আমার বর,পর্ব:০৪
লেখা : মিশু মনি
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি তন্ময়ের ঘুমন্ত মুখ।খুব পবিত্র আর মিষ্টি লাগছে দেখতে!
বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
উঠে নামায পড়ে কাজ শুরু করে দিলাম। মা বাবা কাল চলে যাবেন। সবকিছু ঠিক ঠাক মত গুছিয়ে দিতে হবে।
সারাদিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কাটল।তন্ময়ের সাথে তেমন কথা হয়নি।
বিকেলে কাজ শেষ করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। তন্ময় এসে বলল,সব কাজ কমপ্লিট?
– হুম।
– আমি একটু বাইরে যাবো। ফ্রেন্ডরা ডাকছে।
– আচ্ছা যান।
– জান! আমি তোমার জান?
– উহহু।কথা পেচান কেন? আপনাকে যেতে বলেছি।জান বলতে আমার বয়েই গেছে।
– ওকে যাচ্ছি।আজ কোনটা শার্ট পড়ব?
– গু কালার টা পড়ে যান।
– এত রেগে আছো কেন?
– কই নাতো। যেটা পরেছেন, সেটা পড়েই যান।কাল আমার আব্বু আম্মু আসবে মা বাবাকে বিদায় দিতে।আমি ওদের সাথে বাসায় চলে যাবো।
– যেও।নিয়মানুযায়ী আমাকেও তোমার সাথে যেতে হয়।কিন্তু আমার এসব ফর্মালিটি একদম ই ভাল্লাগেনা।তাছাড়া আমি মেয়বি পরশু থেকে ডিউটিতে যাবো। তুমি একাই বাড়ি যেও।
– আচ্ছা।
তন্ময় বেড়িয়ে গেল।
বিশাল বাড়িটাকে খুব শুন্য শুন্য লাগছে।
.
তন্ময় বাসায় ফেরার পর থেকেই বেলকুনিতে বসে আছে।অনেক্ষন ধরে ফোনে কথা বলল।তারপর থেকে মনটা খুব খারাপ মনে হচ্ছে।হয়ত ওর গার্ল ফ্রেন্ড এর সাথে ঝগড়া হয়েছে।
আমি চুপচাপ দূর থেকে দেখছি।কাছে যেতে সাহস পাচ্ছি না।
.
গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি।হঠাত বুঝতে পারলাম তন্ময় আমার দুই পা জরিয়ে ধরে বসে আছে।আমি এক লাফে উঠে বসলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, পা ধরে বসে আছেন কেন?
– মা গো, তোমার পায়ের নিচে আমার বেহেশত।
– কিহ! কি বলছেন এসব?
– ফান্দে পইড়া কাইন্দা বলি এখন কি করি,ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাচি তোর পায়ে ধরি….
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম,মাথা ঠিক আছে? আমি আপনার বউ।
কয়েকবার বউ শব্দটা উচ্চারণ করে গান গাইতে শুরু করল,-
“প্রেম পিরিতি ভাল্লাগেনা, দিয়া দিছি দাড়ি, ফটকামিতে ব্যস্ত আমি আজাইরা কাম ছাড়ি… ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে..
ওর গান শুনে আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম।
বললাম,খুব অন্যায় করে ফেলেছেন। আমি আপনার বউ।আর আপনি এসে কি উলটা পাল্টা কথা বলছিলেন।
তন্ময় আমার কোলে মাথা রেখে বলল,বউ মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।
আমি ওর আচরনে অবাক হয়ে যাচ্ছি।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,কি হইছে আপনার?
তন্ময়ের চোখ ভয়ংকর দেখাচ্ছে।চুল গুলা এলোমেলো হয়ে আছে।মায়া লাগছে দেখলে।কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে।এত কাছ থেকে কখনো ওকে দেখিনি।মাথা টা সামান্য নিচু করতেই আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না।প্রচণ্ড পরিমানে রেগে গেলাম।খুব বিশ্রী গন্ধ লাগছে।ও নিশ্চয়ই মদ টদ নয়ত নেশাকর কিছু খেয়ে এসেছে।এ জন্যই পাগলামি করছে!
রেগে বললাম,আপনি ড্রাগ নিয়েছেন?
– ড্রাগ কি গো?
– ড্রাগ কি তাইনা? মদ খেয়েছেন না অন্যকিছু? কি খেয়ে এসেছেন বলুন?
– খেয়ে আসিনি তো। এসে খেয়েছি।
আমার রাগ আরও বেড়ে গেল।বললাম,কি খেয়েছেন?
– খাই নাই কিচ্ছু খাই নাই।খাবো।
– খাবো মানে?
তন্ময় আবারো গান শুরু করল,গাজা খাবো আটি আটি.. মদ খাবো বাটি বাটি…
আমি আর রাগ সামলাতে পারছিনা।তন্ময় এসব কি শুরু করেছে! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।
ও বলল,মিফতা…
– হুম।
– খাবা? অল্প একটু পেটে পড়লে জগত সুন্দর হয়ে যাবে!
– চুপ করুন।আমার কোলে মাথা রাখবেন না।উঠুন। আমি মা বাবাকে ডাকব।
তন্ময় উঠে গিয়ে আলমারি খুলে একটা বোতল বের করে ঢকঢক করে গিলল।আমি একদম নিশ্চুপ।
.
আমি কি করব বুঝতে পারছিনা।তন্ময়ের পাগলামি বেড়েই চলেছে।এমনসব পচা গান গাওয়া শুরু করেছে যা অসহ্য লাগছে।
চুপচাপ দেখতে লাগলাম।
তন্ময় এসে আমার পাশে বসল।বলল,জানো মিফতা,আমি ছোট থেকেই ঘুমালে স্বপ্ন দেখতাম একঝাক পরি আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।রোজই নিয়ে যেত।কিন্তু ওরা সবাই আমাকে বিয়ে করতে চাইত।এ জন্য ওই স্বপ্ন আর দেখিনা।
আমি হেসে উঠলাম।ওর এই অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনতে ভালই লাগছে!
তন্ময় বলল,আমার না খুব বাথরুম পেয়েছে।বাথরুম করবো।
– বাথরুমে যান।
– নাহ।এখানেই বাথরুম সারব।
– কিহ!
আমার চোখ কপালে উঠে গেল।ও বলল,ছোটবেলায় তো রুমেই করতাম। আম্মু পরিষ্কার করত।এখন তুমি আমার সহধর্মিণী, আমার সেবাকারী,এখন তুমি পরিষ্কার করবা।
– আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন? – তোমরা সবাই আমাকে পাগল বলছ? আমার জিএফ ও আমাকে আজ পাগল বলেছে।কিন্তু আমিতো পাগল নই।
-আপনি পাগল নন।আপনি সুন্দর একটা মানুষ।এখন বাথরুম এ যান।এসে ঘুমান।সব ঠিক হয়ে যাবে।
– উহুম।বলছিনা এখানেই করবো।
কি জ্বালায় পড়লাম রে বাবাহ! কাঁদবো না রাগ করবো বুঝতে পারছিনা।তন্ময় এমনভাবে কথা বলছে যেন ও সত্যিই এখানে….. উফফ ভাবতে পারছিনা।কি করি আমি?
.
আমার মাথা দিয়ে ওর মাথায় জোরে আঘাত করলাম। ও মাথাটা জোরে ঝাকিয়ে বলল,গরু গরু খেলছো?
– চুপ করুন।আমার দিকে তাকান।
ও আমার দিকে একদৃস্টে তাকিয়ে রইল।তারপর আস্তে আস্তে ওকে বুঝিয়ে বললাম।ও একটু বুঝল।কিন্তু হাত ধরে আমাকেই বাথরুম এ রেখে আসতে হলো।
.
তন্ময় এসে উদ্ভট সব কথাবার্তা বলছে আর গান গাইছে।আমাকে বারকয়েক মা মা বলে ডাকছিল।রাগ দেখাতেই বউ বউ বলে ডাকতে আরম্ভ করে দিয়েছে।
ওর আচরনে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।কি যে করব বুঝতে পারছিনা।ওকে বুঝানো ও যাচ্ছেনা,থামানো ও যাচ্ছেনা।মা বাবার ঘর কয়েকটা ঘর পড়ে। ওদের ঘর অব্দি কথা পৌছাবে না।কিন্তু যদি কোনোক্রমে তারা তন্ময়ের গান শুনে ফেলে,ব্যাপার টা খারাপ হবে।উনারা কাল চলে যাবেন, এই অবস্থায় কিছুতেই তাদেরকে এই ব্যাপার টা বুঝতে দেয়া যাবেনা।
.
কিন্তু কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা।তন্ময় আজেবাজে কথা বলছে।পরিস্থিতি সামলাবো কিভাবে?
.
তন্ময় অনেক আজগুবি কথাবার্তা বলা শুরু করেছে।ওকে ঘুমানোর কথা বলতেই ও বলল,তুমি আমার বউ?
– হুম বউ।আমার কথা শুনো, ঘুমাও এখন।তুমি কি বুঝতে পারছ,পুরোপুরি নেশা হয়ে গেছে তোমার।
তন্ময় কোনো কথা না বলে মেঝেতে বসে পড়ল। ওর চোখে পানি।বলল,আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মিফতা।খুব কষ্ট হচ্ছে।আর পারছিনা।সবাই মিলে আমাকে মেরে ফেলছে।মিমি আমাকে খুব বাজে কথা বলেছে।আমাকে খুব অপমান করেছে।আমি ওকে ভুলে যেতে চাই মিফতা।
– আমি আছি তো।সব ঠিক করে দিবো।কাদবা না তো, ছেলেরা কখনো কাদেনা।
– মিফতা,খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি তোমাকেও ঠকাচ্ছি তাইনা?
তন্ময় কেমন যেন অসহায়ের মত তাকাচ্ছে।ও একটু মানসিক শান্তি চাইছে। কিন্তু আমিই বা কি করতে পারি?
.
টেনশন হচ্ছিল।কি করব বুঝে উঠতে না পেরে বোতল টা হাতে নিলাম।নাকের কাছে নিতেই কেমন একটা গন্ধ লাগল।কিছু না ভেবেই একটু খেয়ে নিলাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। কেমন যেন লাগতে শুরু করল।আরও একটু খেলাম।এবার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।অনেক কষ্টে আরেকটু গলায় ঢাললাম।এবার বুঝতে পারছি নেশা ধরে আসছে।পা টলছে,দারিয়ে থাকতে পারছিনা।
বিছানায় বসে পড়লাম। আমি জানি আমার সামনে তন্ময়। কিন্তু তন্ময়কে যেন চিনতে পারছিনা।অচেনা অচেনা লাগছে।হাত বারিয়ে ধরার চেষ্টা করেও ধরতে পারলাম না।
ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করল।সব কিছুই ভালো লাগছে।মন থেকে সকল চিন্তা দূর হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।নতুন একটা জগতে প্রবেশ করলাম। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে।
অনেক কিছুই বলতে চাচ্ছি কিন্তু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।তন্ময় কে কি বললাম নিজেই জানিনা।ও আমাকে জরিয়ে ধরল শক্ত করে।
.
ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ সময় লাগল স্বাভাবিক হতে।একে একে রাতের সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।হাসি পাচ্ছে আর লজ্জায় লাল হয়ে উঠলাম।
.
আব্বু আম্মু আসলে সবার সাথে অনেক ভালো সময় কাটালাম।তন্ময় আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।আমি লজ্জায় মাথা নিচু করলাম।
.
মা বাবা চলে গেলেন।
আমি বাসায় আসার সময় তন্ময়ের দিকে অনেক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম হয়ত কিছু বলবে।কিন্তু ওর মনটা অনেক খারাপ। হয়ত মা বাবা চলে যাওয়ার কারনে।আমার সাথে শেষ মুহুর্তে কোনো কথাই বলল না।আমি বাসায় চলে আসলাম।
(চলবে…..)