“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ৪
(নূর নাফিসা)
.
.
সবজি কেটেকুটে ফারহানার রান্নার কাজ এগিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে রহিমা। অসুস্থ মা শুয়ে আছে আর ছোট বোন কারিমা ফোন নিয়ে খুচুরখুচুর করছে! তা দেখে রহিমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে! তাই সে বকাঝকা করতে লাগলো কারিমাকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অথচ না বসিয়েছে রান্নাবান্না আর না এনেছে বাইরে থেকে কাপড়চোপড়। সারাদিন পড়ে থাকে ফোন নিয়ে!
স্মার্টফোন ইউজ করে কারিমা। কিছুদিন আগে আয়ানকে দিয়ে রহিমাই ফোন কিনিয়েছে। কারিমার নাকি পড়াশোনার জন্য স্মার্টফোন প্রয়োজন। সংসারের দায়ভার যেহেতু তার উপর সেহেতু বোনের প্রয়োজন মেটাতে সে আয়ানের হাতে আড়াই হাজার টাকা দিয়েছিলো দেখেশুনে একটা ফোন কিনে দেওয়ার জন্য। সে তো আর এতসব বুঝে না। আয়ান আরও সাতশো টাকা যুক্ত করে তিন হাজার দুইশো টাকা দিয়ে ফোন কিনে দিয়েছে। সাতশো যুক্ত করায় পাঁচশো টাকা আবার মায়ের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিলো আয়ান। মেয়েটা ভোর সন্ধ্যা ছুটাছুটি করে তার একটা ফোন প্রয়োজন হতেই পারে সেই ভেবে মারিয়া কাইয়ুম পাঁচশো দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে ফোন তার বোনের জন্য। অবশ্য পরে জেনেছেন সেটা।
কিন্তু এখন দিনরাত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খুচুরখুচুর করতে দেখে রহিমার মোটেও ভালো লাগে না। যদি জিজ্ঞেস করে, এতো কথা কিসের বন্ধুবান্ধবদের সাথে! তখন কারিমা তাকে বুঝিয়ে দেয় সে পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলছে।
রহিমা বকাঝকা করলে কারিমা ফোন রেখে বাইরে চলে গেলো কাপড়চোপড় আনতে। রহিমা হাতমুখ ধুয়ে মায়ের পাশে এসে বসলো। মাথায় হাত দিয়ে দেখলো মাথাটা গরম হয়ে আছে। সে মাকে ধরে বসিয়ে বললো,
“গোসল করছেন, মা?”
“না রে মা। জ্বর জ্বর লাগে। হেল্লাইগা আইজ করি নাই।”
“ভাত খাইছেন দুপুরে?”
“ভাল্লাগে না।”
রহিমা চুলার পাশে এসে হাড়ি ধরে দেখলো অর্ধেক হাড়ি ভাত নষ্ট হয়ে গেছে। সকালে যে মা বোনকে সাথে নিয়ে খেয়ে গেছে এরপর আর কেউ হাড়ি ধরেনি সে নিশ্চিত! কারিমা কাপড় নিয়ে ঘরে আসতেই রহিমা বললো,
“দুপুরে ভাত খাস নাই?”
“না।”
“ক্যা?”
“বুবু, আজ রত্নার বাড়িত দাওয়াত আছিলো। আমি তো তাদের বাড়িতেই আছিলাম।”
“মুড়াইয়া এক্কেবারে হাড়গোড় ভাইঙ্গা ফালামু! ফাজিল কোথাকার! এতো কষ্ট কইরা রোজগার কইরা ভাত আনি! আর ঘরের ভাত নষ্ট কইরা টাকা খরচ কইরা তুই দাওয়াত খাইতে যাস!”
পরপর এভাবে বকাঝকা করায় কারিমা মেজাজী গলায় বললো,
“বন্ধুবান্ধবের লগে চলতে গেলে যাওয়া লাগে। এত্তো মেজাজ দেখাইয়ো না।”
রহিমা ভাতের হাড়ির ঢাকনা কারিমার দিকে ছুড়ে মেরে বললো,
“হারামির বাচ্চা! সারাদিন যে মায় না খাইয়া রইছে, মায়ের মুখে দুইটা ভাত তুইলা দিতে পারলি না? আইছোস আবার বন্ধুবান্ধব নিয়া চলতে! মা রে একলা ফালাইয়া তুই দাওয়াতে গেলি ক্যামনে? আরেকদিন খালি দেইখা নেই। তারপর তোর বন্ধুবান্ধব ছুটাইতাছি!”
কারিমা মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো পাশের রুমে। রহিমা বকবক করতে করতে বাটিতে দুই মুঠ চিড়া ভিজিয়ে নিলো আর এক টুকরো গুড় নিলো। তারপর মাকে জোর করেই খায়িয়ে দিলো। অত:পর নষ্ট ভাতে পানি ঢেলে শুটকির ভর্তা বানানোর ব্যবস্থা করলো। এরমাঝে পাশের রুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখেছিলো কারিমা বই খুলে গোমড়া মুখু হয়ে চুপচাপ বসে আছে। দৃষ্টি তার বইয়ের দিকেই। এখন পড়ছে না কিছু ভাবছে তা কেবল সে-ই ভালো জানে!
আজ ঘরে রাতের খাবার হলো পান্তা ভাত আর শুটকির ভর্তা। ভাত প্রায় গলে গেছে যা কারিমার রুচিতে আটছিলো না। কিন্তু রহিমার হাতে ঠুসি খেয়ে তাকে এই ভাতই গলদকরণ করতে হলো। অযথা অন্ন নষ্ট করবে না তাই রহিমা এই ভাতই পেট পুড়ে খেয়েছে। যদিও কারিমা দুতিন লোকমা গিলেছে। আর তাদের মায়ের খাবার চিড়া গুড়।
.
নিত্যদিনের মতো আজও রহিমা কাইয়ুম ভিলায় এসে দেখলো মারিয়া কাইয়ুম চেচামেচি করছে আয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে বলে। কিন্তু তা যেন আয়ানের অভ্যাস হয়ে গেছে। এই চেচামেচিতে তার ঘুম এখন আর ভাঙে না। রহিমা মারিয়া কাইয়ুমের উদ্দেশ্যে বললো,
“আম্মা, কান্নাকাটি কইরা কান ঝালাপালা কইরেন না তো! কানের পোকা মইরা যাইতাছে! আপনাগো বাড়িতে পা রাখলে মনে হয় সার্কাস দেখতে আইছি!”
মারিয়া কাইয়ুম কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললো,
“তুই চুপ থাক! কানের আবার পোকা কিসের! আর তোর মতো কারণ ছাড়া চেচামেচি করছি আমি!”
“কারণ আর অকারণ! ভালো কথা কইলে আপনাগো ভাল্লাগে না! অযথা এমনে চেচামেচি কইরা নিজের গলা ব্যাথা করতাছেন, আমাগো কানের পোকাও মাইরা ফালাইতাছেন! এই চেচামেচিতে কি আপনার পোলা আদৌও উঠবো!”
“আবারও বলে কানের পোকা!”
“সরি আম্মা। ভুল হইছে। সরি কইছি, তা-ও আপনে শালিকের মতো চেচামেচি কইরেন না। ভাইজানের ঘুম আমি ভাঙাইতাছি।”
মুখ ফসকে শালিক কথাটা বেরিয়ে গেছে রাহিমার মুখে! রহিমাকে অকারণে বকবক করতে দেখলে পিংকি তাকে এভাবে শালিকের সাথে তুলনা করতো। আর আজ রহিমা মারিয়া কাইয়ুমকে বলে ফেলেছে সেই কথা! নিশ্চয়ই মারিয়া কাইয়ুম তার উপর রেগে যাবেন কথাটা শুনে, তাই রহিমা দ্রুত তার কাছ থেকে কেটে পড়লো। মিটশেফের কাছে এসে সে চাল ডাল বাছাইয়ে ব্যবহার যোগ্য স্টিলের থালাটা হাতে নিলো। মারিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিলো, রহিমা তাকে থামিয়ে দিতে তারাহুরো করে চলতে চলতে বলতে লাগলো,
“আম্মা, সরেন সরেন! ঘুম আমি ভাঙাইয়া দিয়া আসি…!”
কথাটা বলেই রহিমা আয়ানের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্লেটটা রুমের ফ্লোরে আছড়ে ফেললো! এবং ঝনঝন শব্দ হওয়ার সাথে সাথেই সেখান থেকে দৌড়ে কিচেনে চলে এলো। মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক দাত বের করে হেসে রহিমা বললো,
“এইবার দেখবেন ঘুম ভাইঙ্গা গেছে!”
এমনি তারাহুরো করে কাইয়ুম সাহেব নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
“কিসের শব্দ হলো?”
রহিমা হাসিমুখে বললো,
“খালু, ভাইজানের ঘুম ভাঙাইতে প্লেট ঢিল মারছি।”
কাইয়ুম সাহেব কোমড়ে হাত রেখে দাড়িয়ে ব্রু সামান্য কুচকে বললো,
“ঘুম ভাঙাতে গিয়ে যে এখন আমার চশমাটা ভেঙে ফেললি! সেটার কি হবে!”
রহিমা বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো,
“হায় হায়! কি কন খালু! আমি আপনার চশমা ভাঙ্গি নাই! ভাঙ্গা তো দুরের কথা, ছুইয়াও দেখি নাই! সত্যি কইতাছি! মিথ্যা কইলে ঠাডা পড়বো আমার উপর, ঠাডা!”
” হুপ! কি বলিস এসব! আর আমি বলছি নাকি যে তুই আমার চশমা ধরেছিস?”
“আয় হায়! খালু, আপনে দেখি গিরগিটির মতো রূপ পাল্টান! এই মাত্রই না কইলেন আমি ভাইঙ্গা ফালাইছি! আম্মা, আপনে শুনেন নাই খালু যে কইছে?”
মারিয়া দাত কিড়মিড়িয়ে বললো,
“রহিমা, তোর আচরণ আজ খুবই বাজে লাগছে! কার সাথে কিভাবে কি ধরনের কথা বলতে হয়, আজও সেটাই শিখতে পারলি না! এমন বেয়াদব হতে পারিস তুই, আমি ভাবতেও পারিনি!”
বেয়াদব বলায় রহিমা মুখ মলিন করে চুপ হয়ে গেলো৷ আর সেদিকে কাইয়ুম সাহেব বললেন,
“মারিয়া, মেয়েটাকে এভাবে বকাঝকা করো না তো। সে বুঝতে ভুল করেছে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। চশমা তুই ভাঙিসনি রহিমা। এমন শব্দ হওয়াতে আমার হাত থেকেই চশমাটা মেঝেতে পড়ে একটা গ্লাস ছুটে গেছে! সেটাই বলতে চাইছিলাম। কারণ শব্দটা তো তুই ই সৃষ্টি করেছিস।”
“হ খালু, সুন্দরবন আর বান্দরবন ঘুইরা সব দোষ তো আমার উপরেই পড়বো! আপনাগো ভালা করতে গেলেই আমার জ্বালা!”
রহিমা কিচেনে এসে কাজে হাত দিলো৷ কাইয়ুম সাহেব চলে গেলেন রুমে। মারিয়া রহিমার উদ্দেশ্যে বললো,
“কাজে আটখানা, চাপায় ষোলোআনা! শব্দের কারণে চশমা তো ভেঙে খালাস, পারলি না এবার ঘুম ভাঙাতে?”
রহিমা তীব্র মেজাজ নিয়ে স্টিলের গ্লাসটা হাতে নিলো যেটা ড্রাম থেকে চাল নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। কোনো কথা না বলে এবার সে দরজার কাছে না গিয়েই শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গ্লাসটা আয়ানের রুমে ছুড়ে মারলো! ঝনঝন আওয়াজে এবার আয়ান তেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আর দেখতে পেল রহিমা মাত্রই কিচেনের দিকে যাচ্ছে। বুঝতেও বাকি নেই এটা রহিমার কাজ। কিচেনে পা রাখা মাত্রই সে হনহন করে এসে রহিমার হাতটা ধরে ফেললো। তাকে হাত ধরে টেনে ডাইনিং টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আমার রুমে এসব ছুড়ে ফেলার সাহস আসে কোত্থেকে তোর? আজ তো তোর হাতই আলাদা করে দিবো!”
কথাটা বলেই ছুরি নেওয়ার জন্য টেবিলে রাখা কাটার সেটের উপর হাত দিলো আয়ান৷ এদিকে রহিমা বড়বড় চোখ করে “আম্মা…” বলে চিৎকার করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না! আম্মাকে ডাকার পরিবর্তে তাকে আল্লাহকে ডাকতে হলো!
“আল্লাহ…!” বলে জোরে চিৎকার দিতেই দুইদিক থেকে দুজন বেরিয়ে এলো! রহিমার হাত রক্তাক্ত!
.
দুপুরে হক মঞ্জিলে এলো রহিমা। সায়মা তার হাতে ব্যান্ডেজ দেখে চমকে উঠে বললো,
“এই, কি রে! তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন?”
রহিমা এতোক্ষণ ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও সায়মার কথায় এখন তার কান্না আসছে! সে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আর বইলেন না আপা! গরিবের কপাল যে সবসময় পোড়া কপাল থাকে তা তো জানেনই। দুঃখের মধ্যে কান্দন আসে। এই ব্যান্ডেজ সত্যি সত্যি আপনার চোক্ষে পড়ে থাকলে এইডাও বিশ্বাস করেন, আমি যা কইতাছি একটাও মিথ্যা না।”
এমনিতেই রহিমার এমন এলোমেলো ভাষা সায়মার কাছে বড্ড বিরক্তিকর। তারউপর একটা ঘটনা বলতে কত প্যাচিয়ে বলে যাচ্ছে কথা, যা সায়মার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না! তবুও সে শোনার জন্য চুপ করে রইলো। যেই রহিমা মূল ঘটনা বলতে যাবে এরই মাঝে ফারহানা হক নিজের রুম থেকে বেরিয়ে রহিমাকে দেখে বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
“হায় আল্লাহ! তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন রহিমা?”
রাহিমা কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“আর কইয়েন না আম্মা! বিশ্বাস করেন আর না করেন! দুঃক্ষের মধ্যে কান্দন আসে! যা বলমু একটাও মিছা না!”
আবারও একই প্রলাপে সায়মা ধমকের সুরে বললো,
“এই তুই কি শুরু করেছিস এগুলো? দুঃখের মধ্যে কান্না আসবে না তো হাসি আসবে? হাতে কি হয়েছে সেটা জানতে চাইছি আর তুই দেশ বিদেশ ঘুরে আসছিস এইটুকু ঘটনা বলতে! এক কথায় বললে বল, আর না বলতে চাইলে চুপ থাক।”
ফারহানা হক মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“আহ, সায়মা। বলতে দে তাকে। রহিমা, তুই বল।”
রহিমা ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আম্মা, আপায় আমারে দেখতে পারে না। তাই খালি খ্যাচ খ্যাচ করে আমার লগে! হেইডা আমি জানি। তা-ও আপনে আমার জননীর মতো আগ্রহ নিয়া আমার কাছে জানতে চাইলেন তাই বলি। ঘটনা হইলো গিয়া, আমি যেই বাড়িতে কাজ করি সেই বাড়ির ছোট পোলা কারণবশত আমার উপর রেগে গেছে! আর শাস্তি দিতে আমার হাতটা হুট কইরা ডাইনিং টেবিলে ফালাইয়া চট কইরা চাইপা ধরছে, ছুরি নিতে পুট কইরা কাটার সেটে হাত দিছে। তারপর মুট কইরা হাতে নিয়া কুট কইরা আমার হাতের পিঠে কোপ বসায় দিছে! বিশ্বাস করেন আম্মা, আমার কইলজাটা তখন লাফ দিয়া বাইরে বের হইয়া আবার ব্যাক লাফ দিয়া ভেতরে ঢুকছে!”
রহিমার কথা শুনে এদিকে মা মেয়ে উভয়েই বিস্মিত! রহিমা হুহু করে কেঁদে উঠে বললো,
“আম্মাগো আম্মা! আল্লায় বাঁচাইছে গো আমারে। যার কারণে ছুরির বদলে ভাইজানের হাতে কাটা চামচ উইঠা আইছে! তাই মাত্র চারটা ছিদ্র হইছে হাতে! আর ভাগ্যিস, হাতের রগ গুলা চামচের দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে পইড়া গেছিলো! না হইলে আপনাগো কাজের বেটি রহিমা আজ কাজের বেটি হাত কাটা রহিমা হইয়া যাইতো!”