সেই_রাতে,পর্ব_23,24

0
975

#সেই_রাতে,পর্ব_23,24
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_23
.
প্রিতম নিঝুমের দিকে তাকিয়ে আছে। নিঝুম নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। প্রিতম সজাগ ছিলো ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে । প্রিতম বিষয়টা বুঝতে পারল। মুখ টিপে হাসছে প্রিতম । নিঝুমের গা জ্বলে যাচ্ছে । অসভ্য লোক একটা! শয়তানের মত হাসছে।
-” এত জোরে মনে মনে গালি দিলে সবাই ই শুনে ।”
নিঝুম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মনে মনে কথা বললে আবার মানুষ শোনে কেমনে? আর উনি বা কি করে বুঝলো?নিঝুম মাথা নিঁচু করে এসব ভাবছে।
-” কি ভাবছো নিঝুম আমি জানলাম কিভাবে যে তুমি আমায় মনে মনে গালি দিছো এইটা?”
নিঝুম সত্যি অবাক হয়ে যাচ্ছে। লোকটা মনোবিজ্ঞানী নাকি? নিঝুমের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে প্রিতম আবার বললো,
-” এবার তো ভাবছো আমি মনোবিজ্ঞানী নাকি তাই তো?”
নিঝুম বিস্ময়ের চরম শিকড়ে পৌঁছে গেলো। এত বুঝে কিভাবে উনি। প্রিতম বলল,
-” থাক এত অবাক হতে হবে না,আমি তোমার সবটাই বুঝি।”
প্রিতমের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে নিঝুম । পালাতে ইচ্ছা করছে উনার চোখের সামনে থেকে। প্রিতমের ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি নিঝুমের লজ্জা টা আরো বাড়িয়ে দেয়। নিঝুম খাট থেকে উঠে রুম থেকে বের হতে চাওয়া মাত্রই প্রিতম ওর হাত ধরে খাটে বসিয়ে দিলো । তারপর বলল,
-“থাক এত লজ্জা পেতে হবে না। শুধু একটা চুমোই তো দিছো।”
নিঝুমের এবার রাগ হচ্ছে প্রিতমের ঢং দেখে। বলল,
-” শোধ নিছি।”
প্রিতম চোখ বড় বড় করে জিঙ্গেস করল,
-” কিসের শোধ?”
-” আপনি ওইদিন রাতে ছাদে বসে আমার কপালে চুমো খান নি? তাই আমিও…”
-” তুমিও কি?”
প্রিতমের ন্যাকামো দেখে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-“আপনার মাথা।”
-” তুমি আমার চুল ধরে টানলে কেন?”
নিঝুমের ইচ্ছা করছে প্রিতমের চুল গুলো ছিঁড়ে দিতে। ফাজিল লোক একটা!
প্রিতম আবার বলল,
-” আমি তো কারো চুল ধরি নি বা ঘ্রান নেই নি।”
আজব মানুষ! সুযোগ পেয়ে ভালোই লজ্জা দিচ্ছে। নিঝুমের নিজের উপর রাগ হচ্ছে । ইচ্ছে করে নিজের গালে কষিয়ে থাপ্পর দিতে,কেন এমন পাগলামী করল! নিঝুমের আর এখানে এক মুহূর্তও বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আর প্রিতমও যেতে দিচ্ছে না।নিঝুম লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
-“আমি এখন আসি।”
প্রিতম বুঝতে পারছে নিঝুম খুব লজ্জা পাচ্ছে । এতটা লজ্জা দেওয়া ঠিক হবে না।প্রিতম প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
-“এত অস্থির হচ্ছো কেন? চুপ-চাপ বসো। আসল কথাই বলা হয় নি।”
নিঝুম ভয় পেয়ে গেলো। আবার কি আসল কথা আর নকল কথা কে জানে।
-“হুম বলুন।”
-“খুব তো বলছিলে আমায় চাও না,আমায় বিয়ে করতে পারবে না। আরও কত কি! এত প্রথম কোন মেয়ের জন্য কাঁদছি বুঝলে? ছেলে মানুষ কত টা কষ্ট পেলে কাঁদে সেটা জানো? আবার ফিরে আসছে কেন?”
নিঝুম ভারী গলায় বলল,
-” ইচ্ছা হইছে তাই।”
প্রিতম হেসে বলল,
-” আমি জানতাম তুমি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না। এটা তোমায় অনুভব করাতে দুরত্ব বাড়ালাম বুঝছো?”
নিঝুম ঠান্ডা গলায় বলল,
-“হুম।”
-“ভালোবাসার যত্ন নিতে হয়, ভালোবাসা মানুষটা কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝতে হয়। নয়তো মরিচা পড়ে যায়। আর হৃদয় নামে প্রতারক মানুষ দের জন্য নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও বুকের কোনো এক কোনে ভালোবাসা রয়ে যায়। যাদের অতিরিক্ত আবেগ তারা ওই ভালোবাসা টুকু পুষিয়ে রাখতে রাখতে ভালোবাসার সাগর বানিয়ে ফেলে। শুনো যে তোমায় ঠকাইছে মনের গহীন থেকে ধিক্কার জানাও,ঘৃন্য করো। বেশী আবেগী হলেই প্রোবলেম ওই ঠকার যন্ত্রনাটা তাহলে তোমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে।”
প্রিতমের কথা খুব ভালো ভাবেই বুঝছে নিঝুম। হৃদয়কে মন থেকে চিরতরে মুছে ফেলার কথা বলছে।
-” একটা মানুষকে ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?”
-” মানুষ ভুলা কঠিন বাট প্রতারক গুলো ভুলা সহজ। ধরো ,কারো ভালোবাসার মানুষটা মারা গেল বা অনাকাঙ্ক্ষিক ভাবে হারিয়ে গেলো তাঁর জন্য ভালোবাসা পুষে রাখা আমি সাপোর্ট করি কিন্তুু প্রতারক দের মনে রাখা আমি সাপোর্ট করি না।”
নিঝুম জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। প্রিতমের কথার কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না। প্রিতম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
-“বাবা-মা তো বিয়ের কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। তুমি তো রাজি হও নি। কি করব টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম শেষ পর্যন্ত শৈলী কে বিয়ে করতে হবে।”
নিঝুম চোখ লাল করে প্রিতমের দিকে তাকালো।কত সাহস! শৈলীর কথা মুখে নেয়!
-“আর যদি কখনো শৈলীর কথা মুখে শুনি তাহলে ভালো হবে না।”
প্রিতম হেসে দেয়। বলল,
-“তোমরা মেয়েরা এসব বিষয় নিয়ে কেন যে এত হিংসুটে।”
নিঝুম রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
-“যান শৈলী কে বিয়ে করেন। আটকে রাখছে কে আপনায়?”
-“নিঝুম রাগ করলে তোমায় গুলুমুলু লাগে।”
এই লোকটা এত ফাজিল এত দিনে মাত্র বুঝলাম। প্রিতমের মা-বাবার কথা মনে পড়তেই নিঝুম আবার লজ্জায় পড়ে যায়। এতক্ষন উনার রুমে।ইস! উনারা কি ভাববে। বলল,
-” আমি আসি এখন।”
প্রিতম কড়া গলায় বলল,
-“তোমায় বসতে বলছি কিন্তু।”
-“আপনার রুমে আসছি অনেকক্ষন ,আংকেল-আন্টি বেহায়া ভাববে আমায়।”
-“আমার বউ কে কেউ বেহায়া ভাববে না।”
প্রিতমের মুখে ‘বউ’ ডাক শুনে অদ্ভুধ এক শিহরন বয়ে যাচ্ছে নিঝুমের মনে। নিঝুম এই কথায় কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। নিঝুমের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে প্রিতম বলল,
-” জানো শৈলী কে….”
প্রিতমের কথা শেষ না হতেই থামিয়ে দিলো নিঝুম । উচ্চস্বরে বলল,
-” আবার শৈলী!”
-“এত চেঁচাও কেন? পুরো কথাটা তো একটু শুনো।”
নিঝুম গোমড়া মুখে বলল,
-” বলেন।”
-“শৈলী কে একটা স্পেশাল থ্যাংক্স দিতে ইচ্ছে হয়।”
নিঝুম অস্ফুট স্বরে বলল,
-” কেন?”
-” শৈলীর জন্যই তোমার মনের কথা বুঝতে পারছি। শৈলী যদি বাবা-মা কে ওইদিন রাতে ছাদে নিয়ে না যেত তাহলে এতসব এত তাড়াতাড়ি হত না।”
দুইজনই হেসে দেয়। নিঝুম ভেবে বলল,
-” আসলেই তো ঠিক। আপনার একটা বিচার আছে।”
প্রিতম অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
-“কি?”
-” আপনি স্লিপিং পিল খেয়েছেন কেন?”
-“বিষ খাইতে ইচ্ছা করছিলো।”
-” এসব বাজে কথা আর কখনো বলবেন না।”
-” নিঝুম ভালোবাসা আমায়?”
নিঝুমের হার্ট বিট বেড়ে গেল কথাটা শুনে। এক প্রকার অদ্ভুধ অনুভূতি হচ্ছে ।
প্রিতম নিঝুমের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা লজ্জায় একদম লাল হয়ে গেছে। এমন লজ্জা পাওয়া ভালোই লাগছে প্রিতমের ।
প্রিতম বলল,
-” তোমায় লজ্জায় ললিত মুখটাই উত্তর দিয়ে দিয়েছে। তোমার আর কষ্ট করে মুখে বলতে হবে না। আমি যে সারাদিনেও এক ফোঁটা পানিও খাই নি ,এই খবর তো কেউ রাখে না।”
নিঝুম প্রিতমের দিকে তাকালো । বলল,
-“খান নি কেন?”
-“খুশির ঠেলায়।”
নিঝুম ব্যস্ত হয়ে বলল,
-” এখনই খেয়ে নেন,ফ্রেশ হয়ে।”
-” খাবো যদি তুমি খাইয়ে দেও।”
নিঝুম চুপসে গেলো । বার বার ইচ্ছা করে লজ্জা দিচ্ছে ওকে ভাবতেই রাগ হয়। প্রিতম বলল,
-” এত লজ্জা পেতে হবে না। আমি ভাত নিয়ে আসছি তুমি খাইয়ে দিবা।”
নিঝুমের এখন পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। চুপ-চাপ বসে আসে। লোক টা সারাদিনেও খায় নি। নিজের কাছেই খারাপ লাগল নিঝুমের।
প্রিতম ভাত নিয়ে আসল। নিঝুমের কাছে এগিয়ে এসে বলল,
-” কি দিবে না খাইয়ে?”
নিঝুম ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে । প্রিতম অভিমানের সুরে বলল,
-” আচ্ছা না দিলা।”
নিঝুম নিরুপয় হয়ে বলল,
-“আচ্ছা দিচ্ছি।”
নিঝুম কাঁপা কাঁপা প্রিতমের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে ।
-“নিঝুম এভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে তুলে দিলে,মুখের খাবার নাকে যাবে তো।”
নিঝুম প্রিতমের দিকে তাকালো । প্রিতমের চোখ গুলো লাল আছে। খুব মায়া কাজ করছে। প্রিতমও নিঝুমের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর লজ্জা পাওয়া দেখতে ভালোই লাগছে।
-” নিঝুম যেদিন তুমি আমায় প্রথম খাইয়ে দিছো ওইদিন খাবার দিয়ে আমার নতুন শার্ট টা নষ্ট করে দিছো।”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” আমি আপনায় আবার কবে খাইয়ে দিলাম?”
প্রিতম হেসে বলল,
-” জ্বরের ঘোরে দিছিলা একদিন। সত্যি বলতে আমি সেদিই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। ইস! কি পাগলামী টাই করছো তুমি।”
নিঝুম এবার বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। সেদিন উনাকে খাইয়েও দিছি! আর কি কি করছি কে জানে। প্রিতম আবার বলল,
-” নিঝুম জানো সব চেয়ে আফসোস হইছে কখন?”
-“কখন?”
-” তুমি জ্বরের ঘোরে বললা তোমার জন্য আইসক্রীম ,ফুসকা,মিষ্টি আনতে হবে । অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি তোমার জ্বর ভালো হয়ে গেছে । আর তুমি এসবের কথা ভুলে গেছো।”
নিঝুম মুচকি হেসে বলল,
-“বেশী জ্বর আসলে এমন হয় আমার।”
প্রিতম ব্যস্ত হয়ে জিঙ্গেস করল,
-“নিঝুম একটা সত্যি কথা বলো তো তুমি বাসা থেকে কেন আসছো সেই রাতে? তুমি তো বললা তোমার বাবা নেই আবার ওইদিন রাতে আব্বুকে বললা…”
প্রিতমের কথা শেষ না হতেই থামিয়ে দিলো নিঝুম । বলল,
-“এই বিষয় টা না জানলে হয় না? আসলে আমি এটা বলতে ইচ্ছুক না।”
-“ওকে। এই বিষয় জেনে আমার কোন লাভ নেই। আর যেহেতু তুমি ইচ্ছুক না সেহেতু জোর করব না।”
নিঝুম এসবের আর উত্তর না দিয়ে বলল,
-“প্লেটের ভাত শেষ এখনও হাঁ করে আছেন।”
প্রিতম প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যি ই শেষ ভাত! এত তাড়াতাড়ি এত গুলো ভাত খেয়ে ফেলল। সবই ভালোবাসা দয়াল! হেসে দিলো প্রিতম ।
নিঝুম বলল,
-“হাসেন কেন? আরও খাবেন?”
-“আরে না আর খেতে পারবো না। খুব জোর করে ফেললাম নিঝুম? ”
-“মানে?”
-“মানে এই যে বাধ্য হয়ে খাইয়ে দিলা ।”
নিঝুম মুচকি হেসে বলল ,
-“না।”
.
আবার সেই জ্যোৎস্না রাত। ছাদে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন। নিঝুমের চুল গুলো উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। প্রিতম বলল,
-“নিঝুম চুল গুলো ছেড়ে দেও।”
প্রিতমের দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বলল,
-“কেন?”
-“শোধ নিবো। তাছাড়া খোলা চুলে তোমায় পরিপূর্ন লাগে।”
-“প্রশংসা করলে কিন্তু…. ”
নিঝুমের কথা শেষ না হতেই ওকে থামিয়ে প্রিতম বলল,
-“নাক ফাটিয়ে দিলে,সবাই তোমায় নাক ফাটার বউ ডাকবে।”
হেসে দিলো নিঝুম । চুল গুলো ছেড়ে দিলো । বেশ লম্বা চুল!
প্রিতম এগিয়ে এসে ওর চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রান নিতে লাগল। মাতাল করা ঘ্রান! যেকোন পারফিউম কে হার মানাবে।
চলবে..

#সেই_রাতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_24
.
কালকে বিয়ে। প্রিতমের বাসায় জাঁকজমক পূর্ন আয়োজন। মেহমানে বাসা ভরপুর। কেউ কেউ পাশের বিল্ডিং এ গিয়ে বউ দেখে আসছে। প্রিতম যতটা পারছে নিঝুমকে খুশি রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে দুই-এক ফোটা জল গাল বেয়ে পড়ছে নিঝুমের। এই জল হৃদয়ের জন্য না, নিঝুমের মা-বাবার জন্য। মা-বাবা হয়ত রাগ বশত ওর সাথে যোগাযোগ করতে চায় না। ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে মরছে দু জন,একমাত্র আদরের মেয়ে তাঁদের। কষ্ট কার ই বা না হয়?নিজের কাছে নিজেকে খুব বেশী অপরাধী মনে হচ্ছে নিঝুমের।একবার কি উচিত ছিলো না বাবা-মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া?
আর প্রিতমের ফ্যামিলির মানুষ নিতান্তই ভালো মানুষ । নয়তো ফ্যামিলির পরিচয় বিহীন এমন একটা মেয়েকে এত সহজে মেনে নিলো?
অবশ্য ছেলের বউয়ের ফ্যামিলি নিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রিতমের বাবার। কি আর করার ছেলের পছন্দ! সবাইকে বলতে হয় মেয়ের বাবা-মা কিছু নেই। এছাড়া আর উপায় কি।
প্রিতম খুব বেশী খুশি। নিজের মনের মানুষকে এত সহজে আপন করে পাওয়ায় ভাগ্য কয় জনেরই বা থাকে?
আর তর সইছে না প্রিতমের । ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বিয়েটা হয়ে যাক। বউ সাজে নিঝুমের লজ্জা মাখা মুখটা দেখা যাবে। অবশ্য নিঝুমের ফ্যামিলি নিয়ে কোন প্রকার কৌতূহল নেই প্রিতমের মায়ের । তার মতে,ছেলের বউ দ্যাট’স এনাফ।
নিঝুম বার বার রুমে বসে পায়চারি করছে। মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। আজকে বাবা-মায়ের কথা খুব বেশী মনে পড়ছে। আজ যদি এরকম ভাবে বিয়ে টা হৃদয়ের সাথে হত তাহলে এত দোটানা থাকত না। যাই হোক চার বছরের সম্পর্ক ছিলো । আর প্রথম ভালোবাসার মানুষটা কে ভুলা কি এত সহজ? কত স্বপ্ন ছিলো দুজনেই। ছোট্ট একটা সংসার হবে। রঙ বেরঙের স্বপ্নে রাঙানো থাকবে প্রতিটা মুহূর্ত । স্বপ্ন ভাঙার যে কি কষ্ট যে এটার ফেস করে সে ই শুধু বুঝতে পারে । হৃদয় কেন করল এমন টা? হিসেব মিলছে না নিঝুমের, হয়ত কখনও মিলবেও না।
.
বিয়ের শপিং করতে যাবে । প্রিতমের মা নিঝুকেও যেতে বলছে।নিঝুম কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছে না। উনারা বিয়ের শপিং করতে যাবে,তাঁদের সাথে নিঝুমও যাবে কি যে বেমানান ব্যাপারটা!
প্রিতম নিঝুমের রুমে এসে হাজির। বলল,
-“নিঝুম পাগলি চলেন শপিং করতে যাবো।”
-“পাগলে পাইছে আপনায়? আপনারা শপিং করতে যাবেন আমি যাব কি করতে?”
-“আরে পাগলি এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আমরা আমরাই তো।”
-“আরে আপনি বুঝেন না…”
নিঝুমের কথা শেষ না হতেই থামিয়ে দিলো প্রিতম ।
-“আর একটা কথা বলবা না। তুমি যাবা এটাই ফাইনাল।”
এই লোক পারেও বটে। নিঝুমের মোটেও ভালো লাগছে না। নিঝুমের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে প্রিতম নিঝুমের হাতে একটা কার্ড দিয়ে বলল,
-“নিঝুম তুমি কিছু জুয়েলারি পছন্দ করো এখান থেকে ।”
-“জুয়েলারির প্রয়োজন নেই। আর শুনেন আমার যদি ফ্যামিলি থাকত তাহলে নিশ্চয়ই আপনায় স্বর্নের কিছু দিত আই মিন চেইন বা রিং।”
-“ওয়েট ওয়েট এসব নিয়ে তোমার আফসোস করতে হবে না। ওসবের কিছুই আমার দরকার নেই। শুধু নিঝুম হলেই হবে।”
-“আমার পুরো নামটা বলেন তো?”
-“ইস মনে নেই! সেই রাতে বলছিলা।”
-“হুম মনে করেন ।”
মাথা চুলকাচ্ছে প্রিতম । কিছুতেই মনে পড়ছে না।
-“আর একবার বলো প্রমিস আর ভুলবো না।”
-“না বলব না।”
-“আমার পুরো নাম বলো তো?”
-“সাদমান প্রিতম ।আমার মেমোরি এত লস না আপনার মত।”
-“তা তো জানি। কিন্তু নাম টা আবার বলো না?”
-“উম্মে আয়শা নিঝুম । আর যদি কখনো ভুলেন তাহলে দেখেন কি করি।”
-“না মহারানী আর কখনো ভুলব না।”
-“হয়েছে ঢং।”
প্রিতম নিঝুমের দিকে নেশা ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে ওর দিকে আগাচ্ছে। নিঝুম পিছনে পিছাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায় নিঝুম । আর পিছনে যাওয়া যাবে না। প্রিতম নিঝুমের কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলল,
-“পালিয়ে যাবে কোথায়?”
নিঝুম চোখ বন্ধ করে ফেলছে।
প্রিতম বলল,
-“নিঝুম তুমি যদি চোখ না মেলো তাহলে আমি কিন্তু তোমায় জড়িয়ে ধরব।”
নিঝুম সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাতেই চোখ পড়ে প্রিতমের চোখে। প্রিতম একদম কাছে চলে আসছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছে নিঝুমের। প্রিতম ফাঁপা ফাঁপা কন্ঠে বলল,
-“ভালোবাসি।”
প্রিতমের মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা নিঝুমের নিঃশ্বাস আরও ভারী করে তুলে ।
কারো পায়ের শব্দে নিঝুমের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ায় প্রিতম । প্রিতম পিছনে ফিরে দেখে ওর মা দাঁড়ানো! বলল,
-“আম্মু তুমি।”
প্রিতমের মা প্রিতমের দিকে এগিয়ে কান টেনে বলল,
-“তোকে আমি সেই কখন পাঠিয়েছি নিঝুমকে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে যাওয়ার জন্য। ওরা সবাই তোদের দুইজনের জন্য ওয়েট করছে ।”
প্রিতম আর নিঝুম দুই জনেই লজ্জা পেলো। শপিংয়ের কথা ভুলেই গেছে প্রিতম ।
প্রিতমের মা চায় না নিঝুম কোন কিছুর অভাব বোধ করুক তাই নিঝুমকেও শপিংএ নিয়ে যেতে বলছে । নয়ত একা বাসায় মন খারাপ করে থাকবো।
প্রিতম বলল,
-“আচ্ছা আম্মু যাও আমি আসতেছি ।”
প্রিতমের আম্মু চলে গেলো । নিঝুম ব্যাগ থেকে কি যেন বের করে প্রিতমের হাতে দিলো । বলল,
-“এগুলো আপনার।”
প্রিতমের চোখ কপালে উঠে গেল। স্বর্নের ভারী গলার চেইন। আর ডায়মন্ডের রিং।
-“এগুলো কার নিঝুম? ”
-“আমার বাবা তার মেয়ের জামাইয়ের জন্য বানিয়েছিলো।”
-“তুমি না বললে তোমার বাবা নেই? আর এত দামের ডায়মন্ডের রিং?”
-“আপনি কিন্তু বলছেন আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে জানতে চাইবেন না।”
থেমে যায় প্রিতম। বলল,
-“আচ্ছা তোমার রহস্য টা বলবা একটু? কেন আসছো সেই রাতে?”
-“আমি এই বিষয় নিয়ে কোন কথা বলতে ইচ্ছুক না।”
প্রিতমের মাথায় কিছুই যাচ্ছে না। খুব রহস্যময়ী মেয়ে একটা! নিঝুম ব্যাগ থেকে সব গহনা গুলো খাটে রাখল । তারপর প্রিতম কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আপনাদের কোন গহনা দিতে হবে না। এগুলো তে ই চলবে।”
প্রিতমের চোখ কপালে উঠে গেল। সব ডায়মন্ডের গহনা।
-” এত গহনা তাও সব ডায়মন্ডের? ”
-“হুম এগুলো সব আমার বিয়ের জন্য।সব আনি নি অর্ধেক এনেছি। আর আমি আপনাদের অফিসে কাজ না করলেও পারতাম। আমি শুধু টাইম পাস করার জন্য চাকরি টা নিয়েছি। এই গহনা বিক্রি করে আমি সারাজীবন খেতে পারব।”
প্রিতম অনুনয়ের সুরে বলল,
-“প্লীজ নিঝুম তোমার ফ্যামিলি সম্পর্কে বলতে হবে না । শুধু এই টুকু বলো কি হয়েছিলো সেই রাতে?”
নিঝুম মুচকি হেসে বলল,
-“প্লীজ বাদ দেন এসব।”
প্রিতম চুপ করে আছে । নিঝুম একটা শাড়ী হাতে নিয়ে বলল,
-” আমার বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো বিয়েতে আমি কালো শাড়ী পড়ব। তাই অর্ডার করে এই শাড়ীটা বানিয়েছে ,সাথে স্বর্ন দিয়ে তৈরী ডিজাইনও করেছে।”
প্রিতম তাকিয়ে দেখল শাড়ীটা ঝকঝক করছে রোদের আলোতে। শাড়ী থেকে আলো বিচ্ছুত হয়ে পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। প্রিতম ঠান্ডা গলায় বলল,
-“হুম শাড়ী টায় তোমায় খুব মানাবে।”
-“আমি চাই এই শাড়ী টাই পড়ব বিয়েতে।”
বিয়েতে সবাই লাল বা খয়েরি শাড়ী পড়ে। এটা একটা চিরচেনা ঐতিহ্য। তবুও নিঝুমের যখন ইচ্ছা তাই প্রিতম বলল,
-“তোমার ইচ্ছা হলে পড়বে কোন আপত্তি নেই। প্লীজ নিঝুম বলো না কেন আসলে সেই রাতে?”
নিঝুমের চোখ ছলছল করে উঠে। আর একটু হলে চোখ থেকে পানি ফোঁটা গড়িয়ে পড়বে। প্রিতম বলল,
-“নিঝুম সরি আমি আর এসব জানতে চাইব না।”
নিঝুম মাথা নিচু করে আছে। প্রিতম নিঝুমের নাক ধরে বলল,
-“নিঝুম পাগলী আর বলব না সরি।”
মুহূর্তেই নিঝুমের বুকের মাঝে কেঁপে উঠল। হৃদয় সব সময় এভাবে ওর রাগ ভাঙাতো। নিঝুম নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রিতম কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।
-“এই নিঝুম কান্না থামাও। আরে পাগলী কি হয়েছে?”
নিঝুম কেঁদেই যাচ্ছে । প্রিতম নিঝুমের মুখ টা উঁচু করে কপালে একটা চুমো এঁকে দিলো । নিমিষেই নিঝুমের সব কষ্ট দূর হয়ে গেলো। মনে হলো এটা জাদুর ছোঁয়া। নিঝুম প্রিতমকে আরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। না,আর যাই হোক প্রিতমের মত মানুষকে কষ্ট দেওয়া যায় না।
-“নিঝুম এত শক্ত করে জড়িয়ে রাখল আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে তো।”
নিঝুম প্রিতম কে ছেড়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,
-“আপনি খুব ভালো ।”
প্রিতম ফিক করে হেসে দিলো। নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে কড়া গলায় বলল,
-“আর যদি কখনো কাঁদো তাহলে ভালো হবে না।”
নিঝুম মুচকি হেসে দিলো। প্রিতম বলল,
-“নিঝুম লেট হয়ে যায় চলো।”
-“আরে আমার রেডি হতে হবে না?”
-“রেডি হতে হবে না। এভাবেই সুন্দর লাগছে।”
-“না,আমি এভাবে যাব না।”
-“একটা কথা কি জানো? মেয়েদের সাজগোজ বা পরিপাটি থাকার চেয়ে এলোমেলোই ভালো লাগে । এই ধরো এলোমেলো চুল,লেপ্টানো কাজল।”
প্রিতম নিঝুমকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে নিয়ে গেলো।
.
প্রিতমের বাসার সামনে ওর সব কাজিনরা ওয়েট করছে। নিঝুম বলল,
-“এই ছাড়ুন,সবাই কি ভাববে?”
-“বউয়ের হাত ধরলেও দোষ?”
এই লোক টার সাথে কথা বলেই পারা যায় না। নিঝুম এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। প্রিতম বলল,
-“শৈলী কে খুঁজছো বুঝি?”
নিঝুম মুচকি হেসে বলল,
-“আপনি বুঝলেন কিভাবে? ”
-“সবই বুঝি। শৈলীদের দাওয়াত করছে কিন্তু আসে নি ।”
প্রিতমের সব কাজিনরা নিঝুম কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল । একজন বলল,
-“কতক্ষন ধরে ওয়েট করছি তোদের মাত্র আসার টাইম হলো? বউ পাগল হয়ে গেছিস তো পুরো।”
নিঝুম সবার কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে । আর একজন বলল,
-” ভাবী তো দেখছি পুরো পিচ্ছি। একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগে।”
প্রিতম বলল,
-“হুম আমার পুতুল বউ।”
প্রিতমের কথা শুনে রাগ হচ্ছে নিঝুমের এতগুলো মানুষের মাঝে কি প্রেম টা দেখায়। প্রিতম বলল,
-“চলো এমনিতেই লেট হয়ে গেছো। ”
নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“নিঝুম ড্রাইভ করবে না আজকে? ”
নিঝুম লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
-“না।”
সবাই হেসে দিলো। বলল,
-” এই টুকু মেয়ে ড্রাইভও জানে।”
প্রিতম ভাব নিয়ে বলল,
-“হুম সব কিছুতেই এক্সপার্ট।”
.
সবাই শপিং মলে পৌঁছে গেল। প্রিতম বলল,
-“নিঝুম সব কিছু তোমার পছন্দে কিনবে।”
নিঝুম প্রিতমের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলল,
-“উহু।”
-“এত ইন্নসেন্ট সাজতে হবে না। সব তুমি পছন্দ করে কিনবে ব্যাস।”
এমন একজন জীবন সঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ভাবতেই আনন্দে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে নিঝুমের।
প্রিতম নিঝুমকে বলল,
-“তোমার বাবার মত ওত টাকা আমার নেই যে স্বর্নের শাড়ী দিবো।”
নিঝুম মুখ গোমড়া করে বলল,
-“ভালো হচ্ছে না কিন্তু।”
সবাই শাড়ী চয়েস করতে ব্যস্ত। এমন সময় পিছন থেকে ডাক আসে,
-“নিঝুম।”
ডাক শুনে নিঝুম পিছনে ফিরে তাকায়। হৃদয়ের বোন! কি বলবে বুঝতে পারছে না। প্রিতম জিঙ্গেস করল,
-“মেয়েটা কে?”
নিঝুম ব্যস্ত গলায় বলল,
-“একটু ওয়েট করেন আসছি।”
নিঝুম হৃদয়ের বোনের কাছে যেতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে নিঝুম কে জড়িয়ে। কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল,
-” কিভাবে পারলি আমার ভাই টাকে এভাবে ঠকাতে? হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনে। এত স্বার্থপর মেয়ে তুই ভাবতেও পারি না।একটা বার দেখতেও গেলি না।”
নিঝুম কিছুই বুঝতে পারছে না। বিস্ময় ভরা চোখে জিঙ্গেস করে,
-” আপু আগে বলো হৃদয়ের কি হয়েছে? আমি ওকে অনেক খুঁজছি।”
হৃদয়ের বোনের মুখে সবটা শুনে চিৎকার দিয়ে সেন্স লেস হয়ে যায় নিঝুম ।
যাকে এতদিন প্রতারক ভেবে আসছে সেই মানুষটা নিঝুমের জন্য মৃত্যু পথযাত্রী!
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here