“প্রিয় দিও বিরহ,২৩,২৪
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
২৩.
এতো এতো ধোঁকা দিয়ে এখন আবার আদিক্ষ্যেতা করা হচ্ছে! যত্তসব ঢং লোকটার৷ মেহতিশা কাগজটা ছিড়ে বেডের নিচে ফেলে দিলো। এরকম গিরগিটির মতো রঙ বদল করা মানুষ জীবনে একটাও দেখেনি সে। সকালেও যখন দর্পণ চলে গেলো একটাবারও তার সাথে কথা বলে যায়নি। মনে মনে মেহতিশা যতোই হেট ইউ, হেট ইউ করুক। বললেই কী আর ভালোবাসা মুছে যায়! প্রেমে পড়তে কারণ লাগে। কেউ কারো চোখের প্রেমে পড়ে তো কেউ সৌন্দর্যের। কিন্তু ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগেনা। কেউ বলবেনা, আমি স্পেসিফিকভাবে তাকে একটা কারণে ভালোবাসি। হাজার কিছু হওয়ার পরও ভালোবাসাটুকু
শেষ হয়না, থেকে যায় মনের কোনো একটা ধুলো জমা পাতায়। হানা দেয় কিছুক্ষণ পরপর। মেহতিশা হেলান দিয়ে বসে রইলো। পেটের কাছটায় চিনচিন করছে। রাতের দিকেও ব্যাথা হচ্ছিল। একটু পরে একজন নার্স আসলেন। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে গাল বড় করে হাসলেন৷ মেহতিশা ভ্রু কুচকে তাকায়। বুঝতে পারছেনা এমন হাসির কারণ। নার্স এসে স্যালাইন খুলে রাখলেন। ঔষধের লিস্টটা রেখে চটপটে গলায় বললেন,
‘ইউ নো, আপনি আসলেই খুব লাকি! ‘
মেহতিশা গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। বোঝাই যাচ্ছে, মেয়েটা হয়তো নতুন। বয়সটাও কম৷ চঞ্চলতায় ভরে আছে আগাগোড়া। মেহতিশা বিনয়ী হাসলো। মেয়েটা উৎসাহীত হয়ে বললো,
‘আমি সিরিয়াস, কাল সারারাত আপনার উনি আপনার হাত ধরে বসে ছিলেন। আর একটু পরপর চুমু খাচ্ছিলেন। আমি একবার আপনার চেক আপ করতে এসে দেখি সে আপনার পেটের উপর মাথা রেখে শুয়ে ছিলেন। হাউ রোমেন্টিক! ‘
মেয়েটা এমন গড়গড় করে কথা বলে গেলো যে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মেহতিশা। মাথা নাড়িয়ে হাসলো একটু। মেয়েটা যেতে যেতে শুধু বললো,
‘আপনিও তো খুব সুন্দর। পার্ফেক্ট ফর ইচ আদার। ‘
মেয়েটার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো মেহতিশা। বিরবির করে বললো ‘ইয়েস,উই আর পার্ফেক্ট এনেমিস। ‘
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ থাকার পর গালে কারো ঠান্ডা স্পর্শে তাকালো। দর্পণ ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
‘এই বউজান, খারাপ লাগছে আপনার?’
মেহতিশা চুপ করে তাকিয়ে আছে,দর্পণ দেখে মেয়েটার মধ্যে অসুস্থতার কিছুটা ছাপ স্পষ্ট। ক্লান্তির পরশ ছড়িয়ে আছে চোখের কোণে। মনে মনে আরও অনুতপ্ত হয় সে। চোখ দু’টো করুণ হয়ে ওঠে। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠলো। হাত বাড়িয়ে মেহতিশাকে উঠিয়ে নিলো। মেহতিশা তাল মেলাতে না পেরে নেতিয়ে লতার মতো দর্পণের বুকের সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়িয়ে গেলো। শক্তি না পেয়ে আর দাঁড়াতে পারলো না। দর্পণ দুই হাতে কোলে তুলে নিলো ওকে। মেহতিশা কথা বললো না। নির্লিপ্ত চোখে সামনে তাকিয়ে রইলো। দর্পণ হসপিটাল থেকে গাড়ি পর্যন্ত ওভাবেই আনলো। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ফিচেল হেঁসে বললো,
‘তুমি অনেক ভারি হয়ে গেছেন বউজান, জানেন?’
মেহতিশা জানালার পাশ থেকে চোখ ফেরায়। বিরক্ত কন্ঠে বলে,
‘জানি, কিন্তু আপনার ‘আপনি ‘ আর ‘তুমির’ কম্বিনেশনটা বুঝতে পারছি না। হয় আপনি বলুন নাহয় তুমি। ‘
দর্পণ ড্রাইভিং করতে করতে হেঁসে বললো,
‘তুমি আমার, ‘আপনি, তুমি ‘ সবকিছু। আপনি আমার জানোপ্প্রিয়া। ‘
–
ঘরের পেইন্টিং থেকে শুরু করে পুরো ঘরের সুরতহাল বদলে গেছে। দেয়ালের চার কোণায় ঝুলছে হোয়াইট স্টার। সিলিং ফ্যানটাও ডেকোরেটেড। ঘরের দরজার একদম চোখ বরাবর একটা বেবিগার্লের ছবি। কী আশ্চর্য সুন্দর রকমের একটা দৃশ্য! মেহতিশা মুগ্ধ চোখে দেখে। দর্পণ মুচকি হেঁসে বললো,
‘পছন্দ হয়েছে? ‘
মেহতিশা তপ্ত শ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকলো। খাটে বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে বললো,
‘একদিনে এতোকিছু! দরকার ছিলো না। ‘
দর্পণ দরজা আঁটকে দিয়ে হাঁটুগেড়ে বসলো মেহতিশার সামনে। কোমল হাতটা মুঠোয় নিয়ে নিজের গালে চেপে ধরে বললো,
‘বউজান, আমি খুব দুঃখীত। আমার অমন করা একদম ঠিক হয়নি। কিন্তু, আমি বুঝতে পারিনি যে আমার ভুলের জন্য আপনি এতো অসুস্থ হয়ে যাবেন। আমাকে ক্ষমা করুন প্লিজ। ‘
‘করবো,এক শর্তে। ‘
‘কী শর্ত? ‘
‘দুই বছর আগে কী হয়েছিলো? অর্পণ ভাইয়া কীভাবে মারা গেছে? আমার বাবার সাথে আপনার পরিবারের কী শত্রুতা? কারখানায় আগুন লাগানোর পিছনে কী সত্যি আপনার হাত ছিলো?সত্যিই কী আপনিই রাজনীতিতে অপরপক্ষকে হারাতে কাজটা করেছিলেন?এসব প্রশ্নের উত্তর চাই আমার। সবকিছু বললে তবেই আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিবো। ‘
দর্পণের চোখ দু’টো অসহায় হয়ে গেলো। মুষ্টিমেয় হাতে উঠে দাঁড়ালো সে। তরল কন্ঠে বললো,
‘আমি এসব প্রশ্নের উত্তর এখন দিতে পারবোনা আপনাকে। তবে.. ‘
‘হয় আপনি এখনি সব বলবেন নাহয়,আমি কী করবো আপনি জানেন। ‘
দর্পণ চুপ করে থাকে। মাথা নত হয়ে আছে তার। মেহতিশার চোখে অশ্রুরা ভীড় করেছে। তার ইচ্ছে করছে সব দেয়াল ভেঙে দিতে। আর কত সহ্য করতে হবে জানেনা সে। মেহতিশা ভাঙা গলায় অশ্রুভেজা চোখে বললো,
‘দর্পণ, আমি শেষবার বলছি আপনি আমায় সব বলুন। আমি কথা দিচ্ছি পরিস্থিতি যেমনই হোক আমি আপনার সাথে থাকবো। আমাকে ভালোবাসলে আপনি আমাকে বলবেন। ‘
দর্পণ মাথা তুললো না। সে আজ বাকহারা হয়ে গেছে। কথা বলতে জানেনা যেনো। মেহতিশা মনটা বিষিয়ে উঠলো। আর কক্ষনো এসব জানতে চাইবেনা বলে ঠিক করলো। যে নিজের স্ত্রীকেও বিশ্বাস করেনা তার কাছে কতটুকু মূল্য আছে তাও বুঝে নিলো। মেহতিশা টলমল পায়ে উঠে গেলো। দরজাটা খুলতে খুলতে বললো,
‘আমি সবসময়ের মতো এবারও গুরুত্বহীনই রয়ে গেলাম দর্পণ। ‘
চলে গেলো মেহতিশা। দর্পণ মাথা উঁচু করে বসলো। বহু কষ্টে শুকনো ঢোক গিলে বললো,
‘আপনি গুরুত্বহীন নয়,বরং আমি প্রতিজ্ঞাবধ্য। ‘
–
বিছানায় উল্টো হয়ে ফুলো কপালে হাত রেখে কাঁদছে নিশিতা। তাকে দেখভালের জন্য যে নতুন মেয়েটাকে রাখা হয়েছে সে সকালে লাঠি দিয়ে বারি দিয়েছে। কাউকে কিছু বলতে না পেরে অবুঝ নিশিতা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। চোখ মুছে বিরবির করে বকছে। এর মধ্যে আবারও কাজের মেয়েটা আসলো। সকালে যখন খাওয়াতে এলো তখন খেতে না করেছিলো নিশিতা। কাজের মেয়েটার অনেক বিরক্ত লাগলো। সে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বসলো। প্রথমে ভয়ে ভয়ে নিশিতা খেলেও যখন বাচ্চাদের মতো হাত পা ছুঁড়ে মানা করলো তখন দুই তিন ঘা বসিয়ে দিলো হাতে। বেশি নড়চড় করায় কপালেও লেগেছে। কাজের মেয়েটা এসেছে ঔষধ নিয়ে। নিশিতাকে ডক্টর দুই বেলা খাওয়ার পর কিছু ঔষধ দিয়েছেন। সেগুলো খাওয়াতে আসলো। মেয়েটাকে দেখেই নিশিতা চেঁচিয়ে বললো,
‘খবরদার,তুই আমার কাছে আসবি না। তুই খুব খারাপ। খুব খুব খারাপ। ‘
মুনিয়া বিরক্ত হলো। এই পাগলীটাকে নিয়ে হয়েছে মহাজ্বালা। এটা খাবোনা ওটা খাবোনা। ওর তো আর ঠেকা পড়েনি এটাকে যত্ন করে খাওয়াতে। শুধু চাকরি বাঁচাতে বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে এসব। মুনিয়া হাতের ঔষধটা নিয়ে নিশিতার গালে চেপে ধরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,
‘একদম চুপ! পাগলী কোথাকার। চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। নকড়া দেখাবি তোর মতো কোনো পাগলকে। ‘
নিশিতা ফোঁপাতে থাকে। কান্নায় ভেঙে পড়তে নিলেই আবারও ধমকে ওঠে মুনিয়া। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে মেহতিশা। অনেক দিন ধরে নিশিতার কাছে আসা হয়নি। শরীরটা অনেক খারাপ ছিলো। নিশিতার ঘরটা দোতালায় হওয়ায় ভারিক্কি শরীরে উঠানামা করতে কষ্ট হয়। তবুও, আজ কী মনে করে যেনো আসলো এখানে। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দরজায়। এতো খারাপ ব্যবহার করে এই মেয়েটা! এতোদিন ধরে কী মা কিছুই দেখেননা! মেহতিশা এসে জোরে ধমক দিয়ে বললো,
‘এই মেয়ে ছাড়ো নিশি আপুকে। তোমার সাহস কী করে হলো এমন করার?’
মুনিয়া ভয়ে কেঁপে উঠলো। নিশিতার গালটা ছেড়ে দিয়ে তাকালো। মেহতিশা নিশিতার কাছে আসতেই নিশিতা গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলো। মেহতিশার প্রচন্ড খারাপ লাগলো। কী অবস্থা হয়েছে নিশিতার! দেখে অদ্ভুত লাগছে। মুখের উজ্জ্বলতাটুকুও অবশিষ্ট নেই। মেহতিশা মুনিয়াকে বললো,
‘মাত্র এক মাস হলো বাড়িতে এসেছো। এসেই দূর্ব্যবহার শুরু। তোমাকে আর কাজ করতে হবেনা। আমি মা’কে বলবো যতদ্রুতসম্ভব তোমাকে রেহাই দিতে। তুমি একদম নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। ‘
মেহতিশার কড়া চোখের দিকে তাকিয়ে মুনিয়া আর কিছু বলার সাহস না পেয়ে বেরিয়ে গেলো। মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। বসে নিশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিশিতা উল্টোপিঠে উপুড় হয়ে শুয়ে রইলো। বালিশের নিচের ফটোফ্রেমটা টেনে বুকে জড়িয়ে মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘সবাই বলে মৃত মানুষরা নাকি ফেরে না? এমন কোনো উপায় নেই, যেখানে মৃত মানুষদের একটু কাছ থেকে ছুঁয়ে তৃষ্ণা মেটানো যাবে?’
চলবে-
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।
“প্রিয় দিও বিরহ”
২৪.
‘আরেকটু খেয়ে নিন বউজান। ‘
‘আমি বললাম তো খাবোনা, সমস্যা কী আপনার?’
‘আমার অনেক সমস্যা, আপাতত আপনি খেলে আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ‘
‘আমি আপনার সমস্যা সমাধান করতে মোটেও ইন্টারেস্টেড নই। ‘
দর্পণ খাবারটা মুখের সামনে ধরেই রাখলো। গত এক ঘন্টা যাবৎ খাবার নিয়ে ঘোরাচ্ছে মেহতিশা। ইচ্ছে করেই অবশ্য। মেহতিশা জোরপূর্বক খাবারটুকু মুখে নেয়। দর্পণ হাসে। অতঃপর উঠে দাঁড়ায়। চুলটা আঁচড়ে নিয়ে ওয়ালেট পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে মেহতিশার কাছে এসে বসে। দুই হাতে মেহতিশার কোমর জড়িয়ে উদরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুমু খায়। মেহতিশা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে শক্ত হয়ে।কালকের পর আর একবারও দু’জনের কথাবার্তা হয়নি। মূলত মেহতিশাই বারবার দর্পণকে সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে।
দর্পণ এটা ওটা নিয়ে কথা বললেও মেহতিশা হু হা করে কাটিয়েছে৷ সকালেও ঘুম থেকে উঠে দর্পণকে ডাকেনি। এখন দুপুরের সময় অফিস থেকে দর্পণ লাঞ্চ ব্রেকে ছুটে এসেছে। যদিও মেহতিশা কোনো প্রকার হাসিখুশি প্রতিক্রিয়া দেখায়নি এতে। দর্পণ মেহতিশার হাত ধরে রেখেছে। মেহতিশা হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তবে পারলো না। দর্পণ হাতটা টেনে ঠোঁটে চেপে ধরলো। মেহতিশা কিছু বলতে পারেনা৷ হাসফাসে নিশ্বাসগুলো গুমোট করে দিচ্ছে ভেতরটাকে। দর্পণ গম্ভীর গলায় বলে,
‘মেহতিশা! ‘
মেহতিশা খেয়াল করেছে দর্পণ ওকে তখনই নাম ধরে আর তুমি করে ডাকে যখন কোনো ব্যাপারে চিন্তিত থাকে বা গম্ভীর হয়ে যায়। মেহতিশা আড়দৃষ্টিতে তাকায়। দর্পণের চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। দর্পণ ভারি গলায় বলল,
‘মেহতিশা, আমি সারাক্ষণ তোমার পাশে থাকবোনা। মানে থাকতে চেয়েও পারবো না। বাবার বয়স হয়েছে।
ভাইয়া থাকতে কখনো বুঝিনি কাজ করে টাকা কামাতে কতো কষ্ট। আমি শুধু ঘুরেছি ফিরেছি রাজনীতি করে বেরিয়েছি। ভাইয়া যেদিন মারা গেলো, হুট করেই সেই শূন্যতাটুকু বুঝতে শুরু করে করলাম।
বয়স্ক বাবা, মা, বোন আর বোনের চেয়েও বেশি আমাকে ভালোবাসা ভাবী মানুষটা। সবাইকে ভালো রাখার দায়িত্বটা যখন কাঁধে এসে পড়লো তখন বুঝলাম। আমি জানি, সব মেয়েরাই নাটক সিনেমার মতো চায় তার প্রেগ্ন্যাসির সময় স্বামী সারাক্ষণ তার পাশে পাশে থাকবে কেয়ার করবে। অনেক ভালোবেসে আনন্দে রাখবে৷ বিশ্বাস করো, আমিও চাই তোমার পাশে থাকতে। দশটা মাস তুমি আমার সন্তানের জন্য কষ্ট করবে, আমারও ইচ্ছে করে তোমার পাশে থেকে সময়টা কাটাতে। আমি সারাটাদিন অফিসে থাকি৷ কিন্তু আমার মনটা আমি এখানেই ফেলে চলে যাই। তুমি সারাক্ষণ কী করছো, কী খাচ্ছো, ঘুমাচ্ছো কিনা ঠিকঠাক ঔষধ নিচ্ছো নাকি, কোনো দৌড়ঝাঁপ করছো নাতো! ঠিক আছো তো, এসব ভাবতে ভাবতে আমার কাজে মন বসেনা। আমার ইচ্ছে করে ছুটে চলে আসতে। তখন ভাইয়ার কথা মনে পড়ে। আমার ভাইটাও তো একইভাবে স্বপ্ন দেখতো, এতদিনে সেই বাচ্চাটাও ঘরে ছুটে বেড়াতো। আমার ভাইয়া বেঁচে থাকলে কতোটা আনন্দ করতাম আমরা! ‘
মেহতিশার চোখও ভিজে জুবুথুবু। দর্পণ ছেলে মানুষ বলেই হয়তো চোখের জল চেপে রেখেছে। দর্পণ হাফ ছেড়ে আবারও বললো,
‘মেহতিশা, আমি এমন করলে কী আমার ভালো লাগে? তুমি ঠিক মতো খাচ্ছো না, ঘুমাচ্ছো না, মা ফোন করে ঘন্টায় ঘন্টায় অস্থির হয়ে বলছেন, তুমি নাকি ঘরে বসে বসে চুপ করে পড়ে থাকো এক কোণায়। এমন কেনো করো তুমি? ‘
মেহতিশা রেগে গেলে যেনো। সে দর্পণকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ভারি শরীরে খুব জোরে কথা বললেই শ্বাসকষ্ট উঠে যায় ওর। তবুও, দানবীয় শক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,
‘তো কী করবো আমি! সব কী আপনার কথা মতোই হবে! আমি তো সবার হাতের পুতুল তাইনা?যে যা মন চায় আমার সঙ্গে তা করবে। আরে, আমি কাকে কী বলছি! হচ্ছেই তো! শুরু থেকেই হচ্ছে। ভালোই তো ছিলাম আমি। পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন ছিলো। রক্তের সম্পর্কে মা বাবা না হলেও কখনো ভালোবাসার অভাব হয়নি। হঠাৎ করেই, একদিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে গেলো। আমাকে বন্ধুর মতো গাইড করা মানুষটা, আমার মেঝো চাচা সাহিল জামান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। লাশটাও বাড়ি পৌঁছালো না। সুস্থ হাসিখুশি মানুষটার একটা পোড়া হাত শুধু ফিরেছিলো। পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসলো। যতটা না কষ্ট হয়েছিলো, সাহিল চাচ্চু মারা যাওয়াতে তার চেয়েও বেশি হয়েছিলো যখন আমার বাবা প্রতিশোধের নেশায় প্রতিপক্ষ দলের আপনাকে পথে বসাতে আপনার কোম্পানির সব পেপার হাতিয়ে নিয়ে চলে আসতে। কথা ছিলো, আপনাকে ভালোবাসায় ফাঁসানো অথচ দেখুন বিয়ের পরে কীভাবে আমিই ফেঁসে গেছি আপনাতে!
বাবা ঠিকই বলেছিলো, নিজের জন্য মাঝে মাঝে খুব স্বার্থপর হতে হয়। আমি হতে পারিনি, যখনই ভেবেছি আপনাকে ঠকাবো ততবার মনে হয়েছে, পারবোনা এই মানুষটাকে ঠকাতে! ভালোবেসে ফেলার অপরাধের মাশুল তো দিচ্ছিই। দেখছেন না, বাজে ভাবে ঠকে গেছি! আমি কিছু না জানলেও, আপনি ঠিকই জানতেন আমার বাবা আমাকে আপনার সাথে বিয়ে দেয়ার মতো বোকামিটা করে ফেলবে। তাই তো দূর্বল সেজেছিলেন। আর এই বাচ্চাটাও আপনি এজন্যই চেয়েছিলেন, যাতে বাধ্য হয়ে আমি আপনার কাছেই থেকে যাই। আর বাবার প্ল্যান সফল না হয়,আমাকে দেখতে না পেয়ে বাবাও যেনো একই কষ্ট পায়।
আমার অসহ্য লাগে সবকিছু! যতবার আমি ভাবি আমি বাবার আর আপনার কাছে প্রতিশোধের গুটি এছাড়া কিছুনা ততবার আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে!আমি মরিনা কেনো দর্পণ?’
দর্পণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরমুহূর্তেই দুই হাতে শক্ত করে মেহতিশাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘আমি আপনাকে সব বলবো বউজান! আপনি ছাড়া আমার কে আছে! ভালোবাসি তো! ‘
চলবে