বিভাবতীর_জীবন #পর্বঃ১০,১১,১২

0
381

#বিভাবতীর_জীবন
#পর্বঃ১০,১১,১২
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ১০

–” অতিত ধুয়ে কি পানি খাবো আমি? বিয়ে করতে অতিত লাগে?”
বিভা চমকে গেল,এই লোক কি কথা সব সময়ে এমন ভাবেই বলেন?আর বললেও সব জায়গায় এমন করে উত্তর দিতে হবে? কথায় কোন রসকস কিছুই নেই।
বিভা যেন কিছুটা দমে গিয়েছিল ফাইয়াজের কথায় পরে নিজেকে কিছুটা দমিয়ে বলল –

–” অতিত ধুয়ে পানি খাবেন না, খুব সুন্দর একটা কথা বলেছেন। অতিত দিয়ে কি করবেন? যেখানে সংসার করতে দুজন মানুষের মনের ভাব লাগে। সংসার গুছিয়ে রাখতে মনের মিল হওয়া লাগে। কিন্তু এটাও ঠিক অতিত টা কিন্তু আসলেই লাগে। আর এই অতিত টাকেই হয়তো প্রত‍্যেকেই বিয়ের আগেই জানতে চায়। প্রত‍্যেকটা ছেলে চাইবে তার স্ত্রী ভালো কোন মেয়ে হোক। প্রত‍্যেকটা মেয়ে চাইবে তার স্বামী ভালো হোক। হবু স্বামী স্ত্রীদের নিয়ে তাদের মনে একটা আলাদা অনুভূতি থাকে। সবাই চায় তার সঙ্গি বা সঙ্গিনী বেটার হোক বা সবচেয়ে ভালো হোক।”

–” লিসেন, আমি তো দরদাম করছি না, জিনিসটা আসলেই কত দাম, কত দিয়ে বিক্রি করবেন তাতো নয়। যে জিনিসটার আগে কোন আঘাত লেগেছিল কিনা। কত বছর এটা দোকানে পরেছিল কজন ধরেছে কিছু বলেছি? আমি বিয়ে করবো। আমার একজনকে ভালো লেগেছে বলেই তো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। সো এখানে এত কিছু জানার তো তেমন কিছু দেখছি না।”

–” ডাঃ ফাইয়াজ আপনি খুব স্ট্রেইট কথা বলতে পছন্দ করেন। ভেরি গুড, কিন্তু আমাকে আমার ব‍্যাপারে কথা ও তো বলতে দিবেন। আমার মনে হলো তাই আমি বলবো।
এভাবে ফোনে কথা বলে লাভ নেই, কাল আপনি আমার সঙ্গে দেখা করছেন ব‍্যাস । ”

–” আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যখন বলছেন দেখা না হয় করলাম। তো বলুন কোথায় দেখা করতে পারি ?”

–” আপনি কোথায় দেখা করতে চান? আপনার যেহেতু ব‍্যাস্ততাটা বেশি।”

–” ব‍্যাস্ততটা শুধু আমার একার না আপনার ও আছে। তাই আমি একাই বলবো তা নয় আপনিই বলুন কোথায় দেখা করতে হবে?”

–” মধুমতি লেকের পাড় আসতে পারবেন?”

–” আপনাদের বাড়ির পিছনে?”

—” হুম,”

–” ও আচ্ছা, কখন দেখা করবো?”

–” সকালবেলায় পারবেন?”

–” কয়টা?’

–” এই ধরুন সাতটায়,”

–“আমি বরং ছয়টায় দেখা করি, সকালে আমাকে জগিংয়ে বের হতে হয়। একসাথে দুটো কাজ হলো।”

–” আচ্ছা ঠিক আছে,”
_______________________________________

সূর্যদয়ের পর আকাশটা বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ঘোলা আকাশ একদম পরিষ্কার হয়েগেছে। ঢাকার এই জনজীবনে খোলামেলা পরিবেশ খুব একটা দেখা যায় না।ফ্ল‍্যাটের বারান্দায় দাড়ালে রোদের লুকিয়ে চুরিয়ে আসা কিছু আলোক রশ্মি মাঝে মাঝে চোখে পরলে ও সব সময় তা দেখা যায় না। ফাইয়াজ তৈরী হয়েই এয়ার ফোনের কড দুটোকে কানে ঢুকিয়ে, জগিংয়ের জন‍্য ট্র‍্যাকস‍্যুট পরে একেবারে তৈরি হয়ে নিল। বের হতে নিলে মায়ের সঙ্গে দেখা। প‍্যারালাইসিসে আক্রান্ত ফাহিমা বেগম তখন হুইল চেয়ারে বসে ঘাড় কাত করে হাতে তজবি নিয়ে বসেছেন।
ফাইয়াজ সালাম দিয়ে বলল।

–” আমি বাহিরে যাচ্ছি আম্মু, ফুফি আম্মুকে দেখে রেখো। ফিহাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখলে বলো ও যেন আজ কলেজ মিস না দেয়।”
ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় ফাহিমা বেগম ডেকে উঠলেন ছেলেকে।
কথা একদম স্পষ্ট বলতে পারেন না তবুও সেই গলায় বলে উঠলেন –

–” গাড়ির চাবি নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস এত সকালে ?”
ফাইয়াজ নিজের হাতের চাবিটাকে দেখে হেসে বলে উঠল-

–“একটা জায়গায় যাচ্ছি, ফিরতে খুব বেশি দেরী হবে না। যাবো আর আসবো ঠিক আছে। এত টেনশন করো না।”

–” ও,”

ফিহা সকাল সকাল উঠেছিল ফাইয়াজের হাতে চাবি দেখে বলে সামনে দাড়িয়ে বলল-

–” ভাইয়া তুই এখন এইভাবে এই বেশে বেড় হবি?”

–“এভাবে বেড় হবো নাতো কিভাবে বেড় হবো? লুঙ্গি পরে বেড় হতে হবে আমাকে? জগিং করতে গেলে তো ট্র‍্যাকস‍্যুট পরেই বেড় হতে হয় জানি, অন‍্যকিছু তো পরতে হয় জানতাম না আমি ।”

–” আম্মু তোমার ছেলেকে কিছু বলবা? আমি জিজ্ঞেস করেছি কি? আর সে কি উত্তর দিচ্ছে। আমি কি জানি তুই গাড়ি নিয়ে জগিং করতে যাবি? গাড়ি নিয়ে যে কেউ জগিং করতে যায় আমি তা জানি? এই জন‍্যই তো প্রশ্ন করলাম কোথায় যাচ্ছিস আর কেন যাচ্ছিস। প‍্যাচাঁলি একটা, এর কপালে বউ থাকবে না দেখো মা । তুই দেখিস তোর বউ ও তোর মত হবে,বেয়াদব ছেলে !”
ফাহিমা বেগম অবস্থা বেগতিক দেখে, ডেকে উঠলেন দুজনকে।

–” কি শুরু করেছিস দুজন? ফিহা সকাল সকাল এত কথা বাড়াচ্ছিস কেন? যা নিজের ঘরে যা। আর ফাইয়াজ তুই না কোথায় যাবি যা সেখানে।”

–” হুম যাচ্ছি,

গাড়িটি নিয়ে বিভাদের বাড়ির পিছনের মধুমতি লেক এ চলে এলো। লেকের পাশে গাড়ি পার্কিংয়ের ব‍্যবস্থা থাকায় সেখানকার পার্কি প্লেস এ রেখে সে কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে একটি বেঞ্চে বসে পরল। কিছুটা সময় পার হওয়ার পর দেখল সামনের একজন রমণীকে এখানে খুব দ্রুত হেটে আসতে। সেদিকে তাকিয়ে দেখল খুব স্নিগ্ধ রুপে পৌষের সকালে চাদর জড়িয়ে একরাশ খোলা চুলে একটি রমণী আসছে। পৌষের হালকা কুয়াশায় সুন্দরী রমণীটি তারদিকেই আসছে মনে হয়। ফাইয়াজ নিজের ঘোলাটে চশমাটা তুলে আবার মুছে নিয়ে দেখল সত‍্যিই একটি মেয়ে আসছে এখানে। কুয়াশায় মুড়ানো সকালটা তার কাছে যেন আরও একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ধরল। মেয়েটি সামনে এসে দাড়িয়ে সালাম দিল। ফাইয়াজ যেন হুট করে আছড়ে পরল একদম মাটিতে। জট করে তাকিয়ে দেখে ও মা এত সেই সুন্দরী!

–” দুঃখিত ফাইয়াজ সাহেব, আপনাকে এমন সকাল সকাল এভাবে বিরক্ত করার জন‍্য। আমি চাইনি আপনাকে এভাবে ডেকে আনতে। আপনি হয়তো ভাবছেন ডেকে না এনে মোবাইলেই বলা যেত কথাগুলো, কিন্তু, সত‍্যি বলতে মোবাইলে সব কিছু বলা যেত না। ”

–” হুম হয়তো, আপনি যেহেতু ডেকেছেন বুঝেই ডেকেছেন। যা বলতে চান ইতস্তত না হয়ে বলতে পারুন আমাকে। তার আগে চলুন এক কাপ চা খেয়েনি!”

–” আমি খাবো না, প্লিজ আমার জন‍্য চা না নিলেই ভালো হয়, আপনি নিলে নিতে পারেন।”

–” আচ্ছা চা খেতে হবে না, পান করুন। চা তো আর খাওয়া যায় না সকাল সকাল পান তো করতে পারেন।
এরকম শীতের সকাল আর কত আসবে বলুন? মাঘ আসছে আসছে আবার আপনি সকাল সকাল স্নান করে এসেছেন ঠান্ডা কিন্তু বেশ আছে।”
বিভা ফাইয়াজের রসিকতা মাখা আবদার আর না করতে পারল না। সেখানকার একটি টঙ্গের দোকানে দুজনে মিলে বেঞ্চে বসে পরল।”
দুজনে মিলে দু কাপ চা নিয়ে বসে পরল।
ফাইয়াজ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলল-

–” তা বলুন আপনার সেই কথা, মানে অতিত যার জন‍্য ডেকেছেন আপনি।”

–” আমি কথা খুব একটা বাড়াতে চাই না খুব সংক্ষিপ্তে শেষ করতে চাই। আমার একজনের সঙ্গে আড়াই বছরের সম্পর্ক ছিল। আড়াইটা বছর আমি আর সে, আমরা দুজন চুটিয়ে প্রেম করেছিলাম। দুজনের মধ‍্যাকার সম্পর্কটা ছিল খুব গভীর। একজন অন‍্যজনকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না।
একদিন হুট করে সে বলে উঠল তোমার পরিবার তো আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না বিভা, তখন আমরা কি করব? আমি ও তখন অনেক ভেবে দেখলাম সত‍্যিই তো এই জিনিসটা তো আমি আগে ভাবিনি। খুব তো দুজন মানুষ দুজনকে মন দিয়ে ফেললাম দুজন গভীরে ডুবে গেলাম। এখন এই সম্পর্কের পূর্ণতা নাহলে আমরা ও তো বাচঁতে পারব না। দেখুন কি আবেগ আমার সেই সময়ে আমি ভাবতাম তাকে ছাড়া বাচঁতে পারব না।” ত‍াচ্ছিল‍্যমাখা গলায় বিভা বলতে লাগল।

–” তারপর কি হলো? পালিয়ে বিয়ে করেছেন?”

বিভা সামন‍্য ভ্রু কুচকে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল –

–” হুম পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম, আমাদের একটা ছোট্ট সংসার ছিল। সুখ ও ছিল তবে ক্ষণস্থায়ী!”

–” দীর্ঘস্থায়ী কেন হলো না সেই সুখ?

–” আমার সেই প্রাক্তনের মতে আমি চরিত্রহীন। অন‍্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। আমার ওরসজাত সন্তান নাকি তার নয়!”

–” হুম তারপর তার সঙ্গে বিচ্ছেদ?”

–“হুম,”

–” তাহলে বাচ্চাটি কার কাছে ?”

–” সে নেই,”

চলবে।

#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
পর্বঃ১১

–” আমার সেই প্রাক্তনের মতে আমি চরিত্রহীন। অন‍্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। আমার ওরসজাত সন্তান নাকি তার নয়!”

–” হুম তারপর তার সঙ্গে বিচ্ছেদ?”

–“হুম,”

–” তাহলে বাচ্চাটি কার কাছে ?”

–” সে নেই,”

–” নেই মানে? ঐ বাচ্চাটিকে আপনার কাছে আনলেন না কেন? যেখানে তার বাবাই তাকে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় অস্বীকার করেছে। সেখানে ঐ বাচ্চাটা তার বাবার কাছে ঐ পরিবারের কাছে থেকে বাচঁতে পারবে?”

—” সেই বাচ্চাটাই তো নেই, মাতৃগর্ভেই তার নিশ্বাস শেষ!”
স্তব্ধ হয়ে পরল ফাইয়াজ, কি বলবে সে বুঝতে পারছেনা। চেয়ে আছে সে কোমল মেয়েটির দিকে। ঠোট দুটো তিরতির করে কাপছে মেয়েটির। টুপ করে এই বুঝি গড়িয়ে পরল চোখের কোণায় জমা থাকা জল। ফাইয়াজ মেয়েটির চোখে থাকা সেই জল গুলোকে যদি একটু মুছে দিতে পারতো। এমন চোখে যে জল গড়িয়ে পরা নিষেধ। অধিকার থাকলে হয়তো জলগুলোকে সযত্নে মুছে দিয়ে বলতো –

-‘ভিজে যাওয়া চোখে আপনাকে মানায় না বিভাবতী! আপনার ঐ মারাত্মক দুটো চোখ যে প্রাণখুলে হেসে দেওয়ার চোখ! আপনি তো জানেন না আপনি যখন হাসেন আপনার চোখদুটো ও যে হেসে উঠে। ঐ চোখদুটোও কেমন মিটিমিটি করে হেসে উঠে।ভিষণ ভালো লাগে সেই দুটো চোখকে এমন করে হাসতে দেখলে । এভাবে কাদঁলে যে ভালো লাগে না।’ কিন্তু, কিছুই বলতে পারল না সে চেয়ে থাকা ছাড়া যে কিছুই করার নেই তার এই সময়ে।

তাই চুপকরে মেয়েটির নিরব অশ্রুমাখা চোখ জোড়ায় চেয়ে রইল।
বিভা চোখের পানি মুছে বলল –

–জানেন, ভালোবাসা না বড় কঠিন জিনিস!যাকে একবার এই হৃদয়ে স্থান দিয়ে দিবেন। সে কালো, সুন্দর, সাবলম্বি না গরিব না ধনী এগুলো আপনার মনে কখনও আসবে না। তখন আপনি তাকে প্রাণ ভরে ভালোবাসবেন, ভালোবেসেই যাবেন। আসলে তখন তো আপনার মনে তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আর মুগ্ধতা কাজ করবে। কিন্তু সেই মানুষটা যখন আপনার সেই ভালোবাসার দাম দিবে না তখনই সে হয়ে উঠবে ঘৃণার। ঘৃণাটা হয়তো থাকতো না।

চোখের পানিটা মুছে আবার বলতে লাগল –

“আমি তো তার জন‍্যই সেখান থেকে চলে এলাম। শুধু মাত্র ঐ একটা ডাক একটা শব্দে কেউ আমাকে ডাকুক। সেই ডাক শুনার জন‍্যই তো চলে এলাম এই শহরে দেখুন ভাগ‍্যের কি পরিহাস তাকে আমি রাখতে পারলাম না।
যে সন্তান নিয়ে আমার এতকিছু সেই সন্তানকে কিনা আমার স্বামী মারতে একটি ছক কষেছেন! তবুও আমি কিছু ভাবিনা হয়তো তার মনে আমাকে নিয়ে কোন সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আমাদের সন্তান এলে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু তার উল্টো টাই হলো। শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার প্রাক্তন আমাকে হত‍্যা করার ছক করেছিলেন।

কত কথা যে আমাকে শুনতে হয়েছে তার কাছ থেকে। ও বাড়ি ছেড়ে আসার পর আশ্রিতা হিসেবে ছিলাম, সেখান থেকে বেড় হওয়ার পরেই তো আমার সন্তানকে হারালাম। আমার সন্তানটাকে হারিয়ে যেন আমি উন্মাদ হয়েগিয়েছিলাম জানেন! মনে হতো এই বুঝি সে ডাকছে। খুব করে মা, মা, সুর তুলে ডাকে।
একটা সন্তান যখন গর্ভাবস্থায় মারা যায় তখন যে কত কষ্ট হয় সেই মায়ের আমি আপনাকে বলতে

পারব না। সেই কষ্টের মাঝে একটু সুখের আর ছায়া হয়ে এসেছিল আমার বাবা কিন্তু, তবুও কিছু লোক আমার বাবাকে আর আমার পরিবারকে নিয়ে নানা ধরনের কথা বলতো। কারোর তো আমার সামনেই কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে না বসলেই হতো না। প্রচলিত কথা–“অতি সুন্দরী রমনী -না পায় বর ”
“অতি ঘরণী -না পায় ঘর” আমার দশাটা ও না ঐ একই রকম

–“এত গভীর সম্পর্কে কিভাবে এমন হয়?”

–“গভীর তো হয়েছিল তবে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক হয়ে উঠেনি, তাই হয়তো দেখতে দেখতে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। ”

–” খুব নড়বড়ে ছিল বিশ্বাস, আপনার প্রাক্তনের কথা বলছি। এত নড়বড়ে বিশ্বাস নিয়ে কাউকে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসলে মন প্রাণ উজাড় করে বাসতে হয়।
যদি সেই মানুষটা ধোকা দেয় তাহলে ভাববেন যে সে কখনই জিতেনি। উল্টো সে হেরেগেছে! আপনি ঠকেননি সে ঠকেছে আপনার হৃদয়ের গভীরে যে স্থান ছিল সে হারিয়েছে। এমন গভীর ভালোবাসার জন‍্য তার যোগ‍্যতা নেই। ”

–” হুম হয়তো সেটাই, আপনার এই সুন্দর সকালটা নষ্ট করার জন‍্য আমি দুঃখিত। হয়তো এমন কিছু শুনবেন বা এমন কিছু জানতে হবে তা আপনি আশা করেননি। এটা স্বাভাবিক ব‍্যাপার আপনার জায়গায় অন‍্য কেউ হলেও হয়তো সে ও এমন কিছু আশা করতো না। বা তার ও মন খারাপ হয়েযেত।”
ফাইয়াজ চমকে উঠল বিভার কথা শুনে। বিভার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল বিভা স্বাভাবিক ভাবেই সব বলছে।
ফাইয়াজের হঠাৎ রাগ হলো। এই ধরনের চিন্তা আর মনোভাব কিভাবে একজন মানুষ নিজের মধ‍্যে পোষণ করতে পারে? সবার সঙ্গে তাকে ও মিলিয়ে দিল? ফাইয়াজ চুপচাপ চা টা খেয়ে উঠে দাড়ালো।
বলল-

–” সব মানুষ এক নয়, এই একতার মাপ কাঠিটা অন্তত সবার সঙ্গে মেলাবেন না।”

–” দেখুন এটা আমি এই জন‍্য বলেছি, আমি জানি প্রত‍্যেকটি মানুষ তার জীবনসঙ্গী সমন্ধে সবকিছু জানতে চায় তাই আমি বললাম। ”
ফাইয়াজ বিভার থেকে মুখ সরিয়ে দোকানদারের হাতে চায়ের বিল মিটিয়ে বলল –

মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ কি জানেন?
-সম্মান,লজ্জা, বা চরিত্র!!
তারপর? আর কি হতে পারে? চোখ? নাক? না জিহ্বা?
–“আচ্ছা আমিই বলছি আপনাকে, জিহ্বা! শুনতে অদ্ভুত লাগছে না? জিহ্বা সম্পদ হয়?
হুম হয়,ভেবেদেখুন তো প্রতিনিয়ত আপনাকে প্রায় সবার সাথে কথা বলতে হয়।আপনি কারো সঙ্গে ভালো কথা বলছেন জিহ্বা দিয়েই তো বলছেন!
কাউকে তো আর আঘাত করছেন না।
আপনার প্রতিটা স্বরবর্ন ব‍্যাঞ্জন বর্নই কিন্তু সেই জিহ্বা দিয়ে চালিত হয়।

আর সেই বাক‍্য বা কথা দিয়ে আপনি ছুরির মত কাউকে অনায়াসে আঘাত করতে পারবেন। আর এই মুহূর্তে আপনি আমাকে আঘাত করেছেন ও।
এই যে সবার সঙ্গে আমার তুলনা করলেন আর এটাতো আপনার ছুরির মত জিহ্বা দিয়েই।”
বিভা অবাক হয়ে চেয়ে আছে ফাইয়াজের মুখের দিকে। সে কি তার দুঃখের কথা বলবে সব তার মুখেই আটকেগেছে। এই লোকটা এমন অদ্ভুত কেন? সব জায়গায় তার কড়া কড়া উত্তর। কথা যেন বুলেটের গতিকে ও হার মানাবে। বলতে দেরী তার ঠোটের আগায় কথা ফুটতে দেরী না। বিভার দিকে তাকিয়ে ফাইয়াজ বলে উঠলো –

–” আপনার বাসায় মনে হয় সবাই অপেক্ষায় আছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরুন।”

–” আপনি? ”

–” আমিও যাচ্ছি, একটু জগিং করে বাসায় ফিরতে হবে, কত কাজ আছে।”

–” আপনি কি রেগে আছেন আমার উপর? না মানে আমার মনে হলো আমার কথাগুলো আপনার পছন্দ হয়নি হয়তো। কিন্তু আমি তো ভুল বলিনি!”

–“প্লিজ, বিভা এই নিয়ে আর কথা বলতে আসলে আমি চাইছি না। আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে।”
বিভা বুঝতে পারল ফাইয়াজ ঠিকই রেগেগেছে তার উপর। ফাইয়াজ বিভাকে সঙ্গে নিয়ে হাটতে হাটতে বিভার বাড়ির পাশে নিয়ে এসে বলল -.

–” ভালো থাকবেন, আর ভালো লাগলে কথা বলবেন।”

–” আসুন না বাসায়!”

–” আমি তো আর জামাই নই বলুন হুটকরে কোন এক সকালে বউয়ের বাড়িতে হাটতে হাটতে মন চেয়েছে বলে চলে এলাম। এখন যদি আমি হঠাৎ করে এই সকাল সকাল বাড়িতে যাই। তাহলে আঙ্কেল আন্টি কি ভাববে বলুন তো?
লজ্জায় তো আমারই পরতে হবে। তার চেয়ে বরং কোন বিকেলবেলায় আবার দেখা হবে! বায়!”
ফাইয়াজ কথাগুলো আপন মনে বলতে বলতে চলেগেল। আর বিভা বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলছে লোকটা এই রেগে রেগে কত গুলো কথা বলল। আবার এখন এমন কথা বলেগেল। এমন লোকের পাল্লায় পরলে কপাল খারাপ হয়ে যাবে তার।

চলবে।

#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
পর্বঃ১২

লজ্জায় তো আমারই পরতে হবে। তার চেয়ে বরং কোন বিকেলবেলায় আবার দেখা হবে! বায়!”
ফাইয়াজ কথাগুলো আপন মনে বলতে বলতে চলেগেল। আর বিভা বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলছে লোকটা এই রেগে রেগে কত গুলো কথা বলল। আবার এখন এমন কথা বলেগেল। এমন লোকের পাল্লায় পরলে কপাল খারাপ হয়ে যাবে তার। বাসায় ঢুকতেই মায়ের সামনে পরল বিভা।

–“কিরে সকাল সকাল কোথায় গেলি? কিছুই তো বললি না!”

–” এইতো পার্ক থেকে হেটে এলাম মা।”

–” ও, এইদিকে আয় তো, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে কিছু।”

–” হুম আসছি,
বিভা রুমে চলেগেল। ফ্রেশ হয়ে একবার নিজেকে আয়নায় দেখেনিল আর ভাবতে লাগল -‘ এই তো বেশ ভালোই তো আছি আমি। কই আমার মুখে তো আগের মত ক্লান্তির ছাপ দেখা যায় না। আবার আগের মত সবকিছু ফিরে পেলাম আমি। রঙ্গরুপ, শরীরের মলিন হওয়া সৌন্দর্য। আগের মতই বিলাসবহুল জীবন সবকিছুই পেলাম। কিন্তু, ভালোবাসার মানুষটাকে আর পেলাম না।
আর না পেলাম নিজের হারানো সংসারটাকে, ঠিক যেমন সে হঠাৎ করে না জানিয়ে আমার মনের জায়গা দখল করেছিল। ঠিক,যেমন ভাবে আমায় নিয়ে তার সংসার গড়ার খেলা খেলেছিল, তেমন ভাবেই না জানিয়ে তাড়িয়ে দিল। তাড়িয়ে না দিলেও তো আর কখনো তার খোঁজ ও নিল না। এতটা বছর পেরিয়ে গেল অথচ মানুষটা তাকে একবার ও জিজ্ঞেস করল না কেমন আছো? আমি তো তার কাছে কখনোই ফিরে যাবো না। কখনো না!
বেশ ভালো আছি আমি সেই নরক থেকে এসে, ঐ মানুষটার প্রতি কোন ভালোবাসা আমার মনে নেই।নেই কোন সহানুভূতি! অনেক আগেই তো সব শেষ!

বলা হয়ে থাকে স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা নারীদের অনেক সাহস বেড়ে যায়। মিথ‍্যে নয় একদম সত‍্যি কথা, যে কথাটা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বিভা। প্রতিনিয়ত সে যুদ্ধ করে গেছে সবার সঙ্গে। কম তো করেনি।

বিভা চোখের জলটাকে মুছে দাড়িয়ে পরল। নিচে নেমেই দেখল মা ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পত্রিকা দেখছেন।
বিভা এগিয়ে গেলে তিনি বসতে বললেন। চোখের চশমাটা রেখে বললেন —

–” যা বলার জন‍্য ডেকেছিলাম, গতকাল যে ছেলেটা এসেছে ওর সাথে নাকি তুই একবছর কাজ করেছিস।
মানে যেকদিন সঙ্গে ছিলি তোর কেমন মনে হলো ছেলেটাকে দেখে? কেমন হতে পারে? ছেলেটার কথাবার্তা! চালচলন, কিভাবে সে মানুষের সঙ্গে চলতে পছন্দ করে তা ও তো দেখতে হবে আমাকে।”

–” মা, কথাটা তুমি বলোনি, একজন মানুষের সঙ্গে চললে তার চালচলন কথাবার্তা সবকিছুই বুঝতে পারা যায়। আচ্ছা তুমি তো বাবার সঙ্গে আজ প্রায় ত্রিশ বছর আছো।
অনেক সাধনার পর নাকি আমার জন্ম। এতটা বছর যে আছো তুমি বাবার সম্পর্কে কি জানো? কি জেনেছো?
বাবার কি পছন্দ অপছন্দ সব কিছুই জেনেছো। কিন্তু বাবা সব সময় কি চায় তা জেনেছো? বাবার মনে কি আছে?
বাবার ভিতরে কতটা মানসিক চাপ আছে তা জানতে চেয়েছো? অনেক দিন তো থাকছো তোমরা দুজন।”

–” তোর বাবার সম্পর্কে আর কি জানবো। মানুষটাতো কখনোই আমাকে কোন কথা মুখফুটে বলেনি। আর না কখনো সে আমার চাহিদার কোনক্রুটি রেখেছে।
আর সে কি চায় না চায় আমি বুঝবো কি করে বলা ছাড়া সব হয় নাকি?”

–” তুমি ত্রিশ বছর সংসার করে আজ পর্যন্ত বাবার মনের অবস্থাটা ধরতে পারলে না! আর আমি গুটিকয়েক দিনে একজন মানুষের আচরণ কেমন তা ধরতে পারবো?
আর তাছাড়া মা যে মানুষটাকে আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি । যার সঙ্গে ঘর করেছি তাকেই তো আমি চিন্তে পারিনি। তিনটা বছর তার সঙ্গে ছিলাম, দেখা মানুষটাই তো অচেনা হয়েগেল। আর ওনাকে তো আমি তেমন কখনো পায়নি। হয়তো কোন অনুষ্ঠান, কোন কাজ ছাড়া আমি সেখানে যেতাম না।”

–” তা ও ঠিক, তবে আমার মনে হয় ছেলেটা খারাপ হবে না। এখানে এসেছে সেদিন ওর ফুফিকে নিয়ে। জানিস আমি নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকার আগেই শুনছিলাম ছেলেটা বলছিল -‘বউকে সে এভাবে নিবে না স্ট‍্যাম্প করে নিবে। মায়ের দেখাশুনা করার জন‍্য বিয়ে করছি, অতএব, দেখাশুনাই করবে এর বেশি করলে টুটি চেপে দিব তোমার!আমি তো ভেবেছিলাম কি সাংঘাতিক ছেলে!
বিয়ের আগেই কি কথা ছেলের!”
বিভা ফিক করে হেসে দিল মায়ের কথা শুনে।হেসে বলে উঠল- “উনি এরকমই, কথা বলেন না তবে বললে একদম হাসানোর মত আর নাহয় ধুম ধরিয়ে দেওয়ার মত কথা বলেন।”

” কিন্তু পরে ওর ফুফু ও হাসতে বলতে লাগল -‘বিয়ের আগে এমন ফাজলামো করেনিস। বিয়ের পরে টুটি ছুতেঁ গেলে বউ তোকে ফোনা তুলে না ছোবল মারে। আমি সামনে নাশতার টেবিল নিয়ে যেতেই ওর ফুফু হেসে হেসে বলছিল কথাটা। বুঝতে পারলাম ছেলেটা নিছক বেশ রসিক তবে ভাব এমন যেন একদম গম্ভীর! এমন রসিক আর রাগী রাগী ভাবের কথা বলা মানুষ কিন্তু খুব ভালো হয়। মনে হয় ছেলেটা খুব ভালো হবে। আমার মন বলছে দেখিস, মিলিয়ে নিস! খুব একটা খারাপ হবে না।”

–” তুমি বলছো যখন তখন তো খুব ভালোই হবে।”

–” আমি বললেই ভালো হবে, তুই বললে ভালো হবে না?”

–” আমি দুধ ভেবে চুন খাওয়া মানুষ। বলা যায় না আবার কোন ভুল করে বসি!”
দীর্ঘশ্বাসটাকে দীর্ঘায়িত না করে উঠেগেল বিভা। একটু পরেই তৈরী হয়ে অফিসে যেতে হবে।
______________________________

ফাইয়াজ বাসায় এসে চাবিটা টেবিলের উপর রাখতেই ফাহিমা বেগম এসে বললেন –

–“এত সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিস বললি নাতো।
তুই তো না বলে যাওয়ার মত নস!”

–” ঘুরতে গিয়েছিলাম, কি বলোতো সব সময় একই জায়গায় ঘুরাফেরা করা উচিৎ নয়। তুমি জানোনা হাওয়া বদল করতে হয়। মন খুব ফুরফুরে থাকে।”

—” ফুরফুরের জায়গায় মন এমন মলিন হয়ে আছে কেন?”

–” ফুরফুরে থাকবে কেমন করে জ‍্যাম পরলে কি ভালো লাগে?”

–“কোথায় গিয়েছিস তুই? এত জ‍্যাম পরেছে?”

–” উফফ মা এত প্রশ্ন করো কেন? ফুফু এসেছে ওনাকে একটু আদর সমাদর করো। ইশশ জার্নি করে সেই রাজশাহী থেকে এসেছে। রেস্ট করতেই পারল না, আবার আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরল। এখন ফিহাকে পাঠাও দেখে আসতে ফুফুকে।”
ফাইয়াজ মাকে পাঠিয়ে দিল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন সব প্রশ্নই করে যাবে শেষ হবে না। ফাইয়াজ মাকে বিদায় করে ফোনটা হাতে নিয়ে বসে পরল। বিভার কালরাতের করা কলটির দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সেখানে দুবার কল করে রেখেদিল। হয়তো বিভা বিরক্ত হতে পারে বেশি কল করলে। মেয়েটির জন‍্য তার খুব খারাপ লাগছে বারবার তার বলা একটি কথা যেন তার মাথায় গেথে গেছে। বিভা উঠে আসার আগে বলেছিল –

–“ঘর পোড়া গরু সিদূঁরে মেঘ দেখলে ডরায়! আমার হয়েছে সেই দশা! বাংলার এইসব প্রাবাদ বাক‍্য এখন আমার মাঝেই সোভা পায়। এই যে আজ যত মানুষ আমার জীবনে আসছে বা ভবিষ্যতে আসবে কিন্তু,আমি হয়তো তাদের আপন করে নিতে পারব না। আপন করে নেওয়ার মত পরিস্থিতে অন্তত আমি নেই!”

সত‍্যিই তো মেয়েটার কথাগুলো মন্দ নয়। এমন কিছু ঘটলে যেকোন মানুষই দ্বিতীয়বার এই সমস‍্যায় পরতে চাইবে না।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here