কোথাও_কেউ_ভালো_নেই-০১
জাহান আরা
মা মারা যাবার ৩ মাস পর পূরবীর বাবা ফয়েজ আহমেদ দুবাই থেকে বাংলাদেশে আসেন,এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিয়ে করেন।বিয়ের ২ মাস পর আবার বিদেশ চলে যান।
এক মাস ধরে পূরবী ও সুরভী দুপুরে এক বেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। লজ্জায় বাবার কাছে বলতেও পারছে না যে সৎ মা সালমা ওদের খাবার দেয় না ঠিকমতো। তাছাড়া প্রবাসী বাবার কাছে এসব বলার সুযোগ ও নেই দুবোনের।বাবা সপ্তাহে এক দিন ওদের সাথে কথা বলে,আর তখন সালমা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
আজকাল পূরবীর খুব ক্ষিধে পায়।সন্ধ্যা হতেই পূরবীর মনে হয় দুনিয়ার সব ক্ষিধে যেনো আল্লাহ তাকে দিয়ে দিয়েছেন।ভিটের মাটি ছাড়া পূরবী খাবার মতো কিছু খুঁজে পায় না।
পেটের ভিতর এক ধরনের ব্যথা অনুভব করে পূরবী। শোয়া থেকে উঠে বসে সুরভীর দিকে তাকায়।ঘুমন্ত সুরভীর মুখে যেনো বিষাদের ছায়া।ডান গালে ৩ টি আঙুলের ছাপ স্পষ্ট।
নিজের ক্ষিধের কথা ভুলে গিয়ে মুহুর্তে বোনের ব্যথায় ব্যথিত হয় পূরবী।ছোট মানুষ না খেয়ে থাকতে পারে না। ক্ষিধে লাগলেই পূরবীর কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করে। সন্ধ্যায় ও সুরভী কান্না করছিলো খাবার জন্য,পূরবী রেগে গিয়ে একটা থাপ্পড় বসায় বোনের গালে।কাঁদতে কাঁদতেই সুরভী ঘুমিয়ে যায়।
নিজের ব্যবহারে নিজেই অনুতপ্ত হয় পূরবী। বোনের হাত দুটো কোলে নিয়ে কান্না করে বলে,”আমাকে মাফ করে দিস বোন,আমার কাছে যে কিছুই নাই।আমি কোথা থেকে তোকে খাবার দিতাম বল?
মা ও গেলো,সাথে নিয়ে গেলো আমাদের ভালো থাকা।ছোট মা যে এক বেলা খেতে দেয় সেটাই তো অনেক আমাদের জন্য।আমি তোকে মারতে চাই নি,কিন্তু হঠাৎ রাগ উঠে গেলো।”
পূরবীর কান্নায় সুরভী জেগে গেলো ঘুম থেকে।উঠেই বোনকে জড়িয়ে ধরলো। পূরবীর কান্নার তোড় আরো বেড়ে গেলো।
সুরভী চুপ করে রইলো।ইদানীং বড় বোনের শরীর থেকে সুরভী কেমন মা মা গন্ধ পায়।
পূরবীর চোখ মুছে দিয়ে সুরভী বললো ,”আমার যে ভীষণ ক্ষিধে পায় বুবু।”
পূরবী চোখ মুছে বলে,”এবার থেকে দুপুরে খাবার আগে বেশি করে পানি খাবি।তারপর দুপুরের খাবার থেকে ২ ভাগ খেয়ে এক ভাগ রেখে দিবি।আমিও এক ভাগ রেখে দিবো।রাতে আমার ভাগের টুকু আর তোর ভাগের টুকু খেয়ে নিবি।”
বোনের কথা শুনে সুরভী ভীষণ খুশি হয়,এই চমৎকার বুদ্ধি তো তার মাথায় আসতো না।এক বোন অন্য বোনকে জড়াজড়ি করে ধরে আবার শুয়ে পরে।ফজরের সময় আবার উঠতে হবে দুই বোনকে।
ফজরের আজান শেষ হতেই পূরবী সুরভী উঠে পরে ঘুম থেকে।পূরবী এবার এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে আর সুরভী সবে মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ে। ঘরের কাজ শেষ না হলে সালমা সুরভীকে স্কুলে যেতে দিবে না।তাই দুই বোন অন্ধকার থাকতেই বাড়ির কাজ শুরু করে দেয়।
সালমা সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে চাল,ডাল,তরকারি,দুটো মুরগির ডিম বের করে দিয়ে রান্নাঘরের সামনে মোড়া নিয়ে বসলো।
পূরবী অভ্যস্ত হাতে দ্রুত সুপারি পাতা দিয়ে চুলায় আগুন দিলো।ডালের সাথে ডিম দুটো সিদ্ধ করতে দিলো।সালমা গর্ভবতী হওয়ায় প্রতিদিন সকালে দুটো দেশি মুরগির ডিম খায়,রাতে এক মগ গরুর দুধ খায়।
সুরভী হাস মুরগির খোয়াড় খুলে দিয়ে খাবার দিলো।বাড়ির পিছনের বাগান থেকে শুকনো লাকড়ি এনে দিলো বোনকে।
লাকড়ি দিতে এসে সুরভী দেখলো সালমা লবন দিয়ে মেখে সিদ্ধ ডিম খাচ্ছে।
সুরভী তাকিয়ে রইলো সালমার দিকে।
মা বেঁচে থাকতে প্রতিদিন দু বোনকে ডিম খেতে দিতো।সুরভীর ডিম ভীষণ প্রিয়।পূরবী তাই প্রায় সময় নিজের ডিম ও বোনকে দিতো।পূরবীর মায়ের অনেকগুলো হাঁস মুরগি ছিলো। সেসব ডিম এখম সালমার দখলে।মালিক ও এখন সালমা হয়ে গেছে।
সালমার হঠাৎ করেই খেয়াল হলো সুরভী তাকিয়ে আছে তার দিকে।বসা থেকে উঠে গাব গাছের ডাল টেনে নিয়ে সালমা সুরভীর পিঠে মার বসিয়ে গালি দিতে লাগলো।
“মা মইরা আমার ঘাড়ে যতো রাক্ষসী রাইক্ষা গ্যাছে।আমার খাওনের দিকে তাকাইয়া থাকে,নজর দ্যাস আমার খাওনে।যাতে আমার প্যাটে অসুক অয় হের লাইগ্যা?খাওন দ্যাখলেই লোল পড়ে তোর না খান*?”
পূরবী ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে বললো,”মাফ করে দেন মা,ও ছোট মানুষ। ওরে আর মাইরেন না।এখনো ওর শরীরের ঘা শুকায় নি।আমার বোন মরে যাবে মা।”
সালমার রাগ আরো বেড়ে গেলো।চিৎকার করে বললো,”মরস না ক্যান?
যমে তোগো দুই বোইনেরে চোক্ষে দ্যাখে না ক্যান?
আমার ঘাড়ে বইসা বইসা আর কতো খাবি?”
দুই বোনের আহাজারিতে গাছের পাতারাও যেনো কেঁপে উঠলো।সালমা থামলো যখন দেখা গেলো সুরভী মাটিতে পড়ে আছে আর তার উপর রক্ষাকবচের মতো পূরবী পড়ে আছে।সালমার মারের প্রায় পুরোটাই পূরবীর গায়ে লেগেছে।
মাটি থেকে উঠে পূরবী আবার রান্না ঘরে ঢুকে গেলো। সুরভী ঘরে গুছাতে গেলো। সালমা ফোন নিয়ে স্বামীর সাথে সুরভী পূরবীর দোষের কথা বলতে বসলো।
পূরবী চুলার লেলিহান অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার তীব্রতাও ফিকে হয়ে যায় এই বুকে যে আগুন জ্বলছে তার কাছে।বাবা মারা গেলে তো মা বদলে যায় না,তবে মা মারা গেলে কেনো বাবা বদলে যায়?”
সুরভী কাজ শেষ করে স্কুলের জন্য রেডি হতে গেলো।স্কুল ড্রেস পরতে গেলেই সুরভী বিড়ম্বনার শিকার হয়।এই ড্রেসটা ভীষণ পুরনো হয়ে গেছে। সাদা সেলোয়ার হলুদাভ হয়ে গিয়েছে,নীল জামার ছোপ ছোপ রঙ উঠে গেছে।
স্কুলে এই ড্রেস পরে গেলে মেয়েরা হাসাহাসি করে সুরভীকে নিয়ে।সুরভীর দুচোখ আবারও জলে ভিজে গেলো।
পূরবী রান্না শেষ করে সব গুছিয়ে রেখে কালির পাতিল,গত রাতের এঁটো বাসন গ্লাস নিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে গেলো।নারিকেল গাছ কেটে পুকুরের এই ঘাট পূরবীর মা পারভীন বানিয়েছিলেন।এই ঘাটটা পূরবীর ভীষণ প্রিয় তাই।কিন্তু বেশীক্ষণ এখানে বসতে পারে না।পুকিরের পাশ দিয়ে গ্রামের রাস্তা চলে গিয়েছে,লোকজন আসা যাওয়া করে বিধায় দ্রুতই পুকুরের কাজ সেরে চলে যেতে হয়।
পুকুর থেকে এসে পূরবী যখন উঠোনে মোড়া পেতে বসলো দেখতে পেলো বোরকা পরা এক বয়স্ক মহিলা আর বয়স্ক একজন পুরুষ উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। পূরবী এগিয়ে দিয়ে সালাম দিলো।
মহিলা সালাম নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো।এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম,ভীষণ তেষ্টা লেগেছে।”
পূরবী দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে গেলো।সদ্য ধুয়ে আনা কাঁচের গ্লাসে পানি নিয়ে ফ্রিজ থেকে এক টুকরো বরফ নিয়ে পানির গ্লাসে দিলো।সালমা রুমেই বসে ছিলো।পূরবীকে এরকম যত্নসহকারে পানি নিতে দেখে সালমাও পূরবীর পিছনে বের হয়ে এলো।
অচেনা আগন্তুকদের দেখে সালমা এগিয়ে এলো।বোরকা পরা মহিলাটি জিজ্ঞেস করলো পূরবীকে,”উনি তোমার কি হয়?”
পূরবী বললো,”আমার মা।”
পানি খাওয়া হতেই পূরবী গ্লাস নিয়ে ঘরে চলে গেলো। পূরবী যেতেই বয়স্ক লোকটি বললো,”আপা,আপনাকে সত্যি কথাটাই বলি।আমার সেজো ছেলে মালয়েশিয়া থাকে,এও সপ্তাহ পর দেশে ফিরবে।আমি এই রাস্তা দিয়েই
আসা যাওয়া করি মাঝেমাঝে। আপনার মেয়েকে পুকুরে দেখেই আমার পছন্দ হয়।তাই আজকে ছেলের মা’কে নিয়ে এলাম মেয়ে দেখাতে।আপনাদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমি আগামীকাল আমার বড় দুই ছেলের বউদের এবং মেয়েকে নিয়ে আপনার মেয়েটাকে দেখতে আসতে চাই।”
সালমা এক মুহুর্ত ভেবে তারপর বললো,”ঠিক আছে,আমার আপত্তি নেই।তবে আগেই একটা কথা বলে রাখি,পূরবী আমার নিজের মেয়ে না।ওদের দুই বোনকে রেখে মা মারা গিয়েছে মাসকয়েক আগে। আমি ওদের দ্বিতীয় মা।”
বোরকা পরা মহিলাটি চমকে স্বামীর দিকে তাকালো। কিন্তু স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো মেয়ের মা না থাকাটা স্বামীর কাছে কোনো ব্যাপার মনে হয় নি। একটুখানি বিরক্ত হলেন তিনি।সৎ মা কি আর জামাই আদর করবে!
এই মেয়েকে কিছুতেই পূত্রবধূ করবেন না তিনি।
ঘরে থেকে সব কথা পূরবী শুনলো।গড়িয়ে পড়া শিশিরের মতো পূরবীর চোখ থেকে ও এক ফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়লো। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুন যেনো বহুগুণ বেড়ে গেলো।
তার বিয়ে হয়ে গেলে সুরভীর কি হবে!
চলবে