“প্রিয় দিও বিরহ,২৫,২৬,২৭
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
২৫.
টলমলে অশ্রুতে সিক্ত হয়ে চোখদুটো আরও মায়াময় লাগছে। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। জোৎস্নার মতো অপরূপা লাগছে মেহতিশাকে। ঘুমিয়ে মুখটা ফুলিয়ে রেখেছে। দর্পণ বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। দর্পণ মেহতিশাকে সেসময় সবটা খুলে বলতে চেয়েছিলো, মেহতিশা তার আগেই তাকে বলেছে,এসব বলার কোনো প্রয়োজন নেই। তারপর বিছানায় চুপ করে শুয়ে রইলো। দর্পণ কাছে আসতে চাইলেও মেহতিশা তাকে আসতে দেয়নি। কথাগুলোর মাঝে কতটুকু অভিমান লুকিয়ে ছিলো তা বুঝতে বাকি নেই দর্পণের।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাতের ঘড়িটা পড়ে নিয়ে মেহতিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘বউজান, আপনি আমার কাছে ভালোবাসার চেয়ে বেশি। আপনাকে পেতে যদি আমি খুন করতে পারি। তাহলে, আপনাকে আমার কাছে আঁটকে রাখতে কী করবো তা আপনার ধারণারও বাইরে। আপনি অভিমান করুন,রাগারাগি করুন, কিন্তু সবশেষে আপনি আমার হয়েই থাকুন৷ আপনার আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়ার সকল পথ আমি বন্ধ করে দেবো। আপনি ডানে, বামে, উপরে, নিচে যতবার ভরসার হাত খুঁজবেন শুধু আমাকেই পাবেন।
আমার আরশীজগতে প্রবেশ আপনার ইচ্ছেতে হলেও গমণ আমার শেষ নিঃশ্বাসের পরই হবে। আপনি যতবার ভাববেন, আপনি মুক্ত হয়ে গেছেন ততবার আমি আপনাকে নতুন করে আমাতে মেশাবো। ‘
দর্পণ মুখে হাসিটুকু অটল রেখে মোবাইল কানে লাগিয়ে কথা বলতে বলতে বের হয়ে গেলো। অথচ, বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকা মেহতিশা কিছু শুনলোইনা।
–
টিকটিক করে ঘড়ি জানান দিলো বিকেল চারটে বাজে। আপেলের জুসের গ্লাসটা হাত থেকে রেখে গায়ে চাদরটা টেনে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। একবার ছাঁদে একা যাওয়ার সিদ্ধান্তে মনস্থির করলেও আবার ভাবলো কাউকে সাথে নিয়ে গেলে ভালো হবে।
সেই ভেবেই নিচের দিকে গেলো, দিয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। ওকে তো আর ডিস্টার্ব করা সাজেনা। মেয়েটা পড়ুক মন দিয়ে। জীবনে বড় কিছু করতে পারলে তখন আর নিজেকে নিয়ে এতো হীনমন্যতা থাকবেনা। মেহতিশা ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে লালিমা শেখ টিভিতে সিরিয়াল দেখছেন৷ মেহতিশা ভেবে পায়না, একটা মানুষ দিনে কতগুলো সিরিয়াল দেখতে পারে! ওর মনে হয় হিন্দি যতগুলো সিরিয়াল তৈরি হয়েছে এই পর্যন্ত তিনি সবগুলোর নামই মুখস্থ করে রেখেছেন। কোনটার পর কোনটা হয় সেগুলোও জানেন। মেহতিশা টিমটিমে পায়ে হেঁটে লালিমার পাশের গিয়ে বসলো। লালিমা প্রথমে ওর শরীরের খোঁজ নিয়ে তারপর গদগদ হয়ে এখনের সিরিয়ালের একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাতে শুরু করলেন। কিন্তু, মেহতিশা যেহেতু এসব টিভি সিরিয়াল দেখেনা তাই ওর মন বসছেনা। লালিমা শেখের গল্পের মূল কনসেপ্ট হচ্ছে, আজকে যমুনা ঢাকি শত্রুপক্ষকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছে এবং নায়ক তাকে প্রচন্ড সাপোর্ট দিচ্ছে। ইহা বড়ই আনন্দের ব্যাপার স্যাপার।
মেহতিশা কিছুক্ষণ বসে তারপর বললো,
‘মা, আমি একটু নিশিতা আপুর ঘর থেকে ঘুরে আসি। সেই সকালে একবার গিয়েছিলাম। তখন, আপু ঘুমিয়ে ছিলো। ‘
লালিমা মুখটা কালো করে বললেন,
‘নিশিতার কাছে তুমি যখন তখন যাবেনা মা, দেখোই তো ও পাগল কিসিমের মানুষ। যদিও, বলতে নেই তবুও বলি নিশিতা একটা অপয়া। আমার ছেলেটার মাথা তো খেয়েছিলো। একেবারে শেষ না করা পর্যন্ত ক্ষ্যান্ত হয়নি৷ চার মাসের বাচ্চাটাকেও খেয়েছে। ওর থেকে যত দূরে থাকবে ততই মঙ্গল। এজন্যই তো আমি মুনিয়াকে রেখেছিলাম৷ যাকগে,মতো পছন্দ হয়নি তাই বাদ দিলাম। কিন্তু তোমার ওর সাথে বেশি ঘেঁষার দরকার নাই। ‘
মেহতিশার খারাপ লাগে নিশিতার সম্বন্ধে কেউ এ ধরনের কথা বললে। এখন যদি মেহতিশা আগের মতো ঠোঁট কাটাই থাকতো তাহলে সহজেই একটা ঠান্ডা মাথার বাঁশ দিয়ে দিতো। কিন্তু এখন কথা অনেক বুঝে সুঝে বলতে হয়। মেহতিশা মুখ সংযত রাখার চেষ্টা করেই বললো,
‘মা, মানুষের হায়াত উপর থেকে একজন লিখেই পাঠান। অর্পণ ভাইয়াকে আমি বাস্তবে কখনো দেখিনি। তবুও, আপনাদের কাছে শুনে আমার কষ্ট হয় তার জন্য। আর আপনার কত কষ্ট হয় তা তো বুঝি। কিন্তু, নিশিতা আপুরই বা কী দোষ! সেও তো আপনার মতোই নিজের সন্তান হারিয়েছে। তার অসুস্থতার জন্য মা বাবাও বোঝা ভেবে বাড়িতে নেয়নি। নিশিতা আপু হয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু পশুও ভালোবাসা আর অবহেলার পার্থক্য বোঝে। আমরা যদি আপুকে একটু ভালোবেসে খেয়াল রাখি, হতেই তো পারে সে আগের মতো হয়ে যাবে! অর্পণ ভাই নাকি আপুকে খুব ভালোবাসতেন। তাহলে, আপুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও কিন্তু অর্পণ ভাইয়া কষ্ট পাবেন। ভাইয়া কিন্তু এই পরিবারের উপরই আপুর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। ‘
মেহতিশা উঠে যায়। কথাগুলে না বললে মনে শান্তি পেতো না একটুও। বড়রা যে সবসময় সঠিক হবে এমন কোনো কথা নেই। তাদের ভুলটাও একটু কৌশলে হাসিমুখে শুধরে দেওয়া সম্ভব৷ এতদিন সুযোগ্য সময়ের অভাবে যা পারেনি তা আজ বলেই ফেললো সে। অন্তত,এবার একটু হলেও বাধ্য হবেন ভাবতে। লালিমা শেখ চিন্তিত মুখে বসে আছেন। টিভিটা চলছে, কিন্তু মনটা হঠাৎ কোথায় যেনো ছুটে চলেছে।
–
নিশিতা খাতায় পেন্সিলের খোঁচায় একমনে কিছু এঁকে যাচ্ছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ যেনো কিছু। মেহতিশা মৃদু হেঁসে ঘরে আসে। নিশিতা এলোমেলো চুলে মুখ নিচু করে খাটে বসে আছে। মেহতিশা খাটে বসে হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বললো,
‘নিশি আপু, তুমি কী আঁকছো?’
নিশিতা মুখ তুলে চায়। দাঁত বের করে নিষ্পাপ হাসে। হাতের খাতাটা সামনে তুলে বলে,
‘দেখো দেখো, আমি আমাদের এঁকেছি! সুন্দর হয়েছে না বলো! ‘
মেহতিশা খাতায় নজর দেয়। চোখদুটো বড় বড় করে তাকায়। সত্যিই নিশিতা অনেক সুন্দর এঁকেছে। এটা দুইদিন আগের ঘটনা। যখন মেহতিশা নিশিতার মাথায় তেল দিয়ে বিনুনি করে দিয়েছিলো। দুজনে অনেক গল্প করেছিলো। সেসময়টা একেবারে অবিকল ফুটিয়ে তুলেছে নিশিতা৷ দেখে মনে হচ্ছে তারা যেনো কত বছর ধরে একে অপরের সঙ্গে আছে। দু’টো বোন পাশাপাশি থাকলে যেমন লাগে তেমন। মেহতিশা মনে এক অন্য রকম অনুভূতি পায়। কোনো বড় ভাই কিংবা বড় বোন ছিলো না ওর৷ নিশিতাকে মনে হয় যেনো সে সত্যিই ওর আপন বড় বোন। মেহতিশা নিশিতাকে বলে,
‘আপু, তুমি এতো সুন্দর আঁকতে পারো! আগেও বুঝি আঁকতে! ‘
নিশিতা হেঁসে বলে,
‘আগেও এঁকেছি। আমার ছোট বোন নিয়ামা, ওর জন্য মাঝে মাঝে আঁকতাম। কিন্তু.. ‘
‘কিন্তু কী আপু?’
নিশিতা মুখ গোমড়া করে বললো,
‘নিয়ামা তো এখন আর আমার কাছে আসেনা। একবার যখন এসেছিলো, তখন আমার সাথে কথাও বলেনি। আমাকে কেউ আর ভালোবাসেনা। অপু বলতো,খারাপ মানুষদের কেউ ভালোবাসেনা কথা বলেনা৷ আমিও খারাপ হয়ে গেছি, একদম পঁচা হয়ে গেছি। ‘
মেহতিশা নিশিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। নিশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি একটুও পঁচা হওনি আপু৷ তুমি খুব ভালো। দেখবে, তুমি একসময় খুব বেশি ভালো থাকবে। আমি তোমার ছোট বোন হয়ে আজীবন পাশে থাকবো, আর কেউ থাকুক আর না থাকুক। ‘
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
“প্রিয় দিও বিরহ”
২৬.
আকাশের মেঘগুলো কমলা রঙে মাখামাখি করে ভেসে বেড়াচ্ছে।
তো কখনো আবার কালো মেঘে পরিবর্তন হচ্ছে। ঘাসের উপর একটা ছোটো মেয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড়ে আসছে।
পাশেই সাদা রঙহীন কাপড়ে সুই দিয়ে সেলাই করতে করতে মলিন দৃষ্টিতে একটা গাছের নিচে বসে আছে মেহতিশা। চেহারায় রাজ্যের বিষন্নতা। যেনো পৃথিবীর সকল দুঃখ কষ্ট গুলো তার একার। দর্পণ হেঁটে আসতে আসতে দেখে ছোট বাচ্চা মেয়েটা চঞ্চল পায়ে ছুটে ওর দিকেই আসছে।
কী নির্মল স্নিগ্ধ একটা মুখ! দর্পণ কেমন একটা যেনো অনুভূতি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে পৃথিবীর সবচেয়ে দানবীয় আদরটা করতে। দর্পণ হাসিমুখে বাচ্চাটাকে কোলে নিতে এগিয়ে আসছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! দর্পণ যতই এগোচ্ছে ততই যেনো পথগুলো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। পথগুলো বিস্তীর্ণ থেকে বিস্তীর্ন হয়ে চলেছে ফেটে চৌচির হলো ধরণীতল। আকাশটাও ঝুম বৃষ্টি দিয়ে শোক প্রকাশ করছে। মেহতিশা দর্পণের দিকে তাকিয়ে ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে বললো,
‘খুনী আপনি, আপনাকে আমি কক্ষনো ক্ষমা করবো না!’
কথা বলতে গিয়ে যখন গলা দিয়ে শত চেষ্টার পরও কোনো শব্দ বেরই হলোনা তখন দর্পণ সমস্ত শক্তি জোগাড় করে চিৎকার করে উঠলো। চোখ খুলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে দর্পণ। এ যেনো কোনো ভয়ঙ্কর ফাঁদ থেকে ছুটে আসা। পুরোটাই একটা স্বপ্ন ছিলো তাহলে। দর্পণের শ্বাস এখনো হাপরের মতো উঠানামা করছে। গায়ের শার্টটা ভিজে গেছে ঘেমে। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। দর্পণ বিছানার পাশ হাতরে দেখলো মেহতিশা বিছানায় নেই। বুকটা আবারও কেঁপে উঠলো তার।
দর্পণ গলা বাড়িয়ে মেহতিশাকে ডেকে উঠলো। মেহতিশা নিশিতার ঘরে বসে ওকে খাওয়াচ্ছিলো। হঠাৎ ডাকে দ্রুত ছুটে আসলো। উপর নিচ ছুটাছুটি করলে শ্বাস টেনে টেনে নিতে হয়। তবুও, দর্পণের চিন্তায় দ্রুত এসে পড়লো। দরজা চাপানো ছিলো। ওটা ফাঁকা করে ঘরে এসে দর্পণের পাশে দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে নিঃশব্দে জিজ্ঞাসার অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতেই দর্পণ অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে মেহতিশার কোমর জড়িয়ে মুখ গুঁজে রাখলো। মেহতিশা চমকালো। কী হলো লোকটার! একটু আগেই অফিস থেকে এসে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
যেহেতু মেহতিশা দর্পণের সঙ্গে গত কয়েক দিন ধরে অতি প্রয়োজনীয় টপিক ছাড়া কথা বলেনা। তাই দর্পণ এটা ওটা নিয়ে প্রচুর জ্বালিয়েছে। যেই ঘুমিয়ে পড়লো, মেহতিশা লুকিয়ে লুকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেছিলো। এর মধ্যেই কী হলো? মেহতিশা দর্পণের মাথায় হাত রেখে চিন্তিত মুখে বললো,
‘বাজে স্বপ্ন দেখেছেন?’
‘হু। ‘
‘এই সময়ের স্বপ্ন সত্যি হয়না, আপনি আসুন নিচে মালা খাবার বাড়ছে। ‘
দর্পণ ছাড়েনা মেহতিশাকে। বরং আরও দৃঢ় হাতে জড়িয়ে নেয় নিজের সঙ্গে। মেহতিশাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসায়। কপালে চুমু খেয়ে বলে,
‘নাহ, আপনি কেনো আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন? আমি ভয় পেয়েছি। ‘
মেহতিশা সিরিয়াস মোমেন্টেও হেঁসে ফেললো। এতদিনের রাগগুলো ধুয়ে গেলো একেবারে। হাসতে হাসতে বললো,
‘আপনি কী ছোটো বাচ্চা দর্পণ? এখন কী আপনার ভয় পাওয়ার বয়স আছে! ‘
ছোটো বাচ্চা বলায় দর্পণের স্বপ্নে দেখা বাচ্চাটার কথা মনে পড়লো। সত্যিই কী স্বপ্নটা অর্থহীন! নাকি কোনো বড় ব্যাখ্যা আছে! দর্পণের হাতটা মেহতিশার উদরে বিচরণ করছে। এমন অদ্ভুত আচরণের কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছেনা মেহতিশা। দর্পণ মেহতিশার পেটের উপর মাথা রেখে বললো,
‘মেহু, আমি কালকে হুজুর নিয়ে আসবো। কী যেনো একটা করেনা! ঘর বন্ধ করা। আমি বলে দেবো ঘরে দোয়া কালাম পড়ে ঘর বন্ধক দিতে। এতিমখানায় বাচ্চাদের খাবার খাইয়ে দিবো সঙ্গে। ‘
মেহতিশা চুপচাপ শুনে যায়। বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই ভয়াবহ ভয়টা পেয়েছে বলেই এমন করেছে। সে নিশ্চল কন্ঠে বললো,
‘আর?’
দর্পণ ভাঙা গলায় বলতে থাকলো,
‘বৃদ্ধাশ্রমেও কিছু ডোনেশন দিয়ে দেবো। ‘
‘আর?’
‘রাস্তার মানুষ গুলোকে দুই বেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবো। ‘
‘আর?’
‘আপনাকে ঘরবন্দী করে রাখবো। কোথাও যেতে দেবোনা। ‘
‘আর?’
‘আপনাকে আরও বেশি ভালোবাসবো। ‘
‘তাই? আর যদি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যাই! ‘
‘তাহলে আমি খুব খুব কাঁদবো! কেঁদে কেঁদে মরে যাবো। ‘
–
ওয়াশরুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে দর্পণ।
এই নিয়ে ভয়ে ভয়ে চতুর্থবার দরজায় নক করে বললো,
‘বউজান, তুমি ঠিক আছেন?’
ভেতর থেকে হাত মুখ ধুয়ে বের হলো মেহতিশা। চোখ মুখ লাল হয়ে এসেছে। কিছু খেতে পারছেনা সকাল থেকে। রাতেও দুইবার বমি হয়েছে। ভাতটুকু শেষ হওয়ার আগেই আবার দৌড়ে এসেছে। দর্পণ নক করায় ধমকও খেয়েছে। অযথাই বকা শুনেছে। মেহতিশার মুড সুইং হয় ঘন ঘন। কখনো রাতের দুইটা তিনটায় জেগে হাঁটাহাঁটি করে। আবার, এটা ওটা বানায় খাওয়ার জন্য অথচ, খেতে নিয়ে বলে এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু ভুলেও দর্পণকে কিছু বলেনা। দর্পণের পায়ের কথাটা যবে থেকে জেনেছে, তখন থেকে দর্পণকে ডিস্টার্ব করা বন্ধ করে দিয়েছে। দর্পণ এখন আর ল্যাপটপ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেনা।একটু পরপর জিজ্ঞেস করে, কিছু খাবে?কিছু লাগবে?এনে দেই? একটু খাও! দেখবে ভালো লাগবে।
মেহতিশা তখন প্রতুত্তর করেনা। চুপ করে শুনে যায়। রেগে কখনো দুই তিনটে কথা শোনায়। যেমন, বেইমান লোক, অসভ্য ধোঁকাবাজ, মাথাপাগল ব্যাটা ইত্যাদি। এরও ভেরাইটিস আছে নানাপ্রকার। দর্পণ কিছুক্ষণ মুখ গম্ভীর করে পুরনো চেহারায় চলে যায়। তারপর বউয়ের কাছে পাত্তা না পেয়ে হাসফাস করতে করতে এসে বলে,
‘বউজান, আপনি খুব পাষাণ। একটু ভালো ব্যবহার করলে তোমার কী হয়?’
মেহতিশা আড়চোখে তাকিয়ে মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
‘কিছু হয়না, তবে আপনার ‘ তুমি, আপনি’ এর ফালুদা বানানো বন্ধ করলে বেশি ভালো হয়!’
‘আমি তো চাই বিশ্বাস করুন বউজান, কিন্তু কীভাবে যেনো দুটো মিক্স করে ফেলি তোমার সামনে। ওহ শিট! আবারও’
এহেন এলোমেলো কথায় হো হো করে হেঁসে উঠলো মেহতিশা। দর্পণের গালগুলো টানতে টানতে লাল বানিয়ে টুপ করে চুমু খেয়ে বললো,
‘হোয়াই সো কিউট!’
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
“প্রিয় দিও বিরহ”
২৭.
নিশীথের অন্ধকারে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দটা বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে।
অস্পর্শে নিভৃতে ভালোবাসা একে দিচ্ছে যেনো বৃষ্টিকন্যারা ধরণীর বুকে। এই তো সেই দিন সবেমাত্র শীত এলো। পিঠেপুলির পার্বণের ধুম লেগেছিলো। কত পদের খাবারের তোড়জোড় শুরু হয়েছিলো। এখন তার রেশ নেই বললেই চলে। শীত বিদায় নিয়ে হালকা হালকা গরম পড়েছে। ঋতুরাজ বসন্তের আগমণ হবে কয়দিনের মধ্যেই। ফাল্গুনী গন্ধে মো মো করবে শহরটা। চমৎকার সাজে সজ্জিত হবে লজ্জায় লাল হয়ে উঠবে।
ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে বিছানায় চোখ বুলিয়ে নিলো মেহতিশা। দর্পণ নেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া
সাদা রঙয়ের ছোট কাগজটি বালিশের পাশে নড়েচড়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। এটি সম্পর্কে মেহতিশা অজানা নয়। কারণ রোজই দর্পণ এই কাজটা করে। ব্যতিক্রম হয় সেদিন, যখন দর্পণ ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে। মেহতিশা খেয়াল করেছে দর্পণ খুব সময়সচেতন মানুষ। ঘড়ির কাটাও সবসময় দশ মিনিট ফাস্ট করে চলে। এমন মেইনটেইনিং লাইফ মেহতিশা একমাত্র এনাকেই লিড করতে দেখেছে। মেহতিশা নিজে জীবনেও এত কিছু নিয়ম মেনে করতে পারেনা। তা-ই হয়তো বলে, জীবনসঙ্গী হিসেবে উপরওয়ালা বিপরীতমুখী কাউকে বাছেন। নাহলে, মেহতিশার যে কী হতো! এই ভেবে মুচকি হাসে মেহতিশা। কাগজটা খুলে দেখে রোজকার মতো কিছু উপদেশ বাক্য –
‘মালাকে বলে দিয়েছি, তোমাকে নাস্তা দিয়ে যাবে। দুধটুকু পুরোটা খাবে। সবজিগুলো ফেলবেনা। আমার নয়টায় মিটিং। দশটায় কল করবো। মোবাইল পাশেই আছে। ফ্লোরে ম্যাট্রেস বিছানো আছে। সাবধানে হাত মুখ ধুয়ে এসো। বই পড়ো, গান শোনো কিন্তু লাফালাফি করতে যাবেনা। আমি তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো। ‘
মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সুখগুলো আমাদের জীবনে চিরস্থায়ী কেনো হয়না! কেনো সুখ খনিকের জন্য এসে মায়া বাড়ায়! অনেক হয়েছে। এবার সব মোহমায়া থেকে বের হতে হবে। সত্যটা আড়ালে ৷ কিন্তু খুব বেশি গভীর নয়। একটু নিচে গেলেই খুঁজে পাওয়া যাবে। মেহতিশা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সেই কাজ করবে। ধাঁধার সমাধান করবেই। পথ দুটো, একটা সত্যি জেনে শান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচবে। নাহয়, জালে ফেঁসে অতলে গহ্বরে তলিয়ে যাবে। দেখা যাক কী হয়। মেহতিশা হাত মুখ ধুয়ে আসে। বোরকা পড়ে রেডি হয়ে নেয়। নিকাবটা মুখে পেচিয়ে চোখ মুখ ঢেকে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন হাসি পেলো তার। বোরখা পড়ে ফুলো পেটে কেমন বয়স্ক দেখাচ্ছে বাহির থেকে। যদিও মেহতিশা তেমন মোটা হয়নি। শুধু পেটটাই উঁচু। কিন্তু তবুও কালো রঙচঙহীন বোরকা কখনো পড়া হয়নি। মেহতিশা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। মোবাইলটা ব্যাগে ভরে মনে মনে ভাবে, আমি আপনাকে আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসি দর্পণ। কিন্তু আমার বাবার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তো আমি অবশ্যই একটা কঠিন পদক্ষেপ নেবো। শতকষ্ট হলেও নেবো।
রুম থেকে বের হয়ে মেহতিশা নিজের শ্বাশুড়ি মা’কে খুঁজলো। তিনি পরম আনন্দে স্টার জলসা দেখছেন। মেহতিশা ধীর পায়ে এসে বাহিরে যাওয়ার পায়তারা করতেই টপকে পড়লো মালা। মেহতিশাকে দেখেই গলা ফাটানো শব্দ করে বললো,
‘আরেএএ ছুডো ভাবিজান! আপনে উঠসেন,আমারে কবেন না? হায়হায়রে! ভাইজান আমারে কয়া গেসিলো আপনার নাস্তা দিতে। কিন্তু, আপনে ঘুমাইতাসেন ভাইবা আমি আর আপনেরে ডিস্টাব করতে যাইনাই। ‘
মেহতিশা ভাবছে,এ তো মহাজ্বালা! মালা মেয়েটা হচ্ছে দর্পণ ভক্ত। সারা বাড়িতে এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি করবে আর দর্পণের অর্ডার মেনে গোয়েন্দাগিরী করবে। দর্পণ যদি বলে, মালা এখনই বনবাসে চলে যা। ওখানে পশুপাখির সঙ্গে সংসার শুরু কর। তাহলে, মালা হেলেদুলে সত্যি সত্যি চলে যাবে। খুব একটা অবাস্তব নয়। দর্পণ মালাকে ফুলবিক্রি করতে দেখে নিয়ে এসেছিলো বাড়িতে। তার কাজ শুধু মেহতিশার খেয়াল রাখা। কিন্তু মেহতিশা অতিরিক্ত গোয়েন্দাগিরীতে বিরক্ত হয়ে ওকে নিশিতার খেয়াল রাখার জন্য লাগিয়েছে। দর্পণ রোজ মালাকে বলে যায় মেহতিশার খাবার দাবারসহ যাবতীয় সবকিছুর খেয়াল রাখতে। যারপরনাই প্রচুর বিরক্ত মেহতিশা। মালা এখনও একগাল হেঁসে বললো,
‘ছুডো ভাবিজান,আপনে খারান। আমি খাওন সাজাই দিতাছি। আপনি খাইয়া লন। আর বোরখা পইড়া আপনে কই যান?’
মেহতিশা জানতো এই ঈগলচোখী মেয়েটা অবশ্যই এই প্রশ্নটা করবে। মেহতিশা বললো,
‘সারপ্রাইজ দিতে। ‘
‘কারে সারপেরাইজ দিবেন ভাবীজান? ‘
‘তোমার ভাইজানকে! আমি তার অফিসেই তো যাচ্ছি। এখন সে দেখে আমাকে খুব খুশি হবে। তোমার ভাইজান কল করলে বলবে, আমি ঘুমাচ্ছি। খবরদার, বলে দিওনা যেনো কিছু। ‘
মালা ভাবুক গলায় বললো,
‘ভাইজান সারপেরাইজ পাইলে খুশি হইবো?’
‘হ্যারে বাবা। ‘
‘আচ্ছা, তাইলে আপনে যান। কিন্তু নাস্তা? ‘
‘ওহহো! ওটা আমি এসে করে নেবো। বেশি সময় লাগবেনা আমার। মা এখন তো টিভি দেখছে, তাঁকেও কিছু বলার দরকার নেই। ‘
মালা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো। মেহতিশা বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। হাফ ছেড়ে বাঁচল একপ্রকার। উফ, এই মালা মানে একটা জ্বালা। সবদিকে নজর রাখে। বয়স খুব কম। পনেরো কিংবা ষোলো হবে। কিন্তু, বুদ্ধি আছে প্রচুর।
মেহতিশা মুখটা পুরোপুরি ঢেকে নিলো। এবার কেউ বুঝতেই পারবেনা, কালো বোরকার আড়ালে মেহতিশা লুকিয়ে আছে। একটা অটোরিকশা ভাড়া করে রওনা হলো মেহতিশা। আধা ঘণ্টা সময় লাগলো পৌঁছাতে। মেহতিশা ভাড়া দিয়ে ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করলো ৷ হ্যা, এটাই সেই ঠিকানা ৷ যেটা মেহতিশা অনেক খুঁজে বের করেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মেহতিশা ভালো করে দেখে চিপা গলিতে প্রবেশ করলো। পঁচা একটা গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠছে। এখানে থাকে কীভাবে মানুষজন? চিপা গলিগুলির একটির ভিতর দিয়ে বস্তিবাসীরা থাকে। টিনের বেড়াজাল দিয়ে তৈরি নিম্নবর্গের বাড়ি। এক বা দুই রুম হবে। তাও কুটিরের মতো। মেহতিশা একটা বাচ্চাকে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘ফজলু দারোয়ানের বাড়ি কোনটা?’
ছোটো ছেলেমেয়ে গুলো হাত দিয়ে জীর্ণ শীর্ণ একটা বাড়ি দেখিয়ে বললো ওটাই তাঁর বাড়ি। মেহতিশা সেদিকে পা বাড়ালো।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ তুলতেই একটা কম বয়সী মেয়ে বের হয়ে আসলো। পেছন থেকে একটা পুরুষালী শুষ্ক কন্ঠের আওয়াজও পেলো। মেয়েটা মেহতিশাকে দেখে সালাম দিয়ে বললো,
‘আপনি কে?’
‘আমি মেহতিশা। ফজলু মির্জা কী এখানেই থাকেন?’
‘হ্যা, বাবা হন আমার তিনি। ভেতরে আসুন। ‘
মেহতিশা ভেতরে আসে। খুব বেশি জিনিসপত্র নেই। একটা চোকির মতো খাট আর আধভাঙ্গা চেয়ার টেবিল। খাবারের থালা গুলো মেঝেতে রাখা। মেহতিশাকে চেয়ার টেনে বসতে বলে মেয়েটা। সামনেই খাটে শুয়ে আছে কেউ একজন কাঁথা মুড়ি দিয়ে। মেয়েটা ব্যাক্তিটির কাছে গিয়ে বললো,
‘আব্বা ও আব্বা, একজন আসছে আপনার সাথে দেহা করতে। ‘
অপরপক্ষ থেকে বললো,
‘কে আইসে তুলি?’
‘আমি চিনিনা আব্বা, আপনি উঠেন৷ ‘
লোকটি উঠে বসলেন কাঁথা সরিয়ে। মেহতিশা তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। কলিজাটা কেঁপে উঠলো যেনো। কী বিভৎস লাগছে লোকটার মুখ। মুখটা আগুনে পুড়ে থেতলে আছে। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে লোকটি বললেন,
‘ভয় পাইয়ো না মা, কে তুমি কও । ‘
মেহতিশা বুঝে উঠতে পারেনা কী বলা উচিত। অনেক ভেবেচিন্তে বলে,
‘আপনি যদি ফজলু মির্জা হয়ে থাকেন তাহলে ‘ময়ূখ’ কারাখানার পুরনো দারোয়ান আপনিই ছিলেন তাইনা?’
লোকটি ভড়কে গেলেন। কাঁপা গলায় বললেন,
‘কে তুমি? ‘
‘আমি শামীউল্লাহ জামানের মেয়ে মেহতিশা। ‘
তিনি নড়েচড়ে বসেছেন ইতিমধ্যেই। এতক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন,
‘আপনে চইলা যান । পুরানো কিছুই আমি বলতে পারমুনা৷ ‘
মেহতিশা বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই কেউ লোকটাকে চেপে রেখেছে যাতে কাউকে বলতে না পারে। মেহতিশা অনুরোধ করে বলে,
‘দেখুন চাচা, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি কেউ জানবেনা আপনি আমাকে কিছু বললে। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। আপনার আর্থিক সমস্যাও দেখবো। ‘
‘ঠিক আছে, বলেন কী জানবেন?’
মেহতিশা ভাবেনি তিনি এতো দ্রুত রাজি হয়ে যাবেন। উৎসাহীত হয়ে বললো,
‘যেদিন ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছিলো তখন ওখানে কী নতুন কেউ এসেছিলো?’
‘হ্যা, চারজন কর্মকর্তা আর অন্য প্রতিষ্ঠানের মালিক এসেছিলো।’
‘আপনি নাম জানেন সেই প্রতিষ্ঠাতার?’
ফজলু খানিকটা দোনোমোনো করছে। কারণ, তার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটাকে কে দেখবে! এসব ভেবে মেহতিশা বললো,
‘আপনি বলুন চাচা, কেউ জানবেনা। কে ছিলো সে? ‘
‘অনন্য শায়ের। ফায়ারবেটাল ইন্ডাস্ট্রির মালিক। ‘
চলবে-