#তিতির পাখির বাসা,পর্ব-১৬,১৭,১৮
#জয়া চক্রবর্তী।
পর্ব-১৬
‘আলু পরোটা আর রায়তা বলি?চাইলে অন্য কিছুও নিতে পারো।সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,’আমার জন্য একটা আলু পরোটা আর টক দই বলো’।
‘নাম পাখির বলে তোর দেখছি খাওয়াটাও ওই পাখিরই মতো’,তুহিনের আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা দুজনের কারোরই ভালো লাগলো না। কিন্তু মুখে কেউ কিছু প্রকাশ করলোনা।
চণ্ডীগড়ে নামার পর থেকেই তুহিন ওদের সাথে।কারনে অকারনে সব বিষয়েই আগ বাড়িয়ে কথা বলে চলেছে।
তবে তিতিরকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা আদৌ ওর সামনে তুহিনের কোন অস্তিত্ব আছে কিনা।তুহিনের কথা গুলো শুনেও না শোনার ভান করছে।
হঠাৎ ফাঁক পেয়ে সুদর্শনকে জিজ্ঞেস করলো তিতির,’কি ব্যাপার বলোতো,তুহিনদা কি হাওড়া অবধি আমাদের সঙ্গে যাওয়ার প্ল্যান করছে নাকি?’
সুদর্শন দুষ্টুমি হাসি হেসে বললো,’বারন তো করতে পারিনা,তোমার একনিষ্ঠ প্রেমিক’।
তিতির মুখ ভেঙচে বললো,’হ্যাঁ তোমায় বলেছে’।সুদর্শন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো,’বোঝা যায় ম্যাডাম,বোঝা যায়’।
তারপর চোখে চোখ রেখে,দুটো ভ্রূ নাচিয়ে বললো,’ওর জন্যই কি ডিভোর্স চাওয়া হচ্ছে নাকি?তিতির রেগে গিয়ে গুমগুম করে দুটো কিল মারলো।সুদর্শন হো হো হেসে উঠলো।
খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে এসে বসলো তিতিররা।
এখন পড়ন্ত বিকেল।
তিতিরের কাছে, বিকেল মানেই
গেরুয়া রঙ।
বিকেল মানেই
তিরতির হাওয়ায় খেলা।
বিকেল মানেই বন্ধুদের সাথে
এক পা তুলে কিতকিত।
কখনো লুকোচুরি,
কখনোবা এলাটিং বেলাটিং শৈল।
খেলা নিয়েই আড়ি-ভাব
খেলা নিয়েই ঝগড়াঝাঁটি।
তবে তিতির খেলার বিষয়ে বরাবরই ভাগ্যবতী।
বায়না করে দাদার সাথে ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন খেলতো।তবে বল হারিয়ে গেলে বা ফেদার কক হারিয়ে গেলে তিতিরকেই খুঁজে আনতে হতো।
আবার কোনদিন খুঁজে পাওয়া না গেলে কষ্টি পেয়ারা গুলো দিয়েই খেলা চলতো,নাহলে খবরের কাগজ গোল করে পাকিয়ে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকে দিব্বি চার ছয় মারা হতো।
‘আমি একটু ঘুরে আসি,তুমি বসবে না যাবে?’সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,আমি বসছি,তুমি বরং তুহিনদাকে নিয়ে যাও’।
সুদর্শন তুহিনকে নিয়ে বেড়িয়ে গিয়ে রাতের আর পরের দিন সকালের মতো খাওয়ার প্যাক করিয়ে নিলো।
তুহিন ও নিজের জন্য খাওয়ার প্যাক করালো।
তুহিন উইদাউট রিজার্ভেশন ট্রেনে উঠেছে।উদ্দেশ্য কিছু টাকা খাইয়ে চেকারের থেকে তিতিরদের কামরাতেই একটা সিট ম্যানেজ করা।
তিতির কোনভাবেই চাইছিলো না,তুহিন ওদের সঙ্গে এক কামরাতে যাক।কিন্তু তুহিনের কাছে চেকার ভগবানের অবতার হিসেবে দেখা দিলেন।তিনি বেশী পয়সা খেয়ে তুহিনকে ওই কামরাতেই সিট বুক করে দিলেন,যদিও বলে গেলেন যে সকালেই সিটের মালিক ট্রেনে উঠবেন।
রাত বাড়তেই সুদর্শন বললো,’খেয়ে নিলে হয়না?’
তিতির বললো,আমি কিন্তু কিছু খাবো না।একেবারেই খিদে নেই।তোমাকে খাওয়ারটা বেড়ে দিয়েই শুয়ে পড়বো।সুদর্শন বললো,আমি বেড়ে নিচ্ছি,তুমি চাইলে শুয়ে পড়ো।
তিতির কথা না বাড়িয়ে নিজেই সুদর্শনের খাওয়ার বেড়ে এগিয়ে দিলো।হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ফেসওয়াস বার করে বেসিনে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো।ফিরে এসে দেখলো তুহিন ও শোওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।তিতির নাইট ক্রিম মুখে হাতে ঘসে নিয়ে সোজা আপার বাঙ্কে।
সারাদিনের ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে এলো তিতিরের চোখে।
তিতিরের ঠিক উল্টো দিকের বাঙ্কে তুহিন উঠে এলো।এখন তুহিনের মাত্র দুহাত দুরেই ওর কাঙ্ক্ষিত নারী।
উত্তেজনায় তুহিনের সারা শরীর কাঁপছে।এই প্রচন্ড ঠান্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে।
কল্পনায় দুটো বাঙ্ক মিলিয়ে এক করে নিলো তুহিন।
তিতির নিজেকে কম্বল দিয়ে মুড়ে রেখেছে।শুধু ওর মুখটা বার করা।তুহিন পরম যত্নে ওর কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো।কল্পনাতেই তিতিরের মাথাটা নিজের বুকে চেপে নিলো।তিতিরের নাকে নিজের নাক ঘষে দিলো।ওর গোলাপি ঠোঁটটায় নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।
হঠাৎ সুদর্শন তুহিনকে ডেকে বললো,’খাওয়ার পর জল খেলেননা তো’।জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,’খুলে একটু গলায় ঢেলে নিন’।
তুহিন সুদর্শনের দেওয়া জলের বোতলটা পুরো শেষ করে বললো,’ আপনার অসুবিধা না থাকলে প্লিজ আপার বাঙ্কে আসুন।আমার ওপরে ঘুম আসতে চায়না’।সুদর্শন বললো,’লাগেজ আছে যে’।তুহিন নীচে নেমে এসে বললো,’আমি খেয়াল রাখবো,আপনি ওপরে যান’।
তুহিনের কথায় সুদর্শন আপার বাঙ্কে তিতিরের মুখোমুখি শুয়ে পরলো।তবে হঠাৎ তুহিনের নীচে নেমে যাওয়াটা ওর কাছে ধোঁয়াশাই ঠেকলো।
তুহিন নীচের বাঙ্কে চুপচাপ আধ শোয়া হয়ে কাঁচের জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো।একটু আগের তুহিনের সাথে এই তুহিনের আকাশ পাতাল পার্থক্য।
সুদর্শনের ডাকার টাইমিংটা ঠিক ছিলো।নাহলে এতোক্ষনে কল্পনাতেই তুহিনের দ্বিধাহীন হাতেরা অবাধ্য আদিমতায় ভর করে গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে যেত।মনে মনে সুদর্শনকে ধন্যবাদ জানালো তুহিন।এখন তিতির সুদর্শনের বৌ।ওকে নিয়ে কল্পনাতেও একসাথে থাকা অন্যায়।
কলেজে পড়তে এই তিতিরকে নিয়ে তুহিন কল্পনায় কতবার যে একসাথে হারিয়ে গেছে তার ঠিক নেই।
কখনো গঙ্গার নিরিবিলিতে, কখনো ময়দানের ভিড়ে।কখনো সিনেমা হলের অন্ধকারে। কখনোবা বিয়ের পর সেই প্রথম রাতে।যেখানে তিতির লাল টুকটুক বেনারসিতে সেজে শুধু তুহিনের জন্যই অপেক্ষা করছে।
তুহিন প্রায় প্রতিরাতেই কল্পনায় তিতিরের ঘোমটা নামাতো।পকেট থেকে আংটি বের করে পরিয়ে,ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডোবাতো।ওর সাথে জীবনের পাওয়া না পাওয়াগুলো নিয়ে গল্প করতো।
ইস তখন যদি একটু সাহস করে তিতিরকে নিজের মনের কথাটা জানাতো,যদি তিতিরের কোন বন্ধুকে দিয়েই তিতিরকে চিঠি লিখে পাঠাতো, তাহলে হয়তো তিতির আজ অন্য কারো বৌ হতোনা। অনেকটা দেরী হয়ে ফেলেছে।এখন আর সেই সব ভাবনার কোন মূল্য নেই।
না তা বলে ভূলে যেতে পারবে না তিতিরকে।অনেকগুলি কঠিন কাজ অভ্যেস করার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হলো ভুলে থাকার অভ্যেস করা।
শুধু এতোদিন তুহিনের যে মন স্বপ্ন-অভিসারে আদিমতম সুখের আশকারা খুঁজতো,আজ সেই মন ডুবে যেতে চাইছে চিরতরে ভোরের সূর্য স্নানে।
সকাল হতেই চা-কফি ওয়ালাদের ভীড়।সুদর্শন নীচে নেমে এসে দুটো কফির অর্ডার দিলো।
‘সব পাখিরা উঠে গেলেও তিতির পাখির ঘুম ভাঙেনি এখনো’,কথাটা তুহিনকে বলতে বলতেই কফির কাপটা এগিয়ে দিলো সুদর্শন।
তুহিন হাত বাড়িয়ে কফিটা নিলো।
সুদর্শন বললো,’ঘুমোননি রাতে?চোখ দুটো লাল হয়ে আছে’।তুহিন বললো,’হুম নীচে এসেও ঘুমটা এলোনা।
তবে সত্যি কথা বলতে কী অনেককাল ঘুমিয়েই ছিলাম,কাল রাতেই ঘুম ভেঙেছে’।তুহিনের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলো না সুদর্শন।
সুদর্শন ব্যাগ থেকে স্লাইস কেক বার করে তুহিনের হাতে ধরালো,নিজেও নিলো।
তারপর বাঙ্কে উঠবার অর্ধেক সিঁড়ীতে উঠে তিতিরের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বললো,’পাখি নীচে নেমে এসো,কাল রাত থেকে পেট খালি’।
আড়মোড়া ভেঙে তিতির বললো,’ঘুমোতে দাও,পরে খাবো’।’আগে খাবে পরে ঘুমোবে’,সুদর্শনের কথায় কিছু একটা ছিলো,যাতে বাধ্য হয়ে তিতির নীচে নেমে ব্রাশ করে আসলো।
তিতির জানলার সামনে বসতেই সুদর্শন কেক এগিয়ে দিলো। তুহিন এখন নীরব দর্শক।দুজনের মধ্যে নিজেকে ওর অতিরিক্ত মনে হলো।ব্যাগ থেকে জীবনানন্দের একটা কবিতার বই খুলে বসলো।
সুদর্শন তুহিনের হাত থেকে বইটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে ফেরত দিয়ে বললো,’আপনি কি আবৃত্তি করেন?’।তুহিন বললো,’না না তেমন কিছু নয়,ভালো লাগে তাই পড়ি’।
সুদর্শন বললো,’তাহলে প্লিজ হয়ে যাক একটা,আজকের সকালটা আমাদের কাছে সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকুক’।
তুহিন ভরাট জমাটি গলায় পাঠ শুরু করলো,
“সুচেতনা তুমি এক দূরতম দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে,সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে নির্জনতা আছে………তুহিনের পাঠ চলতে থাকলো।
তিতিরের হাতের কেক হাতেই রয়ে গেলো।তিতির জানতোই না তুহিনদা এতো দারুণ আবৃত্তি করে।
তুহিনের পাঠ শেষ হতেই সুদর্শন শুরু করলো,”একদিন এ পৃথিবী জ্ঞানে আকাঙ্ক্ষায় বুঝি স্পষ্ট ছিলো,আহা,
কোনো এক উন্মুখ পাহাড়ে মেঘ আর রৌদ্রের ধারে,
ছিলাম গাছের মতো ডানা মেলে-পাশে তুমি রয়েছিলে ছায়া….সুদর্শন বলে চলেছে।
সুদর্শনের শেষ হতেই তুহিন তারপর আবার সুদর্শন….চলতেই থাকলো।তিতির শুধু মুগ্ধ শ্রোতা।দুজনের মধ্যে কে বেশী ভালো বক্তা সে বিচার করার ক্ষমতা তিতিরের নেই।আছে শুধু এক আকাশ ভালো লাগা।(চলবে)
#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-১৭)
#জয়া চক্রবর্তী।
কথায় কবিতায় বেলা বাড়লো।তুহিনের চোখ জুড়ে ঘুম।কাল সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি তুহিন।
তুহিনের চোখ মুখ খেয়াল করে সুদর্শন বললো,’কিছু খেয়ে বরং দুপুরটা একটু ঘুমিয়ে নিন ওপরের বাঙ্কে উঠে’।
তুহিন বললো,’কিরে তিতির তোর আবার দিবানিদ্রার অভ্যেস নেইতো?তিতির হেসে বললো,আরে না না,দুপুরে আমি ঘুমোইনা’।
‘তাহলে তো আপনার প্রস্তাব চমৎকার,সত্যিই আজ ঘুমটা বড্ড প্রয়োজন আমার’,তুহিনের কথায় সুদর্শন হাসলো।
দুপুরের খাওয়ার খেতে খেতে তেমন কথা হলোনা কারোর।তুহিন খাওয়ারটা শেষ করেই সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলো বাঙ্কে।অনুমতি নিয়ে তিতিরের হাওয়া বালিশে মাথা দিয়ে পায়ের তলার কম্বলটা খুলে গায়ে চড়িয়ে নিলো।
কিন্তু ঘুমের বদলে এলো একরাশ অস্থিরতা।এই বালিশে তিতিরের মাথা ছিলো,এই কম্বলটাই তিতিরের সারা শরীরকে উষ্ণ রেখেছিলো এমন সব ভাবনা তুহিনের শরীর মন অসাঢ় করে দিচ্ছিলো।
তুহিন চোখ দুটো বুজতেই তিতিরের শরীরের ভার ওর শরীরের ওপর।তিতিরের নিশ্বাস পর্যন্ত ও অনুভব করতে পারছে।
কতক্ষণ সময় এইভাবে কেটে গেলো তুহিন নিজেই জানেনা।যখন চোখ খুললো,তখন দিনের আলো শেষ।ট্রেনের কামরায় আলো জ্বলছে।
তুহিনের শার্ট ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।হাতঘড়ি চোখের সামনে নিয়ে দেখলো সাড়ে আটটা বাজে।তুহিন বুঝলো, এতোক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো।
তুহিন পড়েছিলো, স্বপ্ন হলো অবচেতন মনের ইচ্ছে ও চিন্তা ভাবনার প্রকাশ।স্বপ্নেই আমরা কাঙ্ক্ষিত বস্তুর সান্নিধ্য পাই,প্রিয়তমার স্পর্শ পাই।
তুহিন বাঙ্ক থেকে নেমে আসে।সুদর্শন হেসে বললো,’কি ঘুমটাই না ঘুমোলেন।দাঁড়ান চা বলছি’।তুহিন চা খেতে খেতে গুনগুন করে সুর ভাজছিলো গলায়।সুদর্শন বললো,’আসতে কেন,গলা ছেড়ে হয়ে যাক’।
“আবার হবেতো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো,কি চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজো হয়তো”… তুহিন মান্না দের গানটা গেয়ে উঠলো।
গাইতে গাইতে তুহিনের চোখ তিতিরের চোখ ছুঁয়ে গেলো বেশ কয়েকবার।
তিতিরের মুগ্ধ দৃষ্টি তুহিনের ভালো লাগছিলো।
তুহিনের গান থামতেই তিতির বলে উঠলো,’তোমার এতো গুন আমি জানতাম না তুহিনদা’।
‘কেন জানলে কি প্রেমে পরতিস আমার?’তুহিনের কথায় তিতির জোরে হেসে উঠলো।
তুহিন বলে উঠলো,
না হয়,বেঁচে রইলি আমার মাঝে
এক টুকরো না পাওয়া হয়ে।
সব পাওয়া স্বর্ণোজ্জ্বল দিনের মাঝে
এক টুকরো মেঘ হয়ে।
সেই এক টুকরো ঘন কালো
পোয়াতি মেঘ চিরে,বৃষ্টি এসে না হয়
ধুয়ে দেবে আমার মনের
যাবতীয় দুঃখ,ক্লান্তি,হতাশা।
ছিঁড়ে দেবে পুরনো হিসেব খাতার
সমস্ত দেনা-পাওনার হিসেব।
না হয় বেঁচে রইলি আমার মনের
এক টুকরো মন খারাপ হয়ে।
বিগতা যৌবনা কোন গাছের ডালে,
মাকড়সার জালে লেগে থাকা,
সেই শিশিরের ছলে।
অমূল্য হীরক কুচি ভেবে হৃদয়ে ছোয়াতেই,
যা মিলিয়ে যাবে কোন এক যাদুমন্ত্রে।
সে যাদু মন্ত্রের ছোঁয়াতেই,
তোর মর্মর দেবীরূপ ভেঙে,
না হয় আবার মানবী হলি!!
চপল বালিকার মতোই,
না হয় ভুল করলি…
‘জীবনের যোগ-বিয়োগের হিসেব’।
সুদর্শন হঠাৎ ‘আসছি’ বলে উঠে
যেতেই তুহিন সম্বিৎ ফিরে পেলো।বুঝলো প্রচন্ড ভূল হয়ে গেছে।
মনে মনে ঠিক করলো,আর নয় নেক্সট স্টেশনেই নেমে পরবে।
কাল সারাটা রাত নিজের সাথে যুদ্ধ করে মনটাকে শান্ত করেছিলো।কিন্তু বুঝতে পারছে বাঙ্কে শোয়ার পর থেকে মনের লাগাম আর তার নিজের আয়ত্তে নেই।
ট্রেন থামতেই তুহিন তিতিরের দিকে তাকিয়ে ‘ভালো থাকিস’ বলে তিতিরকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত পায়ে নেমে পরলো অজানা স্টেশনে।
সুদর্শন অনেকক্ষণ সময় নিয়ে টয়লেটে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলো।কি যে করবে বুঝতে পারছে না।তুহিনের প্রতি তিতিরের মুগ্ধতা সুদর্শনের মনের গভীরে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে।
একা একা বসে আছে তিতির।সুদর্শন সেই যে আসছি বলে চলে গেলো, এখনো আসার নাম নেই।তুহিনদাও হঠাৎ নেমে গেলো কেনো,সেটাও ক্লীয়ার নয় তিতিরের কাছে।
ট্রেনটা হু হু করে ছুটছে।তিতির শান্ত মনে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না।এদিকে লাগেজ ছেড়ে সুদর্শনের খোঁজ করতে যেতেও পারছে না।সুদর্শন যে কেন এখনো আসছে না!অশান্তির ঝড় বয়ে যেতে লাগলো তিতিরের মনে।
কাল সকালেই ওদের হাওড়া পৌঁছোবার কথা।সুদর্শন কথা দিয়েছিলো, ফিরে গিয়েই ডিভোর্স নিয়ে কথা বলবে উকিলের সাথে।তিতির সুদর্শনকে বলতেও পারছেনা,যে আর সে ডিভোর্স চায়না।
‘কি হলো কোথায় ছিলে এতোক্ষন?’তিতিরের কথা শুনে সুদর্শন একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো।’কি হলো জিজ্ঞেস করছি তো,কোথায় ছিলে এতোক্ষন?’সুদর্শন এবারো কোন উত্তর দিলোনা।’সেই কখন থেকে দুশ্চিন্তা করছি একা একা বসে’।
সুদর্শন চারদিকটা তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললো,’তোমার তুহিনদা কোথায়?’তিতির রাগ মিশ্রিত গলায় বললো,’সে আমি কি জানি?ট্রেন থামতেই নেমে গেলো’।সুদর্শন বললো,’হঠাৎ নেমে গেলেন কেন?’
তিতির বললো,’সেইতো আমি এখন পরের খবর নিয়ে বেড়াই।নিজেরটার কোন খবর থাকেনা আমার কাছে।আসছি বলে একঘণ্টা বাদে এসেও কোথায় ছিলো তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়না তার’।
সুদর্শন বললো,’নিজেরটা?কে তোমার নিজের?নিজের বলে ভেবেছো নাকি কখনো আমায়?ফিরে গিয়েই তো উকিলের কাছে ছুটতে হবে’।
তিতির রেগে বললো,’সে না ছুটলেই হয়,আমি তো আর মাথার দিব্বি দিয়ে রাখিনি যে আমায় ডিভোর্স দিতেই হবে।তাছাড়া তুমি চাইলেই বা কি,আমি তো আর ডিভোর্স দিচ্ছিনা তোমায়’।
তিতিরের কথায় অবাক সুদর্শন।’সেকি ডিভোর্স কেন্সেল মানে?তোমার মতো একটা রাগী মেয়ের সাথে আমায় কাটাতে হবে নাকি সারা জীবন?’
তিতির রেগে বাঙ্কে চলে গেলো।সুদর্শন অর্ধেক সিঁড়ি উঠে বললো,’না খেয়ে আবার উঠলে কেন উপরে?’
‘বেশ করেছি,আমি খাবোনা কিছু’।
তিতিরের কথায় সুদর্শন বলে,’খেয়োনা,খেয়োনা।আমি ও তোমার বাবাকে গিয়ে জানিয়ে দেবো প্রচণ্ড জ্বালাও তুমি’।
বাবার কথায় তিতিরের দুচোখে আগলে রাখা অপেক্ষার মোম গলে চোখ বেয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
সুদর্শন কথা না বলে তিতিরের হাত মুঠোয় ভরে নেয়,তিলে তিলে জমা করা ধৈর্য্য সময় হাতের মুঠিতে খুঁজে পায় সুখ- ঐশ্বর্য্য।ছুঁয়ে থাকা আঙ্গুল গুলিতে জন্ম নেয় শিকড়ের টান।
ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যেতেই তুহিন কান্নায় ভেঙে পড়ে।অলস পায়ের পাতা যে নির্ভীক পথিকের বেশে শুধু তিতিরের দিকেই যেতে চায়।(চলবে)
#তিতির পাখির বাসা (পর্ব-১৮)
#জয়া চক্রবর্তী।
দিনটি একটা অন্যরকম ভালো লাগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কেটে গেলো তিতিরের।এখন রাতের অবসরে এলোমেলো ভাবনার অগোছালো মনটাকে একটু গুছিয়ে নিতে চায় তিতির।
‘কীগো কিছু খাবে না নাকি তুমি?সেই কখন থেকে বলে যাচ্ছি ডিনারটা সেরে নাও,গ্রাহ্যই করছো না’।সুদর্শনের কথায় তিতির বাঙ্ক থেকে মুখ ঝুঁকিয়ে তাকালো।
দুষ্টু হাসি হেসে বললো,’এই মুহুর্তে আমি যা খেতে চাইবো খাওয়াতে পারবে আমায়?’
সুদর্শন বললো,’এটা ট্রেন ম্যাডাম,রেস্টুরেন্ট নয়।তবু শুনি কি খেতে চাইছেন আপনি?চেষ্টা করে দেখতে পারি’।
‘শশা-পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা -ধনেপাতা কুচি,সেদ্ধ ছোলা,বাদাম ভাজা,চানাচুর,সর্ষের তেল আর চাট মশলা দিয়ে মাখা মুড়ি সঙ্গে গরম গরম আলুর চপ আর পেঁয়াজি’,এক নিশ্বাসে বলে গেলো তিতির।
সুদর্শন হেসে বললো,’না ম্যাডাম এই রাত সাড়ে এগারোটায় ছুটন্ত ট্রেনে সেটা সম্ভব নয়।কিন্তু মনে রাখলাম,নিজের হাতে মেখে খাওয়াবো।এখন অন্তত কেকটা খাও’।
তিতির নীচু হয়ে হাত বাড়িয়ে কেকের প্যাকেটটা নিলো।সুদর্শন এবার নিশ্চিন্ত মনে নীচের বাঙ্কে শুয়ে পড়লো।
তিতিরের চোখে ঘুম নেই।পায়ে পায়ে একনাগাড়ে ভালো খারাপ মুহূর্তরা ভিড় জমাচ্ছে মনে।আর মাত্র একটা রাত।
তিতিরের খুব ইচ্ছে করছে ট্রেনটা উল্টোদিকে চলুক।খুব ইচ্ছে করছে সুদর্শনকে নিয়ে ফিরে যেতে পাহাড়ে।
ইচ্ছে করছে পাশাপাশি বসে থেকে খাদের ভিতর পা ঝোলাতে।
হাতের মুঠোয় থাকবে হাত।
চুপ কথারা আঙুল ছুঁয়ে নিজেরাই কথা বলে নেবে পরস্পর।জন্মান্তরের শব্দরা মুক্তি পাবে নিবিড় অন্তরঙ্গতায়’।
‘কি হলো ঘুমোওনি পাখি?’তিতির তাকিয়ে দেখলো সুদর্শন বাঙ্কে উঠবার অর্ধেক সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে।হেসে বললো,’ঘুম আসছেনা আমার,কিন্তু তুমি কেন ঘুমোওনি?সুদর্শন বললো, ‘ঘুমটা আমারো আসছে না’।
‘তুমি চাইলে ওপরে আসতে পারো,আমরা গল্প করবো’।সুদর্শন বললো,’বাকীদের অসুবিধে হবে।সবাই তো আর তোমার মতো রাত জাগা পাখি নয়’।
‘রাত জাগা পাখি তো পেঁচা।আমাকে পেঁচা বলতে চাইছো কি?’তিতিরের কথায় সুদর্শন গম্ভীর মুখে বললো,একদম নয়,তোমাকে পেঁচী বলতে চাইছি।পেঁচা পুংলিঙ্গ’।তিতির বললো,বেশ তাহলে পেঁচীর সাথে কথা বলতে হবেনা।তুমি ঘুমোও গিয়ে’।
সুদর্শন কথা না বাড়িয়ে উঠে এসে বসলো তিতিরের পাশে।তিতিরের নাকটা ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বললো,রাগ তো সবসময় নাকের ডগায় থাকে’।তিতির এক ঝটকায় সুদর্শনের হাত সরিয়ে বললো,’বেশ’।
‘আচ্ছা তখন কোথায় চলে গিয়েছিলে আমায় ফেলে?’তিতিরের প্রশ্ন শুনে সুদর্শন খানিক চুপ করে থেকে বললো,’কোথায় আর যাব?আসলে ঠিক নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা’।
তিতির অবাক মুখে জানতে চাইলো,’কোন ব্যাপারটা বলোতো?’
সুদর্শন বললো,’বুঝতে পারছিলাম তুহিনের গান,আবৃত্তি সব কিছুই তোমাকে কেন্দ্র করে’।
একটু থেমে বললো,’আগে পাত্তা দিচ্ছিলাম না কারন তুমিই বলেছিলে তোমার ওর প্রতি কোন ফিলিংস নেই।কিন্তু আজ তোমার চোখে ওর প্রতি মুগ্ধতা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিলো’।
‘তাই?সেতো কারো কিছু গুন আছে দেখলে আমি এমনিতেই প্রশংসা করি।মুগ্ধ হই।তারমানে এই নয় যে তার প্রতি আমার বিশাল ফিলিংস জন্মে গেছে’।
সুদর্শন বললো,’তুহিন ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে তোমায়’।
‘হ্যাঁ আর সেই ভালোবাসার কথাটা সে কখন জানালো?যখন আমি অন্য কারোর স্ত্রী।ডিসগাস্টিং’।একটু থেমে তিতির বললো,’ছাড়ো তো ওসব।এবার নিজের কথা বলো’।
সুদর্শন বললো,’কি বলবো?
‘তুমি ভালোবাসোনা আমায়?’তিতিরের প্রশ্নে
সুদর্শন তিতিরের চোখের দিকে সরাসরি চাইলো।
তারপর দুহাত দিয়ে তিতিরের মাথাটা কাছে টেনে এনে তিতিরের কপালে নিজের কপালে ঠেকালো।তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’ভালোবাসি-ভালোবাসি’।
কথাটা কানে যেতেই চঞ্চল হয়ে উঠলো তিতিরের শিরা ধমনী, রিনরিন করে বেজে উঠলো দেহতন্ত্রী।বুক জুড়ে শিরশিরানি অনুভব।তিতির আবেশে চোখ বুজে ফেললো।
তিরতির করে কাঁপছে তিতির।সুদর্শন বললো,’এটা পাবলিক প্লেস ম্যাডাম।আপনি চাইলেও আমি কিন্তু…..’
তিতির চোখ খুলে বললো,’আমি আবার কি চাইলাম?’সুদর্শন বললো,বুঝি ম্যাডাম সবই বুঝি’।তিতির হেসে বললো,’কচুপোড়া বোঝো তুমি’।
‘ভাবছিলাম বাড়ীতে কথা বলে কালকেই তোমাকে তোমার বাড়ীতে রেখে আসবো’,সুদর্শনের কথায় অবাক হয়ে তিতির বললো,’রেখে আসবে মানে?’
‘দেখো আমাদের বাড়ীতে থেকে তোমার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়।একান্নবর্তী পরিবার।নানা জনের নানা মতামত।তার চাইতে নিজের বাড়ীতে থেকে পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করো।চাকরীর পরীক্ষায় বসো’।
একটু থেমে বললো,’আমি বরং প্রতি সপ্তাহে গিয়ে দেখা করে আসবো’।
সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,আমি পড়াশোনার পাঠ শেষ করে চাকরীর পরীক্ষায় বসলে তোমার কোন সমস্যা নেই তো?’
সুদর্শন বললো,একদমই নয়।প্রতিটি মেয়েরই উচিৎ নিজের পায়ে দাঁড়ানো।তিতির হেসে বললো,’তাহলে আর চিন্তা নেই আমার।আমি তোমাদের বাড়ীতে থেকেই সব করবো’।
একটু থেমে নিয়ে তিতির বললো,’তবে একটা কথা,তোমার বাড়ীর লোকজন আমায় কখনো কিছু বললে,তুমি কিন্তু আমার হয়ে তাদের সাথে কথা কাটাকাটি করতে যাবেনা।সেটা আমি বুঝে নিতে পারবো’।
‘এবার একটু ঘুমিয়ে নাও।নাহলে শরীর খারাপ হবে।আমি নীচে যাচ্ছি’,তিতির মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে সুদর্শন নীচে নেমে গেলো।
তিতির হাওয়া বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো।ঘুমিয়েও পরলো কিছু সময়ের মধ্যে।
‘পাখি ট্রেন এখুনি হাওড়া স্টেশনে ঢুকবে,উঠে পড়ো’।সুদর্শনের বেশ কয়েকবার ডাকে তিতির আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো।তারপর চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে বাঙ্ক থেকে নীচে নামলো।
সুদর্শন বললো,’তুমি ফ্রেস হয়ে নাও।আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিই’।তিতির টয়লেটের দিকে যেতেই সুদর্শন ব্যস্ত হাতে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো।
তিতির ফ্রেস হয়ে এসে ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ে নিলো।মুখে ক্রিম লাগিয়ে,হাল্কা লিপস্টিক বুলিয়ে নিলো।সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললো,’আমি রেডি’।
সুদর্শন বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,’খেয়ে নাও’।
‘
‘এতো জ্বালাও কেন তুমি আমায়?’তিতিরের কথায় অবাক সুদর্শন,’সেকি আমি আবার কখন জ্বালালাম?’
‘সারাক্ষণ শুধু পাখি খেয়ে নাও,পাখি ঘুমিয়ে নাও,আমি নিজেরটা বুঝি বুঝলে।খিদে পেলে অবশ্যই খাবো’।
তিতিরের কথা শেষ হতেই সুদর্শন বললো,’তোমার বলা শেষ?নাকি আরো কিছু বলবে এই বিষয়ে?বললে বলে নাও আমি শুনছি।বলা শেষ হলে বিস্কুটটা খাও,আমি জলের বোতল দিচ্ছি’।
তিতির রাগ রাগ মুখে বিস্কুট চিবোতে শুরু করলো।সুদর্শন হাসি চেপে জলের বোতল এগিয়ে দিলো।
(চলবে)