#বিভাবতীর_জীবন
#পর্বঃ১৯ ও অন্তিম
#লেখিকাঃতামান্না
–” না তেমন কিছু নয়, এক কাপ চা শুধু আপনার জন্য!
সেদিন আপনি তো নিজ হাতে চা বানিয়ে আমাকে দেননি তাই আজ নিজেই আপনার জন্য বানিয়ে নিয়ে এলাম।”
খানিকটা ভ্রু কুচকে তাকালো বিভা।তারপর নিজেই হেসে দিয়ে বলল –
–” আপনি চা নিয়ে আসেননি?”
–” হুম এনেছি তো,”
নিজের হাতে থাকা চায়ের কাপটা দেখিয়ে দিল বিভাকে ফাইয়াজ। বিভা চায়ের কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দিল।
বেশ ভালো হয়েছে চা টা। বিভা ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,’ খুব ভালো হয়েছে চা টা। ‘
–” দেখতে হবে না কে বানিয়েছে!”
–” হুম, সত্যিই অসাধারণ হয়েছে। তা এত ভালো চা কিভাবে বানানো শিখেছেন?”
–” আমি রাতে পড়তাম বেশিরভাগ সময়। শব্দ দূষণ আমার বরাবরই অপছন্দ। তাই রাত জেগে পড়তাম আর মাঝে মাঝে চা বানিয়ে খেতাম। স্বভাব যেহেতু রাত জাগার তাই নিজেই উঠে চা বানিয়ে নিতাম। তাই মায়ের কাছ থেকে শিখে নিলাম চা বানানো।”
দুজনে মিলে চা পান করতে করতে কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল তাদের।
কথার ফাকে ফাকে বিভা ফাইয়াজের দিকে একটা জিনিস খুব ভালো ভাবে লক্ষ করল। সবুজ কথা বলার শুধুই সবুজই একটানা নিজের কথাগুলো বলেযেত। আর বিভা তা মন দিয়ে শুনেযেত কিন্তু বলার আর পথ পেত না। কারন সবুজ তাকে বলতে দিলেও পুরোপুরি তার বলা হতো না। সবুজের চোখের দিকে তাকিয়ে সবুজকে প্রাণভরে সে দেখে যেত আর সবুজের কথাগুলো সে প্রতিটা মুহুর্ত অনুভব করেযেত। কিন্তু সবুজ কি কখনও তাকে এইভাবে অনুভব করেছিল? না তাকে প্রাণভরে উজাড় করে ভালোবেসেছিল? উহুম সবুজ তার সরলতা নিয়ে তাকে বিরাট বড় বাণ মেরেছিল! বাণ প্রেমের বাণ!
প্রেমের আর ভালোবাসার বাণ যে বিষের মত সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কত রাত কত দিন সে এভাবে কেদেঁ কেদেঁ কাটিয়েছে কিন্তু মানুষটার দেখা তার মেলেনি।
বহুবিয়ের ঘরই তো এসেছে তার জন্য কিন্তু সে তো দ্বিতীয়বার বিয়ের চিন্তা করতেই পারেনি। আর সবুজ তারর চলে আসার পরপরই নতুন সংসার পেতেছে।
সমুদ্রের ঢেউগুলো খেলে বেরাচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর ঢেউয়ের তালে তালে কপোত-কপোতিদের হাতে হাত রেখে একসাথে চলা।
বিভা আনমনে তা দেখে হেসে উঠল। আর বলে উঠল –
–” মানুষে মানুষে কত পার্থক্য? কত তফাৎ?”
–” তা তো হবেই,”
বিভা ফাইয়াজের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ বলা নেই কয়া নেই লোকটির সঙ্গে সে জড়িয়ে যাবে তা ও সে ভাবেনি কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তাই ঘটেগেল! সময়ের পরিক্রমায় সব কিছু বদলে যায় সম্পর্ক টান ভালোবাসা।
মানুষ ও বদলায়! আবার ঝড়ের বেগে বদলে যেতে পারে পাশে দাড়ানো মানুষটির স্থান।
“জীবনের প্রতিটা পদে পদে সুখের ছোঁয়ায় ভেসে যাওয়া যায়। যদি সেই সুখ নিজের ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে থাকা যায়। টাকা দিয়ে তো আর মনের বা আত্মার সুখ পাওয়া যায় না। যে সুখ হয় সে সুখ চোখের সুখ! মনের ভিতর তো পরে থাকে মনের বিরাট অসুখ!”
________________________
প্রচন্ড হইহুল্লড় মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে প্রায় টানা পাচঁদিন কাটিয়ে এসেছে সবাই। নিজেদের কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পর এই পর্যন্ত প্রায় বিশদিন দেখা হয়নি বিভা বা ফাইয়াজের। মুঠোফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়েছে কিছুটা আলাপ, হয়তো প্রেম ঘটিত আলাপচারিতা হলে হয়েযেত প্রেমালাপ কিন্তু, তেমন কিছুই হয়নি। যা হয়েছে তা সম্পূর্ন নিজেদের পারিবারিক আলোচনা। বিভার সঙ্গে কক্সবাজার থেকে আসার পর ফাইয়াজ একদিন বলেছিল তার মাকে বিভার সমন্ধে। ভদ্রমহিলা বিভার প্রশংসা শুনে যেমন পঞ্চমুখ হয়েছিলেন তেমনি তিনি একবার দেখতে ও চেয়েছিলেন বিভাকে। ফাইয়াজের মোবাইল থেকে তিনি বিভার ছবি দেখেছেন দারুণ সুন্দরী মেয়ে। দেখেই খুব সহজে বুঝতে পেরেছেন বিভার পরিবার আর ফেমেলী কালচার কেমন। চেহারার মাঝে ফুটে উঠে আভিজাত্য আর মাধুর্য্য! অভিজাত পরিবার দেখেই ছেলের দিকে কিছুটা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন হয়তো ভাবতে পারেননি ছেলে তার সত্যিই বিয়ের উপযুক্ত হয়েগেছে, তা সে এতদিন না বুঝতে দিলেও এখন নিজেই নিজের উপযুক্ত পাত্রী ঠিক করে ফেলেছে। ফাইয়াজ সেদিন সব বলেছিল তার মাকে এ নিয়ে তিনি একটু মন খারাপ করেননি বরং খুশি হয়েছেন মেয়েটা তার আবেগের বয়সে একটা ভুল করেছিল এখন যদি সে ভালো হয় তাহলে তিনি কেন তাকে দূরে ঠেলে দিবেন? তিনি বিভার পরিবারের সঙ্গে দেখার করার জন্য ফাইয়াজের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন কখন তিনি সেখানে যাবেন। আর এই সমস্ত কিছু বিভা ফাইয়াজের কাছ থেকেই জেনেছিল।
বিভা ইতিমধ্যে বুঝেগিয়েছে ফাইয়াজ অনেকটা খোলা মনের মানুষ, এই যে বাসায় কি আলোচনা হলো না হলো সে আবার সবকিছু বিভাকে বলেদিল। কোন সংকোচ ছেলেটার মাঝে নেই। একদম যেন সাদা মনের মানুষ!
যায় এপিঠ- ওপিঠ সবই রঙ্গ এক। তুলনাহীন মানুষ সে যার মনে নেই একরত্বি সংশয়। খুব সহজে সে সবকিছু সমাধান করে ফেলতে পারে।
________________________________
এখন জুনমাস ক্লোজিং এর সময়। যতসব হিসেব সমাধান আর অফিসিয়াল কাজের চাপ যাচ্ছে বিভার উপর দিয়ে।
ব্যংকের কাগজপত্রগুলো খুব যন্ত্রণাদায়ক! একটা থেকে একটা কাগজ হারালে তা খুজেঁ পেতে যে কি কষ্ট হয় তা বলার বাইরে। বিভার অফিস প্রায় সাড়ে চারটা নাগাদ থাকে তারপর সব ক্লোজ! কিন্তু এখন জুনমাস বলে কিছুটা চাপ তাই আজ একটু দেরী করে বের হয়েছে সে।
অফিস থেকে বের হয়েই গাড়িতে উঠেছে। বেয়ে পরা ঘাম টাকে মুছে নিল টিস্যু দিয়ে। ড্রাইভার গাড়ি চালাতেই বিভা সীটে হেলান দিয়ে বসল। প্রচন্ড রকম ধকল যাচ্ছে আজ কদিন তার। এইতো কয়েকদিন পরই হয়তো বিভার ঘটা করে বিয়ে হবে। শুধু অফিসিয়াল ঝামেলা আর ফাইয়াজের একটা কোর্সের জন্য ডেটটা দেরী করে ফেলা হয়েছে।
কিছুক্ষণ বসতেই বিভা বিরক্ত হয়েগেল
জ্যামজটের রাস্তায় স্বস্তি কোথায়?গাড়ীর জানালা খুলে টেনে দিতেই হঠাৎ চোখ পরল সামনের জ্যামে আটকে পরা বাসে সবুজ বসে আছে। এতটা সামনে তার! শেষ কবে দেখা হয়েছিল আর কবেই বা দেখা হবে ভাবতে পারেনি বিভা। অথচ, আজ কিনা দেখাই হয়েগেল বিভার আর তার । বিভা সবুজকে দেখে নিজের চোখ জোড়া সরিয়ে নিল। কিন্তু সবুজ পারল না সবুজের চোখ স্থির হয়ে এখানেই রয়েছে! অনেক কিছু আছে চোখের ভাষায়!
অসহায় চোখ জোড়ায় মলিন মুখে তাকিয়ে থাকা সবুজকে দেখে বিভা অন্যদিকে ফিরে রইল। করুণ আর অসহায় অবস্থায় তো সে ও সবুজের কাছে হাত পেতেছিল! হয়নি তো কোন মায়ময় দৃষ্টির সৃষ্টি তখন।
বুক চিরে বেড়িয়ে আসল দীর্ঘ এক শ্বাস!
ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল –
–” একটা গান ছেড়েদেন আসাদ ভাই, জ্যামটা মগবাজারের রাস্তার জ্যাম,এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে না।”
রেডিও চালাতেই বেজে উঠল চিরচেনা গান।
ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে,
তোমার দেখা আমার সঙ্গে।
মুখোমুখি আমরা দুজন,
মাঝখানে অনেক বারণ। [x2]
ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে,
তোমার দেখা আমার সঙ্গে।
বাইরে তখন হাওয়া ঝোড়ো,
তুমি হয়তো অন্য কারো। [x2]
আরও একবার বলবো সেদিন
আরও একবার বলবো সেদিন,
আজ জানেকি জীদ না করো।।
ধরো যদি চেনা গন্ধে,
মেতে উঠি চেনা ছন্দে।
যদি ছুঁতে চাই আবারও,
জানি ছোঁয়া তবু বারণ।…………
বিভা গানটা শুনছে আর হজম করছে ভিতরে থাকা চাপা কষ্টটাকে। বারণ জিনিসটার কারণ ও অনেক হয়!
হয়তো কোন আঘাত ছাড়া একটা জিনিস থেকে দুটো খন্ড হয় না। নিজের ভিজে যাওয়া চোখটাকে মুছে নিল বিভা। রাস্তার জ্যাম এখন নেই। পুরো রাস্তাই ফাকা। এটাই মনে হয় নিয়ম একই পথে দেখা হবে প্রতারকের সাথে। কিন্তু তাকে ধরে বলা যাবে না কেন এলে আমার জীবনে?
কেন শেষ করলে? বা ছুয়েঁ কখনও বলা যাবে এর দায় কার? সবই তো শেষ। সে তখন হয়ে যায় অন্যকারো বলা হয়না অনেক কথা। বলা হয় না হৃদয়ের ব্যাথা।
বাসায় ফিরে সোজা নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগপত্র ছুড়ে ফেলে ওয়াশরুমে দৌড়ে গিয়ে মাথায় ইচ্ছে মত পানি ঢালতে লাগল বিভা। তপ্ত হৃদয় থেকে এখন প্রচন্ড রকম মাথা যন্ত্রণার কারন হয়েছে। বেশ খানিকটা পানি ঢেলে বের হয়ে বেডে বসে পরল বিভা। চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে নিল আস্তে আস্তে। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই ফাইয়াজের ফোনে কল করল সে। রিং হওয়ার পরপরই ফাইয়াজ ফোন ধরল। বিভা ক্লান্ত গলায় বলে উঠল –
—” আমাকে আজকে বিয়ে করতে পারবেন?”
–” আজকে কেন এখন বললেও করব।”
–” সত্যিই তাই করতে হলে করব।”
–” তাহলে আন্টিকে নিয়ে আসুন আজ।”
–” আচ্ছা ঠিক আছে, তবে কিছু হয়েছে?”
–” আপনি আসবেন?”
-” অবশ্যই,”
_________________________________
মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ফাইয়াজ ও তার পরিবার থেকে মা, বোন, চাচা এসেছে বিভার বাড়িতে। শুরুর দিকে বিভার বাবা-মা ভেবেছিলেন এমনি হয়তো মেয়ে দেখে চলে যাবেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা যে মেয়ে আজই নিয়ে যাবেন তা আর বুঝতে পারেননি। কাজি সাহেব এসে বিয়ের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। দুজনকে দুপাশে বসিয়ে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে ঘরে বসেই বিবাহ সম্পন্ন করা হয়েগেছে। কবুল বলার সময় বিভা কেদেঁছিল অনেক। এই কান্নাটা তার ভিতরকার একটা ভয় আর ভীতির কান্না। কেউ না জানুক বিভা ঠিকই জানে এই বিয়েটা সে শুধুমাত্র নিজের বিষাক্ত স্মৃতি আর প্রাক্তনের উপর একরাশ ঘৃণা নিয়েই করছে। কিন্তু এর চরম পরিস্থিতির স্বীকার ফাইয়াজ হবে। কারন মনের একাংশে এখনও পুরোরো স্মৃতির বাস। সেই স্মৃতিটাকে শেষ করতেই তো আরেকজনকে কাছে টেনে আনার আশ্বাস!
পুরোটা সময় সে কিছুই বলেনি। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর দুজনকে যখন এক ঘরে বসিয়ে দেওয়া হলো। ফাইয়াজ বলে উঠল —
” এমন করলে কেন?”
–” কি?”
–” এই যে হঠাৎ বিয়ে?”
–” একটু শান্তির জন্য, দিতে পারবেন একটু শান্তি? পারবেন সব ভুলিয়ে দিতে? পারবেন একটু কাছে টেনে নিতে।” ফাইয়াজ বিভার সামনের সোফায় গিয়ে তার হাত ধরে বলল –
–” একটু শান্তি নয় হাজার বছর পাশে থাকবো।
শুধু একটু বিশ্বাস রাখবেন। ভালোবাসতে হবে না কাছে থাকলেই হবে। অতিরিক্ত ভালোবাসবেন না আমাকে।
ভালোবাসলে হারাতে হয়। শুধু একটু বিশ্বাস রাখবেন।
বিভা ফাইয়াজের বুকে জাপিয়ে পরল। কাদঁতে লাগল বুকের মাঝে মাথা দিয়ে। এতক্ষণের কান্নাগুলো এখন শব্দ করে হচ্ছে। ফাইয়াজ বিভাকে শান্ত করতে ব্যাস্ত হচ্ছে।
সে জানে এই কান্নায় আছে অনেক রহস্য! থাক রহস্য হয়েই থাক এই কান্না। সব রহস্যের সমাধান করা যায় না।
কেদেঁই যদি সব ভুলা যায় তাহলে কাদুঁক। আজ থেকে তার নতুন জীবনের শুরু। পুরোনো সবকিছু না হয় ভুলে যাক সে।
দূরের আকাশে পূর্ণিমার চাদঁ উঠেছে। তার আলোর ছটা কিছুটা ঘরের মধ্যে এসে পরেছে। অন্ধকার রুমে বুকে নিয়ে এখনও বসে আছে ফাইয়াজ বিভাকে। এখনও বিভা তার বুকেই ঘুমায়। সময় পেরিয়ে বিশ বছর! সন্তানদের সামলিয়ে সবকিছুকে ভুলে এখনও বিভা ঠিক একই ভাবে ফাইয়াজের বুকে ঘুমায়। ফাইয়াজ এখনও তাকে ঠিক সেইভাবেই বুকে ঠাই দেয় ঠিক যেমন করে সে বিয়ের প্রথম রাতে দিয়েছিল। আর বিভাবতী তার বুক ভিজিয়েছিল। মধ্যবয়স্ক ফাইয়াজ বিভার মাথাটা টিপে দিচ্ছে হাত দিয়ে মাঝে মাঝে আর চাদেঁর আলোয় বিভাকে প্রাণভরে দেখছে।
সমাপ্ত!