প্রিয় দিও বিরহ,২০,২১,২২

0
749

“প্রিয় দিও বিরহ,২০,২১,২২
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।
২০.

আকস্মিকতায় হতভম্ব মেহতিশা। যে দর্পণ এতো দিনের সংসারে একবার কড়া চোখেও তাকায়নি। সে কিনা আজ গলা চেপে ধরেছে। ব্যাথার চেয়েও বেশি বুকে কষ্ট হচ্ছে। যার চোখে এতোগুলা দিন ভালোবাসার অথৈজল দেখতে পেয়ে অভ্যস্ত আজ সে চোখদুটো বড়ই অচেনা। বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ চোখ ভারি হয়ে গেছে। মস্তিষ্কশূন্য পুরোপুরি।
দর্পণ কী করে পারলো এতো বড় নাটক করতে! মেহতিশা উন্মাদের মতো দর্পণের বুকে ঝাপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

‘এসব মিথ্যা তাই না?আপনি মজা করছেন আমার সঙ্গে! নাহলে এইসব স্বপ্ন! হ্যা হ্যা সব স্বপ্ন! ‘

দর্পণের ভেতর কী ভাবানুভূতি হলো বোঝা যাচ্ছে না। সে মেহতিশার মাথাটা টেনে শক্ত করে বুক থেকে সরালো। ধারালো ফলার বর্শা ছুড়ে বললো,

‘মিথ্যা নয় মেহতিশা। এসব সত্য। আপনাকে তো মানতে হবে। ‘

তারপর ছেড়ে দিয়ে বিছানায় রাজার মতো বসে পায়ের উপর পা তুলে হেসে বললো,

‘আফটার অল, আপনি শামীউল্লাহ জামানের কন্যা। নাটক করা তো আপনাদের কাজ। ‘

মেহতিশা ক্ষণকাল অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললো,

‘আমি কোনো নাটক করিনি। ‘

‘সত্যিই কোনো নাটক করেননি! ‘

মেহতিশা মাথা নিচু করে মেঝেতে বসে পড়লো, বললো,

‘হ্যা, বাবা আমাকে বাধ্য করেছিলো আমি যেনো আপনাকে নাটক করে কাগজ গুলো হাতিয়ে নেই। আমার প্রচুর রাগ ছিলো আপনার উপর। আপনাকে তখন একটুও সহ্য হচ্ছিল না। আমার অমতে এমন কেনো বিয়ে দিলো? কেনো? কেনো? আমার মাথায় এসব বারবার আঘাত করতো৷ আমি রাজি না থেকেও রাজি ছিলাম। ধীরে ধীরে আমি নাটক করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার সাদাকালো জীবনে একফালি সবুজ সিগন্যালের মতো আপনি আসলেন। কারো একজনের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আমি নিঃশব্দে কাটিয়ে দিতে পারি,কারো অপেক্ষায় রাত জেগে চোখর নিচে ডার্ক সার্কেল বানাতে পারি, কাউকে সবটা দিয়ে ভালোওবাসতে পারি। এসব কোনো নাটকের স্ক্রিপ্ট না। আপনাকে ভালোবাসা এখন আর কোনো নাটক সিনেমা নয়। আপনাকে ভালোবাসাটা এখন আমার প্রাণবায়ু। ‘

দর্পণের চোখ দু’টোতে তাচ্ছিল্য। তা দেখে বুকে মুচড়ে ধরে কষ্ট গুলো মেহতিশার। তবে কী দর্পণ তাকে কখনো ভালোইবাসেনি! তার সাথে ধোঁকাবাজি করেছে। মেহতিশা ধপাধপ পা ফেলে দর্পণের সামনে আসলো। তারপর শক্তি দিয়ে দর্পণের কলার টেনে ধরলো। চিৎকার করে বললো,

‘এমনটা আপনি কী করে করতে পারেন! আপনার সাহস কী করে হয়! এবার আপনি দেখবেন এই মেহতিশা কী। ‘

দর্পণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘কী করবেন আপনি? ‘

মেহতিশা উন্মাদের মতো দর্পণের থেকে দুই কদম পিছিয়ে গেলো। টলমল চোখে হাসলো। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে। দর্পণের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আপনার মতো বেইমানের সন্তানকে আমি আমার গর্ভে জায়গা দেবো কেনো দর্পণ শেখ? ‘

দর্পণ চমকে উঠলো। সে দ্রুত পদে উঠে দাঁড়ায়। মেহতিশা বাহুদ্বয় শক্তি দিয়ে চেপে ধরে। মেহতিশা ভাবাবেগশূণ্য। দর্পণ ক্রুদ্ধ নয়নে বলে,

‘এরকম কিছু করার চিন্তা ভাবনা বাদ দিন মেহতিশা।
খবরদার! আমার বাচ্চার সাথে যদি কিছু করার চেষ্টাও করেন, কসম আমি আপনার বংশকে নির্বংশ করে দেবো। ‘

মেহতিশা হাসে। যেন তার কিছু আসে যায় না। দর্পণ কী করতে পারে সে দেখতে চায়। দর্পণ রাগে কাপে থরথর করে। লম্বা শ্বাসে সে তা নিয়ন্ত্রণ করে আনে।
আগের মতো নিষ্পাপ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,

‘অনেক হয়েছে। আপনি এখন ঘুমাবেন। আর একটা কথাও বলবেন না। যা জেনেছেন ভালো হয়েছে। কালকে আমার সঙ্গে হ্যা-তে হ্যা বলবেন। ‘

মেহতিশা শক্ত হয়ে থাকে। সে ঘুমাবেনা। তার প্রশ্নের জবাব চাই। চোখ বন্ধ করে বললো,

‘আমি আমার প্রশ্নের জবাব চাই৷ ‘

‘কীসের জবাব? ‘

‘আপনি এমন কেনো করলেন? আপনি কী সত্যি মেঝোচাচাকে খুন করেছিলেন? ‘

দর্পণ হাসলো। মেহতিশাকে জোর করে চেপে বিছানায় শোয়ালো। মেহতিশা পণ করেছে কিছুতেই শোবেনা।
দর্পণ বললো,

‘আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। ‘

মেহতিশা মুখ পাশ ফিরিয়ে নেয়। সবটা হজম করতে হিমশিম খাচ্ছে সে৷ কীভাবে কেউ এতো ভালো নাটক করে! দর্পণ রোজকার মতোই তাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজ নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করতেই জল হয়ে বের হয়ে গেলো বুকের নোনাব্যাথা। চোখে ঘুম আসার পর অনুভব হলো তার ঘাড়েও উষ্ণ জলের কণা গড়িয়ে পড়লো বুঝি।

লালিমা শেখ খুশিতে কেঁদে যাচ্ছেন। দিয়াও খুশিতে চোখ মুছলো। কতগুলো দিন পর নিজের ভাইটাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখছে সে। দর্পণের বাবাও হাসছেন। অর্পণ যবে থেকে নেই তখন থেকে খুব একটা কথা বলেননা তিনি। চুপচাপই থাকেন। আজ তিনিও ছুটলেন গরীব মিসকিনদের খাওয়াতে। মিষ্টি খাওয়াবেন সাত পাড়ায়। সামনেই দর্পণ মুচকি হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সাজানো নকল ডাক্তারটা বড়ই পেশাদার ভঙ্গিতে ডাক্তারি সুটকেস আটকাচ্ছে। মেহতিশা বড়ই অবাক হয় এই অভিনেতাদের দেখে। মেহতিশা মনে মনে ভাবলো, এরা তো নোবেল পাওয়ার অধিকার রাখে! এতো নিখুঁত অভিনয় কী করে করলো!

সদ্য ঘুম থেকে উঠেই মেহতিশা দেখলো তাকে আদুরে কন্ঠে ডাকছে দর্পণ৷ পাশে মা বাবা আর দিয়া দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে। মেহতিশা বোকার মতো চেয়ে রইলো।
কী হচ্ছে বুঝতে পারছেনা। তারপর দেখলো দর্পণ তাকে চোখ গরম করে ইশারা করছে, যেনো সেও সমানতালে নাটক করে। নাহলে, ফলাফল ভালো হবেনা। সেও হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘আরে,আপনার পা ঠিক হয়ে গেছে! ‘

‘হ্যা বউজান, দেখুন আমি একদম সুস্থ হয়ে গেছি। সকাল বেলা উঠে দেখি পা নাড়াচাড়া করতে পারছি। সব আপনার সেবা যত্নের ফলে। ‘

মেহতিশা মুখ খিঁচে রাখলো। মা বাবাকেও কত বড় ধোঁকায় রাখছে লোকটা! অসভ্য লোক ৷ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ডক্টররা চলে গেলো। বলা বাহুল্য, এই
লোকগুলোকে দর্পণই ভাড়া করে এনেছে। ভালোই নাটক জানে সবগুলো।

অনেক দিন পর সবার সামনে হেঁটে বাইরে আসতে পারলো দর্পণ। নিজেকে অনেক দিন পর মুক্ত লাগছে তার। অফিসে ঢোকার কারণে এতোদিন পর সবাই চমকে উঠলো। কেউ এতো তাড়াতাড়ি তাকে আশা করেনি। সেই আগেরকার মতো সবাই মাথা নিচু করে সালাম জানালো তাকে৷ দর্পণ মাথা নাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো। সবার আগে অর্পণের কেবিনটায় গেলো। সেখানের জিনিসপত্রে ধুলো পড়েছে। দুটো ফটোফ্রেম রাখা। একটাতে অর্পণের সেলফি। আর আরেকটাতে দর্পণের সঙ্গে। দুইভাই ঘুরতে গেছিলো, তখনকার সময়ের। দর্পণের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। সে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিলে বললো,

‘ভাই, মিস ইউ। ‘

চলবে-
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ ”

২১.

শীতের কনকনে ঠান্ডা কুয়াশায় মিনিট খানেক গা ডুবিয়ে বসে থাকলেও এখন একটু কষ্টই হচ্ছে। সকালের সময়টা রোজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বা জানালায় পাশে বসেই কাটায় মেহতিশা। নাহয়, এই সময়টা দর্পণ তার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে বসে। দর্পণের হাসিমাখা মুখটাই তখন দিনের শুরুটা রঙিন করে তোলে। অথচ, আজ মেহতিশা ঘুম থেকে উঠে আনমনেই বলছিলো,
‘দর্পণ, এসিটা বন্ধ করে দিন শীত লাগছে। ‘

পুরনো অভ্যাস চাইলেই হঠাৎ করে ছাড়ানো সম্ভব না। একদিন দুইদিন তিনদিন, তারপর ধীরে ধীরে হয়তো সয়ে যায় মনে। মনটা মানিয়ে নিতে শিখে। মেহতিশার তখন প্রচন্ড মন খারাপ হলো। ভাবতে লাগলো, ‘এতদিনই তো ভালো ছিলো দর্পণ, নাটক হলেও আমি ভালো ছিলাম। এভাবে কতদিন ধুঁকে ধুঁকে মরবো? ‘
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়ে। আজ আর বারান্দায় দাঁড়াতে ইচ্ছে করলো না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে এলো। অনেক গুলো গোলাপ, হাসনাহেনা ফুলের টব লাগানো আছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো মেহতিশা। ফুলগুলো অনেক স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। কী অপরূপ! এগুলো নাকি দর্পণের টব। সবগুলোর যত্নই সে নিজের হাতে নিতো। ঘরে বসার পর এগুলো লিমন কাকার দায়িত্বে ছিলো। যিনি এখনো মালি হিসেবে এ বাড়িতে কাজ করে। আজ সকালেও নাকি দর্পণ এগুলোতে পানি দিয়েছে। মেহতিশা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবলো, এত সুন্দর ফুলগুলো যার, তার মনটা এতো কুৎসিত কেনো?

আধা ঘণ্টা সময় কাটানোর পর শীতে গা কুঁকড়ে আসছিলো। তাই নিচে নেমে আসলো। রুমে এসে গায়ে চাদর পেচিয়ে নামলো। অন্য দিনগুলোতে রান্না ঘরে ঢুকে দর্পণের জন্য চা বানায়। তারপর দিয়ার সঙ্গে গল্প করে। এখন মেহতিশার সামান্য হাসিটুকু দিতেও অনেক কসরত মনে হচ্ছে। সোফায় বসে টিভিটা অন করলো যদিও মনোযোগ সেখানে নেই। লালিমা শেখ মেহতিশাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন,

‘একি মা, তুমি ওভাবে না খেয়ে বসে আছো কেনো? ‘

মেহতিশা হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘এমনি, খেতে ইচ্ছে করছে না। ‘

‘ওহহো, এখন তো আর দিপু নেই। নাহলে নিজেই এসে তোমাকে খাইয়ে দিতো। পাগল ছেলে আমার, সকালেই অফিসে ছুটছে। কিছু খায়ওনি। ‘

‘উনি কিছু খেয়ে যাননি! ‘

‘না তো, সাড়ে সাতটাতেই রেডি হয়ে দৌড়েছে। টাইম নিয়ে অনেক পজেসিভ। যা কাজই করে অনেক দায়িত্ব নিয়ে ভালোবেসে করে। ‘

প্রথমে মেহতিশার চিন্তা হচ্ছিল দর্পণ খালি পেটে বের হয়ে গেছে বলে। কিন্তু, লালিমা শেখের প্রশংসা শুনে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো ওর চোখে মুখে। হাহ! কত গর্ব নিয়ে প্রশংসা করছেন তিনি৷ অথচ, আসলে দর্পণ কেমন তা তো জানে মেহতিশা। আর কিছু পারুক আর না পারুক, অভিনয়টা ঠিকই পারে। তাও নিখুঁত। নাহলে দু’টো বছর কীভাবে কেউ প্যারালাইসের নাটক করে ঘরে বসে থাকে। হঠাৎ করেই মেহতিশার মনের বিদ্যুতের গতিতে একটা প্রশ্ন খেলে গেলো, ঠিকই তো দু’টো বছর কীভাবে দর্পণ প্যারালাইসের অভিনয় করলো? একজন সুস্থ মানুষ কী পারে এভাবে! আর করলেও কেনো? মেহতিশা তো নিজেও দর্পণের রিপোর্ট নিয়ে নিজের কাজিনকে দেখিয়েছিলো। ভাইয়াও তো বলেছিলো, সত্যিই দর্পণের পা অচল। সে হাটতে পারেনা। অনেক সময় লাগবে তার সুস্থ হতে। তাহলে? মেহতিশা তাড়াতাড়ি উঠে গেলো। লালিমাকে বললো, মা আমি রুমে যাচ্ছি আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা। নাহার খালাকে বলে নাস্তাটা উপরে পাঠিয়ে দিয়েন।

লালিমা শেখ বললেন, ঠিক আছে তুমি রেস্ট নাও মা যাও। নিচে নামার দরকার নাই। বেশি খারাপ লাগলে আমি দর্পণকে কল করে বলবোনে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে।

মেহতিশা কোনোরকমে মাথা নাড়িয়ে ঘরে এসে গেলো। এসেই ড্রয়ার থেকে দর্পণের মেডিসিন গুলো বের করলো, তারপর ঔষধের নাম গুলো সার্চ গুগলে সার্চ দিলো। রেজাল্টে দেখালো, ঔষধগুলো এক ধরনের সিভিট আর কিছু ভিটামিন। অথচ, ভাইয়া কিছু পায়ের হেলথ ইমপ্রুভমেন্টের মেডিসিন দিয়েছিলো। মেহতিশা বুঝতে পারলো, দর্পণ এখানেও কোনো চাল খাটিয়েছে। এবার বুঝতে পারছে, ঔষধ গুলো মেহতিশা নিজেই আনতে চেয়েছিলো কিন্তু দর্পণ দারোয়ানকে দিয়ে আনিয়েছিলো। তার মানে, টাকা দিয়ে দর্পণ এখানেও কারসাজি চালিয়েছে। তাইতো, ঔষধের প্রেসক্রিপশনটা আর পরবর্তীতে খুঁজে পায়নি। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো মেহতিশা। চোখ বেয়ে জল পড়ছে। চোখ মুছে মেহতিশা ঠিক করলো এবার যেভাবেই হোক, সে বের করবে কী কারণে দর্পণ এসব করলো। আর তারপরই এ বাড়ি ছেড়ে, দর্পণকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাবে। আর বাচ্চাকেও নিয়ে যাবে। এটাই হবে দর্পণের উত্তম শাস্তি। উঠে বাবাকে কল করে থমথমে কন্ঠে বললো,

‘আমি আসছি। ‘


গলার টাইটা আরও একবার ঢিলে করে নিয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানিটুকু গিলে নিলো।
এতো ঠান্ডাতেও ঘামছে দর্পণ। কী অসহ্য রকমের গরম লাগছে। উঠে এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিলো। মাকে দু’বার কল করে খোঁজ নিয়েছে মেহতিশা কী করছে,কোথায় যাচ্ছে। মেহতিশাকে কল করেছিলো। মেয়েটা ধরেনি। দর্পণ জানে, ইচ্ছে করেই ধরেনি। নাহ, গার্ড লাগাতে হবে। না জানি মেহতিশা কখন কী করে বসে। সকালে মেহতিশার দৈনিক ঔষধগুলো সাইডে রেখে দিয়েছিলো, একটা কাগজে লিখেও রেখেছে। যাতে ব্রেকফাস্ট করে নেয়। দেখেওনি হয়তো। দর্পণের মেজাজটা গরম হয়ে গেছে। অফিসের কাজ গুলো শেষ করে একবার ক্লাবে যেতে হবে।

অর্পণ থাকতে এই ব্যবসাপাতির দায়িত্ব ছিলো অর্পণেরই। দর্পণ ক্লাব, রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এখন দুইদিক কীভাবে যে সামলাতে হয়, শুধু দর্পণই জানে। আগে মাঝে মধ্যে দুই একবার এসে পেন্ডিং এ থাকা কাজগুলো দেখে দিতো। বাড়তি কিছু কাজ ছাড়া কিছু করা লাগেনি। এখন তো বাবারও বয়স হয়েছে। তিনি খুব একটা প্রেশার নিতে পারেন না। দর্পণ ঘড়িতে সময় দেখলো সাড়ে এগারোটা বাজে। মেয়েটা কী এখনো না খেয়ে বসে রইলো! নাহ, অস্থির অস্থির লাগছে দর্পণের। বাসায় থাকলে মেয়েটা কতশত পাগলামি করতো। ল্যাপটপটাকে নাকি মেহতিশার সতীন মনে হয়। দর্পণ যখন ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে, তখন মেহতিশা হিংসার দৃষ্টি দিয়ে বলতো, আমার ইচ্ছে করে এই ল্যাপটপটাকে দুই ভাগ করে ভেঙে ফেলতে! দর্পণ সারাক্ষণ এটা নিয়ে কাজ করতো বলে কত রাগ করতো। আনমনে হাসলো। কল করলো মেহতিশার নাম্বারে।


নিজের বাড়ি থেকে চোখ মুখ ফুলে থাকা অবস্থায় বাসায় ফিরলো মেহতিশা। চোখ মুখের অবস্থা করুণ।
লালিমা দেখে এক মুহুর্ত থমকে গেলেন। অস্থির হয়ে দর্পণকে কল করলেন। মেহতিশা ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। নির্মম দহনে পু্ড়ছে যেন।

কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসকষ্ট লাগছে। ব্যাগে মোবাইলে রিং হচ্ছে। তীব্র ঘৃণা নিয়ে মেহতিশা বিরবির করে বললো,

‘আই হেইট ইউ দর্পণ, আই জাস্ট হেইট ইউ। ‘

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ”

২২.(বোনাস পার্ট)

টিকটিক করতে করতে ঘড়ির কাটা যখন একটা বেজে দশ তখন বাড়ি এসে পৌঁছালো দর্পণ। ডান হাতে ডিপ ব্লু কোর্টটা ঝুলানো। গায়ের গোছানো ইন করা সাদা শার্টটা এখন এলোমেলো হয়ে গেছে। ললাট ঘেমে উঠেছে। কলিজায় কেমন যেন কামড়াচ্ছে। লালিমা শেখ ওকে দেখেই তাড়াতাড়ি করে বললেন,

‘দিপু, দেখতো সেই কখন মেয়েটা ঘরে গেলো। নাহারকে পাঠালাম খাবার দিয়ে দরজা খুললো না। বলছিলো শরীর খারাপ লাগছে। ‘

হঠাৎ করেই বুকটা মুচড়ে উঠলো দর্পণের। সে একপর্যায়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটলো। একের পর এক করাঘাত দেয়ার পরও যখন মেহতিশা দরজা খুললো না। তখন বাধ্য হয়েই লকটা ফ্লাওয়ার ভাস দিয়ে বারি দিয়ে ভেঙে ফেললো। দরজা খুলে ঢুকতেই পিলে চমকে উঠলো তার৷ ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তুলতুলে নরম দেহটা। হাতে দর্পণের ঔষধগুলো। দর্পণ বুঝতে পারলো,প্রায় অর্ধেকটাই জেনে গেছে মেয়েটা। তড়িৎ প্রবাহের গতিতে মেহতিশাকে কোলে তুলে ছুটে গেলো নিচে।
গাড়িতে তুলে হসপিটালে ছুটে গেলো। নার্সরা এসে বেডে করে কেবিনে শিফট করলো। দর্পণও ভেতরে আসতে চাইলে নার্স বাঁধা দিয়ে বললো,আপনি এখানেই থাকুন। অস্থিরচিত্তে কপালে দুই হাত চেপে বসে রইলো অগত্যা চেয়ারে। লালিমা শেখ এসে পাশে বসলেন। দর্পণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ভয় পাসনা বাবা, কিছু হবেনা। ঠিক হয়ে যাবে দেখবি।’

দর্পণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন তিনি। দর্পণ তার দিকে তাকাতেই দেখলেন চোখদুটো লাল হয়ে গেছে ওর। তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। দর্পণের কেনো জানি কান্না পেয়ে গেলো। পুরোনো কিছু স্মৃতি দাগ কেটে যায় মাঝেমধ্যে। সে মায়ের কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো বললো,

‘মা,তুমি জানো না আমার হাসপাতাল দেখলে ভয় করে। মনে হয়, আবারও কেউ হারিয়ে ফেলবো। ‘

‘এমন বলেনা বাবা, এক ঘটনা বারবার হয়না। তোর ভাইয়ের হায়াত অতোটুকুই ছিলো। আমি মেনে নিয়েছি। ‘

‘তারপরও আমার হাসপাতালে আসলেই মনে হয়, আবারও কেউ বুঝি এসে বলবে, আমরা তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। আমার কষ্ট হয় মা। তুমি দেখো, আমার ভাইয়াকে যারা এতো নির্মম মৃত্যু দিলো, আমার ছোট বোনের মতো মেয়েটাকে পাগল বানিয়ে ফেললো ওদের আমি শাস্তি দিবোই। ‘

‘সব ঠিক আছে। কিন্তু দেখো,অপরাধীর জন্য নিরপরাধ কাউকে শাস্তি দিওনা আবার। ‘

দর্পণ মায়ের দিকে তাকালো। তিনি মৃদু হেসে বললেন,

‘আমার চুলগুলো তো বাতাসে পাকেনি বাবা। মেয়েটার কিন্তু দোষ নেই। তুমি ওকে অযথা দোষ দিবেনা। ‘

দর্পণ দুই হাতে কপাল ঘষলো। মনে হচ্ছে, আসলেই সেই রাগটা মেহতিশাকে না দেখালেই হতো। সব তো প্ল্যানমাফিক চলছিলো। এমন না যে দর্পণ প্যারালাইস কখনোই ছিলোনা। টানা দশটা মাস সে সত্যিকারেই অচল ছিলো। আল্লাহর রহমতেই ট্রিটমেন্টে সুস্থ হয়। কিন্তু কিছুতেই যেনো শত্রুরা খবর না পায়, এবং তাকে দূর্বল ভাবে তাই তো সুস্থ হওয়া পরও নাটক চালিয়েছে। অর্পণের পর নেক্সট টার্গেট তো দর্পণই ছিলো। এমনকি এখনো আছে। দর্পণের যদি কিছু হয় তাহলে ওর মা, বাবা, বোন আর ভাইয়ের রেখে যাওয়া আমানতটা সে রক্ষা করতে পারতোনা।

দর্পণ অনুশোচনা নিয়ে মুখ নিচু করে রাখলো। মেহতিশাকে সে ভয়টা এজন্যই দেখিয়েছিলো যেন মেহতিশা ভয় পেয়ে কোনো কাগজপত্র অন্য জায়গায় ট্রান্সফার করতে না পারে। অন্তত বাচ্চাটা হওয়ার আগ পর্যন্ত যেনো দর্পণকে ছেড়ে যেতে না পারে। এখন মনে হচ্ছে, এতোটা ভয় দেখানো উচিত হয়নি৷ অতিরিক্ত শক পেয়ে এখন যদি কিছু হয়ে যায়! বাচ্চাটা হওয়ার পর সে সবকিছু খুলে বলবে মেহতিশাকে। আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে দেবেনা। দর্পণকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে লালিমা শেখ বললেন,

‘দিপু, আমি কী বলেছি বুঝেছিস? ওর কোনো ক্ষতি করিসনা। ‘

দর্পণ শূন্যে তাকিয়ে রইলো। দরজার ফাঁক দিয়ে মেহতিশার বেডটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে চোখের গ্লাসটা খুলে হাতায় মুছতে মুছতে বললো,

‘সে আমার প্রিয় হয় মা। ‘

দীর্ঘ একটা সময় কেটে যাওয়ার পর মেহতিশার জ্ঞান ফিরে। উঠতে চাইলেই হাতে ক্যানালোতে টান লেগে রক্ত ভেসে উঠলো। স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে হালকা আলো জ্বলছে। দূর্বল লাগছে শরীর।
পরিবেশ দেখে বুঝলো সে হাসপাতালে অবস্থান করছে। হাতটা চিনচিনে ব্যথা করতেই ‘উহ’ করে উঠলো। সজাগ হয়ে গেলো দর্পণ। ঘুম ভেঙে গেলো তার। পাশেই চেয়ারে বসে ছিলো সে। দশ মিনিট হবে চোখটা লেগেছে। মেহতিশার বাম হাতটা এখনো তার মুঠোবন্দি হয়ে আছে। সে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি ডক্টরকে ডেকে আনছি। টানবেন না ওটা। ‘

মেহতিশা মাথা উঁচু করে তাকালো। দর্পণের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘এক্ষুনি খুলবো আমি এটা। অসহ্যকর! ‘

দর্পণ মেহতিশার হাতটা চেপে ধরলো। রাগী দৃষ্টি দিয়ে বললো,

‘চুপপ! একদম টানাটানি করবেনা৷ তোমাকে আমি খুব বকবো মেহতিশা। ‘

‘আমার বয়েই গেলো আপনার বকা শুনতে। ‘

বিরবির করে বললেও শুনে ফেললো দর্পণ। সে ভ্রুক্ষেপ করলোনা৷ দৌড়ে ডক্টরের খোঁজ করে একপ্রকার টেনেই আনলো এক ডক্টরকে। তিনি বোধ হয় সারাদিন ডিউটি করে একটু রেস্ট করছিলেন। তাই দর্পণের কাজে বিরক্তই হলেন। তিনি অবশ্য এই বিভাগের না। তিনি শিশুবিষয়ক ওয়ার্ডের। তবুও, তিনি মেহতিশার হাতের ক্যানালোটা খুলে চেকআপ করে বললেন, শরীরে দূর্বলতা আছে এখনো। এছাড়া সব ঠিক আছে। তবে বাসায় যেতে পারবেন। সবটা বলে একপ্রকার হাফ ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। দর্পণের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বিছানায় শুয়ে রইলো মেহতিশা। চোখে ঘুম নেমে আসলো। সারারাত ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে একের পর এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললো দর্পণ। কপালে আদুরে স্পর্শ এঁকে দিয়ে চেয়ারে বসে থাকলো। যেনো তার বিশাল অন্যায় হয়ে যাবে উঠে গেলে।

মেহতিশার যখন ঘুম ভাঙলো,তখন দশটা বাজে প্রায়। রাতের কথা মনে পড়তেই পাশে তাকালো। দর্পণের বসার চেয়ারটা খালি পড়ে আছে। কোথায় গেলো অসভ্য ধোঁকাবাজ লোকটা?এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো বালিশের পাশে একটা কাগজ রাখা। হাত বাড়িয়ে খুলতেই দেখলো,

তোমার রাগগুলোকে বাক্সবন্দি করে নাও,
আমায় দিওনা, আমি যত্ন জানি না,
আমি মনভোলানো পথিক।

তোমার অভিমানের ঝুলি খুলে ফেলোনা,
আমি শব্দ গোছাতে পারিনা,
বড্ড হাওয়ায় ভাসা নাবিক।

তুমি ভালোবাসার চোখে চেয়োনা,
আমি বুঝিনা ওসব, সাজাতে পারিনা ভেঙে,
আমি বুঝতে পেরেও, নাবোঝা থাকি,
তোমার অভিমানী চোখ চেয়ে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here