কোথাও কেউ ভালো নেই -০৭,০৮

0
1228

কোথাও কেউ ভালো নেই -০৭,০৮
জাহান আরা
০৭

ঝড়ের বেগে এসে সুরভী পূরবীকে জড়িয়ে ধরলো। দুই বোনের গগনবিদারী হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। সুরভীর মনে হলো লক্ষ কোটি বছর হলো বুবুকে দেখে না।
আর পূরবী!
সে-তো যেনো হারানো মানিক ফিরে পেয়েছে।নিজের অজান্তেই তানভীরের চোখ ভিজে গেলো। তবু নিনেকে সামলে নিয়ে দুই বোনকে সান্ত্বনা দিলো তানভীর।

তারিনের সাথে এলো তারিনের বড় খালা রাবেয়া।আগেই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে তারিন খালাকে।
রাবেয়া এসে পূরবীর গহনাদি দেখে বললো,”এগুলো কি বউয়ের বাবার বাড়ি থেকে দিয়েছে নাকি বউ – মা? ”

পূরবী এই প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিব্রত হলো।তারিন কিছু বলার আগেই আনিকা বললো,”আরে না খালা,এগুলো সব তানভীরের আনা।পূরবীর বাবার বাড়ি থেকে একটা সুতা ও তো দেয় নি।আমাদের বাবার বাড়ির মতো কি সবার বাবার বাড়ি না-কি? ”

তারিন ভীষণ খুশি হলো।জ্বালানো আগুন উসকে দিতে বললো,”রাজ কপাল এরেই বলে খালা।লোকে বলে না ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতে নেই,পূর্ণ হয় না।এখন দেখো,কারো কারো হয়ে যায়।”

লজ্জায় পূরবীর ফর্সা মুখখানা কালো হয়ে গেলো। সালমাও কিছুটা দমে গেলো এদের বাক্যবাণে। সবার কথা শেষ হলে তানভীর খালাকে ডেকে বললো,”কি করবো বলেন খালা,আমার বউকে দেখেন আর আমার ভাইদের বউদের দেখেন।কোথায় রাজরানী আর কোথায়…বাকীটা আর বলবো না।হাটে বেচা যায় না কলা তো ঠাকুর ঘরে নিয়া ফালা বলে একটা কথা জানেন?
ভাবীদের ও সেইম অবস্থা। ওনাদের বাবা মা দেখছেন মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছে না।না আছে রূপ,না আছে গুণ।থাকার মধ্যে আছে পেট ভর্তি শয়তানি আর হিংসে।তাদের কি দোষ? এরকম মেয়ে কেউ বিয়ে করবে নাকি?
এজন্য গহনাপত্র দিয়ে,টাকাপয়সা দিয়ে আমার ভাইদের কাছে গছিয়ে দিয়ে গেছে।
আর আমার বোন,তাকে তো আপনি ভালো করেই জানেন,এতো ভালো যে বিয়ের এতো বছর হয়েছে তবুও শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকতে পারছে না নিজের সুমধুর ব্যবহারের জন্য।
এজন্য সবার বাবার বাড়ি থেকে মেয়েদের গুণের ঘাটতি পূরণ করতে এসব দেওয়া হয়েছে।
আমার বউ তো তেমন ফেলনা নয়,তাই তাকে যোগ্য সম্মান দিয়েই আমি এনেছি।আর খালা শুনেন,কোরআন,হাদিস কোথাও কিন্তু এই যৌতুকের অনুমতি নেই। আমি কেনো যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবো?
আল্লাহ আমাকে যেটুকু সামর্থ্য দিয়েছে তাতে পূরবীর সব শখ আমি পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট।
শ্বশুর বাড়ির লোভ করলে তো আপনার মেয়ে লায়লাকেই বিয়ে করতাম।আমার ইনকাম দেখে আপনি ও তো কম ফাঁদ পাতেন নি আমার কাছে লায়লাকে বিয়ে দিতে তা কি ভুলে গেছেন না-কি ।”

পূরবী অবাক হয়ে তাকালো তানভীরের দিকে।সহজ সরল দেখতে ছেলেটা মহিলাদের মতো কেমন করে ঝগড়া করতে পারে!
সালমা ভেবেছিলো তানভীরের সাথে সুরভীর ঝামেলা বাঁধিয়ে দুজনকে আলাদা করার প্ল্যান করবে কিন্তু তানভীরের কথা শুনে বুঝলো এই ছেলে অন্য ধাতুতে গড়া।একে এতো সহজে সে হাত করতে পারবে না।

খাওয়া দাওয়ার পর পূরবীদের বাড়ি গেলো তানভীরসহ।পূরবীর ইচ্ছে ছিলো না যাওয়ার। ওখানে গেলে তানভীরের জন্য কোনো আয়োজন করবে না সালমা তা পূরবীর চাইতে ভালো কে জানে!
এই মানুষটাকে অসম্মানিত করা হোক তা পূরবী চায় না।
কিন্তু দেখা গেলো তানভীরের আগ্রহ বেশি। দুরুদুরু বুকে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো পূরবী।

বাড়ি ফিরে সালমা সালমার ঘরে ঢুকে গেলো। পূরবীদের দুই রুমের ছোট্ট ঘরটায় পূরবী সুরভী আর তানভীর গিয়ে বসলো।
ঘন্টা খানেক হয়ে গেলো কিন্তু সালমার বের হবার নাম নেই।লজ্জায় পূরবীর মাথা কাটা যাচ্ছে।যে মানুষটা তাকে সবার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে আসছে বারেবারে তার সমাদর করার মতো কেউ নেই এই বাড়িতে।
নিজের স্বামীর এতো বড় অপমানে পূরবীর অন্তর দহন শুরু হলো।

তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”এখানে খাবার হোটেল বা রেষ্টুরেন্ট কিছু নেই পূরবী? ”

পূরবীর ভীষণ লজ্জা হলো।আহা বেচারা!
হয়তো ক্ষিধে পেয়েছে খুব তাই জিজ্ঞেস করছে।পূরবীর অশ্রু টলটলে চোখ তানভীরের নজর এড়ালো না।

মুচকি হেসে আবারও জিজ্ঞেস করলো।

পূরবী বললো,”বাড়ির বাম দিকে মসজিদের সামনে দেখবেন রিকশা আছে,রিক্সাকে বলবেন চাঁদমোহর বাজারে যাবেন।৩০ টাকা ভাড়া নিবে রিকশা। ”

তানভীর চলে গেলে দুই বোন মোবাইল নিয়ে বসলো। একের পর এক ছবি তুলতে থাকলো দুজন মিলে।ছবি তুলতে তুলতে কখন দু’ঘন্টা সময় পেরিয়ে গেছে কেউ-ই টের পেলো না।
তানভীর ফিরলো একটা সিএনজি নিয়ে। উঠানে সিএনজির শব্দ শুনে দু’বোনের সময়-জ্ঞান এলো।তাড়াহুড়ো করে ছুটলো দুজন।গিয়ে দেখে তানভীর ফিরেছে অনেক কিছু নিয়ে।হাড়ি পাতিল,নতুন বিছানার চাদর,দুটো ফ্যান,একটা ডিনার সেট,হলুদ মরিচ মসলা রান্নাবান্নার সবকিছু,একটা মাদুর,অনেকগুলো মোমবাতি,মোমবাতি রাখার স্ট্যান্ড,গরুর মাংস,ইলিশ মাছ,পেয়াজ,রসুন,আদা,জিরা।
কি নেই আর?

পূরবী হতভম্ব হয়ে সামনে দাঁড়ানো ঘর্মাক্ত চেহারার যুবকটার দিকে তাকালো। কি এক পরম নির্ভরতা এই মানুষটির চোখে!

তানভীর সব বের করে রুমে এনে রাখলো।সালমা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো সব।

সমস্ত মালামাল ঘরে নিয়ে রেখে এবার খাবারের প্যাকেট বের করলো তানভীর।
নিজ হাতে উঠানে একটা মাদুর বিছালো।তারপর বাজার থেকে আনা কাচ্চির প্যাকেট,বোরহানি,সেভেন আপ,মুরগির কষা মাংস সব প্লেটে সাজিয়ে উঠানে রাখলো।মোমদানিতে মোম সাজিয়ে উঠানে বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ করে পূরবী সুরভী দুজনকে নিয়ে বসালো।

এতোক্ষণে পূরবী দেখতে পেলো বাহিরে কি উথলে পড়া জোছনা।চাঁদের আলোয় যেনো থইথই করছে পুরো আঙিনা।থেকে থেকে গাছের পাতা নড়ে উঠছে।একটা স্বর্গীয় মুহূর্ত যেনো।
আকাশের দিকে তাকালো পূরবী। চাঁদটা দেখে পূরবীর মনে হলো চাঁদের বুক থেকে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে যেনো মায়া।যেই মায়াতে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যায়।সুরভীর গানের গলা ভীষণ ভালো। সুরভী গুনগুন করে গান ধরলো,

“চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে
কে আইসা দাড়াইসে গো আমার দুয়ারে।

তাহারে চিনিনা আমি সে আমারে চিনে।।

বাহিরে চাঁন্দের আলো ঘর অন্ধকার
খুলিয়া দিয়াছি ঘরের সকল দুয়ার।

তবু কেন সে আমার ঘরে আসেনা
সে আমারে চিনে কিন্তু আমি চিনিনা।

সে আমারে ঠারে ঠারে ইশারায় কয়
এই চাঁদনী রাইতে তোমার হইছে গো সময়।

ঘর ছাড়িয়া বাহির হও ধরো আমার হাত
তোমার জন্য আনছি গো আইজ চাঁন্দেরও দাওয়াত।

চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে
কে আইসা দাড়াইসে গো আমার দুয়ারে।”

নিজের অজান্তেই পূরবী তানভীরের কাঁধে মাথা রাখলো।পরম মমতায় নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তানভীর পূরবীকে।

পূরবী কাঁদবে না বলে ঠিক করেছে।পূরবীর মনে পড়লো সুরভী ঠিক মায়ের মতো গানের গলা পেয়েছে।মা যেমন শুয়ে শুয়ে বাহিরের চাঁদের দিকে তাকিয়ে এভাবে গান গাইতেন,তেমন করেই আজে সুরভী গান গাইলো যেনো।
আহা,আজ যদি মা বেঁচে থাকতো!

গান শেষে সুরভী চোখ মুছল।কেনো জানি মনে হচ্ছে এতো বছর ধরে পাওয়া অবহেলা,অনাদর ঘুছিয়ে দিতে আল্লাহ যেনো তানভীর ভাইকে পাঠিয়েছেন।
এই মানুষটি যেভাবে আজ আপার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে সুরভীর মনে হয়েছে এই পৃথিবীতে এই একটা মানুষই আছে যার ছায়ায় নির্ভয়ে আশ্রয় নিতে পারবে তারা দুই বোন।

হালকা কথাবার্তা বলতে বলতে খেতে লাগলো তিনজনে। সালমা জানালা দিয়ে দেখলো সুরভী মুরগির রানে তৃপ্তি নিয়ে কামড় বসাচ্ছে।বোরহানির গ্লাস যেনো সালমাকে হাতছানি দিয়ে বলছে,”আয় সালমা আয়।”

রাগ হলো ভীষণ সালমার।তাকে কেউ ডাকলো না একবার?
এই না-কি নতুন জামাই!
দিন দিন মানুষের মন থেকে শ্রদ্ধা,সহবত,সম্মান সব উঠে যাচ্ছে।ঘোর কলিযুগের লক্ষণ যেনো।
তানভীরের এই বেয়াদবি সালমা মেনে নিতে পারলো না।
আপনমনে বিড়বিড় করে বললো,”ছি ছি!”

চলবে…..

লিখা: জাহান আরা

কোথাও কেউ ভালো নেই -০৮

রাতে খাবার পর পূরবী সুরভী মিলে তানভীরের আনা কাঁচাবাজার পাশের বাড়ির ফ্রিজে রেখে এলো। তারপর শুতে গেলো সবাই।
পূরবী আজ তানভীরের গা ঘেঁষে শুয়েছে।তানভীর এক হাত পূরবীর গায়ের উপর রেখে শুয়ে পড়লো।এবং শুয়ে পড়ার প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলো।

আকাশে রূপার থালার মতো মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।ভরা পূর্ণিমার রাত।পূরবীর বুক আনচান করছে।ভীষণ কান্না পাচ্ছে।ছোট এই জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব পূরবী মিলাতে পারছে না।
এক জীবনে মানুষ হাজার বার এই পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মিলাতে চায়।কিন্তু পারে না অথবা হিসেব মিলে না।এই হিসাবের গড়মিল খুঁজতে খুঁজতে আমরা একটা জীবন কাটিয়ে দিই।
অথচ বেহিসেবী জীবন কি সুন্দর তা আমরা কখনো ভেবে দেখিনি।

সকালটা শুরু হতেই পূরবীর মনে হলো আজকের দিন ভালো যাবে।মাঝেমধ্যে কিছু দিনের সূচনা মানুষের মন ভালো করে দেয়।আজকের সকাল ও তেমন। ঘুম থেকে উঠতেই পূরবীর মনে হলো আজকের দিনটি সুন্দর।
রৌদ্রজ্বল ঝলমলে একটা দিন।পূরবী ঘুম থেকে উঠেই কাজে লেগে গেলো। পুরো উঠান ঝাড়ু দিলো,ঘর ঝাড়ু দিলো।গত রাতের বাসি প্লেট পরিষ্কার করলো
পাশের বাড়ি থেকে মাছ মাংস এনে ভিজালো।
সুরভী উঠে দেখে তার বোন কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।রান্নাঘরের সামনে একটা পিঁড়ি পেতে সুরভী বসলো।
কালো রঙের শাড়ি পরা মেয়েটিকে কী অপূর্ব সুন্দর লাগছে। যেনো শরৎকালের কাশফুল।কোমল নরম মুখখানা যেনো পবিত্রতার প্রতীক। পেঁয়াজ কুঁচি করতে গিয়ে পূরবীর হাতের চুড়ি একে অপরের সাথে লেগে টুংটাং শব্দ হচ্ছিলো।
সুরভীর মনে হলো এই যেনো তার মায়ের প্রতিচ্ছবি।

সুরভী মৃদুস্বরে বললো, “বুবু”

মরিচ কাটতে কাটতে পূরবী বললো,”হ্যাঁ বল।”

“তুই এতো সুন্দর কেনো বুবু?ঠিক যেনো মায়ের মতো। তোকে কেমন মা মা লাগে বুবু।”

পূরবী থামকে তাকালো বোনের দিকে। সুরভীর চোখ টলমলে হয়ে আসছে আস্তেধীরে।
পূরবী হেসে বললো,”দূর পাগল। বোনেরা বড় হলে তো মায়ের আরেক প্রতিচ্ছবি হয়ে যায় তুই জানিস না?
তুই যখন আরেকটু বড় হবি তখন তুই ও মায়ের মতো হবি।”

সুরভী বললো,”আমি তো মায়ের মতো হতে চাই না বুবু,আমি আর একবার মা’কে কাছে পেতে চাই।মা’কে ভীষণ মনে পড়ে বুবু।তুই পরশু চলে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম এই বিশাল পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে একা।চারপাশে এতো মানুষ অথচ আমাকে একবার ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরার মতো কেউ নেই বুবু।

তুই যাওয়ার পর কেউ আমাকে একবার ডাকে নি। সেই যে শেষ বার তোর সাথে একসাথে খেয়েছি তারপর আমি গতরাতে খেয়েছি। বুবু,বাড়িতে এতো খাবার ছিলো।ছোট মায়ের বোন,ভাবী,মা সবাই খেয়েছে। কেউ একটি বার আমাকে ডাকে নি বুবু।
খাবার পর নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার ছোট মা মুরগী কে ছিটিয়ে দিয়েছে,আমাকে দিয়ে হাঁসকে দিয়েছে।
মসজিদের সামনের সেই লেজকাটা কুকুরকে দিয়েছে,অথচ আমি একটা মানুষ অভুক্ত ছিলাম বুবু,কেউ আমাকে একবার ডেকে একটু খেতে দেয় নি।
এরা কুকুর বেড়ালের জন্য মায়া দেখায়,অথচ আস্ত একটা জীবিত মানুষ এদের সামনে ছিলো কেউ একবার ডেকে জিজ্ঞেস করে নি খেয়েছি কিনা।
পেটের ক্ষুধায় আমার যেনো প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছিলো অথচ কেউ কিছু খেতে দেয় নি।আমার মায়ের রেখে যাওয়া সংসারে আজ অন্য একজনের দখলদারিত্ব। অভিমানে আমি শুধু পানি খেয়েছি বারবার গিয়ে। তবুও খেতে দিতে বলি নি কাউকে।

বুবু,তুই যাওয়ার পর আমার মনে হলো কি এক অতল গহ্বর আমার চারপাশে। আমি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।আমি যেনো শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে আছি যেকোনো সময় পা হড়কে পড়ে যাবো। একবার পড়ে গেলে আর উঠতে পারবো না।”

বিছানায় শুয়ে তানভীর শুনলো সুরভীর সব কথা।শুনে ব্যথিত হলো তানভীরের কোমল হৃদয়। তানভীরের মনে হলো এ যেনো এই যুগের এক বন্দী রাজকন্যা।

পূরবী অবাক হয়ে তাকালো বোনের দিকে। তার বোনটা দুই দিনেই যেনো কতো বড় হয়ে গেছে। পূরবীর ছায়া সরে যেতেই জীবন তার আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে সুরভীকে।
নিজের কান্নাকে বুকের মধ্যে পিষিয়ে ফেলে পূরবী স্বাভাবিকভাবেই বললো,”ভাবিস না তুই,তোর ভাইয়া তোকে এখান থেকে নিয়ে যাবে বলেছে।এইতো আর অল্প কিছুদিন। ”

তানভীর উঠে এলো দুই বোনের কথা শেষ হলে।তানভীর কে দেখে পূরবী উঠে গিয়ে ব্রাশ আর টুথপেষ্ট এনে দিলো তানভীরকে।
হাতমুখ ধুয়ে এসে তানভীর লুঙ্গির উপর একটা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে উঠোনে এসে বসলো মোড়ায়।

সুরভী দ্রুত হাতে রুটি বানাতে লাগলো। এক চুলায় আলুভাজি আর অন্য চুলায় মাংস কষাতে লাগলো পূরবী। তানভীর তাকিয়ে দেখলো কি অভ্যস্ত হাতে দুবোন কাজ করছে।

কষানো মাংসের ঘ্রাণে সালমার জিবে জল এলো। পূরবীর রান্নার হাত ভীষণ ভালো সেটা সালমা জানে।এখন মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে সালমার মনে হলো এই কষানো মাংসের ঝোল দিয়ে দুই প্লেট ভাত সালমা অনায়াসে খেতে পারবে।

সালমা উঠে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। একটা পিরিচে সুরভী লেবু টুকরো করে রাখছে।সালমার জিবের জল সামলানো দায় হয়ে গেলো।
লজ্জায় যেতে ও পারছে না সালমা। তানভীরকে তার ভরসা হয় না। কথার দ্বারা সালমাকে সে চূড়ান্ত অপমান করতে পারে যেকোনো সময়।
গতকাল তো দেখেছে সালমা কিভাবে নিজের বোন,ভাবী,খালাকে সে অপমানিত করেছে। সেখানে সালমা তো সৎ শাশুড়ী।

নিজের লোভকে দমিয়ে রেখে সালমা বিছানায় গিয়ে বসলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো।
মনে হতে লাগলো সালমার প্রাণ পাখি বের হয়ে যাবে বুকের পিঞ্জর ছেড়ে যদি এখনই একটু মাংস খেতে না পারে।প্রেগন্যান্সির সময়টা এরকমই হয় সালমার মনে রইলো না।
একটু পর পূরবী গেলো সালমার ঘরে। দরজায় নক করতেই সালমা এসে খুলে দিলো দরজা।
দেখে একবাটি মাংস,একটা প্লেটে কয়েকটা রুটি নিয়ে পূরবী দাঁড়িয়ে আছে। পূরবী কিছু বলার আগে সালমা একপ্রকার কেড়েই নিলো পূরবীর হাত থেকে। কোনো কথা না বলে বিছানায় বসে গাপুসগুপুস করে খাওয়া শুরু করে দিলো বাসি মুখে।

পূরবী দাঁড়িয়ে সালমার খাএয়া দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর সরে গেলো। তানভীরকে খেতে দিবে।
উঠানে মাদুর বিছিয়ে তিনজনে আবারও বসললো গত রাতের মতো করে।
অনেকদিন পরে আজ তানভীর পেট ভরে মাংস খেলো।তাদের বাড়িতে রান্না করে বাড়িতে কাজ করা তাহেরা।রেবেকা অথবা বউয়েরা কেউ-ই রান্না করে না।
তাহেরা যেভাবে যতোটা পারে রান্না করে। সেই রান্না খাবার হিসেবে কোনো মতে চালিয়ে নিতে হয়।

রেবেকা এই ১০ বছর রান্নার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে।
১০ বছর আগে তানভীর বিদেশে যাওয়ার পর থেকেই রেবেকার সংসারের শ্রী ফিরতে লাগলো। তানভীরের বেতন বাড়ার সাথে সাথে রেবেকার শৌখিনতা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে।সেই শৌখিনতা রূপ বদলে অপচয়ে রূপ নিলো অল্প কয়েক দিনেই। এজন্য দশ বছরে তানভীর একটা বারের জন্যও ছুটিতে দেশে আসতে পারে নি।
তানভীর বিদেশে থাকতেই তারিনের বিয়ে হলো,তারপর একে একে তারেক তুহিন বিয়ে করলো।
বিদেশে থেকে তানভীর শুধু টাকা পাঠাতে লাগলো। ভাইবোনের বিয়েতে আনন্দ করার ভাগ্য আর রইলো না তার।যতোবারই তানভীর আসতে চেয়েছে,রেবেকা আঁতকে উঠে বলেছে,”আব্বা,তুই এই সময় দ্যাশে আসলে এতো খরচ কেমনে চালামু আমি। তোর মুখের দিকে তো আমরা সবাই তাকাইয়া আছি।”অবিবেচকের মতো এসে তানভীর তাই সবার আশা ভঙ্গ করতে পারে নি।

প্রবাসের মাটিতে গলাকাটা মুরগির মতো একা একা তড়পে মরেছে বারেবারে বাড়ির কথা মনে করে। কিন্তু কিছু করার ছিলো না তার।শুধু তমিজ মিয়া ছেলেকে ফোন করে বলতেন,”আব্বা,আর কতো দিন থাকবা তুমি ওই দ্যাশে?বাড়িতে আসপার মন চায় না আব্বা?
এই বুড়ো বাপেরে দ্যাখবার আসব না একবার?
সেই কবে তোমার চাঁদমুখখান দ্যাখছি,আমার যে ম্যালা কষ্ট হয় তোমার লাইগ্যা আব্বা।প্রতি ঈদে,উৎসবে আমার বাড়িতে চান্দের হাট বসে,সেই হাটে আমি আমার চান্দটারে খুঁইজ্যা পাই না আব্বা।আমার চান্দটা আমার থাইকা বহুদূরে একা একা জ্বলে। কি দরকার এতো টাকার? আমার আব্বারে আমি একবার বুকে জড়াইয়া ধরতে পারি না।এই ট্যাকা তো আব্বা তোমারে ছোঁয়ার সুখ দিতে পারে না।”

বাপের এই করুণ মিনতি তানভীরের সব কষ্ট দূর করে দিতো।রাতে ঘুমাতে যাবার আগে একবার করে ভাবতো,”কেউ অপেক্ষায় নেই তো কি হইছে,আমার আব্বায় আছে আমার অপেক্ষায়। আমার আব্বার তো পরান পোড়ে আমার জন্য। আমার আর কিসের কষ্ট তাইলে?”

পূরবী তাকিয়ে রইলো তানভীরের উদাসী মুখটির দিকে।হুট করেই পূরবীর মনে হলো,”এই যে কথায় কথায় এতো প্রতিবাদ করে এই মানুষটি। এই প্রতিবাদের পিছনে ও নিশ্চয় এক সীমাহীন ধৈর্যের গল্প লুকিয়ে আছে।যে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর মানুষটা এরকম প্রতিবাদী হয়ে গেছে।”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here