সেই_রাতে,পর্ব_25,26(EnD)

0
1444

#সেই_রাতে,পর্ব_25,26(EnD)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_25
.
-“হৃদয়ের বাবা হৃদয় যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন মারা যায়। ওরা তিন ভাই বোন । হৃদয় সবার বড়। হৃদয়ের বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মা আর বিয়ে করে নি। হৃদয় ওর বড় চাচা মানে আমাদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করত। ওর যাবতীয় খরচ আমার বাবা দিত আর ওর মা ওর ছোট দুই ভাই বোন কে নিয়ে ওর নানা বাড়ি থাকত। আমি বরিশালে থাকতাম। আমার বাসার কাছেই নিঝুমের বাসা ছিলো। হৃদয় একবার আমাদের বাসায় বেড়াতে যায়।নিঝুম প্রায়ই আমাদের বাসায় যেত। ওখান থেকেই ওদের রিলেশনের শুরু । আমি ওদের রিলেশনের ব্যাপারে জানতাম না। নিঝুম ওর বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে।বিশাল অবস্থা ওদের। একদিন রাতে হৃদয় আমায় ফোন দিয়ে ওর আর নিঝুমের রিলেশনের ব্যাপারে জানায়। বলে, ওদের নাকি চার বছরের রিলেশন। নিঝুমের ফ্যামিলি ওদের রিলেশনের ব্যাপার টা জেনে গেছে। তাই হুট করে নিঝুমের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলছে। ওইদিন হৃদয়ের মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে তাই ওর মাকে নিয়ে হসপিটালে ছিলো। তাছাড়া ওর ছোট দুই ভাই-বোন। হৃদয় টিউশনি করে ওদের লেখাপড়ার খরচ চালায়। হৃদয়ের লেখাপড়া এখনও কমপ্লিট হয় নি। নিঝুম ওর সাথে এখন পালিয়ে আসতে চায়। কিন্তু হৃদয় বলছে এই অবস্থায় ওকে আনা ওর পক্ষে সম্ভব না। আমার কাছে জানতে চায় এখন কি করবে? আমি বলছি ‘তুই ওকে নিয়ে আয় যা হবার হবে।’ ও বলে ‘ওর মা অসুস্থ এই অবস্থায় তাঁকে রেখে বরিশাল যাওয়া সম্ভব না।’ সব দিক ভেবে হৃদয় নিঝুম কে আসতে না করে দেয়। নিঝুম কোন কথাই শুনে না। ও বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে একা ঢাকা চলে আসে। হৃদয় ওকে এগিয়ে আনতে বাস স্টেশনে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়।
পরের দিন সকালে খোঁজ পাওয়া যায় হৃদয় হসপিটালে ভর্তি। পুরো মাথা রক্তাক্ত কিভাবে যেন মাথার পিছন দিকে প্রচন্ড আঘাত খায়। আমি জানি না সেই রাতে ওর সাথে নিঝুমের দেখা হয়েছে কিনা। ওর ফোন মানিব্যাগ কিছুই পাওয়া যায় নি। হয়ত ছিনতাইকারীরা ওর এই অবস্থা করছে। আর নিঝুমেরও কোন খোঁজ পাই নি ,আমার আগের ফোনে নিঝুমের নম্বর ছিলো সেই ফোনটা হারিয়ে গেছে।”
হৃদয়ের বোনের মুখে সবটা শুনে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে প্রিতম। হৃদয়ের বাঁচার কোন সম্ভবনা নেই। ছয় মাস ধরে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। শুধু চোখ মেলে কোন রকম তাকাতে পারে। প্রিতম চায় না হৃদয় মারা যাক,বেঁচে থাকুক। ভালোবাসার জন্য একজন মানুষের মৃত্যু তো কামনা করতে পারে না।
.
নিঝুম হৃদয়ের মাথার কাছে বসে আছে। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে । দৃষ্টি বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে । হৃদয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। নিঝুমের চিৎকার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে ।
এমন একটা মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ টা কে কতই না ঘৃন্য করছে। হৃদয়ের উপর ঘৃন্য হয়েছে এতদিন তাই ওকে ভুলে বাঁচতে পেরেছে। এখন তো আর ঘৃন্য হচ্ছে না এখন অনুশোচনা হচ্ছে । হৃদয়ের মায়া ভরা মুখ টার দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে আলতো করে হাত ছোঁয়াই রাখছে। নিঝুম জানে ও কখনও সুস্থ হবে না। হয়ত বাঁচবেও না ।
.
প্রিতম উদাস মনে তাকিয়ে আছে। ওর কাজিনরা বিয়ের শপিং করছে। নিঝুমের অসুস্থার অজুহাত দিয়ে শপিং মল থেকে বেড়িয়ে আসে ওরা। কালকে বিয়ে। এই অবস্থায় বিয়ের কথা কি খেয়ার আছে নিঝুমের? এখন কি ওকে এটা বলা উচিত হবে? নানা রকম দ্বন্দ্ব দ্বিধায় ভুগছে প্রিতম। এভাবে বিয়ে ভেঙে যাওয়া কত সম্মানহানীর ব্যাপার। তাছাড়া বিয়েটা সম্পূর্ন প্রিতমের ইচ্ছেয় হচ্ছে। প্রিতমের ফোন বেজে উঠে।
-“হ্যালো আম্মু।”
-“হ্যাঁ রে কই তোরা?”
-“আম্মু আমরা একটু কাজে আসছি ,একটু লেট হবে আসতে।”
এই বলে ফোন কেটে দেয়। এই কাজ আদো শেষ হবে কিনা জানা নেই। বিয়ে যদি না তাহলে পালিয়ে কোথায়ও চলে যেতে হবে, মানুষ কে মুখ দেখানোর উপয় নেই।বাবা-মাকেও বা কি জবাব দিবে?
উদাস মনে হসপিটালের বারান্দায় বসে এসব ভাবছে প্রিতম।
নিঝুম এখনও বসে আছে হৃদয়ের পাশে। হৃদয়ের মনে ওর জন্য যত টা ভালোবাসা,প্রিতমের জন্যও সমান। হৃদয়ের কথা ভাবতেই বুকের ভেতর টা হু হু করে উঠে। নিঝুম কাঁদতেও পারছে না। মূর্তির মত বসে আছে। বেশী কষ্ট বা শোকে চোখের পানি শুকিয়ে যায়,শুধু ভেতরটা পুড়ে যায় যা কেউ দেখে না ।
যে মানুষ টার সাথে চার বছরের সম্পর্ক ছিলো। তাঁর আজ এই অবস্থা। কি করা উচিত নিঝুমের? কালকে বিয়ে প্রিতমের ফ্যামিলির মান-সম্মানের ব্যাপার। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। আল্লাহ্ এ কেমন পরীক্ষায় ফেলছে? হৃদয়ের এই অবস্থা মেনে নিতে পারছে না নিঝুম । সব কিছু আবার আগের মত হয়ে যাক,হৃদয় আগের সেই চঞ্চল হৃদয় হয়ে যাক। সব ভাবনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রিতম। কি করা উচিত এখন? হৃদয়ের এই অবস্থায় ওর পাশে থাকা টা কি নিঝুমের উচিত না? এই তো সেই মানুষ টা যার জন্য বাবা-মা সবাইকে ছেড়ে আসছে। আবার প্রিতমের কথা ভাবতেই বুক কেঁপে উঠে নিঝুমের ।
নিঝুম রুম থেকে বের হয়ে দেখে প্রিতম বারান্দায় দাঁড়ানো। প্রিতমের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়াই ধরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। প্রিতম কি করবে বুঝতে পারছে না । নিঝুম কে কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত? ‘হৃদয় সুস্থ হয়ে যাবে কেঁদো না।’ এটা বলা উচিত?
প্রিতম নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“কেঁদো না নিঝুম।”
নিঝুম কেঁদে কেঁদে বলে,
-“কেন এমনটা হলো আমার সাথে?”
প্রিতম ওর চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।বলে,
-“নিঝুম সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে আমার বাসায় যেতে হবে। আম্মু-আব্বু ফোন দিচ্ছে বার বার।”
নিঝুম মাথা নেড়ে প্রিতম কে যাওয়ার জন্য সম্মতি দেয়। হৃদয়ের বোন বলে,
-” নিঝুম তুমি যাবে না? কালকে তোমাদের বিয়ে।এই পরিস্থিতিকে এত ভেঙে পড়লে চলে বলো?”
কোন উত্তর না পেয়ে হৃদয়ের বোন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলল,
-“হৃদয়ের তো যা হওয়ার হইছে। তোমরা তোমাদের লাইফ সাজাও।”
নিঝুম মাথা নিচু করে আছে। প্রিতম বুঝতে পারল ও যেতে চাচ্ছে না। অযথা কি দরকার জোর করার। প্রিতম হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে গেলো। পা চলে না । মনে হয় শরীরে কোন শক্তি নেই। এখন গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেও মুক্তি পেত। সুই-সাইড করতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাসায় পৌঁছতেই সবার প্রশ্ন,
-“নিঝুম কোথায়?”
-“নিঝুম ওর খালার বাসায় গেছে একটা প্রয়োজনীয় কাজে। সকালে চলে আসবে।”
প্রিতমের বাবা রাগান্বিত কন্ঠ বলল,
-” এই সময় প্রয়োজনীয় কাজ? আর ওর খালার বাসা কোথায়?”
প্রিতম সবার চোখের সামনে থেকে এক প্রকার পালিয়ে রুমে চলে গেল। এত প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালো লাগছে না। সবাই বিয়ের ফুর্তিতে মেতে আছে। বাবা-মা কে কি করে এসব বলবে? না,এগুলো বলা যাবে না । কাল সকালে কোথায়ও চলে যেতে হবে।
অনেক দিন পর সিগারেট হাতে নিছে প্রিতম। কয়েকটা সিগারেট শেষ করে ফেলছ,তাও টেনশন মুক্ত হতে পারছে না ।
.
হৃদয়ের পাশে বসে আছে নিঝুম। কোন সাড়া শব্দ নেই হৃদয়ের। শুধু শ্বাসটা আছে। চোখ থেকে পানি বের হচ্ছে না,অথচ বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রিতমের কথা ভাবতেই টেনশন আরও বেড়ে যায়। সুই সাইড করার চিন্তা- ভাবনা করছে নিঝুম। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। আবার ভাবছে সুই সাইড ই কি সব কিছুর সমাধান হতে পারে?
হৃদয় একবার ওর ডাক শুনত। একটু ভালো করে তাকাতো!
.
প্রিতম কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে সুই সাইড করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দুই জনেই ভুগছে নানা রকম দ্বন্দ্বে।
সেই রাত টা তিন জনের জীবন ই তছনছ করে দিলো।
চলবে..

#সেই_রাতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_26 (শেষ পর্ব)
.
-“আমি তোমায় ভুল বুঝছি ,ভাবছি তুমি আমায় ঠকিয়েছো।আমি প্রতিটা দিন তোমার নম্বরে ট্রাই করতাম। জানতাম ফোন সুইচ অফ তবুও আমি ট্রাই করতাম। আমি যত বার বাসার বাইরে বের হয়েছি আমি শুধু এদিক-সেদিক তাকিয়ে তোমায় খুঁজতাম। আজ আমি তোমায় যত টা ভালোবাসি,প্রিতম কেও তত টা ভালোবাসি। আমি তোমার এই অবস্থা সহ্য করে পারছি না হৃদয়। একটা দুর্ঘটনা তিন টা জীবন শেষ করে দিলো। সব কিছুর জন্য আমার বাবা-মা দায়ী।”
হেচকি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হৃদয়ের পাশে বসে একটানা কথা গুলো বলে যাচ্ছে নিঝুম।নিঝুম জানে না এখন ওর কি করা উচিত।
রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল। হাতে সিগারেট নিয়ে বসে আছে প্রিতম। সিদ্ধান্ত ফাইনাল বাসা থেকে পালিয়ে যাবে। এছাড়া উপায় নেই। বাবা-মা, বিয়ে,সবার মান-সম্মান এসব নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না। যা হবার হবে।
নিঝুম সারা রাত সজাগ। হৃদয়ের পাশে বসে ছিলো। হৃদয়ের রাত-দিন সবই সমান। আজ কে বিয়ে হওয়ার কথা ভাবতেই বুকের মাঝে কেঁপে উঠে নিঝুমের ।
প্রিতম সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। সবাই বিয়ের আনন্দে মগ্ন। একটু পর যখন নিঝুম বা প্রিতমের কারোই খোঁজ পাবে না তখন কেমন পরিস্থিতি হবে এসব ভাবতে ইচ্ছে করছে না প্রিতমের । এমন জায়গায় যেতে চায় যেখানে ওর চেনা জানা কেউ নেই। রাস্তায় ধীর পায়ে হাটছে আর এসব ভাবছে প্রিতম ।এর ভেতর ফোন টা বেজে উঠে। ফোনের স্কিনের দিয়ে তাকিয়ে দেখে নিঝুম ফোন দিছে। ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। হয়ত ফোন দিয়ে সান্ত্বনা দিবে আর কি! এসব সান্ত্বনার দরকার নেই।
নিঝুমও তো নিরুপয়। যে ছেলে টার সাথে চার বছরের সম্পর্ক ছিলো,যার জন্য বাবা-মা সবাই কে ছেড়ে চলে আসছে তাঁর এই অবস্থায় কি পাশে থাকা দরকার না? হয়ত হৃদয় কে ভুল বুঝার কারনে প্রিতমের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে এত অল্প সময়ে।
নিঝুম ফোন দিয়েই চলছে। অবশেষে ফোন টা রিসিভ করল।নিঝুম ব্যস্ত কন্ঠ বলল,
-“আপনি কোথায়? আমি হসপিটালের গেটের সামনে নিতে আসেন।”
-“নিঝুম আমি বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে এছাড়া আর উপায় নেই আমার।”
-” আপনায় আসতে বলছি আসেন।”
নিঝুমের জোরাজুরিতে হসপিটালের গেটের সামনে আসতে বাধ্য হলো প্রিতম । নিঝুমের কাছে এগিয়ে এসে বলল,
-“কেন আসতে বলছো?”
-“বাসায় চলুন।”
-“কেন?”
-“বিয়ে আমাদের, বাসায় যাবো না তো কোথায় যাবো?দেখুন আমি হৃদয় কে যত টা ভালোবাসি ,আপনাকেও তত টা ভালোবাসি । আর এখানে প্রশ্ন টা ভালোবাসার না,প্রশ্ন টা মান-সম্মানের। আমার বাবার মান-সম্মান ধুলার মিশিয়ে দিয়ে সেই রাতে আমি হৃদয়ের কাছে চলে আসি। হৃদয় বলছে আমাকে আনতে বাস স্টেশনে যাবে । আর রাত 2টা পর্যন্ত ওয়েট করি কিন্তু ওর কোন খোঁজ পাই নি। ওর ফোন টা বন্ধও ছিলো। তাছাড়া ওর আম্মু অসুস্থ,বাবা নেই, ছোট দুই ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ ও টিউশনি করে যোগাড় করত।এমন সিচুয়েশনে ও আমাকে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু আমি জোর করে ঢাকায় আসি। ভাবছি ও এমন সিচুয়শনে আমায় নিতে চাচ্ছে না তাই যোগাযোগ অফ করে দিছে। এদিকে বাবা-মা ও আমায় বাসায় ফিরে যেতে না করে। আমি বাসায় গেলে নাকি তাঁরা দুই জনই বিষ খেয়ে মারা যাবে। যে মেয়ে বিয়ের আসর থেকে বাবা-মায়ের মান-সম্মান এর কথা না ভেবে চলে আসে ,এমন মেয়ে তাদের দরকার নেই। তারপর তো আপনার কাছেই থাকতাম। হৃদয়ের কারনে সবাই কে হারালাম,আর ও আমার কথা একটুও ভাবলো না এই ভেবে ওকে খুব ঘৃন্য করতাম। কিন্তু এখন আমি কিভাবে ওকে ঘৃন্য করব বলেন?”
নিঝুমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়েই যাচ্ছে। প্রিতমের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আবার বলল,
-“আপনিই তো বলছেন প্রতারক কে ভুলা যায়,কিন্তু ভালোবাসার মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হারিয়ে গেলে তাঁকে ভুলা যায় না।”
প্রিতম অনেকক্ষন চুপ করে থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-“তুমি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসলে কেন? তোমার বাবা-মা কে বুঝিয়ে বললেই তো হত।”
-“আমি সব রকম চেষ্টা করি । জানেন একটা মেয়ে কখন পালিয়ে যায়? যখন সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। বাবা-মা নিজের ইচ্ছা টা কে সন্তানের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় কোন কিছু না ভেবে । বাবা হুট করে বিয়ের আয়োজন করে ফেলে। আমি এক রাত বাবার পায়ের কাছে বসে কাঁদছি। আমার কান্না তাঁদের মন ছুঁতে পারে নি।”
-“নিঝুম শান্ত হও।আবার অসুস্থ হয়ে যাবে তো তুমি। তুমি হৃদয়ের পাশে থাকো। আমার কথা ভেবো না।”
-“কারো কথাই আমি ভাবছি না। আমি মান-সম্মানের কথা ভাবছি। হৃদয় কে আমি সারা জীবন ভালোবেসে যাবো। যতটা এখন বাসি। ওর সাথে হয়ত ভালোবাসা পূর্নতা হবে না । সব ভালোবাসার পূর্নতা লাগে না। কিছু ভালোবাসা কোন রকম পূর্নতা, চাওয়া-পাওয়া ছাড়াই মনের কোনে বাস করে। আমি দু জনকেই ভালোবাসি । হৃদয়ের কথা ভাবতে গেলে আপনি বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। আপনার কথা ভাবতে গেলে হৃদয় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আমি শুধু এইটুকু চাই হৃদয় যত দিন বেঁচে আছে,ওর পাশে থাকতে চাই। দিবেন এই সুযোগ টুকু?”
-” দিবো।”
প্রিতম আর নিঝুম বাসায় উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়। বেঁচে থেকে নরকে যন্ত্রনা ভোগ করছে নিঝুম। আজ পরিস্থিতির কারনে বিয়ে টা করতেই হয়। বাসায় গিয়ে মূর্তির মত বসে আছে নিঝুম । প্রিতমের কাজিনরা ওকে পার্লারে যেতে জোর করে। প্রিতম নিঝুমের মনের অবস্থা টা বুঝে। বলে,
-” না পার্লারে যাওয়ার দরকার নেই। আর হাতে মেহেদী দেওয়ারও দরকার নেই। কোন রকম সাজগোজ ছাড়াই শাড়ী পড়িয়ে দেও।নিঝুমের খালা অসুস্থ তাই ওর মন খারাপ।”
প্রিতমের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় নিঝুম! এত ভালো কেন উনি?
নিঝুম ওর বাবার পছন্দের কালো শাড়ী টা পড়ে।সব কিছু অসহ্য লাগছে তবুও কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না।
কবুল বলতে গিয়ে কলিজাটা চিড়ে যাচ্ছে হৃদয়ের কথা ভেবে । প্রিতম সব টাই বুঝতে পারছে। চোখ বুজে বুক ফাটা একটা আর্তনাদের মত শব্দ করে কবুল বলল নিঝুম।
মন টা একটু শান্তি লাগছে প্রিতমের ।যাই হোক বিয়েটা হলো ,মান-সম্মান বাঁচলো। বুকের ভেতর টা শুকিয়ে যাচ্ছে নিঝুমের । নতুন বউ চুপ-চাপ বসে আছে। কত মানুষ দেখতে আসছে। সবাই কে সৌজন্যমূলক সালাম দিচ্ছে । এটা হয়ত জীবনের আসল রূপ! মন পড়ে আছে হসপিটালে। বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছে হৃদয়ের মুখটা।
নিঝুমের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে প্রিতম ।অনুষ্ঠান শেষ রাত হয়ে গেলো। কত সৌখিন ভাবে সাজানো বাসর ঘর! খাটের উপর বসে আছে নিঝুম । প্রিতম রুমে আসতেই মুখ তুলে তাকালো। প্রিতম বলল,
-“নিঝুম হসপিটালে যাবে?”
বরাবরের মত অবাক হয়ে যায় নিঝুম। এই লোকটার এমন ভালো মানুষির জন্যই এত অল্প সময়ে ভালোবেসে ফেলছে। নিঝুমের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে প্রিতম আবার বলল,
-” এই নিঝুম হৃদয়কে দেখতে যাবে?”
নিঝুম ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“না,সকালে যাবো।”
-“নিঝুম তোমার ভেতর অনেক মহানুবতা আছে। আমি বুঝতে পারি নি তুমি এমন সিচুয়েশনে বিয়ের জন্য রাজি হবে। তুমি হৃদয়ের পাশে থাকতে পারবে। ওটা নিয়ে আমার আপত্তি। আমি তোমায় ভালোবাসি এর মানে তোমার সকল ইচ্ছা-অনিচ্ছা,চাওয়া-পাওয়া কে ভালোবাসা।”
প্রিতম কে দেখে বার বার অবাক হয়ে যাচ্ছে নিঝুম।
-“না কালকে সকালে যাবো। এখন বাসা থেকে বের হওয়া উচিত হবে না।”
-“উচিত-অনুচিতের কথা ভেবে বিয়েতে রাজি হলে তাই না?”
-“জানিনা।”
প্রিতম নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । কপালে আলতো করে চুমো খেয়ে বলল,
-“ঘুমিয়ে যাও নিঝুম।”
নিঝুম প্রিতম কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
-“নিঝুম কেঁদো না প্লীজ। আমি সব সময় সব কিছুর বিনিময়ে তোমার হাসি দেখতে চাইতাম। এখন কিভাবে তোমার মুখে হাসি এনে দিবো বলো?”
-“আপনি খুব ভালো। আমার মত ভাগ্যে কয় জনের হয়? এক ভালোবাসার জন্য অন্য ভালোবাসার বুকের মাঝে থেকে কাঁদা।”
.
প্রিতমের বুকে চোখ বুজে শুয়ে আছে নিঝুম।প্রিতম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । মাঝে মাঝে ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে উঠছে নিঝুম। বলল,
-” আমার বাবা-মায়ের জন্য এর সব টা হয়েছে। কখনো ক্ষমা করতে পারব না উনাদের। উনাদের কাছে টাকা মানেই সুখ।”
প্রিতমের বুকে মাথা গুঁজে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নিঝুম। সকাল হয়ে গেছে প্রায়। প্রিতমের ফোন বেজে উঠে। রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় প্রিতমের ।
হৃদয়ের বোন ফোন দিছে। ফোনে কথা বলে মূর্তির মত বসে রইল প্রিতম ।
-“নিঝুম সকাল হয়ে গেছে হসপিটালে যাবে না হৃদয়কে দেখতে?”
নিঝুম ঘুম থেকে উঠে বসে । বলে,
-“হুম যাবো।”
নিঝুম প্রিতমের সাথে হসপিটালের গেটের যেতেই প্রিতম বলল,
-“হসপিটালের ভেতর যেতে হবে না।”
নিঝুম বিস্ময় হয়ে বলে ,
-“কেন?”
প্রিতম হাত ইশারা দিয়ে হসপিটালের গেট থেকে একটু দূরে একটা লাশবাহী গাড়ি দেখিয়ে দেয়। হৃদয় মারা গেছে!
হৃদয়ের মা,ভাই-বোনের চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে । নিঝুম হৃদয়ের লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে নেই কোন পানি,মুখে নেই কোন চিৎকার।
হৃদয় কে ওর নানার বাসায় দাফন দেওয়া হবে। গাড়ি ছেড়ে দিবে এক্ষুনি। শেষ বারের মত হৃদয়ের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। কষ্টে বুকে পাথর চাপা পড়ছে। প্রিতম কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
-“নিঝুম হৃদয়ের নানার বাসায় চলো। লাশের গাড়ি ছেড়ে দিবে, আমার অন্য গাড়ি যাবো।”
নিঝুমের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিতম নিঝুমের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
-“এই নিঝুম। ”
প্রিতমের বুকে ঢলে পড়লো নিঝুম । সেন্স লেস হয়ে গেছে। হসপিটালের ভর্তি করানো হলো । অনেকক্ষন হয়ে গেল জ্ঞান ফিরছে না। প্রিতম হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভেতর যাওয়া নিষেধ। হৃদয়ের জন্য খুব বেশী খারাপ লাগছে ওর। সব কিছু ভেবে মাঝে মাঝে দুই-এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ছে।
ডাক্তারের রুমে গেলো,
-“এখনও জ্ঞান ফিরে নি?”
ডাক্তার অনেকক্ষন যাবৎ কি যেনো ভেবে বলল,
-“ফিরছে। তবে আপনার মিসেস মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। অতিরিক্ত ডিপ্রেশন, মনে ভেতর থাকা কোন আঘাতের কারনে এমন টা হয়। তবে এটা প্রথম ধাপ।উনি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে কিন্তু তাঁর জন্য সবার সাপোর্ট ,কেয়ার,ভালোবাসা প্রয়োজন।”
প্রিতম বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর শুনেন,
-” উনি অনেক উল্টা-পাল্টা আচরন করবে। উনাকে কোন কিছুতে বিরক্ত করবেন না । কোন করতে করতে বাধ্য করবেন না ।”
প্রিতম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-“আচ্ছা।”
প্রিতম রুমে ঢুকে দেখে নিঝুম কাঁদছে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“নিঝুম কাঁদছে কেন?”
-“পেটে ক্ষুদা লাগছে তাই কাঁদছি।”
প্রিতম বুঝতে পারল আসলেই ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে নয়ত এমন সিচুয়েশনে খেতে চাইত না ।
প্রিতম ওকে খুব যত্ন সহকারে খাইয়ে দিচ্ছে । নিঝুম একটা সময় সুস্থ হয়ে যাবে। দুই জনের ভালোবাসা বুকে নিয়েই সারা জীবন বেঁচে থাকবে।
প্রিতম সে তো এক ভালোবাসার নাম। আর হৃদয় সে তো এক আফসোস।
অভিশপ্ত সেই রাত কত জনের জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিলো!
(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here