এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা #পর্ব:১২,১৩

0
841

#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#পর্ব:১২,১৩
#লেখিকাঃতামান্না
#দ্বাদশঃপর্ব

তাই তো সে আকাশ যেভাবেই তাকে চাইতো, ঠিক সেইভাবেই আকাশের কাছে ধরা দিত। আকাশকে পাওয়ার জন‍্যই তো সবকিছু বিসর্জন দিল সে। এতকিছু বিসর্জন দিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। কলঙ্কের লালীমায় লাল রক্তবর্ণ ধারন করল তার জীবনের রঙ্গে। কেন সেদিন সেই ঘটনার পর নিজেকে সুধরালো না?
কেন আবার সেই ঘটনার পুনারায়বৃত্তি ঘটল? কেন সে নিজেকে সেখান থেকে সরিয়ে নিল না! মেহরিন আর আকাশের মাঝে এসে মেহরিনকে কাটার মত উপড়ে ফেলতে গিয়ে নিজেই, চোরাবালিতে ফেসে গিয়েছে সে। দুটোদিন সে খায়নি, কিভাবে এমন খাবার তার মুখে রুচবে? শুকনো মুখে চেয়ে আছে জেলের অন‍্য কয়েদিদের মুখেরদিকে। এক নিমিষেই জীবনটা তার শেষ হয়েগেল। অন‍্যান‍্য কয়েদিরা সবাই যার যার মত কাজ করছে। আজ কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করতে তবে তাদের পরিবার থেকে অনেকে এসেছে। শীলা সেদিকে চেয়ে আছে, কত কয়েদি খুনি, কত কয়েদি চোর, কত কয়েদি ভেজাল কারবারি, কিন্তু সবারই দিন শেষে কেউ না কেউ এসেছে, একবার তাদের দেখে যেতে, কিন্তু শীলার বেলায় একজনও আসেনি।

প্রত‍্যেক কয়েদির সিরিয়াল নাম্বার অনুযায়ী ডাকা হচ্ছে, প্রত‍্যেকের মুখে হাসি, হাসি না পেলেও মুখে তৃপ্ততার ছাপ। কতদিন পর তাদের আত্মীয়, তাদের পরিবারের লোকজন দেখতে এসেছে। ভীড় ঠেলে কত মা, বোন অশ্রুটুকু সন্তানের জন‍্য ফেলছে। শীলা নিজের অশ্রু ধরে রাখতে পারলো না। একটা ভুল পদক্ষেপ শেষ করেদিল তাকে। কান্নার শব্দে জেলার সাহেবা এলেন।

মহিলা জেলার এসেছিলেন দেখতে, সাপ্তাহিক ভিসিট থাকে। এই ভিসিটে জেলার সাহেবা ঘুরে ঘুরে সবকিছুর তদারকি করেন। অন‍্যদিন গুলোতে করলেও তেমন ভালোভাবে হাতে সময় থাকে না তাই একদিন তিনি পুরো কারাগারে প্রদর্শন করেন। সামনে হাটতেই শীলার দিকে তার চোখ পরে যায়। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে, ফর্সা শরীর, ফর্সা মুখটির খাড়া নাকটি লাল আভায় মেখে গেছে।
মেয়েটির দুচোখ জুড়ে টলমল জলের ধারা বয়ে চলেছে।

জেলার সাহেবা জেলা সুপার পুলিশকে ইঙ্গিত করে বললেন- “ম‍্যাডাম ও কি নতুন কয়েদি?”

জেলা সুপার -” হুম, ও নতুন কয়েদি!”

জেলার সাহেবা-” কাদছে কেন?”

জেলা সুপার -” কি আর করবে, ভুল করার সময় করেছে এখন কান্নাকাটি করছে। এগুলো এসব মেয়ের চাল। চলুন ওদিকে যাই!”
জেলার সাহেবার কাছে বারবার মনে হলো মেয়েটি কোন ভুল করতে পারে? যার চোখে ভুলের জন‍্য জল! এমন একটা মেয়ে ভুল করতে পারে? পরে আবার মনে হলো –

-” অপরাধি অপরাধ করবেই, আবার শাস্তির ভয়ে তটস্থ হয়ে ক্ষমা চাইবে, কিন্তু এত সহজে তার ক্ষমা মঞ্জুর করা হবে না। তাকে দেখে অন‍্যরাও ভুল করতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।” জেলার সাহেবা সেই কথাগুলো মনের মধ‍্যে আওরাতে আওরাতে জেলা সুপারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলেগেলেন।
_________________________________

দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছে মেহরিনের, এই তো কিছুদিন আগেই ছোট্ট শিমুকে সে খাটে শুইয়ে রাখত সেই শিমু এখন পুরো খাটে হামাগুড়ি দিয়ে বেরায়। মেহরিন কিছু বললেই তার কথা গুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে উত্তর দেয়। তবে উত্তর গুলো কেউ বুঝতে পারেনা সাতমাস হয়েছে। মেয়েটা মায়ের মুখ চিনে, মাকে সারাদিন খুজে। মাকে পেলে তার আবদারের শেষ হয়না। মেহরিন যখন ঘরের কাজ, রান্না – বান্নায় ব‍্যস্ততা শেষ করতে একটুখানি দেরী করে ফেলে। শিমু চিৎকার করে মাকে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়!

আজকাল শাফায়েত ও মেহরিনকে স্ত্রীয়ের সম্মানটুকু দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগেই সে মেহরিনকে শিমুর মা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে নিশিতার জায়গা হয়তো মেহরিন কখনোই পাবে না। কিন্তু মেহরিন তো আর বাণের জলে ভেসে আসেনি!এই মেয়েটা তার স্ত্রী, তার অর্ধাঙ্গিনী, নিশীতার যেমন প্রাপ‍্য অধিকার আছে, ছিল। মেহরিনের ও আছে নিজের স্বামীর থেকে তার প্রাপ‍্য মর্জাদা সব অর্জন করার। কিন্তু মেহরিনকে সে ঠকাচ্ছে, অন্তত‍্য স্ত্রী হিসেবে আর তার সন্তানের মা হিসেবে তাকে ঠকানো মানে এই সম্পর্ককে নষ্ট করা! গড়াটাই ভেঙ্গে ফেলা।শাফায়েত মেহরিনকে সময় দিচ্ছে, মেহরিনকে সে সাহস দিচ্ছে। মেহরিনের ভিতরে পুরুষ নিয়ে ঘৃণার আভাষ বা তার প্রাক্তন স্বামীর ধারা অত‍্যাচারিত ও তিক্ত অভিজ্ঞতাকে সে কাটিয়ে তুলছে। স্বামী বা পুরুষ মানেই শরীর নিয়ে ছুকছুকানী, বা পুরুষ মানেই নির্যাতন। তা সে ভুলিয়ে দিচ্ছে, সব পুরুষ অমানুষ নয়! সব মানুষ জানোয়ার নয়! ব‍্যক্তিত‍্য, মনুষ্যত্ব সবার মাঝেই আছে। কেউ স্ত্রীকে ঘরের চাকরানী নয়, হৃদয়ের আর ঘরের লক্ষী বানিয়ে রাখতে জানে তাই দেখিয়ে দিচ্ছে সে।

অবশ‍্য এই কঠিন কাজটি করতে প্রায় মাস দুয়েক লেগেছে তার, মেহরিন তার সঙ্গে তেমন কথা বলত না।মেহরিন এরিয়ে চলতো, শিমুকে তার হাতে দিয়ে সুলতানা বেগমের কাছে, বা কখনো ঘরের কাজ দেখিয়ে তাল বাহানা করে তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকাই ছিল তার প্রাধান কাজ।

শাফায়েত সবই বুঝতো, তাই সে হাল ছাড়েনি প্রতিটা মুহূর্তে মেহরিনের সমস‍্যাগুলোকে সে সামলে নিয়েছে , মেহরিনকে আগলে রাখা, মেহরিনের চাওয়া পাওয়ার গুরত্ব সে সঠিক ভাবেই দিত।
_________________________________________

সুলতানা বেগম শিমুকে কোলে নিয়ে বসেছেন। আজ মেহরিনের আবার প্রথম অফিস জয়েন ছিল। বউমার জীবনটাকে তিনি নতুন ভাবে উপভোগ করতে দিয়েছেন। এখন তো তিনি নিজেই রিটায়ার্ড, তাহলে মেহরিনকে কেন আটকাবেন? করুক যেকটা সময় হাতে থাকুক না কেন চাকরি করুক, ঘরে বসে মেয়েটা যেন গম্ভীর হয়েগেছে। তাকে বাহিরে মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সুলতানা বেগমের কথা শুনে অনেকে চরম অবাক হয়েছেন। এই মধ‍্যবয়সি নারী এখনো বউকে দিয়ে চাকরি করাতে চাচ্ছে। তার কি মাথা খারাপ? নাকি টাকার অভাব? আর চাকরি যদি বউ করেই ছেলেকে কেন বিয়ে করালো এমন মেয়ের সাথে? বাচ্চা দেখার জন‍্যই তো বিয়ে! সেদিন ও একজন বেড়াতে এসে অনেকটা হেসেই বলে উঠলেন,

-” বাবাহ, আমি আমার ছেলের বউকে দিয়ে চাকরি করাবো না। এতবড় বাড়ি পরে থাকবে খা খা করবে বাড়িটা। আর ঘরের বউ বাইরে গিয়ে বসে থাকবে। নাতি-নাতনি সামলাবে কে?”
সুলতানা বেগম মনযোগ দিয়ে সব শুনলেন। তারপর বলে উঠলেন-

” চাকরি কি আমরা শুধু সামান‍্য কটা টাকার জন‍্য করি?”
চাকরি করি নিজের আত্মরক্ষার জন‍্য, এটা তোমার ভুল রত্না! চাকরি একটা মেয়ের সম্বল! তুমি দেখো আজ একটা পরিবারে স্বামী যদি কোন বিপদে পরে স্ত্রী তার সামান‍্য সম্বল বা সঞ্চয় টুকু স্বামীকে দিয়ে সাহায‍্য করতো। এখনকার মেয়েরা স্বামী যদি বাহির সামলায় মেয়েরা ঘর সামলায়। অর্জিত অর্থ দিয়ে সাংসারিক দৈনন্দিন চাহিদাগুলো মিটায়। আবার দেখো বাবা-মাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায‍্য করে, এই টাকা কি স্বামীর কাছ থেকে নেওয়া যায়? আবার ভাবো এই যে অনেকের স্বামী স্ত্রীর থেকে যৌতুক চায়! এবং নির্যাতন করে সামান‍্য কটা টাকার জন‍্য তখন মেয়েটি কতবার তার বাবার বাড়ি যাবে বলতো? ”

” তুমি আরেকটি কথা বললে বউকে দিয়ে চাকরি করাচ্ছি এত বাড়ি খালি পরে থাকবে। খা,খা করবে কেন? আমি আছি আমার নাতনিরা আছে,সবাই আছে!বউকে আমি যেমন চাকরি করাবো তেমনি চাকরি ছাড়াবো ও!” ওর যখন সময় হবে তখন ও ছেড়ে দিবে।তোমার কথাটা আমার পছন্দ হয়নি রত্না! তুমি বউয়ের প্রসঙ্গ তুলে কথাটা আমাকে খোচাঁ মেরে বলেছো!”

– “ভাবী আপনি আমাকে ভুল বলছেন!”

– কোথায় ভুল? আমি ও চাকরি করতাম, আমার একটা মাত্র সন্তান, তুমি জানো আমার শাশুড়ি আমার বাসায় আমার ছেলেকে মানুষ করেছেন। ঘর সামলিয়ে আমি বাইরে যেতাম, আমার স্বামী ব‍্যবসার কাজে বিভিন্ন যায়গায় চলেযেত। আমিই সব সামলাতাম কোথায় আমার শাশুড়ি তখনকার মহিলা হয়েও অত কথা শুনাতেন না , শাফায়েত হওয়ার পর ওকে স্কুলে ভর্তির পর আমি আবার প্রাইমারিতে জয়েন করি,এভাবে করিনি! শুনো,সংসারি মেয়েরা সবকিছু আগে থেকেই সামলে নিতে জানে। আমার বউমাকে ও আমি ওমন ভাবেই গড়ে তুলবো!”
রত্না বেগম যেন তব্দা খেয়েগেলেন! এ কেমন শাশুড়ি?
অনেকটা কথায় না পেরে উঠে চলেগেলেন তিনি। কথায় পারা যায় না সুলতানা বেগমের সঙ্গে। খুবই দূর্ত মহিলা!

চলবে।

#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#লেখিকাঃতামান্না
#ত্রয়োদশঃপর্ব

– কোথায় ভুল? আমি ও চাকরি করতাম, আমার একটা
মাত্র সন্তান তুমি জানো আমার শাশুড়ি আমার বাসায় আমার ছেলেকে মানুষ করেছেন। ঘর সামলিয়ে আমি বাইরে যেতাম। আমার স্বামী ব‍্যবসার কাজে বিভিন্ন যায়গায় চলেযেত। আমিই সব সামলাতাম কোথায় আমার শাশুড়ি তখনকার মহিলা হয়েও অত কথা শুনাতেন না , শাফায়েত হওয়ার পর ওকে স্কুলে ভর্তির পর আমি আবার প্রাইমারিতে জয়েন করি। এভাবে করিনি! শুনো সংসারি মেয়েরা সবকিছু আগে থেকেই সামলে নিতে জানে। আমার বউমাকে ও আমি ওমন ভাবেই গড়ে তুলবো!”রত্না বেগম যেন তব্দা খেয়েগেলেন! এ কেমন শাশুড়ি?
অনেকটা কথায় না পেরে উঠে চলেগেলেন তিনি। কথায় পারা যায় না সুলতানা বেগমের সঙ্গে। খুবই দূর্ত মহিলা!

মেহরিন অফিস থেকে এসেছে মাত্র মাথা তার ধরে গিয়েছে। আগে ব‍্যাংকের চাকরি ছিল, আর এখন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র এক্সকিইউটিভ অফিসার হিসেবে জয়েন দিয়েছে। সবার সঙ্গে সারাদিন পরিচয় হতে হতে, আর কাজ বুঝে নিতেই সময় লেগে গিয়েছে তার। অফিসের সবাই খুব মিশুক ছিল, সবাই কাজ সেরে তার সঙ্গে সখ‍্যতা ও গড়ে তুলেছে নিজেদের মত।

মেহরিন সোফায় বসা মাত্রই উপর থেকে শিমুর কান্না শুনতে পেল। কোথায় তার বিশ্রাম কোথায় তার অফিসের চিন্তা , সব বাদ দিয়ে মেয়ের কাছে ছুটে গিয়েছে সে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে শিমুকে কোলে করে বলে উঠলো

-” কি মা! মা টাকে কেউ আদর করে না?”
শিমু কেদে দিয়ে মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো – “না! না! ” মেহরিন অবাক হয়েগেল মেয়ের কথায়।
শিমুর এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট কিছুই উচ্চারণ করতে পারার কথা নয়। যেখানে অনেক বাচ্চারা এই বয়সে মুখে দা,দা, দা, বা, বা, বুলি আওরাতে সময় লেগে যায়।

মেহরিন শিমুর গালে আদর করে বলল

– “একবার মা বলে ডাকতি মা! ডাক না মা! বল -মা, মা”
শিমু মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে কি বলছে মা তাকে। মেহরিন সেদিন সারাদিন আরও বেশি খুশি হয়েছিল শিমু তাকে মা ডাকবে। মেয়েটার মুখে বুলি ফুটবে, প্রথম বুলি উচ্চারিত হবে -” মা নামের এক ঐশ্বর্য পূর্ণ ডাক! এক পরিতৃপ্তময় ডাক। যে ডাক শুনলে প্রত‍্যেকটি নারীর শরীরে আলাদা শিহরণ বয়ে যায়।
___________________________________

আকাশের জেল থেকে মুক্তির দিন আজ, পাচঁ মাস জেলে থাকার পর ছাড়া পেয়েছে কেউ আসেনি দেখতে।
না কেউ কেসটা চালাতে চেয়েছে। মামলা মকদ্দমায় পরে জেলেই ছিল সে। প্রথম প্রথম আকাশের খুব রাগ লাগত! মনে হতো সবঠিক হয়ে যাবে, সব গুছিয়ে নিবে সে কিন্তু এখন সে নিজেই তিক্ততায় যেন ডুবে গিয়েছে।
জেল থেকে পুরোনো পোশাক পরে বেড়িয়ে গেল। পকেটে হাত দিয়ে দেখে মাত্র একশো টাকার নোট!
প্রথমেই আকাশের মুখ দিয়ে গালি বেড়িয়েগেল। যেই পকেটে পাচঁহাজার ছয় হাজার থাকতো এখন সেখানে মাত্র একশো! গেট থেকে বেড়িয়ে সামনে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে একটা লোকাল বাসে উঠেগেল সে।
বাড়ি পর্যন্ত না গেলেও রাস্তায় নামিয়ে দিলেই হয় বাকিটা পথ হেটেই যেতে পারবে।

সারাপথ বাস দিয়ে আসার পর, হেটে হেটে এসেছে সে। পথে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রত‍্যেকের নানা ধরনের প্রশ্ন! কেউ বা নাক মুখ কুচকাচ্ছে। এলাকা অবদি এসে যেন আরও অবাক হয়েগেল সে! এখানকার লোকজন তার সঙ্গে কথা তো দূর, কেউ যেন ফিরে ও তাকাচ্ছে না।
কিছুদূর যেতেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হলো আকাশ। বাড়িটা কেমন সাজানো গুছানো হচ্ছে, নতুন নতুন লোক, সবাই বাড়ি গুছিয়ে রাখছে। আকাশ সামনে যেতেই একজন তার সামনে দাড়ালো।

আকাশ তাকে দেখে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল –

” আপনারা কি নতুন ভাড়াটিয়া?”

-” নতুন ভাড়াটিয়া না বাড়ি ওয়ালা!”
আকাশ অবাক হলো, বলল

-” কি বলছেন?”

-” আরে ভাই আমরা বাড়িওয়ালা!”

-” আপনারা বাড়িওয়ালা কেমন করে?”

-“আজব, এই তো দু সপ্তাহ আগে এই পুরো জায়গা ও বিল্ডিং আমি কিনেছি, দাম একটু কম ছিল! সস্তায় পেয়েছি কিনেছি! পুরো বাড়ির দাম তিন কোটি উঠত প্রায়! ওখানে মাত্র তিয়াত্তোর লাখ পরেছে।কিন্তু সবগুলো ফ্ল‍্যাট নাকি আগেই বিক্রি করে ফেলেছে। শুধু জায়গা আর তিনতলার একটা ফ্ল‍্যাট পেয়েছি! এটা নাকি পাচঁতলা ফাউন্ডেশন করা! তিনতলা পর্যন্ত আগের বাড়িওয়ালারা ছিলেন। দ্বিতীয় তলাটার ফ্ল‍্যাট নাকি বিক্রি করে দিয়েছে। আর রইল বাকি দুই তলা ফাউন্ডেশন। ওটা করলে ক্ষতি আর হবে কি!”
আকাশের মাথায় যেন বিরাট বড়সড় বাজ পরেছে। বাড়িটাও হাত ছাড়া হয়েগেল!

-”বাড়ির আগের মালিকরা কোথায়?”

-” ছেলের নাকি চরিত্র ভালো না, জেলে আছে। মা অসুস্থ, মা নাকি বলছে জায়গা বিক্রি করে ফেলতে।
এখন এই জন‍্য জায়গা বিক্রি করছে এতটুকুই জানি এর বেশি কিছুই জানি না। ওনারা বলেই যায়নি ঠিকানা!
আর শুনছি সম্পত্তি নাকি মেয়ের নামে দেওয়া হবে।”
আকাশ বুঝলো আয়েশা সবই হাতিয়ে নিয়েছে। আকাশ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কিছুদূর এসে ফোন নিল হাতে, শীলার মোবাইলে ফোন করল শীলা ও তো জেলে ছিল।
শীলা যদি ছাড়া পায়! শীলাকে ফোন করার পর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।

শীলা তার ফোন আগেই বন্ধ করে ফেলেছে। সেই সিম থেকে শুরু করে সব বন্ধ শীলার। জেলে থাকা অবস্থায় জেলার সাহেবা আফসানা আইয়ুব তার সঙ্গে কথা বলেছিল। আফসানা আইয়ুব খুব নরম ও দয়ালু মনের মানুষ। শীলার অন‍্যায় এবং নিজের ভুলের জন‍্য অনুতপ্ত হওয়া সব কিছুই তার চোখে পরেছে। জেল থেকে ছাড়া পাবার পরপরই তাকে একটি এনজিওতে কাজ দিয়েছেন তিনি। আফসানা আইয়ুব বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। সমাজের নানারকমের কর্মসূচিতে তিনি অংশ গ্রহণ করেন তাই তিনি জানেন কিভাবে কাকে কোথায় কাজে লাগাতে হয়।
_________________________________________

“শাফায়েত ছাদে এসেছে, পাশে মেহরিন। শাফায়েত আর মেহরিন আর পাচঁটা স্বামী স্ত্রীর মতই স্বাভাবিক ভাবেই জিবন ধারণ করলেও তাদের মধ‍্যে এখনো স্বামী স্ত্রীর গভীরতায় এখনো পৌছায়নি। শাফায়েত যেন কোন একটা জায়গা থেকে বাধা পায়! বাধা বলতে সম্পর্কটা আগাতে তো পেরেছে তবে পুরোনো স্মৃতি আর প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে দুজনের একজন ও ভুলেনি। মেহরিন হয়তো আকাশকে ভালোবাসতো কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা ঘৃণায় পরিনত হয়েছে। অপর দিকে শাফায়েত তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সারাজীবন কাটানোর প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিভাবে অন‍্য কাউকে সেই স্থান দিবে? দোটানায় পরতে তার ভালো লাগেনা অস্বস্তি লাগে!”

” মেহরিন সবই বুঝে, লোকটি যথেষ্ট ভালো মনের মানুষ! এমন মানুষ হয়তো এত সহজে পাওয়া যায় না। কত পুরুষ বিয়ের পর সন্তান ভুলে গিয়ে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে পরে থাকে আর এই লোক দীর্ঘ চারমাসের সম্পর্কে একদিন ও তাকে ইচ্ছাকৃতি ভাবে ছুয়েও দেখেনি। নামাজ পরে স্ত্রীর জন‍্য কাদতে অনেক পুরুষদের কথা সে শুনেছে। কিন্তু তার সামনে বাস্তবে এমন পুরুষ পরবে সে ভাবতেও পারেনি। মাঝে মাঝে মনে হয় ভাগ‍্য হয়তো একেই বলে যে স্ত্রীর জন‍্য স্বামীর ভালোবাসাময় অশ্রুসিক্ত নয়ন সে স্ত্রীই তো আসল ভাগ‍্যবতি!

মেহরিনের গভীর ভাবনা আর আশপাশের নিরাবতা কাটিয়ে শাফায়েত বলল-

” কি ভাবছেন?”

-” কিছুই না,”

-” কিছুই না?”

-” না!”

-” আচ্ছা আমি কি স্বামী হিসেবে ব‍্যার্থ? এই যে এতমাস একটা মানুষের সঙ্গে এক ছাদে রয়েছেন অথচ স্বামী হয়েও আমি আপনার কাছে একদিন ও আসিনি। আপনার বিরক্ত লাগেনা? ”

-” অস্বাভাবিক বা বিরক্তি লাগার মত আপনি কিছুই করেননি। আপনার মধ‍্যে আমি তেমন কিছুই দেখিনি।
বরং আমি বলবো আমি আপনার আচরণে মুগ্ধ হয়েছি।”
কথাটা আপন মনে বলে মেহরিন দাত দিয়ে জ্বীভ কাটলো। হঠাৎ করে মুখ ফোসকে সত‍্য কথা বলে ফেলেছে সে।
শাফায়েত অবাক হয়ে চেয়ে আছে মেহরিনের দিকে।
মেহরিনের লজ্জা পাওয়া মুখের দিকে চেয়ে, চোখ শরিয়ে নিল সে। তারপর বলতে লাগল –

” মুগ্ধ হয়েছেন না ভিতরে ভিতরে অভিমান পুষে রেখেছেন তা আমি জানিনা। তবে এটুকু আশা রাখতে পারুন স্ত্রীর মর্যাদা যেহেতু দিয়েছি, স্ত্রীর হক টাও আপনি আমার কাছ থেকে যথাযথ পাবেন। আমি কথা দিচ্ছি আমি আপনাকে পূর্ণতা দিব।” শাফায়েতের এমন কথায় মেহরিন লজ্জায় মাথা নত করে ফেলেছে।

-” আপনি তৈরি তো?” মেহরিনের হাতদুটো ধরে।

-” জী,” শাফায়েত হ‍্যা শুনেই মেহরিনের হাত ধরলো। নরম হাত জোড়ায় ও কপালের চুল গুলিকে সরিয়ে একটা পবিত্রতার চুম্বন দিয়ে দিল। মেহরিন শাফায়েতের দিকে আর তাকাতে পারল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমেগেল। আর শাফায়েত তার পিছু পিছু মুচকি মুচকি হেসে যেতে লাগল।

সেদিন থেকেই দুজনের মাঝে তৈরি হতে লাগল দুষ্টু মিষ্টি কিছু মুহুর্তের। মেহরিনকে নিয়ে শাফায়েতের আগের সেই অচেনা অজানা বাধা যেন কেটে যাচ্ছে।
তবু মনের এককোণে তার প্রাক্তন স্ত্রীর প্রতি যে টান বা ভালোবাসা তা কোন অংশেই কম নেই । মেহরিন ও তার স্বামীর সেই সুপ্ত গোপন অনুভূতির একাংশ জানে। এ নিয়ে তার হিংসে হয় না কারন সে জানে প্রতিটা মানুষের পক্ষেই তার ভালোবাসার মানুষ থাকে। যেখানে অন‍্যদের হয়তো থাকে ঘৃণা শাফায়েতের আছে হারানোর শোক!

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here