অচেনা এক সময়
পর্ব – ১
সিনথিয়া
বছর শেষের বৃষ্টি ঢাকা শহর টাকে শেষ বারের মত ভিজিয়ে দিচ্ছে। আসলে ভিজিয়ে দিচ্ছে বললে ব্যাপারটা কাব্যিক শোনায় কিন্তু ঘটনা তা নয়। এত বৃষ্টি হচ্ছে সড়ক, গলি সব ডুবে যাচ্ছে। আজ চারদিন বৃষ্টি কখন হবে আর কখন হবে না আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
মৌলী যখন সকালে অফিসের জন্য বের হয়েছে তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল।
বৃষ্টি দেখে কাব্য করার সময় তার কখনো হয় না। কর্পোরেট লাইফে যত বেশি উপর দিকে উঠে যায় মানুষ, জীবন থেকে বৃষ্টি , চাঁদ, পাহাড়, সমুদ্র দেখে কাব্যিক হওয়ার মনটা কেমন মিটিয়ে যায়।
গাড়িতে করে অফিস আসার সময় এটাই ভাবছিল মৌলি।
একটা সময় ছিল ঝুম বৃষ্টি হলে ভিজতে চলে যেত ছাদে। কতদিন মা লাঠি হাতে তেড়ে এসে টেনে নিয়ে গেছে তাকে।
কিন্তু এখন বহু বছর জানালার পাশে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখা ছাড়া আর কোন ইচ্ছাই হয় না।
অফিস টাইমে বৃষ্টি হলে তো জানালার পাশে দাঁড়ানোর সময়টুকুও পায় না সে।
আজ অফিস শেষ করে মৌলি বনানীতে একটা রেস্টুরেন্টের নিচে এসে নামলো। অফিস শেষ করে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে তার একটুও ইচ্ছা করে না কারো সঙ্গে গল্প করতে। কিন্তু আজ মাকে কিছুতেই সে বারণ করতে পারেনি।
দ্বিতীয়বার স্ট্রোকের পর তার মা রওশন আরার মনে মৃত্যু ভয়টা খুব জাঁকিয়ে বসেছে। মৌলিকে বিয়ে করতেই হবে এবার। কোন কিছুতেই বুঝাতে পারেনি মৌলি। সুইডেন থেকে বড় ভাই শাওন একরকম হুমকি ধামকি দিচ্ছে বিয়ে এবার করতেই হবে মৌলিকে ।
একুশ বছর বয়সে একমাত্র বড় ভাই শাওনের বন্ধু তন্ময় এর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মৌলির। তন্ময় শাওনের সঙ্গে সুইডিশ সরকারের স্কলারশীপ নিয়ে উপসালা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো।
হুট করেই বিয়েটা হয়েছিল তখন। সবে মাত্র তখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে মৌলি। মেধাবী ছাত্র পেয়ে ওর বাবা একদম ঝাঁপিয়ে পড়লেন তন্ময়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে।
বিয়ের দুই মাস পর তন্ময় সুইডেন ফিরে যায় একা। তার ঠিক একমাস পরে আফ্রিকান এক ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতে মারা যায় তন্ময়।
মৌলির জীবন টা সেই অল্প বয়সে বিধবাদের মতো ছন্নছাড়া হতে দেয়নি তার বাবাই। বাবা যেমন জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক সেই বাবাই তাকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে নিজের অস্তিত্ব কে মজবুত করতেও শিখিয়েছে।
আজকে মৌলি একটা ফার্মাসিউটিক্যালস কম্পানির সিনিয়র ফার্মাসিস্ট ।
বাবা মারা গেছেন চার বছর আগে। সেই থেকে মা সারাক্ষণ ওর পিছনে বিয়ে বিয়ে করে। তিনি নাকি একা মৌলিকে রেখে মরেও শান্তি পাবেন না।
মায়ের কথা রাখতেই মৌলি বিয়ের জন্য মত দিয়েছে।
আজ অফিস শেষ করে এখন এসেছে রিজওয়ান কবির নামের একজনের সঙ্গে দেখা করতে।
সাতত্রিশ বছর বয়সে এসে এরকম একটা মিটিং করতে বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করছে মনে হচ্ছে ওর।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখলো এই বৃষ্টির ভেতরেও অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের একটা জটলা, দুটো বাচ্চাকে নিয়ে তাদের বাবা মা একটা টেবিলে বসা। আর একটা টেবিলে তিনজন অফিস ফেরত লোক বসে গল্প করছে।
দরজার কাছে ওকে দেখেই কোনার দিকের একটা টেবিল থেকে রিজওয়ান উঠে এলো। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা , সুঠামদেহী । পরনে ছাই রঙের স্যুট, নীল টাই একেবারে প্রপার কর্পোরেট পোশাক। ছোট করে চুল কাটা এতে চেহারায় অন্যরকম একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ পড়েছে।
মৌলির কাছে এসে রিজওয়ান বললেন, আপনি তো মৌলি ?
মৌলি সালাম দিয়ে বলল, জ্বি।
আমি রিজওয়ান।
মৌলি হালকা হাসি, মুখে টেনে রিজওয়ানের টেবিলে গিয়ে বসলো। ছবির চেয়ে বাস্তবে দেখতে ভালো লাগছে লোকটাকে। চেহারায় যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একটা ভাব স্পষ্ট ফুটে আছে। মৌলির ভালোই লাগলো।
বায়োডাটা তে লিখা ছিল লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স থেকে পড়াশোনা করে অনেক বছর সেখানেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করতেন। বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশে এসে নামকরা সেই কম্পানির কান্ট্রি হেড হিসেবে জয়েন করেছেন।
এই লোকটার ডিভোর্স হয়ে গেছে ভাবতেই কেমন অবাক অবাক লাগছে মৌলির !
কি খাবেন বলুন? রিজওয়ান মৌলির দিকে ম্যেনু কার্ড এগিয়ে দিতে দিতে বলল।
আমি ডিনারের আগে তেমন কিছু খাই না আর এখন তো ডিনারের সময়ও হয় নাই তাই কোল্ড কফি ছাড়া তেমন কিছু খাব না। ধন্যবাদ।
রিজওয়ান ওয়েটার কে ডেকে দুটো কোল্ড কফি অর্ডার করল।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো দুজন তারপর রিজওয়ান কথা শুরু করলো, আপনি তো জেনেছেন নিশ্চয়ই আমার চার বছরের একটা মেয়ে আছে।
বাড়িতে আমার মা আছে। মেয়ের জন্যই আমার লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসা। আমি মেয়েকে মায়ের আদর যত্ন দিয়ে বড় করতে চাই। যা সে নিজের মায়ের কাছ থেকে পায়নি।
আমার মায়ের বয়স হলেও তিনি যথেষ্ট কেয়ারিং আমার মেয়ের বেলায়, কিন্তু আমি চাই আমার মেয়ে একজন মায়ের আদর, শাসন পেয়ে বড় হোক। দাদীর আদর আর মায়ের আদরে একটা পার্থক্য আছে আপনি তো জানেনই।
আর আম্মার ও বয়স হয়েছে তিনি অসুস্থ থাকেন । আমি আপনার মতো একজন শিক্ষিত, রুচিশীল মায়ের তত্ত্বাবধানে আমার মেয়েটা বড় হোক আমি সেটাই চাই।
মৌলি মাঝখানে বলে উঠলো, কিছু মনে করবেন না আপনার বিয়েটা ভেঙ্গে গেল কেন জানতে পারি?
কিছু মনে করব কেন , আর আপনাকে বলব না তো কাকে বলব ?
ইলি , ইলিয়ানা আমার এক্স ওয়াইফ ছিল আইরিশ ব্রিটিশ। পড়াশোনা আমরা একসঙ্গেই করেছিলাম। তখন পরিচয় এবং সম্পর্ক।
ও চেয়েছিল আমরা বিয়ের মতো কোন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে না থেকে লীভ ইনেই যেন থাকি। কিন্তু আমার আবার বাঙালি ধর্মীয় মূল্যবোধ আমি বলেছিলাম বিয়ে ছাড়া কোন সম্পর্ক আমার পরিবার মেনে নিবে না। আমিও সেটাই চাই। তাই এক প্রকার ওর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে টা আমাকে করে ইলিয়ানা।
প্রথম দিকে ভালোই চলছিলো আমাদের সংসার। ও ওর ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত আমি আমার ক্যারিয়ার । উইকেন্ডে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো। হৈ হুল্লোড়।
আমাদের মেয়ে জুন পেটে আসার পর থেকে ও অন্য রকম হয়ে উঠলো। প্রথম দিকে বাচ্চার দ্বায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছিল। তারপর মেয়ের জন্মের পর মেয়েকে নিয়ে এক্সাইটেড ছিল কিন্তু মেয়ের বয়স যখন এক বছর পার হয়ে গেল হঠাৎ ওর অফিস থেকে ওকে বেলজিয়াম এ একটা ভালো অফার দিল। এবং ইলি সেটা লুফে নিতে চাইলো, আমি বাঁধা দিলাম। কারণ আমার তখন লন্ডনের বাহিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এই নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি হল। সে একরোখা ছিল বরাবরই। সে যাবেই ।আমি বললাম, মেয়েকে ছাড়া কিভাবে থাকব ?
তখন আমি ওকে আটকানোর জন্য বলে বসলাম যদি যেতে হয় তাহলে আমাকে ছেড়েই যেতে হবে।
প্রথমে সে কিছুটা থমকে গিয়েছিল, আসলে আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম । সে জানতো তাকে ছেড়ে দিতে পারি এরকম কথা আমি কখনো বলতে পারব না।
ওকে আটকানোর জন্য আমি বলেছিলাম কথাটা , কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারিনি।
তবে মেয়েকে আমি ছেড়ে থাকতো পারব না সে জানতো এবং নতুন দেশে গিয়ে মেয়েকে ইলিও একা সামলাতে পারবে না ভেবে মেয়েকে আমার কাছেই একরকম রেখে যেতে বাধ্য হয়।
তারপর একটা সময় মেয়েকে নিয়ে আমি চলে এলাম দেশে।
আপনি বাংলাদেশে চলে আসতে পারলেন মেয়েকে নিয়ে, কিন্তু ইচ্ছা করলে কি বেলজিয়াম যেতে পারতেন না আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ?
তাহলে হয়তো পরিবারটা ভেঙে যেত না।
জ্বি পারতাম । কিন্তু আমাকে সব নতুন করে শুরু করতে হতো । এখানে দেশে আমার বাবার বাড়ি থেকে শুরু করে একটা সামাজিক অবস্থান আছে যেটা বেলজিয়ামে গিয়েই আমি পেতাম না।
আর সবচেয়ে বড় কথা আমি ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম ইলি সংসার থেকে পালাতে চাইছে তাই আর সুর কেটে যাওয়া সুর টাকে বাঁধতে চাইনি।
একটু বিরতি নিয়ে রিজওয়ান বলল,
মেয়ের জন্য আমার একজন মা চাই। মায়ের তো কোন বিকল্প হয় না তাই না ?
তাহলে বলতে চাইছেন মিঃ রিজওয়ান আপনার মেয়ের জন্য আপনি বিয়ে করতে চাইছেন নিজের জন্য নয় ?
কিছু মনে করবেন না আমি বারবার মেয়ের কথা বলছি বলে। মেয়ে আমার প্রায়োরিটি কিন্তু আমার ও একজন সঙ্গী দরকার জীবনে।
মৌলি কিছুটা বিরক্ত হল, মনে মনে ভাবলো মেয়ের প্রায়োরিটি আছে কিন্তু আমার জায়গাটা কোথায়?
মৌলি আর কথা বলল না তেমন একটা। চুপচাপ কফিটুকু শেষ করে চলে আসার অপেক্ষা করতে থাকলো।
রিজওয়ান বলল, দেখুন মৌলি আমি রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ নই আমি আমার মেয়ের জন্য উন্নত দেশের আরাম আয়েশ, সব কিছু ত্যাগ করে এসেছি শুধুমাত্র মেয়েটাকে একটা সুন্দর পারিবারিক মূল্যবোধের মধ্যে বড় করব বলেই । ইলি ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হয়েছে তার মা ডিভোর্সের পর অনেক কষ্ট করে ওদের দুই বোন কে বড় করেছিল। সেই জন্য ক্যারিয়ার ওর কাছে অনেক বড় ব্যাপার ছিল। এমনকি নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি।
আর একটা বিষয় যেটা আমি অনেকদিন পর জেনেছিলাম আমার আর ইলির কমন ফ্রেন্ডের কাছ থেকে। ইলি জুন কে নিয়ে সেই স্ট্রাগল টা করতে চায়নি যা তার মা করেছিল ।
মৌলি চুপ করে আরো কিছুক্ষণ রিজওয়ানের কথা গুলো শুনলো।
তারপর দুজন রেস্টুরেন্টের নিচে নেমে এলো।
রিজওয়ান বলল, আমি আপনাকে ড্রপ করে আসতে পারি।
ধন্যবাদ আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।
গাড়িতে উঠার সময় রিজওয়ান দরজা খুলে দিল ব্যাপারটা ভালোই লাগলো মৌলির।
বাসায় ফিরে দেখে মা নিজের রুমে বসে টিভি দেখছে। সঙ্গে কাজের বুয়া জুলেখা। ওকে দেখে টিভির ভলিউম টা কমিয়ে দিলেন রওশন আরা।
রওশন আরার বয়স সত্তর এর উপর। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। ফর্সা গোল মুখ। এত বয়সেও বোঝা যায় তিনি খুব রূপবতী একজন মহিলা।
দ্বিতীয় বার স্ট্রোকের পর আজকাল টিভি দেখে আর নামাজ পড়েই দিন কাটে। কাজ কর্ম তিনি করেন না। সংসারের কাজের জন্য দুই জন কাজের লোক আছে। তারাই রান্না থেকে ঘর গোছানো সব করেন।
মৌলি সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অফিসে ব্যস্ত থাকে। বাসায় ফিরে মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে গল্প করে তারপর ট্রেডমিলে হাঁটে এক ঘন্টা। গোসল করে ডিনার করে বই নিয়ে বসে। নিজের ঘর থেকে আর বের হয় না তখন।
রওশন আরাও সেই সময় টিভিতে ভারতীয় সিরিয়াল দেখেন । ঐ সময়টা তিনি মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখতেই পছন্দ করেন।
মৌলি হাতের ব্যাগটা মায়ের বিছানার পাশে রেখে বসলো ।
রওশন আরা চোখের ইশারায় জুলেখাকে চলে যেতে বললেন।
জুলেখা চলে যাওয়ার পর রওশন আরা প্রশ্ন করলেন, কিরে কেমন লাগলো ?
কি কেমন লাগলো?
আশ্চর্য তুই যাসনি রিজওয়ান ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে ? রওশন আরা উত্তেজিত মুখে প্রশ্ন করলেন।
গিয়েছিলাম।
কেমন দেখলি ? পছন্দ হয়েছে ? দেখ মৌলি তুই যেমন শিক্ষিত, দেখতে শুনতে ভালো ছেলে চেয়েছিলি আমি আর তোর বেবী খালা সেরকম ছেলেই কিন্তু খুঁজে বের করেছি । এবার কিন্তু না করতে পারবি না।
মা শিক্ষিত, সুদর্শন ,টাকা পয়সা হলেই যে আমাকে বিয়ে করে ফেলতে হবে এমন শর্ত কিন্তু তুমি দিতে পারো না! বাবার পছন্দে একবার বিয়ে করেছিলাম। সেই বয়সে ভালো খারাপ বিবেচনা করার বয়স আমার ছিল না। কিন্তু এখন আমি সব কিছু চিন্তা করেই বিয়ে করব।
হুম আমি কি না করেছি তোকে। শোন, আরো তো দুটো ছেলের সম্বন্ধ আছে তাদের সঙ্গে দেখা করবি নাকি রিজওয়ান কেই হ্যা বলছিস? উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে মৌলির দিকে মা।
মৌলি তার হ্যান্ডব্যাগ টা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো ঘর থেকে যাওয়ার সময় বলল, না বাকি দুজনের সঙ্গেও আমি কথা বলব ।
( চলবে )