কোথাও কেউ ভালো নেই -১৩,১৪

0
1555

কোথাও কেউ ভালো নেই -১৩,১৪
জাহান আরা
১৩

সুরভী মৃত্যুর পর থেকে পূরবীর আচার-আচরণ,ব্যবহার সবকিছু বদলে গেছে।অবুঝ,নির্বোধ মেয়েটা যেনো আগের চাইতে আরো বুঝদার হয়ে উঠেছে।

তানভীর কয়েকবার চেয়েছে কামরুল আর সালমার বিরুদ্ধে একশান নিতে কিন্তু পারে নি।পূরবীর একটাই কথা,সুরভী তো আর ফিরে আসবে না,অযথা ঝামেলায় জড়ানো হবে।সুরভী কে ওরা বাঁচতে দিলো না এবার যদি তানভীরের ও কিছু হয়ে যায় তবে পূরবীর ঠাঁই কার কাছে হবে?

তানভীর অগত্যা হাল ছেড়ে দেয়।পূরবী দিনরাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। আল্লাহ তার অসহায় বান্দার দোয়া কোন সময়ে পূর্ণ করেছে পূরবী জানে না।

আল্লাহ ছাড় দেয়,ছেড়ে দেয় না পূরবী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এটা।সেই বিশ্বাসের জোরেই একদিন তানভীর খবর নিয়ে এলো চাঁদমোহর থানার ওসি কামরুল সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছে।এলাকার ইয়াবা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা নিয়ে কামরুল ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য এলাকায় ঢুকতে সাহায্য করতো। চাঁদার টাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে হগে হাতাহাতি হয়ে যায়। তারপর তাদের হাতেই মৃত্যু হয় কামরুলের।

যেদিন কামরুল মারা গেলো সেদিন বিকেলেই পূরবীদের পাশের বাড়ি থেকে ফোন এলো,সালমা কলঘরে পানির কলস নিতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পরে গেছে।সালমার অবস্থা খুবই খারাপ।উপজেলা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে সালমাকে।
পূরবী ঠিক করলো সালমাকে দেখতে যাবে,কিন্তু তানভীর রাজি হলো না।উল্টো রেগে গিয়ে বললো,”ওই নরকের কীটের চেহারা আমি দ্বিতীয় বার দেখতে চাই না।ওকে আবার দেখলে আমি খুন করে ফেলবো।”

পূরবী ধীর গলায় বললো,”তাহলে আমি যাবো একা।”

তানভীর লাফিয়ে উঠলো পূরবী একা যাবে শুনে।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলো।রিকশায় বসে বসে তানভীর একশো বার বললো,কি দরকার সালমাকে দেখতে যাওয়ার।যা হয়েছে ভালো হয়েছে।পূরবী চুপ করে রইলো।

হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে আছে সালমা। পাশে সালমার মা,বোন,ভাবী আছে।কোনো সীট খালি না থাকায় বারান্দায় থাকতে হচ্ছে। পূরবীকে দেখে সালমার মুখ শুকিয়ে গেলো। পূরবী যে আসবে তা সালমার ভাবনাতেও ছিলো না।
পূরবী ধীর গলায় বললো,”কেমন আছো মা?”

মা ডাকটা শুনে সালমার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। আহারে সন্তান!
হু হু করে কেঁদে সালমা বললো,”আমার পেটের ছেলেটা মরে গেছে।আমি ওরে পৃথিবীর আলো দেখাইতে পারলাম না।”

পূরবী মুচকি হেসে বললো,”মা,যেই সন্তান পৃথিবীতে ছিলো তাকে তো তুমি রক্ষা করতে পারলে না।তাকেও তো বাঁচাতে পারলে না।পাপ বাপকেও ছাড়ে না মা।সন্তান হারানোর ব্যথা কেমন এবার বুঝো নিশ্চয়।
আজ সকালে ওসি কামরুল মারা গেছেন শুনেছো তো?
আমি আমার আল্লাহর কাছে উত্তম বিচার চেয়েছি প্রতি নামাজে মা,আমার আল্লাহ আমাকে নিরাশ করে নি।দেখো না,একইদিনে দুইটা সুখবর এলো তাই আমার।তবে আমার ভাইটা না মারা গিয়ে তুমি মারা গেলে আমার বেশি ভালো লাগতো। ”

সালমার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেলো। পূরবীর হাত চেপে ধরে সালমা বললো,”আমাকে মাফ করে দে তুই?”

পূরবী হেসে বললো,”আমার এই জীবন চলে গেলেও তোমাকে আমি মাফ করবো না।”

তানভীর নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো।পূরবী নেমে এলো।সারাটা পথ পূরবী তানভীরের কাঁধে মাথা রেখে রিকশায় বসে রইলো। তানভীর কিছুক্ষণ পর টের পেলো পূরবী কাঁদছে।সুরভীর মৃত্যুর প্রায় ৩ মাস হলো,এতোদিন পরে আজকে তানভীর পূরবীকে কাঁদতে দেখছে।আজ কোনো বাঁধ দিলো না তানভীর। কাঁদুক পূরবী। মন খুলে কাঁদুক।

তানভীরের ছুটি শেষ হবার বাকি আর এক সপ্তাহ আছে।এই কথা জানার পর থেকে পূরবী কেমন মুষড়ে পড়েছে। পূরবীর এতোদিন মনে হয় নি তানভীর চলে যাবে আবারও বিদেশে।
রাতে তানভীর খাবার টেবিলে এই কথাটা বলার পর পূরবী আর খেতে পারে নি।বেসিনে হাত ধুয়ে রুমে চলে এসেছে। বুকের উপর যেনো একটা দশ মণ ওজনের পাথর চেপে বসেছে।পূরবী কাঁদতে লাগলো জানালায় মাথা ঠেকিয়ে।

তানভীর ও উঠে এলো পূরবীর পিছন পিছন।পূরবী তানভীরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। পূরবীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে তানভীর বললো,”এতো কাঁদছো কেনো?
আমি তো রেগুলার তোমার সাথে কথা বলবো। তুমি কলেজে ভর্তি হয়েছ,নিয়মিত ক্লাস করবে,পড়বে।পড়ায় অসুবিধা হলে আমার চাচাতো ভাই সজীবের থেকে হেল্প নিও,ও তো তোমার ক্লাসমেট। সময় কেটে যাবে।তুমি তো এখনো ছোট পূরবী আরেকটু বড় হলে আমি একজন জুনিয়র তানভীরকে তোমাকে দিয়ে যেতাম।”

পূরবী ভীষণ লজ্জা পেলো এই কথা শুনে।বিড়বিড় করে বললো,”আমার চাইতে ছোট অনেকেরই তো বাবু আছে।তো কি হয়েছে? ”

তানভীর হাসলো।তারপর বললো,”তোমার তো এখনো বিয়ের বয়স হয় নি।তুমি নিজেই তো বাচ্চা।এমনিতেই তো ১৫ বছর বয়সে বিয়ে করেছি,এখন এই বয়সে বাচ্চার মা হয়ে যাও তা আমি চাই না।তোমার জন্য রিস্কি হতে পারে এটা।তোমাকে নিয়ে কোনো রিস্ক আমি নিতে চাই না। ”

পূরবী আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। তানভীরের নিজের ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিভাবে থাকবে সে পূরবীকে ছেড়ে এই চিন্তার চাইতে বড় চিন্তা তানভীর না থাকলে সবাই পূরবীর সাথে কেমন ব্যবহার করবে।ভালো ব্যবহার করার মতো তো কেউ নেই,কার কাছে রেখে যাবে তানভীর পূরবীকে?

রেবেকা ছেলের চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে শুনে ভীষণ আনন্দিত হলো।ছেলের জন্য এই মেয়েটাকে তিনি মজা দেখাতে পারছেন না।একবার শুধু ছেলেটা যাক।তারপর উনি এই মেয়েকে রাহেলার মতো কাজের মেয়ে বানিয়ে নিবেন।ফকিরের ঘর থেকে এসে রানীর আসনে বসেছে।ওই রানীর আসন থেকে তিনি পূরবীকে হিড়হিড় করে টেনে নিচে নামাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন নিজের কাছে নিজে।

এক সপ্তাহ খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। পূরবীর চেহেরাটা মলিন হয়ে গেলো। তানভীরের মুখে বিষন্নতার ছাপ।সকাল থেকে তানভীর লাগেজ গোছানোয় লেগে গেলো। তার পাশে নিরব হয়ে বসে রইলো পূরবী। এই কয়েক মাসে পূরবী বুঝে গেছে এই দুনিয়ায় সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা তার জন্য তার স্বামী।
সেই নিরাপত্তার স্থান যখন তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে আজকে,পূরবীর তখন গলা কাটা মুরগির মতো অবস্থা তো হবেই।

তানভীরের দুচোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে।কাঁদবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও কেনো তার কান্না আসছে এটাই তানভীরের জন্য বিস্ময়ের।তানভীর নিজেকে সামলাতে গিয়ে উল্টো কেঁদে দিলো বউকে জড়িয়ে ধরে।

রাহেলা দরজার সামনে এসে ডাকতে লাগলো খেতে যাবার জন্য।সবার সামনে বসে আজ তানভীর পূরবীকে খাইয়ে দিলো। ভাই,বোন,মা,বাবা কাউকেই যেনো আজ তানভীর দেখতে পাচ্ছে না।

আনিকা কটাক্ষ করে বললো,”লাজ লজ্জা দুনিয়া থেকে উঠে গেলো রে বাবা।এইসব রংঢং রুমে করতে পারে না,বেহায়ার মতো খাবার টেবিলে। ”

তানভীর কথার জবাব দিলো না।অন্য সময় হলে তানভীর আনিকার কথার মোক্ষম জবাব দিয়ে দিতো,কিন্তু আজকে সেসবের মুড নেই তানভীরের।

দশটার সময় গাড়ি এলো।তমিজ মিয়া ছেলেকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।গাড়ি যতোক্ষণ দেখা গেলো পূরবী অপলক তাকিয়ে রইলো গাড়ির দিকে।গাড়িটি চোখের আড়াল হচ্ছে একটু একটু করে পূরবীর মনে হচ্ছে ওর প্রাণটাও আস্তে আস্তে দেহ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো পূরবী উঠোনে।

গাড়ি বাড়ির বাহিরে আসতেই তানভীর গাড়ি থামাতে বললো ড্রাইভার কে।তারপর গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড় দিলো বাড়ির দিকে।তমিজ মিয়া হাসলেন ছেলের পাগলামি দেখে।

ঝাপসা চোখে পূরবী দেখতে পেলো তানভীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পূরবী কিছু বুঝে উঠার আগে তানভীর পূরবীকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো।
সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘরের সবাই এই দৃশ্য দেখলো।

অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরার পর তানভীর পূরবীর কপালে ছোট একটা চুমু খেয়ে বললো,”আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি পূরবী। আমি তোমাকে কখনো কোনো কাজে বাঁধা দিবো না।তোমার খুশিতে আমি খুশি।আমার একটাই অনুরোধ থাকবে তোমার কাছে পূরবী,আমি চলে গেলে কেউ যেনো কখনো তোমার চরিত্র নিয়ে একটা কথা বলার সাহস ও না পায়।পূরবী আমি সব সহ্য করতে পারবো কিন্ত তোমাকে অন্য কারো সাথে আমি সহ্য করতে পারবো না। তার আগেই আমি মরে যাবো।
তুমি শুধু আমার পূরবী। তোমাকে আজ তোমার কাছে আমি আমার আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি,আমার সেই আমানতের যেনো খেয়ানত না হয়।

তোমাকে আমি সিংহের খাঁচায় রেখে যাচ্ছি পূরবী। এরা ভীষণ হিংস্র।যেকোনো সময় তোমার উপর আক্রমণ করে বসবে।সবার থেকে সাবধানে থেকো।আমি সবসময় কল দিবো,আমার সাথে কথা বলো পূরবী।
আসছি,বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে। ”

তারপর গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরলো তানভীর। মায়ের কপালে ছোট একটা চুমু খেলো।রেবেকা রাগ করে বললো,”সর সর,আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।আগে তো গেছস বউয়ের কাছে।বউয়ের জন্যই জীবন। মা তো এখন শত্রু।এসব আদর মা’রে দেখাইতে হইবো না।”

তানভীর হেসে বললো,”মা এবং বউ দুজনের জায়গা দুই খানে।কেউ কারো জায়গা নিতে পারে না মা।তবে বিয়ের পর আল্লাহ ই মানুষের মনে বউয়ের জন্য অন্যরকম একটা টান,ভালোবাসা দিয়ে দেয়।যদি তা না দিতো তবে নিজের সব ছেড়ে এসে একটা মেয়ে স্বামীর কাছে থাকতে পারতো না মা।সেটা নিয়ে যদি কোনো মায়ের মনে হিংসে হয় তবে সেই দোষ মা’য়ের। ”

যেভাবে দৌড়ে এসেছে,সেভাবেই দৌড়ে চলে গেলো তানভীর।

চলবে…….

জাহান আরা

কোথাও কেউ ভালো নেই -১৪

বর্ষা কাল শেষ হয়ে শরৎ এসেছে। কিন্তু বৃষ্টি এখনো বন্ধ হয় নি।সাদা মেঘেরা আকাশে উড়ে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে।
কাশফুল বনে অকারণেই মন খারাপের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে তখন।
বৃষ্টি ও হচ্ছে তুমুল বেগে,যেনো এটাই বর্ষাকাল।

সকাল থেকে পূরবীর ভীষণ মন খারাপ। ইদানীং লেখাপড়া কিছুই পূরবীর ভালো লাগে না।আগের মতো কোনো যথাযথ কারণ খুঁজে পায় না পূরবী লেখাপড়া করার জন্য।মনে হয় বৃথাই সময় নষ্ট।
জীবনে আসলে কিছুই নেই,বেঁচে থাকাটাই এখন নিরর্থক মনে হয় পূরবীর।

যেই জীবনে নিজের বলে দাবি করার মতো একটা মানুষ নেই,মন খারাপ হলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করার জন্য একটা মানুষ নেই,অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে এক নজর দেখার ও কেউ নেই,সেই জীবন কেনো মিছেই বয়ে বেড়ানো?

গত তিন দিন ধরে পূরবীর জ্বর।দিনের বেলায় হুট করে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে আবার আপনাতেই চলে যায়। রাতে সারারাত জ্বর থাকে।এজন্য গত রাতে তানভীরের সাথে কথাও বলতে পারে নি পূরবী। কোনো হুঁশ ছিলো না সারারাত।এই তিন দিন পূরবী এক দানা ভাত ও খায় নি,অথচ কেউ জানেও না পূরবী যে খেতে যায় না।
সজীবকে দিয়ে একটা পাউরুটি আনিয়েছিলো পূরবী,যখন ইচ্ছে করে পানিতে ভিজিয়ে এক স্লাইস খেয়ে নেয়।
ফর্সা গোলগাল মুখখানায় যেনো রাজ্যের ব্যথা নেমেছে। দেখে মনে হয় একটা দুঃখপুরীর রাজকন্যা সে।এই মুখের হাসি ফিরিয়ে দিবে কে আবার?
তানভীর মালয়েশিয়া গিয়েছে ১৫ দিন হলো।এই ১৫ দিনে পূরবী দুইবার মাত্র ভিডিও কলে কথা বলেছে তানভীরের সাথে।
আজকে পূরবীর কলেজে পরীক্ষা আছে।প্রাইভেট কলেজে পড়ার এই এক হ্যাপা।
রেগুলার ক্লাস করতে হয়,এক্সাম দিতে হয়।

ফজরের নামাজের পর পূরবী বই নিয়ে বসলো। নিজেকে বারবার বুঝাতে লাগলো,”বইয়ের চাইতে আপন আমার আর কেউ নেই এই জীবনে। যখন যাকে আঁকড়ে ধরেছি সবাই ছেড়ে চলে গেছে আমাকে একা করে দিয়ে।শুধু আজীবনের সঙ্গী হয়ে আমার বই আমার পাশে আছে।যেই বই আমাকে ছেড়ে যায় নি,আমি কেনো অভিমান করে তাকে ছেড়ে দিবো?”

নিজেকে দেওয়া নিজের মোটিভেশান কাজে লাগিয়ে পূরবী প্রিপোজিশান নিয়ে বসেছে।

দরজায় নক হতে দেখে পিছনে ঘুরে তাকালো পূরবী। দেখে রেবেকা দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম রেবেকা পূরবীর রুমে এসেছে।রেবেকাকে দেখে পূরবী চমকে উঠলো। চেয়ার থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললো,”মা আপনি? ”

কঠোর গলায় রেবেকা বললো, “রাতে রাহেলার হাত কাটা গেছে,আইজ থাইকা ঘরের রান্ধন বন্ধনের কাজ তোমার করতে অইবো।বাপের বাড়িতে তো আছিলা দাসীবাঁদীর মতো, এইখানে আইসা রানী সাইজা বসছো।
এসব পড়ালেখা ধুইয়া আমরা পানি খামু না।”

পূরবী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রেবেকার দিকে।তারপর বই নিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে। চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়ে রেবেকাকে জিজ্ঞেস করলো কি কি বানাতে হবে।

রেবেকা একটু ভেবে বললো,”ভাত রানবা ৫ কেজি চাইলের,ডাল,মাছ ভাজা,আলু ভাজি,গরুর মাংস আলু দিয়ে রানবা,শিলপাটায় ভর্তা বানাইবা,লাউ শাক ভাজি করবা।
আর এখন নাশতার জন্য রুটি বানাও।লগে সবাইরে ডিম ভাইজ্জা দিবা। ”

পূরবী চমকালো এতো আইটেমের কথা শুনে।এখন সাড়ে ছয়টা বাজে,১০ টায় কলেজে ক্লাস শুরু,১১টায় পূরবীর পরীক্ষা। কলেজে যেতেই ৪৫ মিনিট লাগে।
কিছু না বলে এক চুলায় আটা সিদ্ধ করে নিলো রুটির জন্য।চায়ের পানি নামিয়ে ভাত বসিয়ে দিলো।
আটা সিদ্ধ হলে সেই চুলায় ডাল বসিয়ে দিলো।দ্রুত রুটি বানাতে লাগলো। ৪০ টা রুটি বানাতে বানাতে পূরবীর ডাল রান্না হয়ে গেলো। সেই সাথে প্রিপোজিশান ও পড়া হলো।

এর মধ্যে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। বুক ফেটে কান্না এলো পূরবীর। কখন বাকি কাজ করবে,কখন রান্না শেষ হবে!
তানভীর কল দিলো এর মধ্যে,পূরবী রিসিভ করতে পারলো না।হাতে মাছের রক্ত।মাছ কাটতে বসেছে সে।মাছ কাটতে কাটতে বইয়ের দিকে বার কয়েক চোখ বুলালো। একটা রিপোর্ট আসতে পারে এক্সামে,সেটা পড়ে নিচ্ছে।

পূরবী কল না তোলায় তানভীর তারিনকে কল দিয়ে বললো,”আপা,পূরবী কোথায়,কল তুলছে না।গিয়ে দেখ তো রুমে আছে কি-না,শরীর খারাপ মনে হয় ওর।”

তারিন ভীষণ বিরক্ত হলো ভাইয়ের উপর। পূরবীর রুমে গিয়ে ভিডিও কল দিয়ে বললো,”তোর বউ রুমে নাই।আমি এখন কি মাইক দিয়ে চারদিকে এনাউন্স করমু যে তানভীরের বউ হারাইয়া গেছে,কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি….. ”

তানভীর বাকী কথা না শুনে ফোন রেখে দিলো।ভীষণ বিরক্ত লাগছে তানভীরের এখন।গতরাতে ও পূরবী কল রিসিভ করে নি।
এখনও কল রিসিভ করছে না।বুকের ভিতর এক অজানা ভয় এসে বাসা বাঁধলো। তার পূরবী ঠিক আছে তো?
শুধু তারই আছে তো!

পূরবী চুলার আঁচ একেবারে কমিয়ে দিয়ে মাছ ভাজতে দিলো।তারপর মাংসের জন্য আলু কাটলো। আলুভাজির জন্য আলু কুঁচি করলো।
পেঁয়াজ,মরিচ,টমেটো সব কাটতে কাটতে মাছ ভাজা হয়ে গেলো।

ভাত নামাতে গিয়ে পূরবীর বুক কেঁপে উঠলো। এতো বড় ভাতের পাতিল আগে কখনো পূরবী নামায় নি।এই পাতিলের মাড় কিভাবে ফেলবে সে?
নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো পূরবীর।স্বামী ছাড়া এই সংসারে তার দাম নেই।
আজ তানভীর থাকলে নিশ্চয় এই সাহস হতো না কারোর।

তানভীর কে কিছু বলতেও পারবে না পূরবী। এই মাথা গরম লোকটা রেবেকাকে তুমুল গালাগালি করবে হয়তো কিন্তু সেই তো সে দূরেই থাকবে।
অযথা রেবেকার সব কাজ তো পূরবীকে করতে হবেই সেই সাথে গালাগালি ফ্রী তে শুনতে হবে।অনেক কষ্টে ভাতের মাড় ফেললো পূরবী।
তার পর এক চুলায় মাংস বসালো অন্য চুলায় আলুভাজি। তারপর বসলো শাক বাঁছতে।শাকে অনেক পোকামাকড় থাকে,তাই ভালো করে না বাঁছা হলে পূরবীর মন খুঁতখুঁত করে।

আলু ভাজি হলে শাক ভাজি বসিয়ে দিলো। ঘড়িতে ইতোমধ্যে ১০টা বেজে গেছে। তারিন রান্নাঘরে এসে বললো,”পূরবী, আমার ছেলের জন্য খিচুড়ি রান্না করতে হবে,একটু তাড়াতাড়ি করে দাও তো। আর আমার রুমে এক কাপ চা দিও।”

পূরবী কি করবে বা কি বলবে বুঝতে পারছে না।একটু পেঁপে,গাজর,আলু,ডিম,পুইশাক, ডাল এসব মিশিয়ে তারিনের ছেলে রকির জন্য খিচুড়ি রান্না করে সবসময় রাহেলা।
পূরবী বসলো এসব নিয়ে,কাটার জন্য।
তানভীর আবারও কল দিলো তখন।পূরবী ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই শুনতে পেলো তানভীর বলছে,”কাল রাত থেকে তোমাকে কল দিচ্ছি,তুমি কল ধরো না।এতোক্ষণ কল দিছি,কল ধরো নাই,ঘরে ও ছিলা না আপা গিয়ে খুঁজে আসছে তোমাকে,কই ছিলা তুমি?
আমার সাথে কথা বলতে এতো বিরক্ত লাগে তোমার?
এরকম অবহেলা করো কেনো আমাকে তুমি? ”

তারিন সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো,পূরবী কোনো কথা বলতে পারলো না তাই। তানভীর কে জবাব না দিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলো।
এখন কথা বলার সময় নেই।১০ টায় যেখানে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে,এখন তানভীরের রাগ ভাঙাবে কখন পূরবী।
তারিনের তানভীরের সাথে মিথ্যা কথা বলায় পূরবীর প্রচুর রাগ হলো তারিনের উপর।
সব কেটে দিয়ে তাই তারিনকে বললো,”আপা,আমার ক্লাসের সময় যাচ্ছে,আমি যাই।আপনি রেঁধে নিন আজ একটু।”

রুমে গিয়ে বোরকা পরেই ব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে পূরবী ছুটলো। উঠোনে নামতেই দেখে সজীব যাচ্ছে বাইক নিয়ে।
পূরবীকে দেখে বললো,”ভাবী আপনার ও আজকে দেরি হয়েছে দেখছি,আমার সাথে উঠে আসেন,নয়তো এক্সাম দিতে পারবেন না।”

তমিজ মিয়া উঠোনে বসে চুলে মেহেদী দিচ্ছিলেন।সজীবের কথা শুনে পূরবী কে বললেন,”ক্লাস আছে যখন এতো দেরি করলা ক্যান,যাও সজীবের লগে যাও।পড়ালেখা অইলো গিয়া সবকিছুর আগে।”

পূরবী সজীবের বাইকে করে চলে গেলো কলেজের উদ্দেশ্যে।

তারিন অগ্নিমূর্তি হয়ে মায়ের রুমের দিকে গেলো পূরবীর নামে বিচার দিতে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here