমি ভুলেও এই ভুল করবে না। অথচ, তুমি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলে! কেনো করলে এমন! পেট বাঁধিয়ে বসে গেছো। কেনো! এতো ধৈর্যহীন কেনো! আমি তো বলেছিলামই। চারটে মাস শেষের পথে। আর মাত্র দুটো মাস ছিলো! ‘
মেহতিশার লজ্জায় অপমানে মাথা কাটা যায় যেনো। নিজের পিতার থেকে এমন শ্রীহীন বাক্য মোটেও কাম্য নয়। মেহতিশা ভেজা কন্ঠে বললো,
‘বাবা, এখন আমার কী করার আছে বলবে! ‘
‘কী করবে আর! কোনো মতে দুটো মাস থাকো। তারপর আমি তোমার এবর্শান করাবো। কাকপক্ষীও টের পাবে না। ‘
মেহতিশা রেগে গেলো। এতোদিন নির্বিকার থেকেছে শুধু এই ভেবে যে তিনি মেহতিশাকে বাঁচিয়েছিলেন।
বড় করেছেন আদর করে। তবে, এখন অনেক হয়েছে। আর একটুও সহ্য করবেনা সে। মেহতিশা চেঁচিয়ে বললো,
‘ব্যস,অনেক হয়েছে। এতোদিন সহ্য করেছি কারণ আমি কৃতজ্ঞ আপনার উপর৷ কিন্তু আজ আর না। আপনার কোনো কথাই আমি আর শুনবো না। দর্পণের উপর আমার বিশ্বাস আছে। সে কখনোই ভুল কিছু করবে না। আপনার সাহস কী করে হয়! আমার সন্তানকে নিয়ে বলার অধিকার নেই আপনার। আর কখনো কল করবেন না আমাকে। ‘
মেহতিশা কল কেটে দিলো। শামীউল্লাহ জামান তখন চিৎকার করে বলছেন,
‘খবরদার, এমন ভুল করোনা মেহু। তুমি পস্তাবে অনেক পস্তাবে! ‘
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
“প্রিয় দিও বিরহ”
১৮.
আমরা মানুষ ভালোবাসার বড্ড পাগল। যেখানে এক টুকরো ভালোবাসা পাই সেখানে অনড় হয়ে যাই। ভালোবাসাময় মানুষটাকে অন্ধ হয়ে বিশ্বাস করি। চোখে ভালোবাসার পট্টি বেঁধে ভালোবাসি। ধ্যান জ্ঞান সব হয় ওই মানুষটা৷ মেহতিশা সে দলের মানুষ। যে কিনা অল্পতেই রাগে, অল্পতেই হাসে,অল্পতেই ভালোবাসে। এ ধরনের মানুষরা নরম মনের হয় সাধারণত ভেতর থেকে। বাহির দিয়ে শক্ত। মেহতিশাকে প্রথম দেখলে যে কেউ নাকউঁচু রূপবতী মেয়ে ভাবতে বাধ্য। কিন্তু মেহতিশার সঙ্গে কয়েক দিন যে কেউ থাকলেই বুঝতে পারবে সে অত্যন্ত মসৃণ মনের। রেগে মাঝে মাঝে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও পরে কেঁদেকেটে একাকার হয়। দিয়ার তাই মনে হয়। দিয়া একটু ইন্ট্রোভার্ট ধরনের। সে সবার সাথে কথা বলে মিশতে পারেনা।
মেহতিশাকে যেদিন সে এ বাড়িতে প্রথম দেখলো তখন তা-ই ভেবেছিলো। মেহতিশার ফর্সা নিখুঁত চেহারাটা দেখে মনে মনে নিজেকে কেমন একটা ছোট মনে হচ্ছিল। আসলে, প্রতিটা মেয়েই নিজের চেয়ে সুন্দর কোনো মেয়েকে সামনে দেখলে তুলনা করে আপনা-আপনি। দিয়া সেদিন কথা বলতে একটুও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি মেহতিশাকে দেখে। একে তো সোনালী পাকা ধানের মতো গায়ের রং, বড় টানা চোখ,আর কাটকাট নাক। যেনো কোনো বলিউড সিনেমার নায়িকা। দিয়ার গায়ের রঙটা তার মায়ের মতো। একটু কালচে ধরনের। মুখের গঠন যদিও সুন্দর। কিন্তু, আবার উচ্চতা কম। নিজেকে নিয়ে একটা হীনমন্যতায় ভোগে সে। সবার সামনে তেমন একটা আসেনা। অনেক গুলো দিন কেটে যাওয়ার পর মেহতিশা যখন দিয়াকে খেয়াল করে। তখন মেহতিশা নিজেই সেধে কথা বলেছিলো। তাই একটু লজ্জাই পেয়েছিলো সে। দিয়া ইন্টার পাশ করে এবার অনার্সে ভর্তি হলো। নিজের থেকে বয়সে বড় একজন তার ঘরে এসে নিজ থেকে কথা বললো ভেবে একটু লজ্জিত হলো। তারপর নিজ থেকেই টুকটাক কথা বলতো। একটু মিশে যাওয়ার পর ভালোই লাগতো৷ সারাদিন ঘরবন্দী থেকে দমবন্ধ লেগে যায় ওর। যেদিন শুনলো মেহতিশা প্রেগন্যান্ট। সেদিন থেকে আরও বেশি খুুশিমনে এসে গল্প করতে লাগলো দিয়া। বিকাল হতেই রোজ এটা ওটা খাবার নিয়ে এসে রুমে বসে মেহতিশা আর দিয়া মুভি দেখে ল্যাপটপে। বিকেল হলো যখন তখনই দিয়া বই রেখে পপকর্ণ ভেজে মেহতিশার রুমের দিকে গেলো। মেহতিশা তখন ফোনে বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলো।
একা বসে বসে বোর হওয়ার থেকে তাই ভালো হবে বলে মনে হচ্ছিল। দর্পন সেই যে এক ঘন্টা থেকে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলছে। মেহতিশা কোনো কাজ না পেয়ে কথা বলছিলো। দর্পণ এখন সব কাজ থেকে ছুটি দিয়েছে তাকে ৷ দুই একটা কাজ করলেও দর্পণের রাগ দেখে কিছু করার সাহস পায়না৷ মেহতিশার কেনো জানি মনে হয় দর্পণ মেহতিশা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর অনেক রাগ দেখায়। মাঝে মাঝে তো মেহতিশার মনে হয় সে বুঝি এই বাচ্চাটার সৎ মা। যে কিনা বাচ্চাটাকে একটুও চায়না। উনিশ থেকে বিষ হলেই দর্পণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এই যেমন, সকালেই পানি খেতে গিয়ে কিছুটা পানি ফ্লোরে পড়ে গেছিলো। সেটা খেয়াল করেনি মেহতিশা। আবার ওই পাশ দিয়ে হাঁটার সময় পানিতে পা রাখার আগে দর্পণ তাকে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। তারপর কিছুক্ষণ আরও ওকে বেখেয়ালি, আনমনা, কেয়ারলেস বলে বকাঝকা করলো। মেহতিশা এক পলকের জন্য থমকে গিয়েছিলো। টলমল চোখে তাকালো। দর্পণ পরমুহূর্তেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওকে জড়িয়ে ধরে সরি বললো। তখন মেহতিশা সব ভুলে খেয়ে ফেললো। এতো সুন্দর করে সরি বললে কী আর রেগে থাকা যায়!
দিয়া ঘরের দরজায় নক করতেই মেহতিশা কল কেটে দিয়ে বললো,
‘বোকা মেয়ে, তোমার আসার জন্য নক করার দরকার নেই তো। ‘
দিয়া মুচকি হেসে ভেতরে এলো। বিছানায় এসে বসেই রোজ যে কথাটা সবার আগে বলে তাই বললো-
‘ছোট ভাবি,ছোটু কবে আসবে! ‘
মেহতিশা হেসে উঠলো৷ প্রতি দিন যে কেউ এক কথা কীভাবে বলে বোঝেনা ও৷ মেহতিশা দিয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘এখন তো সবে আড়াই মাস। আরও অনেক দিন বাকী। এই দেখতে দেখতে চলে যাবে। ‘
দিয়া উৎফুল্ল হয়ে বললো,
‘আমার মনে হয় আমাদের একটা ছোট রাজপুত্র আসবে। ‘
‘হাহাহা,এতো তাড়াতাড়ি তুমি কীভাবে জানলে! ‘
‘আমি জানি, রাজপুত্রটা আসলে আমি তাকে অর্পণ বলে ডাকবো। ‘
মেহতিশা থমকে যায়। দিয়া চোখ মোছে। অর্পণ নামের বড় ভাইটাকে সে আজও খুব মিস করে দু’টো বছর সে নেই। কষ্টে বুকে ব্যাথা করে দিয়ার। একমাত্র ঐ বড় ভাইটাই ছিলো যে তাকে খুব বুঝতো। এখনও বাহির থেকে আসলে লেবুর ঘ্রাণ পেলে দিয়া অস্থির হয়। কারণ এক সময় ঐ অর্পণ ভাইটাই তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। বাহির থেকে আসলে লেবুর শরবত বানিয়ে রসিক গলায় বলতো,’দিয়ু,নে শরবতটা খেয়ে বলতো কেমন হয়েছে! আমি কিন্তু অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি। ‘ দিয়া অনেক হাসতো তখন। অর্পণও মজা করে বলতো,হেঁসে নে হেঁসে নে, আমি যখন থাকবো না তখন এই অমৃত কেউ খাওয়াবে না তোকে। দিয়া এখনও সেসব মনে করলে কাঁদে।
মেহতিশা বুঝতে পারলো ওর মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তাই মন ভালো করতে বললো,
‘জানো দিয়া, তোমার ভাইটা আমাকে সময় পেলেই বকে। ভীষণ পঁচা তোমার ভাই। ‘
দিয়ার তখনও মনটা আঁধারে নিমজ্জিত। সে আঁধারিয়া কন্ঠে বললো ,
‘তুমি মনে কষ্ট নিওনা আপু। আসলে দর্পণ ভাই ভয় পায় তো তাই এমন করে। আগের বার যখন নিশিতা আপু এমন প্রেগন্যান্ট ছিলো তখন.. ‘
মুখ ফসকে কথাটা বলে নিজেকেই বকলো দিয়া। মেহতিশা তখন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে উৎকন্ঠিত হয়ে বললো,
‘প্রেগন্যান্ট ছিলো! তাহলে সেই বাচ্চাটা এখন কোথায়? ‘
দিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
‘নেই। ‘
‘নেই মানে?’
‘মারা গেছে। ‘
কত সহজেই দিয়া বলে ফেললো মারা গেছে। কথাটা হজম করতে অনেক কষ্ট হলো মেহতিশার। সে দিয়ার হাতটা চেপে ধরে বললো,
‘কীভাবে মারা গেছে?’
‘সে অনেক কথা। নিশিতা আপু তখন চার মাসের প্রেগনেন্ট। চেক আপের জন্য অর্পণ ভাই তাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলো। রাস্তায় গাড়ি কীভাবে যেনো নষ্ট হয়ে যায়। অর্পণ ভাই,গাড়ি ঠিক করার জন্য একটু দূর থেকে ম্যাকানিক ডাকতে গেছিলো। এসে দেখলো কে যেনো নিশিতা ভাবিকে রাস্তায় পিটিয়ে ফেলে রেখেছে। অর্পণ ভাই এসে পাগলের মতো তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চাটা মারা গেছে পেটেই। তারপর থেকে নিশিতা ভাবি পাগলপ্রায়।’
চোখজোড়া ভেজা দিয়ার। ক্ষতগুলো বোধ হয় এখনি সারেনি। মেহতিশা থমথমে মুখে বললো,
‘তারপর? অর্পণ ভাইয়া কীভাবে মারা যায়? ‘
দিয়া কিছু বলতে নিয়েও চুপ করে যায়। বোধ করে, এতোগুলা কথা বলাও ঠিক হয়নি। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘তুমি এসব নিয়ে আর ভেবো না। ভাইয়া ভয় পায়, যদি তোমার সাথেও এমন হয়! তাই তুমি সাবধানে থেকো। ‘
মেহতিশা তখনও অস্থির পরবর্তীতে কী হয়েছে তা জানতে। কীভাবে অর্পণ ভাইয়া মারা গেছে, আর নিশিতা আপুর বাচ্চাটাকে কে মারলো! শত শত প্রশ্ন ওর কানে চিৎকার করছে। মেহতিশা দিয়াকে শেষ আরেকটা প্রশ্ন করলো,
‘দিয়া, এতোটুকু বলো কীভাবে মারা গেছিলো অর্পণ ভাইয়া!’
‘আমি আর বলতে পারবো না ভাবি। বারণ আছে। ‘
‘কে বারণ করেছে? ‘
‘ভাইয়া। ‘
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
“প্রিয় দিও বিরহ”
১৯.
নিশিতা তখন গভীর নিদ্রায় বিভোর। মুখে মুচকি হাসি বিদ্যমান৷ স্বপ্নে মগ্ন সে। কীসের একটা সুবাস নাকে এসে লাগছে। নিশিতা ঘুমিয়ে স্মৃতির পাতায় বিচরণ করছে। গোলপাতা গুলো দুলে দুলে উঠছে বাতাসের তোড়ে। কী অপূর্ব সুন্দর জায়গাটা!নিশিতা পরিবেশটা দেখে মনে মনে ভাবে এই জায়গাতে ওর বেবি হওয়ার পর অর্পণ আর সে আবারও আসবে। এসব ভেবেই পাশের সিটের অর্পণের হাতটা আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
‘এই অপু! এই! ‘
অর্পণ চমৎকার একটা হাসি দিয়ে তাকালো। দুই গালের মাঝে গর্ত ভেসে উঠলো। গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,
‘বলো নিশি। ‘
নিশিতা বড়ই আহ্লাদী সুরে বললো,
‘ওগো, আমার ইচ্ছে করছে কী জানো? আমি এই অসাধারণ মনমোহিনী রাস্তাটাতেই আজীবন থেকে যাই। ‘
অপূর্ব বললো,
‘তা তো যাবে না। তুমি এখানে থেকে গেলে তোমার এই হ্যান্ডসাম বরটাকে তো অন্য মেয়ে নিয়ে চলে যাবে! ‘
নিশিতা অপূর্বের কাঁধে কিল বসালো। মুখ ফুলিয়ে বললো,
‘রাখো তোমার রসিকতা। ভালো লাগে না সবসময়। ‘
‘উঁহু! রাগ করে না। সোনাবউ আমার! আমি তোমাকে এখানেই একটা বাড়ি বানিয়ে দেবো। দশটা দাসী থাকবে, তিনটা বাগান থাকবে, একটা ইচ্ছে জ্বিন থাকবে। সে সকাল বিকাল তোমার হুকুম পালন করবে। হবে না?
কথায় ফিক করে হেঁসে দিলো নিশিতা। দুই বছরের প্রেম,আড়াই বছরের সংসার। এই পুরোটা সময় জুড়েই কত মিষ্টি মুহুর্ত পাড় করেছে দুজনে। প্রেমের শুরুর দিকে তখন খুব একটা ভালো লাগতো না এই কৃষ্ণ বর্ণের ছেলেটাকে। অর্পণ হয়েছে তার মায়ের মতো দেখতে। কিছুটা কালো রঙের। কিন্তু কথায় আছে, গায়ের রং কখনো কারো মনকে বিচার করার ক্ষমতা রাখেনা। দিন যতই গেলো, নিশিতা ততই এই রসিক, হাসিখুশি মানুষটাকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল। একজন মানুষ কতটা শান্ত, হাস্যরসিক হতে পারে তা অর্পণকে না দেখলে বোঝা যাবেনা। দীর্ঘ একটা সময় পর এই ছেলেটাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা অনেক নির্মম হয়ে উঠছিলো। তখন পরিবারের সম্মতিতে চারহাত এক হয়। তবে, লালিমা শেখের খানিকটা আপত্তি ছিলো। কারণ তিনি চেয়েছিলেন আরও উচ্চ বংশীয় মেয়ে বিয়ে করাতে। কিন্তু তার পথের বাঁধা হয়েছিলো এই নিশিতা। আগুন সুন্দরীও তো না! সুন্দর বলা যায় তবে আহামরি নয়। তাই সব দিক মিলিয়ে তিনি মত দিচ্ছিলেন না এই বিয়েতে। তবুও,অর্পণ তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে। নিশিতার হাত সেই যে ধরেছিলো শেষ নিশ্বাস অব্দি ধরে রাখার পণ করেছিলো।
নিশিতা হাসিমুখে অর্পণের কাঁধে মাথা রাখে। তার গর্ভে স্বপ্নশিশু তাদের। পাশে ভালোবাসার মানুষ। কী নেই তাদের? সুখ, শান্তি সবই আছে। পৃথিবীটা আসলেই বড় সুন্দর। কিন্তু নিশিতা কী তখন জানতো,এই সুখটা মরিচীকা মাত্র। কয়দিনের স্মৃতি হয়ে যা আজীবন রয়ে যাবে। ড্রাইভিং সিটে বসে তখন দু’জনে নানা স্বপ্ন বুনছে। নিশিতা তখন ধীরে ধীরে ঘুমে ঢলে পড়ছে। কানে ভেসে আসছে অর্পণের গাওয়া সুরমেশালো গান,
এই পথ যদি না শেষ হয় তবে
কেমন হতো তুমি বলোতো?
–
দীর্ঘ পাঁচটি মাসে নানা উথাল-পাতাল ঢেউ সংসারে উঠানামা করেছে। কখনো রাগ, অভিমান। কখনোবা দুষ্ট মিষ্টি মুহুর্ত। সবটা মিলিয়ে ভালোই কাটছে দিনকাল৷ সুন্দর সুখের দিন নাকি তাড়াতাড়ি কেটে যায়। মেহতিশা নিজেকে এখন অবশ্য খুব সুখীই মনে করছে। তবে ভয়ও হয়, বলা তো যায়না কার নজর লাগে এই সুখে। দুঃখ না জানি এসে দাঁড়ায় এই সুখনীড়ে।
ঘুমটা আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। মাঝে মাঝে আবার মাঝরাতে ঘুম হয়না৷ তাই মেহতিশা করিডোরে হাঁটাহাঁটি করে। কখনো ক্যানভাসে এলোমেলো রঙ দিয়ে ছবি আঁকে। চিপসের প্যাকেটটা নিয়ে এসে খচরখচর করতে করতে দর্পণের পাশে বসলো। দর্পণ ল্যাপটপে কাজ করতে করতে একবার আঁড়চোখে তাকালো। রাত অনেক হলেও দু’জনেই জাগনা। দর্পণ অনেক বার ধমকি-ধামকি দিলেও মেহতিশাকে কোনোভাবেই ঘুম পাড়াতে পারেনি। তাই দর্পণও চুপ করে আছে। সেও কোনো কথা বলেনি। মেহতিশা ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিরক্ত করছে যেনো দর্পণ কিছু বলে।
খালি চিপসের প্যাকেটটা ল্যাপটপের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ফিক করে হেঁসে উঠলো মেহতিশা। দর্পণ প্যাকেটটা সরিয়ে দিয়ে প্যাকেটটা ফেলে মুখ বুঁজেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। মেহতিশার এবার রাগ লাগে। সে কাঁথা ধরে ইচ্ছেমতো টানাটানি করছে। দর্পণ এবার বললো,
‘ছেড়ে দিন, ব্যাথা পাবেন। ‘
‘না না না, ছাড়বো না। ‘
দর্পণ এবার মেহতিশার টেনে নিজের উপরে নিয়ে আসলো। গালের উপরের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,
‘এমন করছেন কেনো?’
মেহতিশা মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘আপনি কথা বলেন না কেনো?’
‘তাহলে আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেনো?’
‘ঘুম আসে না তো, আমি চেষ্টা করি। ‘
‘কচু করেন। দুই মিনিট শুয়ে এদিক ওদিক করেই উঠে গিয়ে চিপস নিয়ে বসলেন। একটু আগে চকলেট খেলেন। ‘
‘আমি খাইনি তো! ‘
‘কে খেয়েছে তাহলে?’
‘আপনার ছেলে৷ ‘
‘হু, এখন সব দোষ নন্দ ঘোষ। ‘
‘হুম, সব দোষ দর্পণ সাহেবের ছেলের। ‘
বলে নিজেই হাসিতে ফেটে পড়লো মেহতিশা। দর্পণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখলো। একসময় গভীর ঘুমে ঢলে গেলো মেহতিশা। দর্পণ একটু ভালো করে পরখ করে মেহতিশাকে শুইয়ে দিলো। পড়নের শার্টটা ঝেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সারাদিনে মাত্র একবার দাঁড়ানো হয়েছে। তাই পা দুটো ঝিমঝিম করছে। আর কয়টা মাস ভালো করে গেলেই হলো। তারপর আর এই লুকোচুরির প্রয়োজন হবেনা। ভেবে ঠোঁট এলিয়ে হাসে দর্পণ। খেলাটা মজার আবার একটু রিস্কিও। এখন কিছুতেই ধরা দেয়া যাবেনা। হিতে বিপরীত হতে পারে। একবার এলোমেলো চুলে ঘুমিয়ে থাকা মেহতিশার দিকে তাকালো। মোবাইলটা নিয়ে পকেটে ঢুকালো। কাউকে একটা মেসেজ করে শিটি বাজাতে বাজাতে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলো।
–
দর্পণের দরজা আটকানো মাত্রই চোখ খুলে উঠে বসলো মেহতিশা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে দুই মিনিট থম মেরে বসে থাকলো। তারপর ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো।
কতক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। কী সুন্দর নাটক করে যাচ্ছিলো এই মানুষটা!
আর একেই নাকি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলো সে। হাহাকার জাগছে বুকে। কয়েক দিন ধরেই ঘুম ভেঙে মাঝরাতে ওকে যখন বিছানায় পায়না মেহতিশা তখন একটু অদ্ভুত লাগছিলো। কারণ, দর্পণ তো আর একা চলাচল করতে পারে না। হুইলচেয়ারটাও তো বিছানার পাশেই পড়ে আছে। তাহলে দর্পণ কীভাবে বাহিরে যায়!মেহতিশা বুঝতে পারলো প্রতিটা রাতই দর্পণ ঘর ছেড়ে মাঝরাতে বেরিয়ে যায়৷ মেহতিশা দরজা বন্ধ দেখে চোখ মুছে নেয়। এই বিশ্বাসঘাতককে ভালোবাসাটা ওর পাপ ছিলো। বিরাট অপরাধ। ওর উচিত ছিলো বাবার কথা মতো ছয় মাস পর কাগজপত্র তল্লাশি করে বেরিয়ে যাওয়া। এসব ভেবে ক্রুদ্ধ মনে আলমারি খুলে দর্পণের গোপন লকারটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করলো। যে লকারটায় কখনো আড়দৃষ্টিতে তাকিয়েও সে দেখেনি, আজ সেটাই হাতাচ্ছে। সময় সত্যিই পাল্টায়। একসময় আকাঙ্ক্ষিত কাগজটি পেয়েও গেলো। কাগজটার দিকে তাকিয়ে ভেজাচোখেও হাসলো।
এমন সময় হঠাৎ করেই দর্পণ ঘরে এসে গেলো। গেটের চাবিটা নিতে ভুলে গিয়েছিলো সে। মেহতিশাকে আলমারি খুলে নাড়াচাড়া করতে দেখে চমকে উঠলো।
দরজাটা লক করে দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে সামনে আসলো। প্রথমবার দর্পণের ক্রোধ ভরা চোহারাটা দেখে মেহতিশার ভয় লাগলো। তবুও, সাহস সঞ্চয় করে বললো,
‘দর্পণ শেখ, ভালো মানুষীর মুখোশটা তাহলে খুলেই গেলো। ‘
দর্পণ মুচকি হাসলো৷ দেয়ালের এক পাশে হেলান দিয়ে হাত বুকের উপর ভাজ করে বললো,
‘জেনেই গেলেন তাহলে বউজান৷ ‘
পরমুহূর্তেই মেহতিশার গলাটা চেপে ধরে হিসিয়ে উঠলো,
‘জেনেছেন ভালো কথা, কিন্তু ভুলেও মুখটা খুলবেন না। পরিণাম একটুও ভালো হবে না। ‘
চলবে-