এমন_কেনো_তুমি,সূচনা_পর্ব

0
2425

#এমন_কেনো_তুমি,সূচনা_পর্ব
#ফাতেমা_তুজ

আরহান কে লাঠি দ্বারা আঘাত করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলেন জ্যেষ্ঠ স্টাফ মাযহার। শরীর ঘেমে একাকার। না এতো মারের ভয় দেখানোর পর ও ছেলে টার মুখ থেকে টু শব্দ বের হলো না। আর না এক চুল প্রস্থান করলো সে। ১৪ টা মাস মানসিক হসপিটালে আটকে আছে ছেলেটা। প্রথম দিন গুলোর কথা ভাবলেই কেমন গাঁয়ে কাঁটা দেয়। একজন লোক এসে ফিসফিস কন্ঠে বললেন
” স্যার ওনার মা বাবা আসবেন কিছু দিন পর। তাই বড় স্যার বলেছেন আঘাত যেন না লাগে কোনো ভাবে। ”

বিরক্তি তে মুখ কুঁচকে নিলেন মাযহার। মানসিক হসপিটালের সব থেকে বদ আর মেজাজি রোগী আরহান। প্রথম দিকে কি জোড়েই না আঘাত করেছিলো মাযহার কে। যেই নির্দেশনা দেওয়া হোক না কেন তাঁর বিপরীত কান্ড করবেই ছেলেটা। হাতে থাকা স্টিক টা ফেলে দিলেন মেঝেতে। ঝনঝন শব্দ তুলে এক কোনে পরে রইলো শক্ত কাঠের বস্তু টি।আরহান তাকিয়ে ঠিক যেন যন্ত্র মানব। নিষ্প্রাণ, আর নেশাক্ত ধারালো স্থির সেই চাহনি। শরীরের প্রতি টা লোম কূপ জানান দেয় ছেলেটার অবস্থান। কি নির্মম আর বিবর্ণ সেই ইতিহাস!

খাবারের ট্রে হাতে আসলো প্রকাশ। রুমে প্রবেশ করার সময় বাহির থেকে ক্ষীন আর্টিফিশিয়াল আলোর ঝলকানি এলো আরহানের গাঁয়ে। সমস্ত শরীরে যেন জ্বালা পোড়া শুরু হয়ে গেছে। কেঁপে উঠলো মৃদু। প্রকাশ তাগাদা দিয়ে বলল
” খাবার খেয়ে নিবেন। ”

আরহান নিরুত্তর, মুখের ভঙ্গিমা এমন যেন ঐ ধারালো চোখ দিয়ে এখনি ধ্বংস করে দিবে সব। হসপিটালের সকলেই বেশ সমীহ করে ওকে। করবেই না কেন মাস গেলেই তো কচকচে ৪৫ হাজার টাকার নোট আসে। আঘাত করলে রক্ষা আছে?

ঘোলাটে চোখ আর উসকো-খুসকো চুল। শ্রীহীন,রুক্ষ, অবিন্যস্ত মুখ টা যে কারো হৃদপিন্ড থামিয়ে দিতে সক্ষম। প্রকাশ স্বর নিচু করে শুধালো
” খাবার খাবেন না? ”

অবহেলা করলো আরহান। উত্তর দেওয়া তো বহু দূরের কথা ফিরে তাকালো না অব্দি। প্রকাশ যেন অপমান বোধ করলো তবে মানসিক রোগীর আচারনে রাগ মান অভিমান করা কতো টা বাঞ্ছনীয়?

কি করবে বুঝলো না সে। খাবারের থালা রেখে বেরিয়ে গেল সে স্থান ছেড়ে। কথায় আছে ক্ষিদে পেলে সব পাগল ও সাধারণ আচারন করে। আর আরহান তো শত ভাগ সুস্থ। শুধু মস্তিষ্কের উপর চাপ যাচ্ছে ঔষধের কারনে।

দুপুরের দিকে আবার এলো প্রকাশ। উঁহু খাবার মুখে তুলে নি সে। শরীরের প্রতি টা জয়েন্ট বুঝি লেগে গেছে সে স্থানেই। সেই একি ভঙ্গিমায় বসে আছে ছেলেটা।খারাপ লাগলো প্রকাশের। আহা কি সুন্দর ছেলে টা আজ মানসিক হসপিটালে বন্দী জীবন যাপন করে।

খাবারের থালা নিয়ে আরেক টি থালা রাখলো প্রকাশ। সেখানে দুপুরের খাবার রাখা। মূলত আজ একটু বেশিই স্থির চিত্ত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে আরহান। যেন মন দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। বড্ড জানতে ইচ্ছে হয় প্রকাশের। যদি ও লোক মুখে শুনেছিলো আরহানের ভঙ্গুর জীবন দশার নির্মম ইতিহাস। কি ভাগ্য ছেলেটার!

” খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে গলা দিয়ে নামবে না। এবার খেয়ে নিন। ”

আরহানের জবাব নেই। অপমান বোধ হলো প্রকাশের। কেন এমন টা করবে আরহান? অহেতুক খাবারের প্রতি মান অভিমানে সব ঠিক হবে বুঝি। প্রকাশ বেরিয়েই যাচ্ছিলো তবে আরহানের কন্ঠস্বর পেয়ে থমকে গেল তাঁর পা। কি মিষ্টি কন্ঠ ছেলেটার। যেন কন্ঠে সুর বাজে। প্রকাশ শুধালো
” আমাকে ডাকছিলেন? ”

” আহমম্ও”

কথা টা বুঝতে পারলো না প্রকাশ। কারন আরহানের কন্ঠে খাদ জমেছে বেশ। ভাঙা আর অস্পষ্ট কন্ঠে শুধুই সুর আসে, তবে নেই কোনো অর্থবহুল শব্দ। তবু ও ভালো লাগলো তাঁর।

হাতে থাকা গ্লাস আর সকালের অবহেলিত নাস্তা নিয়েই আরহানের পাশে বসলো।কি মায়াবী মুখ।বয়স আর কত একুশ বাইশ হবে। তবে চোখ মুখের নাজেহাল অবস্থায় মনে হলো চব্বিশ পেরিয়েছে।
” কাউ কে মনে পরে? ”

মাথা ঝাঁকালো আরহান।অর্থাৎ মনে পরে তাঁর। প্রকাশের ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি। আরহানের সাথে কথা বলার প্রবল আগ্রহ। মাস খানেক হলো হসপিটালে কর্মরত সে। তবে কখনো ছেলেটার কন্ঠ স্বর শোনার সৌভাগ্য হয় নি বটে। আজ হয়েছে, দারুণ আড্ডা জমাবে আজ। উঁহু আড্ডা কি করে দিবে? মানসিক রোগীর সাথে আড্ডা হয় নাকি! ওর গভীর ভাবনার অতলের ছন্দপতন ঘটলো আরহানের খাবার খাওয়া দেখে। অল্প একটু খেলো আরহান। মনে হচ্ছে পেটের খিদে মেটানোর জন্য ই খেলো শুধু বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই একটু ও।

এখন রাত নাকি দিন জানে না আরহান। বেডের উপর গুটি শুটি মেরে বসে আছে।সারাক্ষণ কিছু একটা ভাবে সে। যাঁর ভাবনার এক অংশ জুড়ে দেখতে পায় একটি মেয়ে কে। বয়স খুব বেশি নয় ক্লাস ওয়ান টু হবে। যে দরজার ওপাশে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখে। পেছন ঘুরলেই কেমন করে যেন বিড়াল পায়ে পালিয়ে যায়।ঘুম পাচ্ছে ওর, প্রচন্ড ঝিমুনি তে চেয়ে থাকার অবকাশ নেই। বেডের উপর লুটিয়ে গেলো আরহান।ঘুম আসার ই কথা খাবারের সাথে যে ঘুমের ঔষধ ছিলো।

****

ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করছে সিয়া। কি একটা অবস্থা তৈরি হলো বুঝতে পারছে না আরহান। সিয়ার কান্নার বেগ বেড়ে গেল কয়েক গুন। কাছে আসতেই আরহানের পিঠে থাপ্পড় মেরে দিলো মেয়েটি। ক্লাস থ্রি তে পড়ুয়া মেয়ের গাঁয়ে এতো জোড়?

ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো আরহান। তাঁতে কোনো ভাবান্তর হলো না সিয়ার। কেবলি নিজ রাগের প্রশমন খুঁজে নিলো থাপ্পড়ের দ্বারা। অথচ এই যে একটু আগের কর্মের জন্য বিন্দু মাত্র আফসোস নেই। ঝড়ের গতিতে এসে সাজিদা বেগম আরহান কে বললেন
” যা না বাবা, দোকানে নিয়ে যা। মেয়েটা কখন থেকে কাঁদছে। ”

” আমি পারবো না। ”

” কেন পারবি না, যা বলছি। ”

সাজিদার কন্ঠে ধমক। আরহান তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বলল
” একটু আগে আমার পিঠে থাপ্পড় মেরেছে ও। ”

শুরু হয়ে গেল সিয়ার নাটক। বাচ্চা হলে কি হবে অভিনয় জগতে তাঁর অবস্থান সবার উপরে। সাজিদা কে অবিশ্বাস করাতে কান্না বাড়িয়ে বলল
” মারি নি আমি। মিথ্যে কথা বলছে আন্টি। ”

” একটু আগেই তো মেরেছো আমায়। দেখো পিঠ এখনো লাল হয়ে আছে। ”

সাজিদা পাত্তা দিলেন না ছেলে কে। রান্না বসিয়ে এসেছেন। জোড়ালো গলায় বললেন
” এখনি যা ওকে নিয়ে। তোকে ছাড়া কোথাও যায় না জানিস না। ”

ভেঙ্চি কাটলো আরহান। এমন পাকা মেয়ে দুটো দেখে নি ও। তবে হাতের জোড় আছে বলা বাহুল্য। ইসস এখনো কেমন ব্যথা করছে।

—————-

বয়স্ক এক ব্যক্তি তমীজ উদ্দিন। আরহান কে বেশ আদর করেন তিনি। প্রথম প্রথম আরহান যখন পাগলামি করতো খুব তখন তিনি খুব যত্ন নিয়েছেন ওর। লোক টার কথায় যেন জাদু আছে। আরহানের বাহু তে হাত বুলিয়ে বললেন
” উঠো, তোমার মা, বাবা এসেছেন। ”

মা, বাবা! এ শব্দের সাথে কি পরিচিত আরহান? উহুহ মনে তো পরছে না কিছু। কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে মা শব্দ টা অনুভব করলো আরহান। তবে মায়ের মুখ, মায়ের মুখ কেমন হয়? মনের আনাচে কাঁনাচে খুঁজে ও মায়ের মুখ টা স্পষ্ট হলো না ওর। তমীজ মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
” সোনা ছেলে, খাবার খেয়েছো আজ? ”

” হু। ”

” চোখ মুখ ফুলে গেছে আসো মুখে পানির ছিটে দিবে। ”

আরহান তাঁর শরীর ভারী অনুভব করলো। রোগা পাতলা শরীর টা মুটিয়ে গেছে অনেক খানি। তমীজ এর সাথে এগিয়ে গেল ওয়াসরুমে। যেই ওয়াসরুমের কোনো দরজা নেই। আছে শুধু একটা পর্দা লাগানো। ভাবান্তর হলো আরহান। আচ্ছা এই স্থান কে কি বলে? কিছু কিছু শব্দ মনে পরলে ও পুরো টা খেয়াল হলো না। শরীরে ব্যথা অনুভব হয় খুব। নতুন নয় এটা, প্রায় প্রতি নিয়ত ব্যথা আর জ্বর লেগেই থাকে। শরীরে চামড়া বেশ পাতলা হয়ে গেছে। সূর্যের আলো পরে না আজ বহু মাস। রাত দিনের পার্থক্য ভুলে গেছে কবেই। এ ছোট রুমে ঘড়ি তো রয়েছে তবে ঘড়ির কাঁটা সময় বুঝিয়ে দিলে ও রাত নাকি দিন সেটা বোঝাতে পারে না। জানালা বিহীন রুম টা সব সময় কেমন স্যতস্যতে। একটা মানুষ থাকায় ছত্রাকের অবস্থান গড়ে উঠে নি। না হলে এই ঘর কে অন্ধকুঠরি বলে বেমালুম চালানো যেতো।

উৎকন্ঠিত সাজিদা। অপেক্ষা যেন আর শেষ হয় না। ছেলে কে দেখার জন্য মাতৃ মন পাগল হয়ে আছে। সহ ধর্মিনীর এমন আকুলতা দেখে চোখ ভিজে যায় ফারেগ সাহেব এর। বাহু তে হাত রেখে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করেন। যার অর্থ ‘ আমাদের ছেলে ঠিক আছে, সুস্থ আছে। তবে ঐ যে মায়ের মন সব সময় শঙ্কিত, চমকিত। কিছু লোক এসে বলল তাঁরা এখন যেতে পারেন।ফারেগ কে তুচ্ছ করে ছুটে যান সাজিদা। বদ্ধ ঘরে নিশ্চুপ বসে আছে আরহান। ইস ছেলেটার চোখ মুখের কি অবস্থা হয়েছে। তবে মুখ অতিরিক্ত ভরাট। তাই স্বস্তি পেল সে। ফারেগ বললেন
” দেখলে তো আমাদের আরহান সুস্থ হয়ে গেছে। ”

আরহান তাকালো না। হালকা শব্দ গুলো তাঁর কানে এসে লাগছে ঠিক ই তবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টা কথা গুলো কে পাত্তা দিচ্ছে না। ভাবনা, তাঁর ভাবনা জুড়ে বিশালতা। সর্বদা সে দেখতে পায় সেই মানবীর মুখ। কচকচে হাতের অসহ্যনীয় থাপ্পড়ের ব্যথা। আহা কি স্বাদ তাঁতে!

” আরহান, বাবা। ”

সাজিদার মায়াবী ডাক। যেন ছেলে টা এখনো বয়সের ক্ষেত্রে চারে ঠেকে আছে। ফারেগ কন্ঠ নালী পরিষ্কার করে ডাকলেন। উঁহু কোনো রেসপন্স নেই আরহানের। একে অপরের দিকে তাকিয়ে সাজিদা এগিয়ে গেলেন। জাপটে ধরলেন ছেলে কে। পর পর কতো বার চুমু খেলেন তা হিসেব নেই। আরহান যেন অনুভূতি পেল এবার। তবে পজেটিভ প্রতিক্রিয়া এলো না। তেঁতে উঠে বলল
” কে, কে তোমরা। ”

ছেলের মুখ থেকে এমন বাক্য শুনে ঝমঝমে কেঁদে উঠলেন সাজিদা। ফারেগ হতবাক, বিমূঢ়, বিস্ময় ঠেকাতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। তমীজ বললেন
” ধীরে ধীরে ঠিক হবে। অনেক দিন ধরে কাউ কে দেখে না যে তাই। ”

মাতৃ মন কি সান্ত্বনার বুলি মানে? চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন সাজিদা। আরহানের বুকে মাথা রেখে বলতে লাগলেন ” বাবা আমারে চিনতে পারছিস না তুই। আমার ছেলে আমাকে চিনতে পারছে না। ”

ফারেগের চোখে জল। সন্তর্পণে চোখ মুছলেন তিনি। আরহান ঝটকা মেরে সরে গেল। চিনতে পারছে না ব্যক্তি দুটো কে।কে এরা?

হঠাৎ করেই মাথায় যন্ত্রনা শুরু হলো। আরহান মাথা চেপে ধরে রইলো। চোখে ভাসতে লাগলো এক পুতুলের মতো চোখ। ইসস কি সুন্দর সেই চাহনী, যেন ডুবে যাবে এখনি।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here