“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
আয়ান চলে গেলে কাইয়ুম সাহেব খাওয়ার জন্য প্লেট সামনে নিলেন। এবার শান্তিমত খাওয়া যায়। মারিয়া রহিমাকে ডেকে প্লেট ধরিয়ে দিলেন। রহিমার জন্য আলাদা প্লেট রাখা আছে এখানে। সকালে সে এ বাড়িতে খায়৷ দুপুরে হক মঞ্জিলে আর রাতে নিজ আশ্রমে। রহিমা খাবারের প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেলো। সাথে একটা কাচা মরিচ নিয়ে মেঝেতে বসে খাবার খেয়ে নিলো।
রহিমা বাড়ির অন্যান্য কাজকর্ম শেষ করে মাছ কাটতে বসলো। কেটেকুটে পরিষ্কার করে ফ্রিজে তুলে রাখলো৷ অত:পর বসে আছে, দুপুরে তাদের খাওয়া হলে থালাবাটি ধুয়ে তারপর হক মঞ্জিলে যাবে। তাকে বসে থাকতে দেখে মারিয়া বললো,
“কাজকর্ম তো শেষই। চলে যা তুই। লাঞ্চের পর দুজন মানুষের প্লেট আমিই ধুয়ে রাখতে পারবো। এখন তো আর রান্না করিনি যে হাড়িপাতিল মাজতে হবে!”
“চলে যাবো?”
“হ্যাঁ, যা।”
“পরে কিন্তু আবার বলতে পারবেন না আমি কাজে ফাঁকি দিয়া দুইটার আগেই চলে গেছি!”
“বড্ড বেশি কথা বলিস! গেলে যা, না গেলে বসে থাক।”
“হুহ্! থাক, যাইগা।”
“এই, যাইগা কি শব্দ?”
“সরি, আম্মা৷ চলে যাই। আসসালামু আলাইকুম।”
মারিয়া সালামের জবাব দিয়ে বলে দিলো সাবধানে যেতে। রহিমা চলে গেলো। ভরদুপুরে হাটতে লাগলো হক মঞ্জিলের দিকে। মাঝপথে গলা শুকিয়ে গেছে। রাস্তার ধারে শরবত বিক্রি করছে। রহিমা তার গলাকে দোষারোপ করলো কারণ তার ধারণা লেবুর শরবত দেখে তার গলা শুকিয়ে গেছে! তাই মনে মনে বললো,
“মরার গলা! শরবত দেখলেই তোর চুলকানি উঠে! এতো খরচ করাস ক্যা!”
বলতে বলতে সে ভ্যানের কাছে এসে দাড়িয়ে বললো,
“এক গ্লাস লেবুর শরবত দেন তো।”
কথাটা বলে নিজেই গ্লাস হাতে নিয়ে ভালো পানিতে ধুয়ে এগিয়ে দিলো। তা দেখে বিক্রেতা গ্লাস হাতে নিয়ে বললো,
“হুহ্! চেহারার নাই ছুড়ুত, আবার আইছে পরিষ্কারগিরি দেখাইতে!”
রহিমা ক্ষেপে গিয়ে বললো,
“ওই মিয়া! আপনারে আমার চেহারা দেখতে কইছি, না শরবত দিতে কইছি! যান মিয়া বাজে লোক! আপনার শরবত খাইতাম না!”
রহিমা হনহন করে চলে গেলো। বিক্রেতা পেছন থেকে ডাকছে কারণ শরবত গ্লাসে নিয়ে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু রহিমা পেছনে ফিরে তাকালোই না। বিক্রেতা হয়তো গালি দিচ্ছে তাকে। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে সামনের ভ্যান থেকে শরবত কিনে খেলো। অত:পর হাটতে লাগলো। হক মঞ্জিলে তিন তলায় এসে ফ্ল্যাটের সামনে দাড়ালো সে। কলিং বেল বাজানোর পরপরই দরজা খুলে দিলো সায়মা। ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে সালাম দিলো রহিমা। সায়মাও হাসিমুখেই জবাব দিয়ে বললো,
“আজ তুই এতো তারাতাড়ি! আড়াইটা তো বাজেনি! আরও চল্লিশ মিনিটের মতো বাকি।”
“ওইবাড়িতে কাজ তারাতাড়ি শেষ হইছে, আপা। আসার অনুমতি পাইছি তাই তারাতাড়ি চইলা আইছি।”
“তোকে না বলেছি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে!”
“বলি ই তো।”
“এটা কেমন বলা! কখনো শুদ্ধ আবার কখনো অশুদ্ধ! এমন হলে চলবে না।”
“ভুলে যাই, আমার কি দোষ।”
“ভুলে যাওয়াটাই তোর দোষ। ভেতরে আয়।”
“একটু জিরিয়ে নেই।”
“জিরিয়ে নিতে হবে না। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নে। তারপর ফ্যানের নিচে বসে থাক।”
রহিমা ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। সায়মা বললো,
“তুই তারাতাড়ি আসায় আমার ভালোই হয়েছে। একটু বাইরে যাবো তোকে নিয়ে।”
“শপিং করতে যাইবেন?”
“না, বুক শপে যাবো। কিছু বই আর খাতাপত্র কেনা প্রয়োজন।”
“ওহ্, আইচ্ছা। আমি তারাতাড়ি কাজ সাইরা নেই।”
“তোর করার মতো কাজ তেমন কিছুই নেই আজ। আমি ঘর মুছে দিয়েছি। তুই শুধু খাওয়াদাওয়ার পর প্লেটগুলো মেজে রাখিস। আর সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে পারলে মায়ের রান্নার কাজে একটু হেল্প করিস। আর সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট বিষয় তোর এই এলোমেলো ভাষা ঠিক করবি।”
“এহ! আপনারা না কেমন জানি করেন আমার লগে। ওইবাড়িতে এক আম্মা আর গোলাপি ভাবি! আর এই বাড়িতে এক আম্মা আর আপনি! চারজন মিল্লা যেন একটা স্কুল দিয়া বসছেন! আমি একলা ছাত্রী আর আপনারা চারজন শিক্ষক! আমার লগে আর লাগে কেডা! শুদ্ধ ভাষা শিখতে শিখতে ভাষামন্ত্রী হইয়া যামু!”
“গোলাপি ভাবিটা আবার কে?”
“ওইযে, যেই বাড়িত কাজ করি সেই বাড়ির বড় বউ।”
“এর আগে না নাম বললি পিংকি?”
“নাম পিংকি। আমি তো বাঙালি মানুষ তাই বাংলা ছাড়া কথা বলি না, তা-ও আপনাগো চাপে পইড়া মাঝে মাঝে সরি আর থ্যাঙ্কিউ! তা জানেনই তো আপা! তাই পিংকির বাংলা গোলাপি ভাবিই ডাকি! হইছে না? ছোট কালে তো পড়তামই, রেড লাল, হোয়াইট সাদা, বেলাক কালা, পিংক গোলাপি!”
সায়মা হাসতে হাসতে বললো,
“বেলাক না, ব্লাক। কালা নয়, কাল। তা গোলাপি ভাবি কিছু বলে না তোর মুখে বাংলা নাম শুনে?”
“আয় হায়! এমনিতেই কোনো কিছু উল্টাপাল্টা করলে শুদ্ধ ভাষায় যেই টাস টাস বকাঝকা করে! তার সামনে আবার বাংলা নাম কমু! আগে পরে কই! তা-ও দুই তিনবার শুইনা ফেলছে আর আচ্ছা ঝাড়ি মারছে!”
“এসব কেমন ভাষা! একবার ‘বলি’ আরেকবার ‘কই’! এগুলা কি?”
“আপা, সময় তো লাগবো! আমি কি আর আপনাগো মতো স্কুল কলেজ পড়ছি! মায়ের ভাষা যেমন, তেমনই তো বলমু!”
“শোন, চেষ্টা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়। তোর মাঝে আমি কোনো চেষ্টাই দেখছি না! তোকে এতো বছর ধরে নাকি ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে, আবার এখানে আসার পর আমিও ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছি তা-ও তুই পারছিস না কেন জানিস? কারণ তোর মাঝে কোনো চেষ্টাই নেই!”
“করতাছি তো।”
“এই করাতে চলবে না। আপ্রাণ চেষ্টা কর। যা হাত মুখ ধুয়ে নে। মায়ের নামাজ হয়ে গেলে একসাথে লাঞ্চ করবো।”
“খালু বাড়িতে নাই?”
“বাবা দাওয়াতে গেছে।”
রহিমা হাতমুখ ধুয়ে সায়মার রুমে ফ্যানের নিচে বসে রইলো।
হক মঞ্জিলের মালিক আবু সালেহ হক। ছেলেমেয়ে দুজন। ছেলে সায়েম ইশতিয়াক বড়, এইচএসসির পর কর্মসূত্রে আমেরিকা চলে যায় এবং সেখানেই থাকে। মেয়ে সায়মা হক ইতু, অনার্সে অধ্যয়নরত। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু ডিএমসি তে চান্স হয়নি তাই আর পড়লো না। বাবা বলেছে প্রাইভেটে পড়তে, কিন্তু সে পড়লো না৷ তার মতে প্রাইভেটে পড়া মানেই অযথা টাকা নষ্ট করা!
আবু সালেহ হক আগে সরকারি চাকরি করতেন।দুবছর ধরে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। বর্তমানে বাড়িভাড়া, পেনশন, ছেলের আয়ে তাদের সংসার বেশ সচ্ছল। এককথায় উচ্চবিত্ত পরিবার। একটি বৃদ্ধাশ্রম চলে তাদের আয় দ্বারা।
যদিও বাড়িতে কাজের মেয়ে রাখার তেমন প্রয়োজন ছিলো না, মেয়ের জন্যই কেবল রেখেছেন মিসেস ফারহানা হক। সায়মা কোথাও গেলে সাথে রহিমাকে পাঠান। কেননা বিপদ-আপদের পূর্বাভাস নেই। কখন কি হয়ে যায় সেই ভয় পান তিনি। এমনিতে মেয়ের সময় কাটে ভার্সিটিতে এবং ছাদে তার বাগানে। বাড়িতে থাকাকালীন পুরোটা সময় সঙ্গী হয় মা এবং রহিমা। টুকটাক ঘরের কাজের সাথে বাগানও পরিচর্যা করে রহিমা।
দুপুরে লাঞ্চ করার সময় তাকে তাদের সাথে টেবিলে খেতে বলা হয়। কিন্তু খায়না সে। তার ভালো লাগে না। মেঝেতে আয়েশ করে বসতেই তার ভালো লাগে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরপরই দুজন বেরিয়ে গেলো। সায়মাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। কিন্তু তার রিকশায় ভ্রমণ করতে ভালো লাগে। সে রহিমাকে সাথে নিয়ে রিকশাতেই চলে গেলো। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটার পর তারা বাড়ি ফিরবে। এখনো সন্ধ্যা হয়নি, একটু আগে মাত্র আসরের আযান পড়লো। তাই সায়মা রহিমাকে নিয়ে রাস্তার ধারে ফুচকা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ফুটওভারের পাশে দাড়ানো ভ্যান থেকে তারা দুই প্লেট ফুচকা নিলো। আগে রহিমা ফুচকায় কামড় দিয়ে অল্প অল্প করে খেতো। পরে সায়মা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে পুরো ফুচকা একবারে মুখে পুড়ে দিয়ে খেতে হয়। এখন সে সেভাবেই খায়। দুজনের মাঝে এক প্রকার প্রতিযোগিতা চললো। ভার্সিটিতে ফ্রেন্ডের সাথে অন্যথায় রহিমার সাথে সায়মা ফুচকার স্বাদ উপভোগ করে। ফুচকা খাওয়ার সময় ফুটওভারের উপরের দিকে চোখ পড়তেই আয়ানকে দেখতে পেল রহিমা। রেলিংয়ে কনুই ভর দিয়ে নিচের দিকে সামান্য ঝুকে দাড়িয়ে আছে। রহিমার তখন মনে হয়েছিলো আয়ানের দৃষ্টি সায়মার দিকে। কিছুক্ষণ পর আবার তাকালো, এবারও আয়ানের দৃষ্টি নিচের দিকেই কিন্তু সায়মার দিকে কি না তা বুঝতে পারছে না রহিমা। ফুচকা খাওয়া শেষে সায়মা দুই প্যাকেট ঝালমুড়ি নিলো। টাকা পরিশোধ করে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি রহিমার হাতে দিলো আরেকটা নিজের হাতে রেখে কথা বলতে বলতে ফুটওভারে উঠতে লাগলো। তাদের দুজনের কাধেই ব্যাগ আছে। সায়মার কাছে পার্স আর রাহিমা কাছে কাধে নেওয়ার কলেজ ব্যাগ। দুজন ভাগাভাগি করে বইপত্র নিয়েছে ব্যাগে আর হাতে ঝালমুড়ি। ফুট ওভারে উঠার সময়ও রহিমা খেয়াল করলো আয়ান এতোক্ষণ উল্টোপাশ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো আর এখন সোজা হয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ফুটওভারের মুখোমুখি! আয়ানের দৃষ্টি সায়মার দিকেই ছিলো। পরক্ষণে রাহিমা দিকে চোখ পড়তেই ঠোটের মৃদু হাসি আরও প্রশস্ত হয়ে গেলো। রহিমার মতে এটা ইতরমার্কা হাসি! এই ইতরমার্কা হাসির বিপরীতে রহিমা ব্রু কুচকে মুখ মোচড় দিয়ে দ্রুত হাটতে লাগলো। সায়মা তাকে থামিয়ে বললো,
“আরে! এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেন! দাড়া এখানে বাতাসে দাড়িয়ে ঝালমুড়ি শেষ করে তারপর যাই।”
ফুটওভারে আয়ানের বিপরীত পাশে তারা রেলিংয়ে কনুই ভর করে দাড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছে আর নিচে ধারাবাহিকভাবে চলাচল করা যানবাহন দেখছে। কিছুক্ষণ পরপর লাল বাতিটা জ্বলা মাত্র গাড়িগুলো থেমে যায় আর অন্যরাস্তার গাড়িগুলো চলতে থাকে। আবার সবুজ বাতি জ্বলে উঠলে গাড়িগুলো দৌড়াতে থাকে। আর নানানরকম হর্নের শব্দ তো আছেই শহরকে মনোরঞ্জন করার জন্য! বাতাসটা খুব ভালো লাগছে সায়মার কাছে। সায়মা নিরবে পরিবেশের মাধুর্য উপলব্ধি করতে থাকলেও রহিমা একটু পরপর পেছনে থাকা আয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। আয়ানকে কখনো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার কখনো পাশে থাকা বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে দেখে। আয়ান রহিমাকে যখনই তাকাতে দেখে, তখনই পা তুলে জুতা দেখায় কিংবা হাতের ফোনটা রহিমার মাথায় মারার ভঙ্গিতে হাত ওঠায়!
ঝালমুড়ি খাওয়া শেষ হলে সায়মা তাকে বললো,
“চল, এবার বাসায় যাওয়া যাক।”
সায়মা হাটতে লাগলে রহিমা আয়ানের দিকে এক কদম এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে গেলো,
“রাস্তায় রাস্তায় আড্ডা দেন আর সুন্দরী মেয়ে মানুষের দিকে তাকাইয়া থাকেন খালি? খাড়ান, আম্মার কাছে আপনার লুইচ্চামির বিচার দিয়া লই।”
কথাটা বলে রহিমা আর এখানে দাড়িয়ে নেই। সায়মা এগিয়ে যাওয়ায় সে দৌড়ে সায়মার কাছে এসে সমান তালে হাটতে লাগলো। পেছন থেকে আবার আয়ান মাথা ফাটাতে আসে কি না সেটা দেখার জন্য একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়েছিলো রহিমা। আয়ান তখন সেখানেই দাড়িয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো রহিমার দিকে। হয়তো রহিমাকে এখন একা সামনে পেলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো আয়ান, এটাই রহিমার ধারণা!