#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#অন্তিমঃপর্ব
#লেখিকাঃতামান্না
সেদিন থেকেই দুজনের মাঝে তৈরি হতে লাগল দুষ্টু মিষ্টি কিছু মুহুর্তের। মেহরিনকে নিয়ে শাফায়েতের আগের সেই অচেনা অজানা বাধা যেন কেটে যাচ্ছে। তবু মনের এককোণে তার প্রাক্তন স্ত্রীর প্রতি যে টান বা ভালোবাসা তা কোন অংশেই কম নেই । মেহরিন ও তার স্বামীর সেই সুপ্ত গোপন অনুভূতির একাংশ জানে। এ নিয়ে তার হিংসে হয় না কারন সে জানে প্রতিটা মানুষের পক্ষেই তার ভালোবাসার মানুষ থাকে। যেখানে অন্যদের হয়তো থাকে ঘৃণা শাফায়েতের আছে হারানোর শোক!
__________________________________________
আকাশ পানিতে ঢিল ছুড়ে মারছে আর বিড়বিড় করে বলছে –
” কেউ নেই, আমার কেউ নেই!”
সত্যিই আকাশের আজ কেউ নেই, যে আকাশের টাকার জোড়ে পকেটে থাকতো টাকা! নিজের সম্মানের সাথে সাথে আকাশ যেন সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। যার জন্য আকাশ নিজের বিবাহিতা স্ত্রী মেহরিনকে কখনো সম্মান দেয়নি। দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার করেগেছে।
দিনের পর দিন মায়ের কথা মত তার শরীরে আঘাত করে গেছে। আজ সেই মা ও যে নেই! নেই আদরের বোনটি, শশুড় বাড়ির লোকেদের আবদার মেটানোর জন্য আয়েশা সবসময় যেকোন মুহুর্তে ভাইয়ের কাছে এসে এটা ওটা চাইতো।আজ সেই আদরের বোনটি ও নেই! যে ক্ষনিকের সুখের জন্য অসুস্থ স্ত্রীকে ছেড়ে আবারো নিজের জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রেমিকার কাছে একান্ত সময় কাটাতে যেত সেই প্রেমিকা তো আর আসবে না! আকাশ যেন পাথর হয়েগেছে।মেহরিনের কষ্টে জর্জরিত মুখটি মাঝে মাঝে তার খুব মনে পরে। মেয়েটি তার সামনে সব সময় হাসি মুখে দাড়িয়ে থাকতো। যদি সে একটু হেসে কথা বলে। যদি সে আরেকটু কাছে ডাকে। কত ছোট আবদার মেহরিনের ছিল, কিন্তু সে কোনদিনই তার আবদার গুলোকে আবদার হিসেবে নয় ন্যাকামো হিসেবেই দেখেছে।
আজ মেহরিন সুখেই আছে, খুব সুখেই আছে এই তো সেদিন মাঝরাস্তায় মেহরিনের সাথে দেখা হলো তার।
ধানমন্ডির লেকের পাড়ে এসেছিল সেদিন মেহরিন।
মেহরিনের কোলে তখন ছোট্ট একটি বাচ্চা। কি সুন্দর বাচ্চাটি! ছেলে বাবু, বাচ্চাটি মেহরিনের শরীরে যেন একদম মিশে ছিল। মেহরিন ও বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে হাটছিল। পাশেই একটি লোক আরেকটি ছোট্ট মেয়ে নিয়ে দাড়ালো। মেয়েটার হাতে আইসক্রিম, আইসক্রিম খেতে খেতে বাবুটাকে বারকয়েক কোলে নিতে চাইলো। মেহরিন তার হাতে দেয়নি।
আকাশ তখনই বুঝলো পাশে দাড়ানো লোকটি মেহরিনের স্বামী আর কোলে বাচ্চাটি মেহরিনের বাচ্চা।
আকাশ আগেই এই কথা শুনেছিল। আর আজ এই ভাবে দেখা হবে তা ভাবতেই পারেনি সে।মেহরিন ও তার স্বামী বাচ্চা দুটোকে সাথে করে নিয়েগেল। আকাশ সেদিন অসহায়ের মত চেয়েছিল, কিছুই যে করার নেই তার! এ জিবনে পাপের খোড়া পূর্ণ হচ্ছে তার। মেহরিনের বাচ্চাগুলোর মত তারও দুটো বাচ্চা থাকতো, কিন্তু আজ আর নেই! ক্লান্ত আকাশ ঐ বিরাট বড় আকশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল
-” তোর কেউ নেই আমারো কেউ নেই!
আমি একা তুই ও একা!” পাশের লোকজন চেয়ে আছে আকাশের দিকে। পাগলের মত বকছে আকাশ! আকাশ ও পাগল হয়েগেছে।হবেই না কেন? যার জীবনের কোনকিছুই ঠিক নেই সেই মানুষ কতটুকুই বা ঠিক থাকে?
_______________________________________
মেহরিন তার ছেলে মাহিমকে ফিডিং করাচ্ছিল। এর মধ্যেই নিচ থেকে ব্রেকফাস্ট করে শাফায়েত রুমে এলো। মেহরিন শাফায়েতকে দেখে তাড়াতাড়ি মাহিমকে শুইয়ে দিয়ে নিজে বসে পরল। বাবাকে দেখে ছেলেটা একেবারে চনমনিয়ে উঠে পরলো, দুধ খাওয়ানো আর হলো না মেহরিনের । এই ছেলেটা একদম বাবা পাগল।
বাবা ছাড়া একদমই কিছুই বুঝতে চায়না। আগে শুনেছে-
“ছেলেরা মায়ের ভক্ত হয়, মেয়েরা হয় বাবার!” কিন্তূ মেহরিনের বেলায় তা উল্টো ” মেয়ে তার মায়ের ভক্ত, ছেলে তার বাবার ভক্ত ”
মেহরিন ছেলেকে শাফায়েতের কোলে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। ছেলে তার বাবার কোলে উঠে বাবার চুলগুলো হাত দিয়ে খেলা করতে লাগল। মেহরিন মাহিমের গাল টেনে দিলো। শিমু বাবা আর মায়ের মধ্যে গুটিগুটি পায়ে হেটে এসে দাড়িয়ে পরলো।
শিমু-” আম্মু মাহিমকে আমার কোলে দেও না!”
শাফায়েত -” তুমি কোলে নিতে পারবে না মা!”
শিমু-” আমি পারবো!”
শাফায়েত -” না পারবে না!”
শিমু রেগে গিয়ে কাদতে শুরু করেছে। মেহরিন শিমুকে খাটের মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে মাহিমকে শিমুর কোলে দিয়ে দিল।
শাফায়েত-” ও ফেলেদিবে তো,কি করছো! দুজনই ছোট।”
মেহরিন -” ফেলবে না, আমি আছি না!” ওদের দুজনকে দেখে রাখবো। ” শাফায়েত আর এ বিষয়ে কিছুই বলল না। অফিসের কিছু জরুরি কাগজ পত্র রিডিং টেবিল থেকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল।
মেহরিন শিমুর মাথায় হাত বুলিয়ে তার দাদির কাছে পাঠিয়ে দিল। আর মাহিমকে আবার শুইয়ে ঘুম পাড়াতে লাগল।
বিয়ের আড়াই বছর পর অনেক সাধনার পর মেহরিনের গর্ভে আবার ও সন্তান এলো। তৃতীয় বারের মত মা হওয়ার আনন্দ সত্যিই প্রকাশ করার মত নয়। প্রথম সন্তানদের কথা এখনো মনে পরে মেহরিনের। যতই হোক মাতো মাই হয় সন্তান মৃত বা জীবিত মায়ের মনে সব সময় সে থাকে। মেহরিনের মনেও তারা সব সময় জীবিন্ত। ঘুমন্ত মাহিমকে বুকে টেনে আদর করল কিছুক্ষণ। আজ আবার শিমুর জন্মদিন কত কাজ আছে তার।
সন্ধ্যায় শিমুর কিছু স্কুলের বান্ধবী আর আশেপাশের কিছু বাচ্চা এবং পরিবারের লোকদের ইনভেটিশেন ছিল তারা সবাই এসেছে আজ। মেহরিন মেয়ের জন্মদিনের সব কিছু রেডি করে, সুন্দর ভাবে নিজেকে তৈরি করল। মাহিমকে শাফায়েত কোলে নিয়ে দাড়িয়ে পরল মেহরিন আর শিমুর পাশে। শিমু কেক কেটে প্রথম পিসটা মেহরিনের মুখে ধরিয়ে দিল। মেহরিন ছলছল চোখে কেক খেয়ে শিমুর মুখে তুলেদিল। শিমু শাফায়েতকে এক টুকরো কেক দিয়ে, মাহিমের মুখে দিয়ে দিল। মাহিমের ছয় মাস চলে তাই মেহরিন তার মুখে অল্প একটু ডুকিয়ে দিল। সুলতানা বেগমকে এবং মেহরিনদের বাড়ি থেকে আসা সবাইকে শিমু খাইয়ে দিল।
_____________________________________________
শাফায়েতের কোলে শিমু আর মেহরিনের কোলে মাহিম।
একটু আগেই সবাই চলেগিয়েছে। সবাইকে বিদায় করে দুজনকে ঘুম পাড়িয়েছে অনেক কষ্টে। মেহরিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসলো, নিজের সাজ গুলো উঠাতে লাগল। খোপা থেকে গোলাপ ফুল খুলতে নিলে। শাফায়েত বিকট শব্দে ধমক দেয়!
মেহরিন বুকে থুথু দিয়ে, বলে –
“এত জোরে কেউ ধমক দেয়? বাচ্চারা যদি জেগে যায়?”
-” জাগলে জাগবে, খোপা থেকে ফুল কেন খুলছো?”
-” রাত কত হয়েছে দেখেছো? ফুল খুলবো নাতো কি করবো? তোমার জন্য সারারাত সেজে বসে থাকবো?”
“হ্যা বসেই থাকবে।”
“হুহ, বসেই থাকবে! এমন ভাবে কথা বলছে যেন…”
শাফায়েত মেহরিনকে আর কথা বলতে দিল না। হাত ধরে ফেলল,
-” বসে না থেকে , এদিকে এসো ” বলেই মেহরিনকে টানতে টানতে পাশের রুমে নিয়ে গেল। রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো, শিমুর ছোটবেলাকার ছবি, মেহরিনের খোলা চুলে ছাদে দাড়িয়ে থাকা বিয়ের পরের মুহূর্তের কিছু ছবি। মেহরিন অবাক হয়ে দেখছে সব।
-” এগুলো কি?”
-” কেন দেখছো না?, আচ্ছা আমাদের সংসার জীবনের আজ কত বছর?”
-” তিন বছর আটমাস!”
-” রাইট!”
মেহরিন পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে বলল
-” এত কিছু কেন?”
-” আমার সংসারের রানীর জন্য এতটুকু তো করতেই পারি নাকি? ”
বলেই শাফায়েত মেহরিনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল।
মেহরিন আবারো পুরো রুমটিকে ভালো ভাবে দেখতে লাগল। মেহরিন ভিজে যাওয়া চোখ মুছে, শাফায়েতকে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা রাখা অবস্থায় বলল-
-” ধন্যবাদ!”
-” আর?”
-” কি?”
– “আর কিছু না?”
মেহরিন কিছুক্ষণ বোকার মত চেয়ে থাকলো,হঠাৎ কিছু মনে হতেই শাফায়েতের দিকে লজ্জা লজ্জা চাহুনি দিয়ে রুম থেকে বেরুতে চাইলে। শাফায়েত হাত টেনে ধরল তার। অতঃপর মেহরিনকে বন্ধি হতে হলো ভালোবাসার মানুষটির মায়াময় হাতে!”
সমাপ্ত!