#তিতির_পাখির_বাসা-৪পর্ব,০৫,০৬
#জয়া_চক্রবর্তী
৪পর্ব
বেলা করেই ঘুম ভাঙলো তিতিরের।না আজ আর কেউ তাকে আদর করে ঘুম ভাঙায়নি।ঘড়ির কাঁটাটা দশটা ছুঁই ছুঁই।তারমানে বাসি ঘরেই বেড়িয়ে গেছে সুদর্শন।
তিতির মুক্তির আকাশ দেখতে চাইলো,কিন্তু….
উধাও জানলার এপারে দাঁড়িয়ে,কিভাবে দেখবে আকাশ??বিষন্ন মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে তিতির,কোথায়ই বা পাবে যমুনার নীল জল?কিকরেই বা ভাসাবে,মনের নৌকো??
রাতপোশাকটা চটপট বদলে ব্রাশ করেই তিতির রান্নাঘরের দিকে ছুটলো।একটু পরেই বুঝলো,একরাতেই সবকিছু বদলে গেছে।
আজ আর রান্নাঘরে ঢোকবার আগে বাবা (শ্বশুর মশাই)তাকে সুপ্রভাত জানায়নি,চায়ের ফ্লাক্স এগিয়ে দিয়ে চা খেতেও বলেনি মামনি,আজ তো এক গামলা আটা দিয়েও তাকে মাখতে বলেনি কাকিয়া,বলেনি সবজি কুটে,বাটনা বেটে দিতে।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তিতির নিজেই জিজ্ঞেস করলো,তাকে কি করতে হবে?তারপর উত্তর না পেয়ে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।যেতে যেতেই পিছন ফিরে তাকিয়ে একবার দেখে নিলো,ভ্রুক্ষেপহীন খাপছাড়া চেহারাগুলো।
মনে মনে নিজেকে বললো,ভালোই হয়েছে।মাঝেমাঝেই তিতিরের কাজের অক্ষমতা নিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে হাসাহাসি করতে দেখেছে মামনি আর কাকিয়াকে।এমনকি ফোনেও তাকে নিয়ে গাল ভরা গল্প শোনাতে শুনেছে।সত্যি বলতে কি,এসব শুনে ভীষন কষ্ট পেয়েছে তিতির।ডুবে গেছে নিজস্ব বিষাদে।বুক টান টান করা অনুভব সম্বিৎ ফিরে পেতেই ফুসফুস খালি করে বেড়িয়ে এসেছে দীর্ঘশ্বাস।
সুদর্শনকে এসব কিছুই জানায়নি তিতির,শুধু ভেবেছে যে,তিতিরের বাড়ির লোক সম্পর্কে যদি সুদর্শন কিছু বলতো, তাহলে কতটা বেশী খারাপ লাগতো তিতিরের।
আচ্ছা কি করে নিখুঁত কাজ করতে পারবে তিতির?বিয়ের আগে কি সে ঘরকন্নার কাজ শিখেছিলো?পড়াশোনা,গান,নাটক নিয়েই তো ব্যস্ত ছিলো সে।তবুও তো এই তিন মাস ধরে সব কাজ শিখে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।অপটু হাতে কাজ ভুল হয়ে যাচ্ছে, সময়ে শেষ হচ্ছেনা।কিন্তু কি করতে পারে তিতির?মাঝেমাঝে ভাবে,তার না পারা গুলো নিয়ে সবাই এতো আলাপ-আলোচনা করে,কিন্তু তিতির যে কাজগুলোতে পারদর্শী, সেগুলো নিয়ে এদের কোন মাথা ব্যথাই নেই।
অথচ এরাই কাগজে ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো,গান জানা,সুন্দরী,শিক্ষিতা, সংস্কৃতিমনা পাত্রী চাই।তিতির তো এখনো পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি বিজ্ঞাপনের সেই সব চাহিদার কারন!!
তিতিরের পরীক্ষার ফলাফলে যে সবাই খুব খুশি হয়েছে,তেমনটাও মনে হয়নি তিতিরের।বন্ধুরা যখন রেজাল্টের খুশিতে পার্টি করছে,তিতির তখন এক গামলা আটা ঠেঁসে ঠেঁসে মেখে সকলের জন্য একাঁ বেঁকা রুটি বানিয়েছে।
টুকরোটুকরো মনখারাপ গুলো কাউকে জানাবারও সুযোগ নেই তিতিরের
।সেবার মাকে জানাতেই তিতিরকে জ্ঞানের কথা শুনতে হয়েছে,মা বলেছে,”কেউ নিন্দে করলেই যেমন তুমি খারাপ হয়ে যাবেনা, তেমনি প্রশংসা করলেও ভালো হয়ে যাবে এমন নয়…কে-কখন-কাকে-কি বললো,সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কাজ গুলো শিখে নাও”।
মা তো বলতেই পারে,অনেক কিছুই মুখে বলা সহজ।তার চাকরী করা মা কি করে বুঝবে যে দুটো করে মোচা,দুটো করে এঁচোড় কাটা মুখের কথা নয়,মিক্সি ছাড়া মিহি করে মটরডাল কি তার মা বেটেছে কখনো?বড় এক গামলা আটা ঠেঁসে ঠেঁসে নরম করে মাখতে তার মা থোড়াই পারবে।
আরো এমন অনেক কাজের লিস্ট মনেমনেই বানাতে বসলো তিতির,যেগুলো করতে তার মাও হিমসিম খেয়ে যাবে।একান্নবর্তী পরিবারের কাজ যে কতো শক্ত তার মা কি করে জানবে?চা এর কাপে চুমুক দিয়েই তিতির বেসিনে গিয়ে থুঃ থুঃ করে ফেলে দিয়ে আসলো,এসব এলোপাথাড়ি চিন্তার মাঝে চা জুড়িয়ে কখন ঠান্ডা জল হয়ে গেছে।
এক ফাঁকে বাবাও একবার শুনিয়েছিলো তিতিরকে,”adjustment is the best policy to maintain your family peace”….অথচ স্বপ্নপূরণ করতে হলে গ্র্যাজুয়েশনেই থেমে থাকলে চলবে না,আরো অনেক পড়াশোনা করতে হবে তিতিরকে।কিন্তু এরা তো পড়াতেই চাইছেনা।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তিতরের।
জোড় করে অন্যের বাড়িতে বিনে মাইনের পার্মানেন্ট ‘হাউজ-ওয়াইফ’ পদের চাকরীতে বহাল করিয়ে তার বাবা-মা যে কি সুখ পেলো,সেটাই তিতিরের কাছে পরিষ্কার নয়।কিন্তু এই বিনে মাইনের চাকরীই যদি সে করবে তাহলে কি দরকার ছিলো তাকে পড়াশোনা শেখাবার?কি দরকার ছিলো গান শেখাবার-নাটক করতে দেওয়ার?তিতিরের নিজের জীবনই আজ চলমান নাটক।
কতদিন যে তিতির গল্পের বই পড়েনি,কতদিন যে তানপুরা নিয়ে রেওয়াজে বসেনি।এরা খিল্লি বানিয়ে ছেড়েছে তিতিরের জীবনটাকে।
হয়তো বদলে যাওয়াটাই নিয়তি,বদলে যাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।মা-বাবাও চেয়েছে বদলে যায় তিতির।
ভালো থাকে,খুশী থাকে,আনন্দে থাকে এসব কিছুই নয়।শুধু যেন সব কিছু মেনে নেয়।
সব কিছু মেনে নিয়ে বদলে নেয় নিজেকে।
সেই কবে থেকে বদলাচ্ছে তিতির,স্পার্ম থেকে ভ্রুণ,ভ্রুণ থেকে মাংসপিণ্ড,মাংসপিণ্ড থেকে মানবশিশু।তারপর তো শরীর বড়ো হওয়ার সাথে সাথে মনের বদল ঘটেছে নিরন্তর।বদলে গিয়েছে তিতির।কখনো নিজেরজন্য,কখনো সবার জন্য।
গিরগিটি দেখেও ইদানীংকালে ভয় পায় তিতির।না আর নয়,আর বদলানো নয়।সিদ্ধান্তটায় অটুট থাকতে হবে।মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে,গিয়ে উঠবে কোন লেডিস হোস্টেলে,গয়নাগাটি বেচে পাওয়া টাকা ব্যাংকে রাখলে যা সুদ পাবে,তাতে নিশ্চিন্তে পড়াশোনাটা শেষ করতে পারবে,কন্টিনিউ করতে পারবে নাটক,গান।চাকরীর পরীক্ষাগুলোতেও এরপর নিয়মিত বসতে হবে তিতিরকে,জানে যতটা সহজ ভাবছে তত টা সহজ হবেনা ,অনেক সংগ্রাম করতে হবে তিতিরকে।
তবু কাঁটা বেছানো পথে চলেই তাকে ফুলের বাগানে পৌঁছোতে হবে,অন্ধকার রাস্তা দিয়েই হেঁটে পৌঁছোতে হবে আলোর সীমানায়।
হঠাৎ হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো সুদর্শন।তিতিরের দিকে একবার ও না তাকিয়েই ঢাউস ব্যাগ দুটো আলমারি থেকে নামিয়ে ব্যস্ত হাতে গোছাতে শুরু করলো,নিজের আর তিতিরের জামাকাপড়।
তিতির অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলো,আমরা কি কোথাও যাচ্ছি?? ছোট্ট হেসে সুদর্শন বললো,”স্যরি পাখি আগে জানাইনি,আজ রাতেই ট্রেন,যাচ্ছি সিমলা কুলু মানালি,ফর হানিমুন..
(চলবে)
#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব ৫)
#জয়া_চক্রবর্তী
রাত ৭টা৪০মিনিট নাগাদ হাওড়া থেকে কালকা মেইল ছেড়েছে।দেখতে দেখতে প্রায় দেড়ঘন্টা হতে চললো।সুদর্শনের তিতির পাখিটি কিন্তু ঠায় জানলার ধারে বসে।অবাধ্য চুল গুলো হাওয়ায় উড়ছে,মাঝেমাঝেই অলস হাতে কপাল থেকে চুলের গোছা সরাচ্ছে।পাতলা ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক করা।
উল্টো দিকে বসা সুদর্শনের ভীষন ইচ্ছে করছে,আঙ্গুল ছোঁয়াতে ঠোঁটে,ইচ্ছে করছে দুহাতের পাতায় মুখটা ধরে নাকে নাক ঘষে দিতে,দুষ্টুমি করে কানের লতিটা কামড়ে দিতে।ইচ্ছেগুলো গাছেদের মতো ক্রমশঃ শাখা প্রশাখা বিস্তার করে অস্থির করে তুলছে সুদর্শনকে।
আসবার সময় তো রাস্তায় কোন কথাই বলেনি তিতির।বলবে কি আসতেই তো চাইছিলো না,রীতিমতো সাধ্যসাধনা করে ম্যাডামকে রাজি করাতে হয়েছে।এমনকি একথাও সুদর্শন কে বলতে হয়েছে যে ফিরে গিয়েই ডিভোর্সের ব্যাপারে উকিলের সাথে কথা বলবে।
কথাটা মনে পরতেই সুদর্শনের চোখ জ্বালা-জ্বালা,বুক টনটন করে উঠলো।কত কথাই যে বলার ছিলো তিতিরকে।সেই সব না বলা কথা গুলো বলতে চায় সুদর্শন।বলতে চায়,
তোমার সমস্ত অভিমান নিয়ে
তুমি আছড়ে পড়ো আমার বুকে।
চারদিকে ছিটকে পড়ুক
জমে থাকা,সমস্ত পাওয়া-
না পাওয়ারা।
ঠিক যেমনটি জলরেনু
ছিটকে পড়ে পাহাড়ের বুকে,
আর তাতে খেলে যায়
রামধনু রঙ।
আমি হিমালয়ের মতো
শান্ত স্থির হয়ে,
সয়ে যাব তোমার অভিমান….
আমার না বলা কথারা সব,
তোমার অভিমানী কথার বুকে
সাঁকো বেঁধে দেবে পরম আদরে।
কিন্তু সুদর্শনের প্রকাশ কম।ও কি আদৌ এসব বলতে পারবে তিতিরকে?আর না বললেই কি তিতির কখনো বুঝে নিতে পারবে যে,সুদর্শনের মনের প্রতিটি শব্দ তিতিরের আঙুল ছুঁয়ে শুধু একটা কথাই বলে যায়,’ভালোবাসি’…..
এখন নভেম্বরের শেষ।ঠান্ডা হিমেল ভাব বাতাসে।এই সময়টাই ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ভয় থাকে।জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় শিরশির করছে গা।বেশ কয়েকবার তিতিরকে জানলা ছেড়ে সরে বসতে বললো সুদর্শন।তিতির এক চুল ও নড়লো না।
বাধ্য হয়েই তিতিরকে সরিয়ে কাঁচের জানলাটা নামিয়ে দিলো।খাওয়ারের ব্যাগটা বের করে বললো,এসো খেয়ে নিই।তিতির চুপচাপ সুদর্শনকে খাওয়ার বেড়ে দিয়ে,নিজেও একটা পরোটায় মাংস নিয়ে রোল করে আলতো কামড় দিতে থাকে।
বন্ধুদের সাথে সিমলা কুলু-মানালি ঘুরতে এসেই ঠিক করেছিলো সুদর্শন যে বিয়ের পর হানিমুনেও এখানেই আসবে।শীতকালে শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে আবৃত থাকে পাহাড়ের চূড়া।অসাধারণ লাগে যখন সেই চূড়ায় লুকোচুরি খেলে রোদ আর মেঘ।শুনেছিলো পূর্ণিমায় চাঁদের আলো পরলে আরো মায়াবি হয়ে ওঠে পাহাড়।তাই এমনভাবেই প্ল্যানিং করে টিকিট কেটেছিলো,যাতে মাঝে পূর্ণিমা পায়,আর হানিমুনটা স্বার্থক হয়ে ওঠে ওদের জীবনে।
কালরাতেই তিতিরের হাতে টিকিট দুটো দিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো,কিন্তু তিতির নিজেই ওকে ভয়ঙ্কর রকমের সারপ্রাইজ দিয়েছে।
তিতির ঘুমিয়ে পরবার পর সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সুদর্শন।ভেবেছিলো কেন্সেল করে দেবে টিকিট।কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদলে নেয়।,কোন এক অজানা আশায় বুক বেঁধে।
সকাল হতেই রাতপোশাক বদলে,লেকের ধারে গিয়ে এক্সারসাইজ সারে।তারপর ওখান থেকেই সোজা চলে যায় লেক মার্কেট।দুদিনের বেশী ট্রেনজার্নি,তাই বেশ কিছু ড্রাই ফুড,মেডিসিন, শ্যাম্পুর পাতা,সাবান ইত্যাদি লিস্ট মিলিয়ে কিনে নেয়।তিতির ছাড়া বাড়ীশুদ্ধু লোক সবাই জানতো ওদের এই ট্রিপের কথা।
দুদিন আগেই বেশ কিছু গরম জামা-কাপড় কিনে মায়ের আলমারিতে রেখে দিয়ে এসেছিলো সুদর্শন। আজ যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল,তিতিরের হাঁ মুখটা দেখবার মতো ছিলো।
তিতির বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে হ্যান্ড ব্যাগ খুলে ক্রিম বের করে হাতে মুখে লাগিয়ে নিয়ে,ওপরের বাঙ্কে গিয়ে শুয়ে পরলো।সুদর্শন ওকে ভালো করে কম্বলে মুড়ে দিয়ে,নিজেও শুয়ে পরলো নতুন ভোরের আশায়,ক্রমে হারিয়ে গেলো ঘুমের অতলে।
(চলবে)
#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-৬)
#জয়া_চক্রবর্তী
‘চা-কফি’,’ডিম-পাউরুটি’ করে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ফেরীওয়ালা।ওদের হাঁকডাকে অনেকক্ষন আগেই ঘুমটা কেঁচিয়ে গেছে তিতিরের।তবু আরো একটু ঘুমের আশায় নিজেকে কম্বলের ওমে মুড়িয়ে নিলো তিতির।
নীচে বেশ জমাটি আড্ডার আমেজ,সুদর্শনেরও গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।ওদের কথাবার্তায় বুঝলো,এই কামরায় আরো একটি হানিমুন কাপল আছে,যাদের বিয়ের তারিখ আর হানিমুন প্লেস তিতিরদের সাথে মিলে গেছে।
তিতির একটু ঝুঁকে পরে ওদের মুখ গুলি দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলো।দেখলো দুটো ছিপছিপে ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে অনর্গল কথা বলে চলেছে।
আরো দেখলো মেয়েটি কারনে-অকারনে হেসে লুটিয়ে পরছে ছেলেটির গায়ে।মাথার চুল ঘেঁটে দিচ্ছে,ছেলেটিও বেশ উপভোগ করছে বিষয়টি।হয়তো বহুদিনের প্রেম পরিণতি পেয়েছে।
আড়মোড়া ভেঙে তিতির উল্টো দিকে ফিরে শুলো,ঘুমিয়েও পরলো একসময়।
ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই,তাই আর তিতিরকে না ডেকে পারলোনা সুদর্শন।মেয়েটা কাল রাতে সেই যে একটা পরোটা খেয়ে ঘুমোচ্ছে,এখনো দাঁতে একটা দানা কাটেনি।এতোক্ষন খালি পেটে থাকাটা ঠিক নয়।
দ্বিরাগমন থেকে ফেরবার সময় শ্বশুরমশাই হাত দুটো ধরে বলেছিলেন,’ছোট থেকেই বড্ড খাওয়া নিয়ে জ্বালায় মেয়েটা,দেখো যেন খাওয়া-দাওয়াটা ঠিক মতোন করে’।সুদর্শন ওনার হাতে আলতো চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলো যে ও বিষয়টা অবশ্যই খেয়াল রাখবে।
কিন্তু যৌথ পরিবারে এমন কাজ করা যে কঠিন সেটা অচিরেই বুঝে গিয়েছিলো সুদর্শন।একদিনতো কাকিমুনি বলেই বসলো,’আমাদেরও নতুন বিয়ে হয়েছিলো,তোমার কাকাই, বাবা কিন্তু কখনোই আমাদের খাওয়া নিয়ে এমন আদিখ্যেতা দেখায়নি’।
সুদর্শন কি করতে পারে ওর কাকাই,বাবা যদি কেয়ারিং না হয়!!তাছাড়া সময়ে তিতির খেয়েছে কিনা শুধু এটা জানতে চাওয়ায়,কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে?
তিতির বাঙ্ক থেকে নেমে ঘুম চোখে তাকালো।
সুদর্শন কফি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,চুমুক দিয়ে নাও,ঘুমটা কেটে যাবে।পাশের মেয়েটি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলে উঠলো,’সেকি ঘুম কাটেনি এখনো?ট্রেনে এতো ঘুমোনো যায়?আমার তো ট্রেনের আওয়াজ,আর হকারদের জ্বালায় ঘুমই আসেনা’।
তিতির ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,’ আমিও উঠেছিলাম,কিন্তু আবার ঘুমিয়ে পরেছি,আমার নাম তিতির,তোমার?’
মেয়েটি হেসে বললো,’আমার নাম দিয়া,আর ও হলো অচিন্ত্য’।ছেলেটি হাত নাড়ালো তিতিরের দিকে তাকিয়ে।তিতির মিষ্টি হেসে এক চুমুকে কফি শেষ করে বললো,ফ্রেস হয়ে আসছি।
তিতিরের স্বাভাবিক আচরনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো সুদর্শন।ফ্রেশ হয়ে তিতির এসে পাশে বসতেই দিয়া বলে উঠলো,’তিতির তো পাখি,ধরে না রাখলে কিন্তু ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে’।
ভারি দুষ্টু মেয়ে তো?।মজা পেয়ে সুদর্শন তিতিরের নরম হাতটা নিজের মুঠোয় ভরে নিলো।
তিতির ছাড়িয়ে নিতে চাইলো।
কিন্তু সুদর্শনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে পারলোনা।দিয়ার দিকে তাকিয়ে সুদর্শন বলে উঠলো ,’উড়ে যেতে দিলে তো,এ পাখি মনের খাঁচায় রাখা’।
তিতির প্রসঙ্গ ঘোরাতে দিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় থাকো?’
এই একটা প্রশ্নের উত্তরে দিয়া অনেক খবর একসাথে দিয়ে দিলো,যেমন ও বালিগঞ্জের মেয়ে,বিয়ে হয়েছে দমদম,ওরা দুই বোন,আগামী বছর ও পার্ট-টু তে বসবে।ওর বিষয় হলো ইতিহাস।
অচিন্ত্যর মা নাকি দিয়াকে কোন এক বিয়েবাড়িতে দেখে পছন্দ করেছে সে কথাও জানালো।তার মানে,সম্বন্ধ করে বিয়ে। তিতির একটু অবাকই হলো।
তিতির বললো,’বাহ ইতিহাস নিয়ে পড়ছো যখন,তখন তোমার এলেম আছে বলতে হবে,আমার আবার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয় হলো ইতিহাস,খুবই কঠিন।আমি পড়েছি জিওগ্রাফি নিয়ে’।
হঠাৎ অচিন্ত্য বিজ্ঞের মতো মুখ করে বলে উঠলো, ‘ইতিহাস আবার কি এমন কঠিন?ঘ্যানঘ্যান করে শুধু মুখস্থ করো আর খাতায় বমি করে দাও,আর মুখস্থ না হলেও চাপ নেই,উত্তরের প্রথম আর শেষ দিকটা মুখস্থ করে মাঝে কোন অন্য গল্প লিখে দিলেও নাম্বার পেয়ে যাবে,ভীষন বোরিং বিষয়’।তিতির হেসে ফেললো ওর কথা বলার ধরনে।
দিয়া কিন্তু রেগে গুম গুম করে কিল মারতে থাকলো অচিন্ত্যকে,আর অচিন্ত্য হা হা করে হাসতে থাকলো।বেশ মজার জুটি,ভালো লাগলো তিতিরের।
হঠাৎ ভাবগম্ভীর গলায় সুদর্শন বলে উঠলো,’যদিও আমি বিজ্ঞানের ছাত্র,তবু ইতিহাস কিন্তু আমার প্রিয় বিষয়।বিজ্ঞানের মতো ইতিহাস ও সত্যানুসন্ধান করে’।
দিয়া এবার অচিন্ত্যকে কিল মারা বন্ধ করে দিয়ে বললো,’একদম ঠিক বলেছো দাদা’।
সুদর্শন বললো,’আমি তো মনে করি,অতীতের চেতনা ছাড়া যেমন বর্তমানকে উপলব্ধি করা যায়না,তেমনি ভবিষ্যৎ কেও নির্মাণ করা অসম্ভব’।দিয়া বলে উঠলো,’অতীত মানুষের অভিজ্ঞতা কিন্তু আমাদের বর্তমান আর আগামীর জন্য খুব প্রয়োজন’।
সুদর্শন বললো,বিশিষ্ট রুশ ইতিহাসবিদ মন্তব্য করেছিলেন,”ফুলকে অন্ধরা দেখছে না,এর জন্য ফুল দায়ী নয়,মানুষের অন্ধত্বই দায়ী”।
দিয়া বললো, ‘তাছাড়া সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কিন্তু ইতিহাসের ভূমিকা থাকে’।সুদর্শন বললো,’অবশ্যই, সাহিত্যিকদের লেখা থেকে আমরা সেই বিশেষ সময়ের সামাজিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক অবস্থা জানতে পারি’।
ভাগ্যিস খাওয়ার চলে এসেছিলো,নাহলে হয়তো ইতিহাসের সাথে ভূগোলের সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা শুনতে হতো।কোন কুক্ষনেই যে তিতির ইতিহাস কে অপছন্দের বিষয় বলেছিলো।নিজের পিঠেই এবার গুম গুম কিল লাগাতে ইচ্ছে হলো ওর।আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো।
(চলবে)