#তিতির পাখির বাসা,পর্ব-১৯,২০,২১
#জয়া চক্রবর্তী।
পর্ব-১৯
ট্যাক্সির ধারে বসে চলন্ত রাস্তাটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সুদর্শন।
‘কী অতো দেখছো বলোতো?’
তিতিরের কথায় সম্বিৎ ফিরে আসলো সুদর্শনের।
বললো, ‘দেখো পাখি প্রতিদিন কতো লরি,ট্রাক,ট্রাম,বাস,প্রাইভেট গাড়ী,ট্যাক্সি অনবরত চলছে ওর বুকের ওপর দিয়ে।ক্ষতবিক্ষত করছে ওকে।
তবু দেখো কেমন নির্বাক,নিশ্চল হয়ে জেগে আছে ও’।
তিতিরের হাঁ মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শন বললো,পথের সাথে পথিকের সম্পর্ক কি জানো?’তিতির কথা না বলে মাথাটা এলিয়ে দিল সুদর্শনের কাঁধে।
সুদর্শন বললো,আমরা সবাই নশ্বর কিন্তু পথ অবিনশ্বর’।
একটু থেমে বললো,’দেখো আবহমান কাল ধরে কত তিতির-সুদর্শন ওর বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে,আরো কত আসবে যাবে।ও কিন্তু ওর নিজের জায়গাতেই থাকবে।হয়তো কাঠামো বদলাবে তবু থাকবে।থাকবে নতুনদের আপ্যায়নে’।
তিতির সুদর্শনের কথা শুনে নিজেও রাস্তার দিকে তাকালো,তবে এবার সেই তাকানোর ভাষা বদলে গেছে।
সুদর্শন ড্রাইভারকে রাস্তা চিনিয়ে বাড়ীর সামনে এনে দাঁড় করালো। তিতিরের আঙুল গুলো মুঠোয় ভরে আলতো চাপ দিয়ে বললো,’আবার দুজন হারিয়ে যাব পাহাড়ে,সমুদ্রে অথবা জঙ্গলে’।
তারপর বেড়িয়ে এসে তিতিরের দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে বললো,’ওয়েলকাম ম্যাডাম’।
তিতিরের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।তিতির গাড়ী থেকে নেমে এসে কলিংবেলে হাত রাখলো।
দরজা খুলেই তৃণা তিতিরকে দেখে বলে উঠলো,’এমন বেআক্কেলে বৌ দেখিনি জন্মে,একটা ফোন তো করতে হতো।এদিকে আমরা এখানে ভেবে মরি’।
সুদর্শন লাগেজগুলো ঘরে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,’টাওয়ার ছিলোনা কাকিয়া’।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আর বাহানা দিতে হবেনা।আগের বার যখন বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলিস,তখন তো দিব্বি টাওয়ার ছিলো’।
কাকিয়ার কথায় সুদর্শন বললো,সে তো কল্লোলের ফোন থেকে করেছিলাম।আমাদের মধ্যে একমাত্র ওর ফোনেরই টাওয়ার ছিলো’।
ডাইনিং এ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে সুদর্শন বললো,’আজ বাড়ী এতো শান্ত কেন?নীল,অর্না,পর্না বাড়ী নেই?’
‘না নেই।নীল কলেজে গেছে।আর অর্ণা,পর্ণা স্কুলে’,কথাটা শেষ করেই তৃণা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো।
ঠিকে-ঝি শিউলির বর মারা যাওয়ার খবরটা পাওয়ার পর থেকেই মাথাটা গরম তৃণার।এক সিঙ্ক বাসন জমে আছে।ঘর মোছা হয়নি।তার ওপর দিদি রান্নাটা সেরে দিয়েই শিউলিদের বাড়ীতে গিয়ে বসে আছে।মনে মনে বলে উঠলো তৃণা,’আদিখ্যেতা’।
কাকিয়ার দুই মেয়ে অর্ণা,পর্ণা আর সুদর্শনের নিজের ভাই নীলের ভারি ভাব।তিনজনে বাড়ী থাকলে নিজেরাই হইচই করে খুব।তিতিরের সাথে ওরা কেউই আগবাড়িয়ে ভাব করেনি।একটু এড়িয়েই চলে তিতিরকে।সুদর্শনের সাথেও ওদের ভাব নেই বিশেষ।একটু যেন ভয়ই পায় সুদর্শনকে।
‘তুমি আবার দাঁড়িয়ে কেন,যাও গিয়ে ফ্রেশ হও’,কাকিয়ার কথায় তিতিরের ভাবনায় ছেদ পরলো। বললো,হ্যাঁ যাচ্ছি,আচ্ছা কাকিয়া মামনি কোথায়?’।
‘দিদি গেছে শিউলি দের বাড়ীতে।সকালে ওর বর মারা গেছে’,কাকিয়ার কথায় তিতিরের মুখ কালো হয়ে গেলো।
বললো,’সেকি!!মারা গেছে!শিউলি মাসী বলেছিলো বর অসুস্থ হওয়াতেই নাকি ঠিকে কাজে নেমেছে,আগে অবস্থা সাধারণ হলেও কোনরকমে চলে যেত’।
একটু থেমে বললো,’আচ্ছা শিউলি মাসীর মেয়েটা তো ছোট’।তিতিরের কথার উত্তর দিলো না তৃণা।
নিজের মনেই গজগজ করে বলে উঠলো,’এখন কত দিন কামাই করবে কে জানে!
এমনিতেই ওর কাজকর্ম নোংরা।কতবার বলেছি ওকে ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য লোক রাখো।তা আমার কথা শুনলে তো’।
তিতির বলে উঠলো,’শিউলি মাসীর বাড়ী কোথায় কাকিয়া?’।
তৃণা তিতিরের কথার উত্তর না দিয়ে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললো,’বাবিন ফ্রেশ হয়ে আমাকে ডাকিস,খেতে দেবো’।বলেই রান্নাঘরে শিকল তুলে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
তৃণা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই তিতির বললো,’আমি শিউলি মাসীর বাড়ীতে যাব।কোথায় বাড়ীটা?’সুদর্শন বলে উঠলো,’ওখানে তুমি গিয়ে কি করবে?শুনেছিলাম টালি দেওয়া মাটির ছোট্ট ঘরে থাকে।আর মা তো গেছেই ওখানে’।
তিতির বললো,’থাক বলতে হবেনা,আমি ঠিক খুঁজে নেবো’।তিতির ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই সুদর্শনও দরজা টেনে বন্ধ করে ওর পিছন পিছন বেড়িয়ে আসলো।
বললো,’রাগ দেখাতে হবেনা।আমার সাথে চলো।শুনেছিলাম বাগচী পাড়ার দিকে থাকে।ওখানে গিয়ে খোঁজ করলে পেয়ে যাব’।
সুদর্শনের সাথে তিতির গিয়ে হাজির হলো শিউলিমাসীর বাড়ি।অনুশ্রী তিতিরদের দেখে আকাশ থেকে পড়ার মতো।
‘কিরে বাবিন,তোর কি মাথা খারাপ হলো নাকি!বিয়ের একবছরের মধ্যে কোন অশৌচ বাড়ীতে আসতে হয় নাকি?একটা মঙ্গল অমঙ্গলের ব্যাপার আছে তো’।
তিতির বললো,’ওর দোষ নেই মামনি।খবরটা শুনে আমিই আসতে চাইলাম।আর তুমি থাকতে আমাদের কোন অমঙ্গল হতে পারেনা’।
কথাটা বলেই তিতির এগিয়ে গেলো শিউলির দিকে।হাত চেপে ধরে ভরসা দিলো।
তিতিরকে দেখে আরো জোরে কান্নায় ভেঙে পড়ল শিউলি। বললো,’নতুন-বৌ আমার মেয়েটাকে এখন কে দেখবে?আমি তো ওর বাবার ভরসাতেই মেয়ে রেখে কাজে যেতাম’।
তিতির হাত বাড়িয়ে শিউলির মেয়েটার মাথায় হাত রাখলো।বললো,’আমি তোমার মেয়েকে দেখবো।তুমি আমার কাছেই ওকে রেখে কাজে যেও।আমি ওকে পড়াবো,মানুষ করবো’।
অনুশ্রী শিউলিকে পছন্দ করলেও তিতিরের এই মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার কথাটাকে সমর্থন করতে পারলেন না।বেশ বিরক্তিই লাগলো।
কি দরকার ছিলো তিতিরের এসব কথা বলবার!
কথায় বলে গরিবের দুঃখের দিনে পাশে এসে দাঁড়াও,কিছু টাকা হাতে গুঁজে দাও।
যেমন আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা করেন।
আরে তবেই না এরা কৃতজ্ঞ থেকে সারাজীবন দলের পক্ষে থাকবে।
এই যে তিনি শিউলির হাতে দুটো পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে দিলেন।তিনি জানেন এরপর শিউলি যেখানেই কাজ ছাড়ুক,অনুশ্রীদের কাজটা ঠিক ধরে রাখবে।
তেমন হলে বাবিনের থেকে টাকা নিয়ে তিতিরও দিতে পারতো। তা নয় ওর মেয়েকে মানুষ করবে,পড়াশোনা করাবে।যেন টাকা পয়সা লাগবে না এসবে।বোঝেনা তো কত ধানে কত চাল!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অনুশ্রীর মনে হলো,আমাদের দেশের নেতা,নেত্রীরাও তো কত প্রতিশ্রুতি দেন,’এই করে দেবো’,’সেই করে দেবো’।কিন্ত ওগুলো সব ফাঁকা আওয়াজ।
বাড়ীতে গিয়ে সময় করে তিতিরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে হবে।এসব দায়িত্ব ফায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে ওর ঝেড়ে দিতে হবে।কথাটা মাথায় আসতেই স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল অনুশ্রীর।
শিউলিদের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে অনুশ্রী বললো,’বাবিন তোর কাকিয়াকে একটা ফোন করে বল ঠাকুরঘর থেকে গঙ্গাজলের বোতলটা নিয়ে গেটের কাছে রাখতে।ঢোকার সময় যেন একটু ছিটিয়ে দেয়’।
একটু থেমে তিতিরের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,’স্নান না সেরে কেউ যেন ঘরে না ঢোকে’।
তিতির হেসে বললো,তোমার চিন্তা নেই মামনি।স্নান করেই ঢুকবো’।
সুদর্শন তিতিরের এই নতুন রূপটার সাথে পরিচিত ছিলোনা।
যেভাবে রাগ দেখিয়ে একাই বেড়িয়ে পড়েছিলো শিউলি মাসীর বাড়ীতে আসবে বলে,তারপরে যেভাবে শিউলি মাসীকে ভরসা দিলো…সব মিলিয়ে একটা ভালো লাগা ছেয়ে গেছে সুদর্শনের মনে।
‘তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন/তাই হঠাৎ পাওয়ায় চমকে ওঠে মন’…গানটা মনে মনে গুনগুন করতে করতে মা আর পাখির পেছনে এক বুক গর্ব নিয়ে এগিয়ে চললো সুদর্শন।(চলবে)
#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-২০)
#জয়া চক্রবর্তী।
‘পুকুর থেকে একটা ডুব দিয়ে ঘরে ঢুকলেই তো হয়’,অনুশ্রীর কথায় তিতির আঁতকে উঠলো।’সেকি মামনি পুকুরে ডুব দেবো মানে!আমি তো সাঁতারই জানিনা’।অনুশ্রী বললো,’তাতে কি?ডুব দিতে গেলে আবার সাঁতার জানতে হয় নাকি?’
তিতির এবার উদ্বিগ্ন মুখে সুদর্শনের দিকে তাকালো।সেটা দেখে অনুশ্রী ও সুদর্শন নিজেদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।হাসতে হাসতেই অনুশ্রী বললো,’গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেওয়ার পর সোজা গিয়ে বাথরুমে ঢুকবে’।সুদর্শন বললো,’আর তাড়াতাড়ি কোরো।আমরাও কিন্তু লাইনে’।
কলিংবেলে হাত রাখার সাথে সাথেই বেশ বিরক্ত মুখে দরজা খুললো তৃণা।গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিতে দিতে বললো,’আমাকে তো একবার বলে যেতে হতো বাবিন।এতো কেয়ারলেস তো আগে কখনো ছিলিস না’।
অনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,’বিয়ের একবছর পূরণ না হলে কেউ অশৌচ বাড়ীতে যায়না এ তোমার থেকেই শেখা দিদি।এখন বাবিনদের ক্ষেত্রে কি সব নিয়ম বদলালে?’
অনুশ্রী বললো,’অনুমতি নিয়ে তো আর যায়নি।হঠাৎ গিয়ে হাজির।’তুমি কিছু বললে না দিদি?একটা মঙ্গল অমঙ্গলের ব্যাপার তো আছে নাকি?’তৃণা বেশ রাগের সাথেই কথাগুলো বললো।
তিতির ভাবলেশহীন মুখ করে ব্যাগ খুলে নাইটি আর টাওয়াল বের করলো।কলঘরের দিকে এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে।তারপর দরজা বন্ধ করলো।তিতির জানে ওর প্রতিটি কাজেরই এখন পোস্ট মোর্টেম চলবে বাইরে।
তিতির শাওয়ার চালিয়ে চোখ বুজে নিলো।চোখ বুজতেই শুনতে পেলো মেঘের ডাক,বৃষ্টির একটানা শব্দ।বৃষ্টির দানারা তিতিরের মাথা গড়িয়ে খোলা বুকউঠোনে এসে পরলো।বিদ্যুৎ চমকে উঠলো বুকের এক দিগন্ত দূরত্বে।
মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে নাইটি পরে বেড়িয়ে আসতেই সুদর্শনের সামনে।
তিতির সুদর্শন কে পাশ কাটিয়ে যেতেই হাতে টান পড়লো তিতিরের।
সুদর্শন তিতিরের কানের সামনে নিজের মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘আরো একবার বৃষ্টি নামুক
ভিজুক তোমার মন
আরো একবার দিন দুপুরে
আঁধার নামুক আকাশ জুড়ে
আরো একবার নেশায় মাতুক
মেঘলা আমন্ত্রণ’।
তিতির হেসে বললো,’হয়েছে হয়েছে।এবার স্নানে যাও’।
খাওয়ার টেবিলে তৃণা তিতিরকে বলে উঠলো,’প্রমীলার দায়িত্ব নিয়েছো শুনলাম’।
‘প্রমীলা কে কাকিয়া?তিতিরের প্রশ্নের উত্তর দিলো অনুশ্রী,’কেন নিজেই তো সবার সামনে শিউলিকে বলে আসলে ওর মেয়ের দায়িত্ব তোমার’।
‘ও শিউলি মাসীর মেয়ের নাম প্রমীলা।বাহ ভারী মিষ্টি নাম তো’।তিতিরের কথায় অনুশ্রী বললো,’দায়িত্ব নেওয়ার মানে বোঝো তুমি?তাও একটা মেয়ের দায়িত্ব!প্রতি পদে পদে বিপদ মেয়েদের সেটা জানো?’
‘জানি বলেই তো দায়িত্বটা যেচে নিলাম।ওই টুকু মেয়ে একা রেখে শিউলি মাসি কাজে যাবে।কত খারাপ লোক তাদের অসুস্থ মানসিকতার সাথে মেয়েটাকে খুবলে খাবে।সে কারনেই তো…’।
তিতিরের কথার গুরুত্ব বুঝে অনুশ্রী বললো,’সে না হয় থাকলো এখানে।কিন্তু ওকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করিয়ে দেবে সে আবার কেমন কথা?টাকা পয়সা লাগবে না বুঝি?’
তিতির বললো,’লাগবে তো’।
‘সেটা আমাদের বাবিনের ঘাড় ভেঙেই আদায় করবে তাইতো?’
তৃণার কথায় হেসে ফেললো তিতির।
বললো,’আরে না না কাকিয়া।সেই কারনেই তো ঠিক করেছি টিউশানি করবো’।
একটু থেমে বললো,’আমাদের পেছনের দিকের ঘরগুলো তো বন্ধই থাকে।যদি আমাকে অনুমতি দাও তাহলে ওর একটাতেই না হয় পড়ানো যাবে। সেক্ষেত্রে অন্য কোথাও আমাকে ঘর ভাড়া নিতে হয়না’।
‘ও ঘর ভাড়া করবে বলেও ভেবেছো!ভালো!’
অনুশ্রীর কথায় তিতির বললো,’সে তো তোমরা রাজি না হলে।তাছাড়া আমি নিজের পড়াটাও কন্টিনিউ করতে চাই’।
অনুশ্রী বললো,বুঝেছি ছেলের বৌয়ের কাছ থেকে আর কিছুই সেবা পাওয়া যাবেনা’।
‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’কথাটা তো তুমিও জানো মামনি।আর যদি তেমন অসুবিধে হয় সেক্ষেত্রে না হয় আরো একটা লোক রেখে নেবো’।
তিতিরের কথায় অনুশ্রী রেগে গেলেও মুখে কিছু বললো না।কিছুক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে বেসিনে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
অনুশ্রীকে দেখে তৃণাও না খেয়েই উঠে পড়লো।
এতো কিছুর মধ্যেও সুদর্শনের মধ্যে কিছু হেলদোল লক্ষ্য করা গেলোনা।
সে দিব্বি ভাত গ্রাস করে মুখে তুলছে।
তিতির হাতের কনুই দিয়ে ঠেলা মেরে জিজ্ঞেস করলো,’কিগো কিছু তো বলো’।
সুদর্শন খেতে খেতে বললো,’কোন ব্যাপারে বলবো বলোতো?’
‘যাও কিচ্ছু বলতে হবেনা তোমায়?’,তিতিরের কথায় হেসে ফেললো সুদর্শন।বললো,’দেখোই না কি হয়!তোমার কথা তো তুমি বলেই দিয়েছো।বাকীটা সময় বলবে’।
দেখতে দেখতে একবছরে পড়লো সংশপ্তক।
যাদের পয়সা আছে তারা যেমন এখানে পড়ছে তেমনি বিনা মাইনার পড়ুয়াও কম নেই সংশপ্তকে।
প্রমীলা ছাড়া ওদের পাড়ার আরো অনেকেই বিনা মাইনায় তিতিরের কাছে টিউশন পড়তে আসে সকালবেলায়।যদিও প্রমীলার উপর তিতিরের মায়াটা বেশী।
তিতির নিজের কাছেই প্রমীলা কে রাখে।রাতের বেলাতেও তিতিরের প্রায় সব ব্যাচেই প্রমীলাকে দেখতে পাওয়া যায়।শিউলি রাত দশটায় মেয়েকে নিয়ে যায় নিজের কাছে।
হ্যাঁ তিতিরের তৈরি প্রতিষ্ঠানের নাম সংশপ্তক।আপাতত একাই পড়াচ্ছে তিতির।সঙ্গে নিজেও এম.এ এর প্রস্তুতি নিচ্ছে।তবে ওর ইচ্ছে আছে আরো কয়েকজন কে নিয়োগ করবে সংশপ্তকে।কিন্তু মাইনে বেশী দিতে পারছে না বলে কেউই সেভাবে রাজী নয়।
এক বছর আগে তিতির এই পড়ানোর বিষয়টা নিয়ে নিজের জ্যাঠার ছেলের সাথে কথা বলেছিলো। বড়দাভাই সব শুনে নিজেই বোর্ড বানিয়ে নিয়ে এসেছিলো তিতিরদের বাড়ীতে।
তারপর তো বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তিতির বাবাই আর দুই কাকাইকে রাজী করিয়ে বাড়ীর বাইরে সেই বোর্ড টানিয়ে ছিলো।
দেওর নীলের বন্ধুদের সাথে কথা বলে কিছু হ্যান্ড বিলও বিলি করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো সংশপ্তকের।
তিতির আজকাল সকাল হওয়ার অনেক আগেই বিছানা ছাড়ে।এখন আর সুদর্শনকে তিতিরের ঘুম ভাঙাতে হয়না।
তিতির ঘুম থেকে উঠেই চট করে স্নান সেরে রান্নাঘরে ঢোকে।চা করে ফ্লাস্কে রেখে আটা মাখতে বসে।রুটি করে হটপটে রাখে।সবজি গুলো কেটে ধুয়ে,বাটনা বেঁটে নিজেই রান্না চাপায়।
তৃণা আজকাল মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায়
রান্নাঘরে তার দর্শন কমই পাওয়া যায়।
অনুশ্রী বলেছিল অর্না,পর্ণাকে তিতিরের কাছেই পড়াতে।কিন্তু তৃণা রাজী হয়নি।টানতে টানতে মেয়ে দুটোকে নিয়ে এই জায়গা,সেই জায়গা ছুটছে।
তাতে অবশ্য তিতিরের সুবিধাই হয়েছে।অনুশ্রীর সাথে থেকে যেমন কাজ শিখে যাচ্ছে ,তেমনি দুজনে বেশ ভালো বন্ধুও হয়ে গেছে।
রবিবার করে তিতিরের সংশপ্তক বন্ধ থাকে।অনুশ্রী খেয়াল করেছে আজকাল রবিবার হলেই তিতির একটু উদাস থাকছে।
‘তিতির বাড়ীর জন্য মন খারাপ তোমার?ঘুরে তো আসতে পারতে বাড়ী থেকে”,অনুশ্রীর কথায় তিতিরের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।অনুশ্রী বললো,’এতে কাঁদবার কি হলো আবার?’
তিতির চোখ মুছতে মুছতে বললো,’জানো মামনি প্রতি শনিবার রাতে তোমার বাবিনকে বলি আমায় কাল বাড়ী ঘুরিয়ে আনবে?রাতে রাজী থাকে কিন্তু সকাল হলেই বলে,পরের রবিবার নিশ্চয়ই নিয়ে যাব,আজ অনেক কাজ’।
অনুশ্রী মুখে কিছু বলেনা।কিন্তু নিজেও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।কৌশিক ও ঠিক এমনটাই করতো।
দিনের পর দিন,মাসের পর মাস অনুশ্রীর যাওয়াই হতোনা বাপেরবাড়ীতে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া পর্ব সাড়া হলে অনুশ্রী তিতিরকে বলে,’আমরা দুজন বের হবো।চটপট তৈরি হয়ে এসো’।তিতির বলে,’আমরা কোথায় যাচ্ছি মামনি?’অনুশ্রী বললো,’এখনো ঠিক করিনি।বেড়িয়ে ঠিক করবো।একটু তাড়াতাড়ি কোরো’।
তিতির তৈরি হয়ে আসতেই অনুশ্রী ওকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
মাঝ রাস্তায় রিক্সা থামিয়ে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টিও কিনলো।তারপর স্টেশনে এসে তিতিরকে দাঁড় করিয়ে নিজেই গেলো টিকিট কাউন্টারে।
টিকিটটা এনে তিতিরের ব্যগের চেন খুলে রাখতে রাখতে বললো,’আপ-ডাউন কাটা আছে।আর মিষ্টির প্যাকেট টা মাঝের চেনে রাখলাম।মনে করে দিয়ে এসো’।
তিতির অবাক হয়ে তখনো তাকিয়ে আছে অনুশ্রীর দিকে।অনুশ্রী একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে তিতিরের হাতে গুঁজে দিলো।তিতিরের হা মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,’এর মধ্যে সব ট্রেনের নাম লেখা আছে।তাও একটু দেখেশুনে জিজ্ঞেস করে উঠো’।
তিতির বললো,’আমি কি একা কোথাও যাচ্ছি মামনি?’
অনুশ্রী হেসে বললো,’হ্যাঁ তোমার বাপেরবাড়ীতে যাচ্ছ।আমি চাইনা সামান্য একটা বিষয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে থাকো’।
একটু থেমে বললো,’আমি সাথে যেতেই পারতাম।কিন্তু আমি গেলে আত্মবিশ্বাস টা আসবেনা,তাই একাই যাও।আর সাবধানে যেও আমি কিন্তু চিন্তায় থাকবো।আর অসুবিধা হলে ফোন করতে ভুলোনা যেন’।
তিতিরের চোখ জলে ভরে গেলো।অনুশ্রী বললো,’এটা স্টেশন তিতির।কাগজটা দেখে নিজেই ট্রেনে উঠো।আমি আসছি’।
অনুশ্রী তিতিরকে স্টেশনে রেখে আবার উলটো দিকের রিক্সা ধরলো।তিতির কাগজটা মেলে ধরলো চোখের সামনে।তারপর অপেক্ষা করতে থাকলো ট্রেন এনাউন্সের।
অনুশ্রী বাড়ীতে ঢুকে দেখলো ডাইনিং প্রায় জমজমাট।সবাই খোশ মেজাজে গল্প করছে।অনুশ্রীকে দেখে কৌশিক বলে উঠলো,’তোমার সাথে তো তিতির ছিলো,সে কোথায়?’
অনুশ্রী বললো,’বাপের বাড়ীতে গেছে।তবে রাতেই ফিরে আসবে’।
সুদর্শন বলে উঠলো,’সেকি একা একা ট্রেনে করে গেছে?স্কুল কলেজে শুনেছি ওর দাদার সাথেই যাতায়াত করতো,তাও বাইকে চেপে’।
কৌশিক বিরক্ত সহকারে বলে উঠলো,’কোন আক্কেলে তুমি ওকে একা একা যেতে দিলে শুনি?’
অনুশ্রী কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,’বাবিন তোমার মতোই নেচার পেয়েছে তা জানো? প্রতি শনিবার রাতে তিতিরকে কথা দিয়ে বলে,ওকে ওর মায়ের সাথে দেখা করিয়ে আনবে।কিন্তু রবিবার হলেই নেক্সট রবিবারে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেয়”।
একটু থেমে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললো,’আমাকে কম চোখের জল ফেলতে হয়নি এই বাড়ীতে।আমি চাইনা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক।আর একা না গেলে আত্মবিশ্বাসটা আসবে না’।
সুদর্শনের মাথা নীচু করে বললো,’বুঝতে পারছি মামনি আমার ভীষণ ভূল হয়ে গেছে।আর কখনোই এমনটা করবো না।আমি বরং তিতিরকে একটা ফোন করে দেখি ও কতদূর পৌঁছলো!’
অনুশ্রী বললো,’না না রাস্তায় ফোন করে ওকে বিব্রত করতে হবেনা।তিতিরকে সব বলা আছে।অসুবিধা হলে ও নিজেই ফোন করে নেবে’।
না তিতিরের কোনই অসুবিধা হয়নি।মামনির দেওয়া ভরসা আর মনের জোরকে সঙ্গী করে তিতির একা একাই দিব্যি ঘুরে এলো বাপের বাড়ীর থেকে।(চলবে)
#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-২১)
#জয়া চক্রবর্তী।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে অনুশ্রী তিতিরকে বললো,’তিতির তোমাকে জানানো হয়নি,কাল রাতের ট্রেনে আমরা সবাই মিলে শিলিগুড়ি যাচ্ছি।ওখানে একদিন থেকে দার্জিলিং কালিম্পং হয়ে লক্ষ্মী পূজোর আগের দিন সকালে ফিরে আসবো’।
তিতির উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো,’বাহ দারুণ খবর মামনি।ভালো করেছো আগে থেকে না বলে।আমার সারপ্রাইজ পেতে খুব ভালো লাগে।আমি আজ রাতেই প্যাকিং সেরে নেবো’।
একটু থেমে বললো,’অবশ্য আগে জানা থাকলে গতকালই ক্লাস করিয়ে সংশপ্তকে পূজোর ছুটি দিয়ে দিতাম’।
‘তুমি আর বাবিন তো বাড়ীতেই থাকছো।ওদের বরং আগামীকালই ছুটিটা দিও’,কাকিয়ার কথা আর মুখের তির্যক হাসিতে তিতিরের মুখ শুকনো হয়ে গেলো।বললো,’মামনি যে বললো আমরা সবাই যাচ্ছি।সবাইএর মধ্যে বুঝি আমি নেই?’
‘বাড়ী পুরো খালি রেখে কি যাওয়া যায়?বাবিন জব্বলপুর থেকে কালকেই ফিরবে।বাবিন আর তোমার ভরসাতেই তো বাড়ী রেখে যাচ্ছি’,মামনির কথার কোন উত্তর দিলোনা তিতির।চুপচাপ খেতে থাকলো।
মামনির ওপর অভিমানে ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে।ভাত গলা দিয়ে যেন নামতেই চাইছে না।অথচ একটু আগেও খিদে পেয়েছিলো খুব।
এই তো গত রবিবার মামনিকে নিয়ে গিয়ে প্রমীলা সহ পাঁচজন দুস্থ ছাত্রছাত্রীর জন্য পূজোর জামাকাপড় কিনে আনলো তিতির।
সংশপ্তকের টাকাপয়সার হিসেবের ভারটাও আজকাল মামনির ওপরেই থাকে।
মামনির সাথেই যা কিছু গালগল্প ওর।সেই মামনি ওকে না নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে এই ব্যাপারটাই হজম হচ্ছেনা তিতিরের।
রান্নাঘরের পর্ব কোনরকমভাবে মিটিয়ে তিতির চুপচাপ ছাদে এসে দাঁড়ালো।ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। এলোপাথাড়ি হাওয়ায় তিতিরের চুল অবিন্যস্ত।এই মুহুর্তে ওর খুব মন কেমন করছে বাড়ীর জন্য।
যদিও মাস চারেক আগে মামনির উদ্দ্যোগে বাপের বাড়ী থেকে একা একাই ঘুরে এসেছিলো তিতির।
সেদিনও ফিরবার সময় ট্রেনের জানলা দিয়ে দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে তিতিরের চুল গুলোকে ঘেঁটে দিচ্ছিলো বারবার ।
ও বারবার আঙুলের শাসনে চুল গুলোকে পোষ মানাতে চাইছিলো। হাওয়াটায় সোঁদা গন্ধ ছিলো।
হয়তো বৃষ্টি হচ্ছিলো কোথাও!
কোথায় বৃষ্টি হচ্ছে! কত দূরে! দূরে, নাকি খুব কাছাকাছি! হয়তো ওর আঁচলের নীচেই!
ওর যদি দুটো পালক থাকতো, তাহলে তো ও তক্ষুণি উড়ে চলে যেতে পারত ওই জলভরা মেঘ গুলোর কাছে!
সেদিন সন্ধ্যার ভাললাগা টা অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়ে ওর বুকের উঠোন বানভাসি হয়ে গিয়েছিলো।
ভাবতে ভালো লাগছিলো যে, সুদর্শনের সময়ের ওপর আর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না তিতিরকে।মামনির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তখন মাথা নত হয়ে আসছিলো তিতিরের মন।
কারন এবার থেকে তিতির একাই পারবে বাড়ীতে গিয়ে মা-বড়মার আঁচলের গন্ধে সমস্ত মেয়েবেলাকে ফিরে পেতে। বাবার বুকে মাথা রেখে সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে । অথবা উঠোনের যমজ কাঁঠাল গাছটার নিচে এসে সেই আগের মতো একলা হতে।
সেদিন তিতির বাড়ী ঢোকবার পর মামনি নিশ্চিন্তে হয়ে টিভি সিরিয়ালে মনোনিবেশ করেছিলো।
ভালো লাগার রেশ নিয়ে রাতের রুটি বানাবে বলে তিতির রান্নাঘরের বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে ভিজে হাতে একফোঁটা হ্যান্ড ওয়াশ নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই, দুহাত ভর্তি নরম ফেনা ভরে উঠেছিলো।এই ফেনিল কোমলতা খুব ভালো লাগে তিতিরের।
তখনই গ্রানাইটের স্ল্যাবের ওপর লোহার চাটুটা বোধহয় একটু বেশিই জোড়ে আছড়ে পড়েছিলো।ধাতব শব্দের আতিশয্যে সম্বিত ফিরে পেয়েছিলো তিতির। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ও গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ওভেনের কাছে।
‘কাকিয়া তুমি সরে এসো। আমি রুটি বানাবো বলেই ড্রেস চেঞ্জ না করে আগে রান্নাঘরে এসেছি’।তিতিরের কথায় কাকিয়া বলে উঠেছিলো,’হ্যাঁ মা উদ্ধার করেছো।বাইরের জামাকাপড়ে তোমায় আর রুটি করতে হবেনা। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে খেতে এসে ধন্য করো দেখি’।
তিতির বুঝতে পারেনা কাকিয়ার ওর ওপর এত রাগ কেন! তিতির রান্নাঘরে আর না দাঁড়িয়ে ঘরে চলে এসেছিলো।তারপর গোলাপি রঙের নাইটিটা ঘর থেকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছিলো।
বৃষ্টিরা যখন শাওয়ার থেকে ইচ্ছের ধারা হয়ে নেমে এসে ভিজিয়ে দিয়েছিলো ওর সারাটা শরীর।
ও গুনগুন করে গাইছিলো,
“যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে
জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে..”
সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত দুজন ছাদে কাটিয়ে বেডরুমে আসবার পর সুদর্শন তিতিরের চুল গুলোকে নিয়ে খেলা করতে করতে বলেছিলো, ‘পাখি আর একবার গাইবে ওই গানটা, যেটা তোমার বাড়ী থেকে ফিরবার পরে তুমি বাথরুমে গাইছিলে’।
তিতির লজ্জা পেয়ে বলেছিলো,’ধ্যাত’।
তারপর নিজের বাঁ হাতে সুদর্শনের গলাটা জড়িয়ে ধরে চোখ বুজেছিলো পরম নিশ্চিন্তে। সুদর্শনও হাত বাড়িয়ে বেডসুইচ টিপে নিভিয়ে দিয়েছিলো ঘরের দৃশ্যমানতা।
পরের দিন,’হে নূতন দেখা দিক আরবার
জন্মের প্রথম শুভক্ষণ..”
মাইক থেকে ভেসে আসা সুর তরঙ্গে চোখ খুলেছিলো তিতির-সুদর্শন।
সেদিন ছিলো পঁচিশে বৈশাখ।
সুদর্শন বলেছিলো,’দেখো পাখি,কবিগুরুর গান,কবিতা ছাড়া হৃদয়ের সঠিক ভাবটি ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই বড়ো কঠিন’,তিতির সুদর্শনের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলেছিলো,’একদম ঠিক বললে।কবিগুরুর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন আবেগ উপাচার হিসেবে যেন তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে’।
সুদর্শন বলেছিলো,’রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্যই হলো, তাঁর ভাব গভীরতা,গীতিধর্মিতা,আধ্যাত্মচেতনা,বাস্তবচেতনা,প্রগতিচেতনা,ঐতিহ্যপ্রীতি’।
তিতির সুদর্শনের কথার রেশ ধরে নিয়ে বলে গিয়েছিলো,’তাঁর প্রকৃতি প্রেম,স্বদেশ প্রেম,বিশ্বপ্রেম,মানবপ্রেম,রোমান্টিকতা, সৌন্দর্য্য চেতনা,ভাব,ভাষা,ছন্দ আঙ্গিকের বৈচিত্র্য। সবেতেই তিনি এক এবং অদ্বিতীয়’।
সুদর্শন বলেছিলো,’জানো তিতির আগে পাড়া থেকে প্রভাতফেরীতে যেতাম।এখন আর কাজের চাপে সময় হয়ে ওঠেনা’।
তিতির বলেছিলো,’আমি কিন্তু আজ একটা ছোট্ট ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি আমাদের ছাদে।সংশপ্তকের সবাই,আশেপাশের বাড়ীর কয়েকজন আর আমাদের বাড়ীর সবাই।তুমি থাকছো কিন্তু’।
সুদর্শন খুশী হয়ে বললো,’ওমা তাই নাকি!’
তিতির মাথা নাড়িয়ে বলেছিলো,’আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।মামনি বলেছে বাবাই আর দুই কাকাইকে ছাদে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব মামনির’।
সুদর্শন বলেছিলো,’তাহলে পাখি একবার বাজারটা ঘুরে আসি’,তিতির অবাক হয়ে বলেছিলো,’বাজার তো করাই আছে।তুমি আবার কি আনবে বাজার থেকে?’
সুদর্শন বলেছিলো,’আমি কিছু নারকেল আর মুড়ির প্যাকেট কিনে আনি’।
তিতির বলে উঠেছিলো,’কি হবে তাতে?’
একটু থেমে বললো,
‘তুমি শিউলিদিকে বলে দিও বিকেলে এসে নারকেল কুঁড়িয়ে দিয়ে যেতে।
ভাবছি যারা আসবে তাদের সবাইকে ঘি দিয়ে মুড়ি মেখে নারকেল কোড়া আর চিনি দিয়ে বাটি চামচ ধরিয়ে দেবো’।
তিতির উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো,’দারুণ আইডিয়া।তাহলে রসগোল্লাও এনো।সঙ্গে দুটো করে মিষ্টিও দেওয়া যাবে’।
সন্ধ্যে হতেই ধীরে ধীরে সুদর্শনদের ছাদ ভরে উঠেছিলো।ছাদের একদিকে তিতিররা ছিলো আর একদিকে দর্শকরা।
মাথার ওপর ত্রিপল টানিয়ে নীচে তক্তপোশ এর ওপর কার্পেট পেতে স্টেজ মতো বানানো হয়েছিলো ছাদের একপাশে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে উদ্বোধনী সংগীত গেয়েছিলো সেদিন অনুশ্রী,
“তোমার কথা হেথা কেহ তো বলেনা,
করে শুধু মিছে কোলাহল।
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া,
পান করে শুধু হলাহল”।
গানটা অনুশ্রীর গলায় দারুণ জমে গিয়েছিলো।কৌশিক পর্যন্ত চোখ বুজে শুনছিলো অনুশ্রীর গান।
অনুশ্রীর পরে সংশপ্তকের বাচ্চারা গানে,কবিতায়,নাটকে মাতিয়ে দিয়েছিলো সান্ধ্য আসর।সেদিন বাচ্চাদের মায়েরাও এসেছিলো ওদের সাথে।
অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে তিতির কখনো ঘোষিকা,কখনো আবৃত্তিকার,কখনো গায়িকার ভূমিকায় ছিলো।
অনুষ্ঠানের ফাঁকেই সুদর্শনের উদ্দ্যোগে দর্শকদের হাতে উঠে এসেছিলো ঘিয়ে মাখা মুড়ির সাথে নারকেল কোড়া-চিনি-মিষ্টি।
অনুষ্ঠানের মাঝেই তিতির লক্ষ্য করেছিলো কাকিয়া,অর্না,পর্নাকে অনুরোধ করে ছাদে আনবার পরেও ওরা তিনজনেই কখন যেন অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।
না তিতির তা বলে দুঃখ পায়নি।কারন তিতিরের মামনি আর সুদর্শন পুরো সময়টা তিতিরের ছায়াসঙ্গী হয়ে তিতিরকে সাহায্যই করে গিয়েছিলো।
সেই মামনি কাল তিতিরকে ছেড়ে বেড়াতে যাচ্ছে শুনে মন তো খারাপ হবেই তিতিরের।(চলবে)