উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৫৫

0
3318

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৫৫
(নূর নাফিসা)
.
.
৫১.
দেখতে দেখতে দিনগুলো পেরিয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ। মেঘ ও নাফিসা দুদিন আগে এসেছে ঢাকা। রায়হান চৌধুরী ও মোহিনী রোকসানাকে বলেছে অনেক কিন্তু রোকসানা আসেনি। মেঘ সবটা জানে বিধায় তার বাবা-মাকে ম্যানেজ করেছে সে।
সকালে নাস্তা করার পর নাফিসা বৃষ্টির সাথে কথা বলছিলো বৃষ্টির রুমে। এমন সময় মেঘ তাকে ডাকলো “মেঘা” নাম ধরে। বৃষ্টি বললো,
– যাও, মেঘা! তোমার মেঘের ডাক পড়েছে যে। দেড়ি হলে আবার গর্জন তুলবে!
– পাজি মেয়ে।
বৃষ্টি হিহি করে হেসে উঠলো আর নাফিসা চলে গেলো। হাসি থামিয়ে কোল বালিশটা কোলে নিয়ে বললো, “মেঘ থেকে যদি মেঘা হয় তাহলে তুই কি হবি বৃষ্টি! আকাশী না বাতাসী!” নিজের সাথে কথা বলে একা একাই হাসতে লাগলো বৃষ্টি। পরক্ষণে মায়ের কথা মনে করে মায়ের কাছেই চলে গেলো।
নাফিসা রুমে এসে দেখলো মেঘ খাটে বসে ফুল নিয়ে কিছু করছে। নাফিসাকে দেখে বললো,
– বাচ্চাদের আম্মি, দরজা লাগিয়ে আমার কাছে এসো।
নাফিসা দরজা লাগিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– ফুল দিয়ে কি করবে?
– তোমার শীতের জামা কোথায়? বাচ্চাদের যদি ঠান্ডা লাগে, তোমার খবর আছে!
– এখন তেমন ঠান্ডা লাগছে না, তাই খুলে ফেলেছি। বললে না তো, ফুল দিয়ে কি করবে?
মেঘ কোনো উত্তর না দিয়ে তার কাজের সমাপ্তি ঘটিয়ে উঠে দাড়ালো। নাফিসার কাছে এসে তার গলায় শিউলী ফুলের মালা ও হাতে বালা পড়িয়ে দিয়ে বললো,
“কুড়িয়ে এনেছি শিউলি ফুল,
অনায়াসে মুগ্ধ করেছে আমায়!
গেথে মালা, হাতের বালা,
পড়িয়ে দিবো তোমায়!
চাইলে তুমি আরও দেবো,
নাকে ফুল,
আর কানের দুল,
সাথে বেধেও দিবো খোপায়!”
ছাদে গিয়ে দেখলাম অনেকগুলো ফুল পড়ে আছে তাই কুড়িয়ে নিয়ে এলাম।
– এখন কি এগুলো পড়ে আমি সারাদিন রুমে বসে থাকতে পারবো!
– সারাদিন না, যতক্ষণ আমি বাসায় আছি ততক্ষণ পড়ে আমার কোলে বসে থাকো।
– অসময়ে তোমার দুষ্টুমি! বিয়ে বাড়ি, কাজ তোমার আমার সবারই আছে!
মেঘ খাটে বসে নাফিসাকে টেনে তার কোলে বসিয়ে দিলো। দু’হাতের বন্ধনে বেধে বললো,
– মা কিন্তু তোমাকে কাজ করতে একদম নিষেধ করেছে। আর আমার কাজ তো আমি করবোই। সব কাজে একটু একটু ফাকি দিয়ে বাচ্চাদের ও তাদের আম্মিকে আদর দিয়ে যাবো। বলা তো যায় না কখন আবার রাগ করে বসে!
– বাচ্চারা ও তাদের আম্মি জানে তুমি কাজে ব্যস্ত। দুষ্টুমি ছাড়ো আর যাও।
– এই, চুপচাপ বসো।
ঠান্ডা থেকে একটু উষ্ণতায় আনতে মেঘ তার জ্যাকেটের চেইন খুলে নাফিসাকেও অর্ধেক ঘেরাও করলো জ্যাকেটের মধ্যে। অত:পর কাধে থুতনি রেখে বললো,
– বাচ্চারা কি খুব জ্বালাতন করে?
– উহুম। শুধু খাওয়ার সময় উপচে দেয়!
মেঘ হেসে উঠলো এবং বললো,
– আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আগের চেয়ে কমেছে না অনেকটা?
– হুম।
এভাবেই চললো কিছুক্ষণ তাদের প্রেমালাপ। মেহমান আসতে শুরু করেছে বাড়িতে। সময় যাচ্ছে আর জাকজমাক হয়ে উঠছে বাড়ি। গায়ে হলুদ গেলো ধুমধামে, তারপর বিয়ে। মারিশা গায়ে হলুদে আসেনি কিন্তু বিয়েতে এসেছে। নাফিসার সাথে দেখা করেছে। বাচ্চার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। মেঘ পাশেই ছিলো সেটুকু সময়। মারিশা এবং বৃষ্টির বান্ধবীরা সঙ্গ দিয়েছে বৃষ্টির। নাফিসা অল্প সময় সেন্টারে অবস্থান করেছে। পরবর্তীতে মেঘ নাফিসা ও মোহিনীকে বাসায় দিয়ে গেছে। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় যখন বিদায় হবে তখন মোহিনী সেন্টারে গিয়েছে। সেখান থেকেই বৃষ্টির বিদায় হয়েছে। ছেলে বিয়ে করে অন্যের ঘর শূন্য করে ঘরে এক মেয়ে এনেছে অন্যদিকে নিজের মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছেন অন্যের ছেলের ঘরে। প্রকৃতির কি অপূর্ব নিয়ম! ছেলে আর ছেলের বউ থাকতেও আজ বাড়ি ফাকা লাগছে!
.
বৃষ্টি ফুল সজ্জিত বিছানায় একা বসে আছে। মাত্রই আকাশ রুমে এসেছে। বৃষ্টি একপলক দেখে আবার দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে। আকাশ দরজা লক করে মাথার টোপর খুলে টেবিলে রাখলো এবং বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,
– বৃষ্টি, আমার সাথে এক রাত কাটাতে চাও নাকি জীবনের সব রাত?
এমন প্রশ্নে বৃষ্টি হতবাক হয়ে তাকালো তার দিকে! এর দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছে সে! বৃষ্টি কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না! আকাশ ব্রু নাচিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– এতো কনফিউশনে আছো কেন তুমি? বলো, এক রাত কাটাতে চাও নাকি বহুরাত?
– বহুরাত।
– তাহলে এসব চেঞ্জ করে এসো।
বৃষ্টি তার কথামতো নেমে গেলো। লাগেজের কাছে এলে আকাশ এসে লাগেজ খুলে দিলো। বৃষ্টি সুতি জামা নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। হাতমুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসে দেখে আকাশও চেঞ্জ করে প্যান্ট আর টিশার্ট পড়েছে। আকাশও বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। বৃষ্টিকে বসে থাকতে দেখে বললো,
– বসে আছো কেন? এনি প্রব্লেম?
– না।
– তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো।
বৃষ্টি বালিশ ঠিক করতে গেলে আকাশ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে মাথা আঁচড়ে বললো,
– মশা আছে কিন্তু প্রচুর। আমার এলার্জি আছে তাই স্প্রে করা যাবে না। মশারী টানিয়ে নিতে পারো।
বৃষ্টি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো খাটের কোনে মশারী আছে। সেটা নিয়ে ফুলের ঝারের ভেতরে চারকোনা টানিয়ে নিলো। বৃষ্টি ভেতর থেকে মশারী ঠিক করতে লাগলো, এদিকে আকাশ এসে দুই কোনা ছুটিয়ে দিয়ে বললো,
– তোমার দিকে রাখো। আমার আবার মশারী টানালে ঘুম আসে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হয়!
আশ্চর্য! মশারী না টানাতে পারলে রেখেছে কেন রুমে! এভাবে দুই কোনা টানিয়ে কি ঘুমানো যায়! বৃষ্টি ব্যর্থতার নিশ্বাস ছেড়ে বাকি দুইকোনাও ছুটিয়ে ফেললো। আকাশ শুয়ে পড়েছে। মশারী খুলে ফেলতে দেখে বললো,
– খুলে ফেলছো! কয়েল কিন্তু জ্বালাতে পারবে না। আমি কয়েলের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া তোমাকে মশা কামড়ালে কিন্তু আমার দোষ না!
বৃষ্টি কোন জবাব দিলো না। মশারী রেখে বললো,
– খাটে শুতে পারবো কি?
– অবশ্যই। খাট শুয়ার জায়গা তাহলে কোথায় শুবে! কিন্তু বালিশটা একটু দূরে রাখো। কেউ আমার সাথে ঠেকলে নির্ঘুম রাত কাটবে আমার। এজন্য আমার বন্ধুরাও আমার সাথে কখনো রুম শেয়ার করতে চায় না।
আকাশ বালিশটা একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে অপরদিকে ঘুরে শুয়ে আছে। বৃষ্টির ভেতরটা খুব কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ হচ্ছে না। চুপচাপ খাটে উঠে একপাশে চুপটি মেরে শুয়ে পড়লো। আকাশ আবার এদিকে ঘুরে বললো,
– কি ব্যাপার! ঠান্ডা লাগছে না? কম্বল নিচ্ছো না যে!
বৃষ্টি কম্বলের এক কোনা টেনে নিয়ে কোনোমতে এঁটেছে তার উপর। দুজন দু কোনায় থাকলে কি এক কম্বলে থাকা সম্ভব! বৃষ্টি অন্যপাশে ঘুরে চোখ বন্ধ করে রইলো। আকাশ এমন ব্যবহার করছে কেন ভেবে পাচ্ছে না! তার কথামতো পনেরো দিন ধরে কোনো যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেনি বৃষ্টি। এর মাঝে তো কোনো ঝামেলার রস গন্ধ পাচ্ছে না সে! তাহলে আকাশ এমন আচরণ করছে কেন! আজ প্রথম রাত এমন কাটবে সেটা ভাবতেও পারেনি বৃষ্টি! আকাশকে বুঝে উঠতে পারে না সে! কখনো ভালোবাসা দেখায় আবার কখনো অবহেলা! মানুষ তো সবার কাছে একটু ভালো ব্যবহারই প্রত্যাশা করে! সেদিন তো বিয়ে না করেই একেবারে নিজ বাসায় তুলে এনেছে আর কি প্রেম দেখিয়েছে! আবার ও বাড়িতে গিয়ে বাবা মায়ের কথা উপেক্ষা করে বিয়ে করে তারপরই এসেছে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে এসেছে। তাহলে এতো ভালোবাসা দেখিয়ে এখন অবহেলা করার মানে কি! এতোসব ভেবে বৃষ্টি মনে মনে বললো, “কোনো প্রতিবাদ করবো না কখনো তোমার বিরুদ্ধে, আকাশ। যেভাবে রাখতে চাও সেভাবেই থাকবো আমি তোমার কাছে। চুপচাপ না হয় তোমার পাগলামোর ভালোবাসার অপেক্ষায় জীবন পাড় করে দিবো।” বন্ধ চোখের ফাক দিয়ে গড়িয়ে পড়লো বৃষ্টির দু চোখের অশ্রু!
হটাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকালো বৃষ্টি! অবাক হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলো আকাশের কোলে! আকাশ তাকে বিছানা থেকে তুলে নিয়েছে এবং মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকে। বারান্দার দিকে যেতে যেতে গানের সুরে বললো,
.
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি তোমায় ভালোবাসি…
তুমি আমার প্রানপাখি, মৃগনয়না তোমার আঁখি
তাই পলকে পলকে শুধু তোমাকেই আগলে রাখি।
তোমায় ভেবে ভেবে কেটে যায় সাজের বেলা
নীলাম্বরে জমেছে দেখো লাখো তারার মেলা!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি তোমাকেই ভালোবাসি…
ঝিকিমিকি জ্বলছে দেখো, কত শত জোনাকির আলো!
অনুরাগে অভিমানে, অশ্রুপাতে লাগে কি আর ভালো।
ভালোবাসা কি, তা যদি তুমি জানো,
অভিমান ভেঙে বলছি তো এবার শুনো!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি…
লাখো স্বপ্ন, লাখো ইচ্ছে
বুনেছি যত, সবই তোমায় ঘিরে।
ছোটবড় সব ভ্রান্তি নিয়ে
কভু হারিয়ে যাবো, আবারও আসবো ফিরে।
কারণ শুধু একটাই ওগো প্রেয়সী!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি যে এই তোমাকেই ভালোবাসি…
.
এটা তো সেই গান যেটা মৌলভীবাজার থাকতে একবার আকাশ গেয়েছিলো! গান গাইতে গাইতে আকাশ বারান্দায় এসে বৃষ্টিকে কোলে নিয়েই চেয়ারে বসলো। বৃষ্টি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বারান্দায় কোনো লাইট নেই কিন্তু চাদের আলো পড়ে আলোকিত হয়ে আছে। দুজন দুজনকে দেখতে পাচ্ছে। আকাশ বৃষ্টির মুখখানা ধরে কাছে এনে গাল গড়িয়ে পড়া অশ্রু ঠোঁটে শুষে নিলো। বৃষ্টির অশ্রুধারা যেন আরও বেড়ে গেছে! অশ্রু বিন্দু আকাশ ঠোঁটে মুছে নিতে নিতে বললো,
– বলছি আজ শুনো, চোখের বৃষ্টি ঝরতে দেবো না কখনো। আর ঝরে পড়লে তা শুষে নিবো ওষ্ঠে! প্রেমের তরীতে ভেসে যাবো, যেখানে থাকবে তুমি সুখে।
মাতাল স্পর্শে কাতর হয়ে বৃষ্টি আকাশের টিশার্ট খামচে ধরে বললো,
– আকাশ, আমি এক রাত কাটাতে চাই না তোমার সাথে। আমার জীবনের সব রাত প্রয়োজন তোমাকে।
আকাশ বৃষ্টির কপালে চুমু দিয়ে বললো,
” তোমার প্রতিটি রাতকে রাঙ্গিয়ে দিবো শত রঙের মিশ্রণে।
মধুমাখা রাতগুলো উপভোগ করবো দুজন একসাথে।
যা দেখে নিশি আর শশীও লজ্জায় মুখ লুকাবে।”
অত:পর বৃষ্টির নাকে ও নাকফুলে চুম্বন করে বললো,
“তোমার প্রতিটি দিন শুরু ও শেষ হবে আমার কোমল স্পর্শে।
প্রেমময় প্রহর কাটাবো দুজন একসাথে।
যা দেখে রবিসহ, প্রকৃতির হিংসে হবে!”

এবার ঠোঁটে আঙুল স্পর্শ করে বললো,
– বৃষ্টি, সেদিন বলেছিলাম তুমি আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেছো। তোমার আর রক্ষা নেই। দীর্ঘ সময় পরের কাজ তুমি আগে করতে বাধ্য করেছো আমাকে। বিশ্বাস করবে, সেদিনের পর এক মুহুর্তও চলছিলো না আমার তোমাকে ছাড়া। অবশেষে আজ সম্ভব হলো আমার কাছে নিয়ে আসার। আজ আমার পূর্ণ অধিকার আছে তোমার উপর। তবে অধিকার দিয়ে নয়, ভালোবাসার চাদরে জড়াবো তোমার সাথে। দিবে কি আমার ভালোবাসায় একটু সাড়া?
আকাশের কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তা বৃষ্টিকে শিহরিত করে তুলেছে! এতোক্ষণ কি ভাবছিলো আর এখন কি হচ্ছে তার সাথে! সব ভুলে সে আকাশের ভালোবাসার চাদরে জড়ানোর সাড়া দিয়ে দিলো চোখ বন্ধ করে। কিন্তু আকাশের কোনো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে না! বৃষ্টি আরেকটু এগিয়ে এলো তবুও আকাশের কোনো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে না। এবার চোখ খুলে তাকাতেই আকাশ ডুবে গেলো তার ওষ্ঠে!
পরক্ষণে লজ্জায় তলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। আকাশের কোলে বসেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আকাশ তাকে একটু ঘুরিয়ে পেছন থেকে কাধে থুতনি রাখলো। হাত বাড়িয়ে সামনে থাকা টেবিল থেকে দিয়াশলাই নিয়ে মোমবাতি জ্বালালো। বৃষ্টি অবাক হয়ে আছে টেবিলে তাকিয়ে! টেবিলে একটা কেক রাখা আছে। তার চারপাশে চারটা মোমবাতি। সবগুলোতেই আকাশ আগুন ধরালো। কেকের ওপর লাভ শেভের মধ্যে লেখা আছে, ” Welcome in my life, Mrs. Akash”. আকাশ বৃষ্টিকে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আমাদের বিয়ের প্রথম রাত উদযাপন করেছি আমি একা। বিয়ের প্রথম সপ্তাহও উদযাপন করেছি আমি একা। আজ বিয়ের প্রথম পক্ষ ও বাসর রাত উদযাপন করবো তোমার সাথে। পরপর মাস ও বছরগুলোও ইনশাআল্লাহ তোমার সাথেই উদযাপন করবো।
বৃষ্টির চোখে বইছে সুখের বিন্দু। ধাধালো কন্ঠে বললো,
– আকাশ! বলবে একটু! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
– স্বপ্ন নয় অপ্সরী, স্বপ্ন তো এতোদিন দেখছিলে। আজ থেকে সব বাস্তব মুহূর্ত উপভোগ করবে। রুমে এসে আমি তোমার ধৈর্যশক্তির পরিক্ষা নিচ্ছিলাম। একটা গুণ গভীরভাবে ছুয়েছে আমায়, তুমি সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে নও। এতোদিন গোপনে ভালোবেসেছি ওয়াইফি, আজ থেকে প্রকাশে ভালোবেসে যাবো যখন তখন! কেক কাটো।
বৃষ্টি মৃদু হেসে বললো,
– এখন কেক খাবে কে?
– তুমি, আমি এবং আমরা।
– মোমবাতি নেভাতে হবে?
– না।
বৃষ্টি কেক কেটে এক টুকরো তুলে নিয়ে আকাশের মুখের কাছে ধরলো। আকাশ সেটা কামড়ে ধরে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে এলো। বৃষ্টি বুঝতে পেরেছে এবং লজ্জাও পাচ্ছে খুব। কিন্তু লজ্জা দূরে ঠেলে মুহুর্তটা অবহেলা না করে বরং উপভোগ করলো। আকাশের কেকের অংশ থেকে কামড় দিয়ে একটু নিয়ে নিলো। বাকি কেক ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখলো। কিছুক্ষণ নিরবে দুজন পূর্ণিমা উপভোগ করলো সাথে শীতল হাওয়া। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে দুজনেরই। পরক্ষণেই আকাশ বৃষ্টিকে কোলে নিয়ে আবার বিছানায় ফিরে এলো।
বৃষ্টিকে বসিয়ে রেখে সে ড্রয়ার থেকে একটা ওষুধের প্যাকেট নিয়ে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে দিতে গিয়েও দিলো না। নিজেই টেবলেট বের করতে করতে বললো,
– না, তোমার কাছে দেওয়া যাবে না। সাইন্সের স্টুডেন্টরা বেশি বুঝে!
– এটা কিসের ওষুধ! আমি তো অসুস্থ না।
আকাশ কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– এটা পূর্ব রোগ নিরাময়কারী ওষুধ। অসুস্থ হওয়ার আগেই খেতে হয়!
বৃষ্টি ব্রু কুচকে তাকাতেই আকাশ ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে পানি নিতে নিতে বললো,
– রুমে প্রবেশ করার আগে আম্মু বারবার আমাকে তোমার ক্যারিয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো। কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না! তাই আগে থেকেই সাবধান।
বৃষ্টি এবার কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। আকাশ তার হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে টুল নিয়ে এলো। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলো টেবলেট হাতে রেখেই নাড়াচাড়া করছে। তাই বললো,
– বৃষ্টি, এনি প্রব্লেম?
বৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না জবাব দিলো এবং ওষুধ খেয়ে নিলো। আকাশ টুলে দাড়িয়ে দেয়ালে আটকানো সেই সাদা ফ্রেমটা ধরলো। বৃষ্টি তাকিয়ে দেখছে আকাশ কি করছে। পরক্ষণেই দেখলো আকাশ সেই ফ্রেমের উপর থেকে আস্তে আস্তে টিস্যুর আবরণ তুলছে। সম্পূর্ণ আবরণ তুলে ফেলতেই বৃষ্টি চরম অবাক! এটা তো তার ছবি! ছবিটা এক সাইড থেকে তোলা, যখন সবাই রংধনুর সাথে সেলফি তুলছিলো আর ফোন না থাকায় সে পাহাড়ের উপর বসে রংধনু দেখেছিলো! আকাশ এ ছবি তুলেছে আর সে টেরই পায়নি! এবার তার কাছে পরিষ্কার, কেন সে সাদাকালো ছবি বলা সত্ত্বেও আকাশ বলেছে এখানে শত রঙের মিশ্রণ আছে! হ্যাঁ, এখানে শত রঙ ই আছে। বৃষ্টিসহ রংধনুর রং গুলো একই ফ্রেমে আবদ্ধ হয়ে আছে।
বৃষ্টিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আকাশ মুচকি হেসে এগিয়ে এলো তার পাশে। কম্বল নিতে নিতে বললো,
– দেখেছো আমার শত রঙের ফ্রেম? এর চেয়ে রঙিন কোনো দৃশ্যই হয় না।
– এটা কেন তুলেছো তুমি?
– আজকে তোমাকে দেখাবো বলে। একদা পাহাড়ে গিয়েছিলো এক কন্যা। সেদিন পেয়েছিলো দেখা রংধনুর। মুগ্ধ হয়েছে প্রবল ও ইচ্ছে ছিলো বহুগুণ! ইশ! যদি থাকতো সাথে ফোন, কতো না ছবি বাধাই করতো আজ! কিন্তু অবহেলা করেনি সে মুহুর্ত। পাহাড়ের গায়ে বসে প্রত্যক্ষ করেছে রংধনু দর্শন!
বৃষ্টি চোখ বন্ধ করে বললো,
– স্বপ্নেও ভাবিনি আকাশ, আজকের দিনে আমি এতোটা সারপ্রাইজড হবো! এতো ভালোবাসা জমা আছে তোমার মাঝে, একটু পূর্বাভাস দিলে কি হতো!
– মহা প্রলয় ঘটতো। তাছাড়া আগে এমন কিছুই ছিলো না। তুমি এসে জীবন পুরোই উলটপালট করে নতুন রূপে সজ্জিত করেছো।
– ফ্রেমে সবার সাথেই তুমি আছো, তাহলে আমার সাথে এক ফ্রেমে কেন নেই?
– নিচের দিকটায় আমারদের বিয়ের ছবি টানিয়ে দিবো, কি বলো?
বৃষ্টি মুচকি হাসলো। আকাশ বৃষ্টির উপর কম্বল দিতেই বৃষ্টি বললো,
– ওহ, আপনি তো আবার কারো গা ঘেঁষে ঘুমাতে পারেন না!
বৃষ্টি তার বালিশে শুতে গেলে আকাশ তার বালিশ মাঝামাঝি রেখে বৃষ্টিকে শুয়িয়ে দিয়ে বললো,
– একটাই যথেষ্ট। মিথ্যে বলেছিলাম তোমাকে। আমার কোনো এলার্জি টেলার্জি নেই। রুমে মশাও নেই। স্প্রে আগেই করা আছে। সত্যি করে বলো তো, কিছুক্ষণ আগে শুয়ে শুয়ে কি ভাবছিলে?
বৃষ্টি চুপ করে আছে। আকাশ আবার বললো,
– কি হলো, বলো?
– ভাবছিলাম, তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তুলবো না কখনো। যেভাবে রাখতে চাও আমি সেভাবেই থাকবো তোমার কাছে।
– আমার আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছো না?
– এখন যে তার চেয়েও শতগুণ বেশি সুখ অনুভব করছি! সইবে তো আমার কপালে?
– সবসময় এমনই থেকো, সব সয়ে যাবে।
নিমিষেই ঠান্ডায় জমে যাওয়া দেহ পাশাপাশি জড়ো হয়ে কম্বলের নিচে চলে গেলো উষ্ণ ছোয়া পেতে। অবশেষে পেয়ে গেছে আজ তাদের ভালোবাসার পূর্নতা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here