তিতির পাখির বাসা,পর্ব-২২,২৩,২৪

0
485

#তিতির পাখির বাসা,পর্ব-২২,২৩,২৪
#জয়া চক্রবর্তী।
পর্ব-২২

আজ চতুর্থী। সুদর্শনের ফোনেই ঘুম ভেঙেছে তিতিরের।ওর ট্রেন লেট,আসতে দেরী হবে-শুধুমাত্র এই টুকু জানিয়েই ফোন রেখে দিয়েছে সুদর্শন।

তিতির আরো খানিকক্ষণ সময় এপাশ ওপাশ করে বিছানা ছাড়লো।আজ রাতের ট্রেনেই অনুশ্রীদের বেড়াতে যাওয়ার কথা। তিতির চটপট স্নান সেরে রান্নাঘরে ঢুকে তরকার ডাল ভেজালো।
প্রেশারে ছোট আলু অর্ধেক করে কেটে ধুয়ে নিয়ে নুন দিয়ে সেদ্ধ বসালো।

তারপর চা বসিয়ে গামলায় ময়দা নিয়ে তার ভিতর সাদা তেল,নুন,চিনি,একটা ডিম,হাফ কাপ দুধ দিয়ে ময়ান ঠেসে উষ্ণ জল দিয়ে মাখতে থাকলো।আজ সকালে লুচি আলুরদম হবে বলে রেখেছিলো মামনি।

‘কি হলো তিতির চায়ের জল তো শুকিয়ে গেলো।একটু তো খেয়াল রাখতে হয় নাকি!কোন জগতে যে থাকো কে জানে!’,তৃণার কথায় রাগ হলেও কথার উত্তর না দিয়ে তিতির বোতল থেকে আরো কিছুটা জল ঢেলে দিলো চায়ের বাসনে।

জল ফুটলে চা পাতা দিয়ে ঢেকে দিলো রেকাবি দিয়ে।প্রেশারকুকার একটা সিটি দিতেই নামিয়ে রাখলো।তারপর আপন মনে ময়দার লেচি করে রাখতে থাকলো।
অনুশ্রী রান্নাঘরে ঢুকেই বললো,’বাবিনের তো সকালেই আসার কথা।তিতির বাবিন কি ফোন করেছিলো?’
তিতির বললো,’ফোন করে শুধু ট্রেন লেট জানিয়েই কেটে দিলো’।অনুশ্রী বললো,’তারমানে চার্জ নেই ফোনে’।

‘মামনি তোমাদের ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে?ওষুধ গুলো ঠিকঠাক মতো নিয়েছো তো?’তিতিরের কথায় অনুশ্রী শুধু বললো,’হুম’।

অনুশ্রীর নিজের ও বেশ খারাপ লাগছে পুজোর সময়টা তিতির আর বাবিনকে ছেড়ে যেতে।
তার ওপর তিতির যেভাবে মুখ শুকনো করে কাল বলেছিলো,’সবাইএর মধ্যে আমি নেই?’,তাতে মনটা বেশ খারাপ লাগছে অনুশ্রীর।

একবার ভেবেছিলো,থেকেই যাবে তিতিরদের সাথে।কিন্তু কৌশিক কে জানাতেই এক কথায় নাকচ করে দিয়েছে।

‘তরকার ডালটা আবার কেন ভেজালে?’,তৃণার কথায় তিতির বললো,’ তোমরা যাওয়ার আগে এগ-চিকেন তরকা আর রুটি বানিয়ে দেবো’।

অনুশ্রী বললো,’তোমার বাবাই বলেছে চারটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়বে।হাতে সময় রেখে না বের হলে রাস্তায় জ্যামের কারনে পৌঁছোতে দেরী হবে।এসব কিছু বানাতে হবেনা।আমরা কিনে নেবো’।

তৃণা বললো,’আহাঃ বানাতে চাইছে যখন বানিয়ে দিক।তোমার আবার বাড়াবাড়ি। আমরা কোথাও যাওয়ার সময় ট্রেনের খাওয়ার তো বানিয়েই নিয়ে যাই’।

তিতির বললো,’চিন্তা কোরনা মামনি।তোমরা বের হওয়ার আগেই রুটি তরকা হয়ে যাবে।এখন লুচি খাবে তো?’অনুশ্রী বললো,না আমি স্নান সেরে পুজোর কাজটা সেরে ফেলি।তুমি কিন্তু জল মিষ্টিটা দিও রোজ’।তিতির বললো,’হুম দেবো’।

অনুশ্রী বললো,’তোমার ছাত্র ছাত্রীরা এসে যাবে।যা করার করে বেড়িয়ে যাও।আজ আর সবজি বানাবার দরকার নেই।পরে এসে আমি কালোজিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে হালকা করে মাছের ঝোল বানিয়ে ফেলবো’।তৃণা বললো,’তাহলে আমি গিয়ে বাকী জিনিস গুছিয়ে ফেলি গিয়ে’।অনুশ্রী বললো,’হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে’।

ওরা রান্নাঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই তিতির আলুরদম আর লুচিতে মনোনিবেশ করলো।

অনুশ্রীদের ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
এবার এক কামরাতেই সবার সীট পড়েছে এটাই স্বস্তি।
দীপ, অর্না,পর্না নিজেদের ভিতর আগডুম বাগডুম গল্প জুড়েছে।কৌশিক একটা বই বের করে চোখ বোলাচ্ছে।তৃণা অঞ্জনের সাথে কি একটা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছে।

দেব মানে অনুশ্রীর ছোট দেওর কাগজপত্র বের করে হিসেবনিকেষে ব্যস্ত।

দেব বিয়ে করেনি।প্রথম দিকে অনুশ্রী আর তৃণা অনেক চেষ্টা করেছিলো দেবের একটা বিয়ে দেওয়ার।
কিন্তু রাজি করাতে পারেনি।অনুশ্রী দেখেছে,দেবের যেন কাজেতেই খুশী কাজেতেই আনন্দ।
এই কাজ পাগল লোকটা একটু খামখেয়ালি বদরাগী হলেও ওর মনটা বেশ ভালো।

ট্রেন হু হু করে ছুটছে।সবাই যে যার মতো আনন্দে মশগুল।শুধু অনুশ্রীর মনটা খারাপ।তিতিরের গলাটা কানে ভাসছে।আসার সময় অনুশ্রী তিতিরকে জিজ্ঞেস করেছিলো,’বলো আসার সময় কি আনবো?’

তিতির একটু উদাস গলায় বলেছিলো,’দার্জিলিং- কালিম্পং উপত্যকায় অসংখ্য অনিকেত মেঘ।অন্তত কয়েকখণ্ড মেঘ পাঠিও পৌঁছেই’।

অনুশ্রী হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে এসেছিলো,’সাবধানে থেকো দুজন’।তারপর বাবিনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,পুজোর দিনগুলোতে ওকে ঘরে বসিয়ে রাখিস না।মন্ডপে মণ্ডপে ঘুরিয়ে আনিস।খাওয়াদাওয়া টা বাইরেই করিস’।

‘আরে মা তুমি একদম চিন্তা কোরনা।তোমরা ভালো মতোন ঘুরে এসো।আর আমি তো এখন শিয়ালদা’তেই যাচ্ছি তোমাদের ট্রেনে তুলতে।বাকী ইন্সট্রাকশন গুলো না হয় ট্রেনে উঠবার আগে দিও’।

বাবিনের কথায় হেসে ফেলেছিলো সবাই।
দীপ এই প্রথম তিতিরকে বলেছিলো,’সাবধানে থেকো বউমণি’।
অর্না পর্নাও দীপের দেখাদেখি টা টা করেছিলো তিতিরকে।অনুশ্রী খেয়াল করেছিলো,তিতিরের ছলছল চোখটা।

কিছু কিছু মানুষের চোখ মুখ সত্যিই মনের আয়না।তিতিরকে তাই না ভালোবেসে পারেনি অনুশ্রী।
তাই হয়তো আজ সবার মাঝেও তিতিরের মন খুলে মামনি ডাকটা মিস করছে।

বাড়ী খালি।আপাতত তিতিরের করবার কিছুই নেই।আজ সকালে সংশপ্তকেও পুজোর ছুটি দিয়ে দিয়েছে।

নিজের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে তিতির মাদুর হাতে করে সোজা ছাদে চলে গেলো।পুরো বাড়ীতে এই একটা জায়গা ওদের দুজনেরই বড্ড প্রিয়।

অনেকক্ষণ সময় ধরে কফিটা শেষ করলো।
তারপর খোলা আকাশের নীচে শুয়ে পড়ে তারা ভরা আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।

দূর থেকে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ।আগে পঞ্চমী ষষ্ঠীতে প্রথম ঢাকের কাঠি পড়তো।এখন চতুর্থী থেকেই শুরু হয়ে যায়।

তিতিরের অবাক লাগে এই একই বাজনা প্রথম দিকে মনে আনে আগমনী বার্তা।পরের দিকে আনে বিসর্জনের বেদনা।

তিতির কোনকালেই ভীড়ভাট্টা ঠেলে ঠাকুর দেখতে ভালোবাসে না।তিতিরের কাছে পুজো মানেই ছিলো মন্ডপের কাজ,পুজো মানেই ছিলো পুজোবার্ষিকী।

সুদর্শনরা সম্ভবত বই পড়ে না।এখনো একটাও পূজোবার্ষিকী আসেনি বাড়ীতে।
তিতির মনে মনে ভাবলো কাল সকালেই সুদর্শনকে টাকা দিয়ে ওর প্রিয় পূজোবার্ষিকী গুলো কিনিয়ে নিতে হবে।

অনুশ্রীদের ট্রেনে তুলেই সুদর্শন ফেরার ট্রেন ধরলো।আজ সুদর্শনের পা ঠিক মাটীর ওপরে নেই।
মনের সাথে সাথে শরীরটাও উড়ছে সুদর্শনের।

‘খালি বাড়ী’ আর ‘তিতির’এই শব্দ দুটো ভিতরে ভিতরে কেমন অস্থির করে তুলছে সুদর্শনকে।তার ওপর বেশ কয়েকদিন তিতিরকে জড়িয়ে ধরে তিতিরের নরম বুকের ওমে মুখ ডুবিয়ে ঘুমোয়নি।

তবে ট্রেনে করে ফিরতে ফিরতে নিজের ওপরেই রাগ হলো সুদর্শনের।
আসার সময় তিতিরের জন্য তিনটে পুজোবার্ষিকী কিনে এনেছিলো।বই গুলো দিয়ে আসলে তিতিরকে এখন একা একা থাকতে হোতোনা।

ট্রেন থেকে নেমে পাউরুটি আর তিতিরের পছন্দের গোলাপ জামুন কিনে রিক্সা ধরে নিলো সুদর্শন।

‘একটু তাড়াতাড়ি তো চালাতে পারো ভাই’,সুদর্শনের কথায় একটু রেগে গিয়ে রিক্সাওয়ালা বললো,’জোরেই তো চালাচ্ছি।আর কত জোরে যাব!মেশিন তো নই বাবু।তেমন হলে ট্যাক্সি বুক করে নিতেন’।

সুদর্শন আর কথা বাড়ালো না।আসলে রিক্সা ওয়ালা জোরে রিক্সা টানলেও এই মুহুর্তে সুদর্শনের মনের গতির সাথে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য নেই তার।অগত্যা চুপ করে রিক্সা গন্তব্যে পৌঁছোবার অপেক্ষা।

রিক্সা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে সুদর্শন দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুলে ভিতরের দিকে পা বাড়ালো।
যাওয়ার সময় তিতিরের কথাতেই বাইরে থেকে আটকে গিয়েছিলো সুদর্শন।

সুদর্শন দেখলো পুরো বাড়ী অন্ধকার।ঘুরে ঘুরে লাইট গুলো সব জ্বালালো।তারপর কোথাও তিতিরকে দেখতে না পেরে সোজা ছাদে চলে গেলো।

পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো তিতিরের দিকে।দেখলো তিতির ঘুমে অচৈতন্য।
সুদর্শন তিতিরকে না ডেকেই সোজা নীচে গিয়ে শাওয়ার নিলো।তারপর একটা স্কাইব্লু কালেরের হাফ পাঞ্জাবী আর পায়জামা চাপিয়ে সোজা ছাদে এসে তিতিরের পাশে শুয়ে পড়লো।

ক্রমশ রাত বাড়তে থাকে।
জোনাকি লন্ঠন,ঘুমন্ত তিতির,নির্জীব সূর্যমুখীর গোপন আকুলতা,মৃদুমন্দ বয়ে চলা মলয় বাতাস আর আদিগন্ত চুপচাপ রাতের ঘ্রাণ সুদর্শনকে পাগল করে দিতে থাকে।
তবু সুদর্শন তিতিরের ঘুম ভাঙায়না।

একসময় তিতির চোখ মেললো।আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে শুতেই সুদর্শনকে দেখলো।

বললো,’তুমি কখন আসলে?আমায় ডাকোনি কেন?নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়ে গেছে তোমার।
চলো খেতে দিই’।

সুদর্শন বললো,’সত্যি পাখি ভীষণ ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে আমার।কিন্তু আমি যা খেতে চাইবো কোনো প্রশ্ন না করে খাওয়াতে পারবে তুমি?’

সুদর্শনের চোখে মুখে দুষ্টু হাসি।তিতির বললো,’আমি খাবারের কথা বলেছি’।সুদর্শন বললো,’আমিও তো খাবারের কথাই বলেছি’।

তিতির উঠবার চেষ্টা করতেই তিতিরের হাত ধরে হাল্কা টান মারলো সুদর্শন।
সুদর্শনের বুকে তিতিরের মুখ এসে পড়তেই সুদর্শন তিতিরের মাথাটা জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকে।

তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,’খাইয়ে দাও আমায়,খাইয়ে দাও।
এই আকাশ সাক্ষী থাকুক,তারারা সাক্ষী থাকুক তোমার আমার ভালোবাসার’।

তিতির চোখ বুজেই সুদর্শনের চোখের ওপর ঠোঁট ছোঁয়ালো।তারপর সুদর্শনের সারা শরীর জুড়ে তিতিরের ঠোঁট ওঠানামা করতে থাকলো।উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে তিতির,থরথর করে কাঁপছে সুদর্শন।

সুদর্শনের হাত প্রথমে তিতিরকে পরে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিলো।তিতিরের নোখ বসে গেলো সুদর্শনের পিঠে।সুদর্শনের দাঁত বসে গেলো তিতিরের ঠোঁটের পাপড়িতে।কিন্তু ওদের কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

প্রচন্ড আবেগে একে অপরকে আঁকড়ে ভালোবাসার প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে তিতির, ভিজতে থাকে সুদর্শন। সময় বয়ে চলে তার নিজের ধারায়।কিন্তু তিতির সুদর্শনের জন্য থমকে থাকে সময়।

পূব দিকের আকাশ পরিষ্কার হতে না হতেই দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ।বিশ্বস্ত প্রহরীর মতো অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা গাছেদের সাক্ষী করে সুদর্শন তিতিরের হাত ধরে ছাদের পাঁচিলের সামনে এসে দাঁড়ালো।

‘চলো তিতির বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি’,সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,’কোথায়?’
সুদর্শন বললো,’সে যেতে যেতে ঠিক করলেই হবে’।তিতির পাকা গিন্নীদের মতো মুখ করে বললো,’চলো বললেই তো আর চলা যায়না।শিউলিদি আসবে বাসী কাজ সারতে’।

সুদর্শন বললো,’সে আজকের বাসী কাজ না হয় কাল এসে সারবে।প্লিজ পাখি অজুহাত দিও না।চট করে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও’।

অগত্যা তিতির নীচে নেমে আলমারি খুলে শাড়ী ব্লাউজ নামালো।টাওয়াল নিয়ে বাথরুমের দরজা বন্ধ করতেই সুদর্শনের টোকা পড়লো দরজায়।’শিগগিরি খোলো পাখি,চাপতে পারছিনা’।তিতির দরজা খুলে দিতেই সুদর্শন ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

তিতির বললো,’এটা কি হলো?তুমি নাকি চাপতে পারছো না।আমার সামনেই কি করবে নাকি কিছু?’
সুদর্শন হেসে বাঁ হাত দিয়ে তিতিরের কোমর জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে এনে শাওয়ার চালিয়ে দিলো।

কানের কাছে মুখ এনে বললো,’আজ থেকে লক্ষ্মী পূজোর আগের দিন পর্যন্ত তোমায় চোখের আড়াল করা যাবেনা, এটা মহান অনুশ্রী দেবীর আদেশ।আর তাঁর উপযুক্ত জ্যৈষ্ঠ পুত্র হিসেবে আমার সেই আদেশ পালন করা একমাত্র কর্তব্য’।

তিতির সুদর্শনের চুল মুঠো করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললো,’তাই বুঝি,সব কিছু একসাথে করবে!!’
সুদর্শন হেসে বললো,’আঃ আঃ চুল ছাড়ো লাগছে’।

স্নান পর্ব সারতে না সারতেই শিউলি মাসীর কলিংবেল।সুদর্শন বললো,’জ্বালিয়ে খেলো সব’।তারপর টাওয়াল পেঁচিয়ে সদরে গিয়ে দরজা খুললো।

শিউলিকে বললো,’মাসী কাল সকালে এসে বাসী কাজ সেরো।আমরা একটু বের হবো’।শিউলি নিজের মতো কিছু একটা বুঝে নিয়ে হেসে বেড়িয়ে গেলো।

সুদর্শন টাওয়াল জড়িয়েই ফ্রিজ থেকে পাউরুটি বের করে সেঁকে নিলো।তারপর সময় নিয়ে পাউরুটি তে মাখন লাগিয়ে প্লেটে সাজালো।ফ্রিজ থেকে গোলাপ জামুন ও বের করে প্লেটে দিলো।তিতির বের হতেই বললো,’আগে খেয়ে নাও তারপর তৈরি হবে’।

তিতির বললো,’তুমি খেতে থাকো।আমি চট করে ঠাকুরকে জল মিষ্টি দিয়ে আসি’।

সুদর্শনের বাইকের পিছনে বসে ডান হাত দিয়ে সুদর্শনের কাঁধে হাত রাখলো তিতির।সুদর্শন বললো, ‘এইভাবে বসলে চালাবো না।কোমর পেঁচিয়ে ধরে বসতে হবে’।তিতির তাই করলো।

পঞ্চমীর সকাল হলে হবে কি,বাইরে কিন্তু লোকের ঢল নেমেছে এখনি।সুদর্শন তিতিরকে কোন মন্ডপে দাঁড় না করিয়ে সোজা একটা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো।

তিতির চোখ কুঁচকে চারদিকটা দেখে বললো,’আমরা কোথায় এলাম!’

সুদর্শন উত্তর না দিয়ে বাইকের ডিকি খুলে একটা বড়ো ব্যাগ বার করে আনলো।তারপর তিতিরের হাত ধরে সোজা ভিতরে।

তিতির দেখলো ভিতরে প্রার্থনা চলছে।সেখানে বিভিন্ন বয়েসের মানুষজন।প্রত্যেকেই দৃষ্টিহীণ।

সুদর্শনকে দেখে আশ্রমের একজন এগিয়ে আসলো সুদর্শন বললো,’পরিচয় করিয়ে দিই, আমার বীণা দি আর বীনাদি ও হলো তিতির পাখি,আমার বৌ’।

বীনাদি এক গাল হেসে তিতিরের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বাকীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।সবাই তিতিরের হাত ছুঁয়ে ওকে অনুভব করতে চাইলো।

সুদর্শন তিতিরকে ডেকে ব্যাগটা ধরিয়ে দিলো।তিতির দেখলো ভিতরে র‍্যাপ করা অনেক গিফট।তিতির সবার হাতে একটা একটা করে গিফট ধরিয়ে দিলো।

আর মনে মনে ঠিক করলো,প্রতিবছর পুজোর সকাল গুলো এবার থেকে এখানেই এদের সাথে কাটিয়ে যাবে।

সুদর্শন আশ্রমের এক কর্মী মানব দাকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে গিয়ে মাংস কিনে আনলো।তিতির বীনাদির অনুমতি নিয়ে সেই মাংস রান্না করলো।রান্নার মাসীও তিতিরকে সাহায্য করলো।

বীনাদি জানালো,সব শুদ্ধু ৩০ জন থাকেন এই আশ্রমে।আশ্রমটা দুবছর হলো হয়েছে।সুদর্শন প্রথম থেকেই এই আশ্রমে জড়িত।সব মিলিয়ে তিতিরের মন সুদর্শনের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসলো।

আশ্রম থেকে ফেরার পথে তিতির অনর্গল কথা বলে চললো।সুদর্শনের ভয় ছিলো আশ্রমের কথাটা তিতিরকে জানালে হয়তো সুদর্শনকে তিতির খরচা করতে দেবেনা আশ্রমের জন্য।কিন্তু এখন নির্ভার লাগছে মনটা।তিতির বেশ খুশীই হয়েছে আশ্রমে এসে।

বাড়ী ফিরেই আবার সুদর্শনের দুষ্টুমি শুরু।তিতির বললো,’দস্যি একটা’।সুদর্শন বললো,’যেমনি হই শুধু তোমার’,তিতির এবার নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথাড়ি চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে সুদর্শনকে।

‘শুধু তোমার’ শব্দটায় সত্যিই যাদু আছে।আসলে মানুষ তার একান্ত কাছের মানুষটিকে কারো সাথেই বুঝি শেয়ার করতে পারেনা।(চলবে)

#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-২৩)
#জয়া চক্রবর্তী।

সকালের শেষ আয়েসি ঘুমের মধ্যেই তিতির মেঘের তর্জনগর্জন শুনতে পেলো।
চোখ খুলে দেখলো ঘর প্রায় অন্ধকার।
দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়েও কাঁটার চলন বুঝতে পারলো না তিতির।

জানলা গুলো খোলা।জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সুদর্শন।
বাইরের এলোপাথাড়ি হাওয়ার দাপট ঘরের ভিতর থেকেও অনুভব করা যাচ্ছে।

পাশের মণ্ডপ থেকে পূজোর মন্ত্র ভেসে আসছে।
আজ মহাসপ্তমী।
তিতির বিছানা ছেড়ে সুদর্শনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

সুদর্শন তিতিরকে বললো,
‘আকাশ বাড়ী গড়ছে দেখো মেঘ,
বৃষ্টি শাড়ী জড়িয়ে নিয়ে গায়ে।
হঠাৎ প্রেমে আকাশ মায়া ভুলে,
আছড়ে পরবে মাটির দেহের পায়ে’।

তিতির বললো,’ভালো বললে তো’।
সুদর্শন হেসে বললো,’মামনিকে বলেছিলে মেঘ পাঠাতে।মামনিও পাঠিয়ে দিয়েছে।তিতির একগাল হাসলো।

‘কিন্তু বুঝতে পারছো পাখি বৃষ্টি হলে কত ক্ষয় ক্ষতি হবে?কতজনের রুজিরোজগার জড়িয়ে আছে পুজোর এই দিনগুলোর ওপর’,সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,’কিসের আবার ক্ষয় ক্ষতি হবে?বরং বৃষ্টি হলে এই ভ্যাপসা গরমে স্বস্তি পাবে মানুষ’।

তিতিরের কথা শেষ না হতে হতেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো।বৃষ্টির ছাট দুজনেরই গায়ে এসে লাগলো।তিতির হাত বাড়িয়ে কোষ করে বৃষ্টির জল নিলো হাতে।

সুদর্শন বললো,’ কত পরিকল্পনা নিয়ে কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি চলে এই মণ্ডপ সজ্জার।গ্রামবাংলা থেকে শিল্পীদের ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়।আয়োজকরা নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়ে থাকে মন্ডপে।তুমি ভাবো পাখি কত দিনের প্রস্তুতি প্রকৃতির খেয়ালে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে’।

তিতির বললো,’আরে কিছুই লণ্ডভণ্ড হবে না।বৃষ্টিতে বরং ঠান্ডা হয়ে যাবে পরিবেশ।সবাই শান্তি মতো মণ্ডপ ঘুরতে পারবে।চলো ছাদে গিয়ে বৃষ্টি ভিজি দুজন ‘।

তিতিরের এই ভেজার কথাটা মনে ধরলো সুদর্শনের।বললো,’হুম চলো ভিজে আসি।তবে তার আগে একটা ফোন করে দিই রানা রেস্টুরেন্টে।আজকের লাঞ্চটা বলে দিই’।তিতির মাথা নাড়িয়ে সমর্থন জানালো।

সুদর্শন ফোনপর্ব সেরে তিতিরকে নিয়ে ছাদে যেতে যেতে বললো,’আমায় কিন্তু তিনটের পর বের হতে হবে।আজ ঋকদের বাড়ীতে সব পুরোনো বন্ধুরা আসবে।ফিরতে রাত হবে।তুমি চাইলে যেতে পারো আমার সাথে।তবে আমি জানিনা বাকীরা কেউ ফ্যামিলি নিয়ে আসছে কিনা!’

তিতির বললো,’না না আমি যাব না।তুমি ঘুরে এসো।আমি বৃষ্টি থামলে একবার শিউলি মাসীদের বাড়ী যাব।দুদিন ধরে নিজেও আসছে না, প্রমীলাকে ও আসতে দিচ্ছে না’।

সুদর্শন বললো,’শিউলি মাসী গত দুদিনই সকাল বেলায় এসেছিলো।আমিই ফিরিয়ে দিয়েছি।প্রমীলা ছিলো হয়তো সাথে, ঠিক খেয়াল করিনি’।

‘কি যে করোনা তুমি!হঠাৎ ফেরাতে গেলে কেন?আমি দুদিন ধরে ভেবে মরি’,তিতিরের কথায় সুদর্শন একটু বিরক্তই হলো।মুখে বললো,’গত দুদিনই আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিলাম তোমায়’।

তিতির বললো,’তার সাথে শিউলিদিকে ফেরত পাঠাবার কী হলো?জানোই তো প্রমীলাকে এখানে দিয়ে শিউলিদি অন্য বাড়ীর কাজ গুলো সারে’,তিতিরের কথা শেষ না হতে হতেই সুদর্শন বললো,’বাড়ীতে কেউ নেই। আমরা কী প্রমীলাকে ও নিয়ে যেতাম নাকি সাথে?’

তিতির বললো,’কেন প্রমীলাকে নিয়ে গেলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হতো শুনি? আমি তো ঠিক করেছি বছরে দুবার আমার সংশপ্তকের ছাত্র ছাত্রীদের ওখানে নিয়ে যাব।ওদের মানবিক ভাবে জাগানোও একটা লক্ষ্য থাকবে সংশপ্তকের’।

সুদর্শন বললো,’সব ঠিক আছে।কিন্তু তাবলে আমাদের নিজস্ব কোন জগত থাকবে না?এমনিতেই তো একান্নবর্তী পরিবার।রাজ্যের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকছো সবসময়।তার ওপর ঐ সংশপ্তক খুলেছো। প্রমীলার সব খরচ নিজে বহন করতে চাইছো ভালো।আমি কি কিছুতে বারন করেছি তোমায়?’

তিতির ছাদে যাওয়ার মাঝপথেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়লো।বললো,’কেন তোমার কি বারণ করবার ইচ্ছে ছিলো?’

‘উফ আমি সেকথা বলছি না তিতির।শুধু বলতে চাইছি……থাক আর কিছুই বলবো না।ছাড়ো’।

তিতির সুদর্শন কে বললো,দেখো আমি তো সাথে নিজের পড়াশোনা টাও করছি।এমনকি চাকরীর পরীক্ষার প্রস্তুতিটাও নিচ্ছি।একটা চাকরী পেয়ে গেলে সংশপ্তকের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিয়ে দেবো।খুশী??
শুধু ছুটির দিনগুলো ওদের নিয়ে কাটাবো’।

সুদর্শন বিরক্ত হয়ে বললো,’তারমানে তখনো সংশপ্তক?পুরোপুরিভাবে কখনোই পাবোনা তোমায় তাইতো?’
তিতির একটু হেসে সুদর্শন কে বললো,’আচ্ছা আমরা কী সিঁড়ীতেই দাঁড়িয়ে তর্ক করতে থাকবো?ছাদে গিয়ে ভিজবো না?’

সুদর্শন বললো,’তুমি যাও ভেজো গিয়ে।আমার আর ভিজতে ইচ্ছে করছে না’।

তিতির কোন কথা না শুনে টানতে টানতে সুদর্শনকে মাঝ ছাদে নিয়ে ফেললো।

ঝুমঝুম সংগীত যেন ঝরে ঝরে পড়ছে ওপর থেকে।

পাশ কাটাতেই শরীরে শরীর,চেনাগায়ের গন্ধ,বাতাসে প্রবল মাতন।একটু আগের রাগ ভাব,বিরক্ত ভাব সব এক নিমেষেই উধাও।

অবিরাম বৃষ্টি ভিজিয়ে দিতে থাকে তিতির সুদর্শনকে।শব্দহীন দেওয়া নেওয়ারা পা ফেলে কাছে এসে খুঁজে পায় ঐশ্বরিয় সুখ।

বৃষ্টি ভিজে তিতিররা নীচে এসে স্নান সেরে নিলো।

আজ আর সকালে শিউলি মাসী কাজে আসেনি।
তিতির সুদর্শন কে একরকম জোড় করেই সঙ্গে নিয়ে বের হলো। জল ভেঙে ভেঙে গেলো শিউলি মাসীর বাড়ীতে।

গিয়ে দেখে মা মেয়ে দুজনেই জায়গায় জায়গায় বালতি,গামলা বসিয়ে রেখেছে।ফাটা টালি,এখান সেখান দিয়ে জল গড়াচ্ছে।

তিতিরকে দেখে প্রমীলা হাত তালি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’মা আমি আন্টির সাথে যাব’,প্রমীলাকে তিতিরই আন্টি বলা শিখিয়েছে।
তিতিরের কাছেই তো বেশীরভাগ সময় থাকে মেয়েটা।

বব করে চুল কাটিয়ে এনেছে তিতির।শ্যাম্পু সাবান দিয়ে তিতিরদের বাড়ীতেই স্নান করায় ওকে।ওখান থেকেই খাওয়াদাওয়া করে স্কুলে যায় প্রমীলা।

পরিস্কার ফ্রক পরা প্রমীলাকে দেখলে কেউ বলবেই না যে ওর মা লোকের বাড়ীতে কাজ করে।

শিউলি বললো,’বউমনি যে হারে বৃষ্টি পড়তেছে,আমি আজ আর কাজে বেরুতে পারিনি’।
তিতির বললো,’সেটা বুঝেছি।তা ঘরের এমন অবস্থা,আগে বলোনি কেন?

শিউলি বললো,’ওর বাবা থাকতেই জায়গায় জায়গায় টালি ভেঙে গেছিলো।ঠিক করা হয়নি’।
তিতির বললো,’চিন্তা কোরনা মাসী।দেখছি কী করা যায়?’

সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে তিতির বললো,’আচ্ছা বড় প্লাস্টিক বিছিয়ে দেওয়া যায়না টালির ওপর?’

শিউলি মাসী বললো,’এতো অস্থির কেন হচ্ছো বউমনি!আমাদের পাড়ার সব বাড়ীতে গেলেই তুমি এই অবস্থা দেখতে পাবে’।

তিতির কথা না বাড়িয়ে সুদর্শনকে টালিতে বিছোনোর বড় প্লাস্টিক কিনে আনতে বললো’।অগত্যা সুদর্শন ও বাধ্য ছেলের মতো প্লাস্টিক কিনতে গেলো।

একটু আগেই তিতির কতো খুশী ছিলো বৃষ্টি ভেজা নিয়ে।কিন্তু শিউলিদের বাড়ীর অবস্থা দেখে,আরো অনেক অনেক শিউলি,প্রমীলাদের জন্য এখন ওর মন অস্থির।

কলিংবেলের আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বসলো তিতির।খানিকক্ষণ আগেই পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে সুদর্শন।বলে গেছে ফিরতে রাত হবে।

সুদর্শন বেড়িয়ে যেতেই দরজা বন্ধ করে তিতির দেশ পত্রিকার কবিতা পড়ছিলো।

পড়তে পড়তে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো নিজেও বুঝতে পারেনি।কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলো সুদর্শন!

নীচে এসে দরজা খুলতেই দেখলো এক ভদ্রমহিলা সঙ্গে একটি ছেলে।
তিতিরকে দেখেই মহিলাটি একগাল হেসে বলে উঠলেন,’তুমিই তিতির?বাবিনের বৌ ?তোমাদের বিয়ের সময় আসা হয়নি’,বলেই পিছনে তাকিয়ে বললো,’পাপান সামনে আয়।এই দ্যাখ তোর বাবিনদার বৌ’।

তিতির এদের কাউকেই চেনেনা।তবু সৌজন্যের দেঁতো হাসি মুখে এনে বললো, ‘আপনারা ভিতরে আসুন’।

‘দেখলে তো কেমন চিনে নিলাম তোমায়?আমি তোমার শ্বশুরমশাইএর রাঙাজ্যেঠিমার ছেলের বৌ।তোমার শ্বশুর সম্পর্কে আমার দেওর।সেই সূত্রে আমি তোমার জ্যেঠীশ্বাশুড়ী আর পাপান তোমার দেওর।থাকি বসিরহাটে’।

তিতির ঢিপ করে একটা প্রণাম সেরে নিয়ে বললো,’ও আচ্ছা।জ্যেঠীমা তোমরা বিশ্রাম নাও।আমি তোমাদের চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করি গিয়ে’।

‘তা তো বুঝলাম।কিন্তু বাড়ী এতো খালি খালি লাগছে কেন?’জ্যেঠীমার কথায় তিতির বললো,’বাড়ীর সবাই দার্জিলিং, কালিম্পং বেড়াতে গেছে জ্যেঠীমা।আমরা দুজনই বাড়িতে আছি’।

‘ও এবার বুঝলাম।তা বাবিনকে দেখছি না যে’,জ্যেঠীমার কথায় তিতির হেসে বললো,’আপনার বাবিনও এখন বাড়ীতে নেই।বন্ধুর বাড়ী গেছে গেটটু’তে।রাতে ফিরবে’।

তিতির রান্নাঘরে এসে চায়ের জল চাপিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো।সুদর্শন ঘরে নেই।এই কয়দিন বাইরে খাওয়াদাওয়া করবার জন্য বাজার করাও হয়নি।

ঘরে গিয়ে সুদর্শনকে ফোন লাগানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু নেটওয়ার্ক প্রবলেম।কী যে করে তিতির!

দিনটা আবার শনিবার।মানে নিরামিষ এর ব্যবস্থা করতে হবে।তিতির রান্নাঘরে এসে দেখলো জল ফুটে গেছে।চিনি,চা-পাতা,দুধ দিয়ে জল ঢেকে দিলো।

সকালে আনা ব্রাউন ব্রেডের প্যাকেটটা ফ্রিজ থেকে বের করে আনলো।স্লাইস গুলো ছুড়ি দিয়ে ছোট ছোট চৌকো চৌকো করে কেটে নিলো।

একটা বাটীতে অল্প জল আর বেশী করে চিনি দিয়ে সিরা বানাতে বসালো।

কড়াইতে ঘি গরম করে ব্রেডের টুকরো গুলো লাল করে ভেজে তুলে নিলো।চিনির সিরা ঠান্ডা করে তাতে এক ছিপি গোলাপ জল মিশিয়ে,ব্রেডের টুকরো গুলো সেই সিরায় ফেলে তুলে নিলো।

তিতিরের মা মাঝেমাঝে এই ভাবে তিতিরকে টিফিন বানিয়ে দিতো।
তিতিরের মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মা-বড়মার সাথে গল্প করাটা বিয়ের পর মাঝেমাঝেই বেশ কাজে লেগে যাচ্ছে তিতিরের।

তিতির এবার ট্রে নামিয়ে কাপ সাজিয়ে চা ছেঁকে নিলো।আর একটা বড় প্লেটে ব্রেডের টুকরো গুলো দিয়ে দুটো কাটা চামচ ট্রের ভিতর নিয়ে বসবার ঘরে ফিরে এলো।

তিতির ঢুকতেই জ্যেঠীমা বললেন,’পাপান কলকাতায় চাকরী পেয়েছে।আমি চাইনা ছেলে আমার মেসে থাকুক।এখন যতদিন না কোয়ার্টার পাচ্ছে বা নিজে ফ্ল্যাট কিনতে পারছে ততদিন এখানেই থাকবে’।

একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,’সমস্যা হলো দেওর নেই।মুখোমুখি কথা হলো না।দশমীর পরেই ছেলের জয়েনিং ডেট।আমায় আবার কাল সকালেই ফিরতে হবে’।

তিতির বললো,’আমি ঘরে যাচ্ছি জ্যেঠীমা।ওকে একটা ফোন করে বলি যদি তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে’।
‘না না ফোন করে ব্যস্ত করবার দরকার নেই।বন্ধুর বাড়ীতে গেছে যখন একটু আনন্দ করে ফিরুক’।

তিতির এক গাল হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,’আচ্ছা,তাহলে আপনি আর দেরী করবেন না।চা-জলখাবার খেয়ে জামাকাপড় বদলে নিন’।

কথাটা বলেই ওখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা রান্নাঘরে চলে এলো তিতির।ওদের জন্য রাতের খাবারের তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

ফ্রিজ খুলে দেখলো চারটে বড় বড় বীট পড়ে আছে।তিতির কী একটা ভেবে বীট এর খোসা ছাড়িয়ে কুড়িয়ে নিলো।কড়াইতে তেল দিয়ে কালো জিরে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে কুড়োনো বীট দিয়ে দিলো।নিভু আঁচে নাড়াতে লাগলো।হঠাৎ মনে হলো তিতিরের পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

ঘাড় ঘোরাতেই দেখলো পাপান।’কী ব্যাপার তুমি এখানে?’তিতিরের কথায় পাপান হেসে বললো,’এই একটু ঘুরে ঘুরে দেখছি চারদিক।বহুদিন পরে এলাম তো তাই’।

তিতির বললো,’এটা রান্নাঘর।এখানে তোমার দেখার মতো কিছুই নেই ভাই।তুমি বরং অন্য ঘর গুলো ঘুরে দেখতে থাকো’,বলেই বীটের মধ্যে নুন,চিনি,হলুদ দিয়ে নাড়িয়ে পোস্ত কাঁচালঙ্কা বাঁটতে বসলো।

পাপান বললো,’বাবিনদার থেকে আমি মাত্র একবছরের ছোট।তবে তোমার থেকে বড়োই হবো।তাই যদি তোমার আপত্তি না থাকে তোমাকে নাম ধরেই ডাকবো’।

তিতির এই কথার কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। পোস্ত বাঁটাটা বীটে দিয়ে নাড়াচাড়া করে ঢেকে দিলো।তারপর গ্যাস বন্ধ করে সোজা জ্যাঠিমার কাছে।

‘জ্যেঠীমা রাতে রুটি না ভাত, কী খান আপনারা?’,তিতিরের কথায় জ্যেঠীমা বললো,’রাতে রুটিই খাই।আমি দুটো আর পাপান ছয়টা’।
তিতির বললো,’ঠিক আছে।কখন খাবেন বলবেন।গরম গরম বানিয়ে দেবো’।

তিতির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একবার সময় দেখে নিলো।সুদর্শন যে কখন আসবে!(চলবে)

#তিতির পাখির বাসা।
(পর্ব-২৪)
#জয়া চক্রবর্তী।

তিতির ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকালো।
দূর থেকে ভেসে আসা গান,ঢাকের বাজনা,ঝকঝকে তারা ভরা আকাশ,রাস্তায় লোকজনের ভিড় সব মিলিয়ে দারুণ লাগছিলো তিতিরের।

এরমধ্যেই হঠাৎ কান্নার আওয়াজ।তিতির একটু ঝুঁকে পড়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো।দেখলো একটা ছোট মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে একনাগাড়ে বলে চলেছে,”আমি আর হাঁটবো না ,আমাকে কোলে নাও’।

মেয়েটির মা বোঝাবার চেষ্টা করছে যে মেয়েটি আর কোলে নেওয়ার মতো ছোটটি নেই।তিতির দেখলো মেয়েটা তেজ দেখিয়ে প্রায় রাস্তায় ওপরেই বসে পড়ছে।

হঠাৎ এক ভদ্রলোক সামনে থেকে এসে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো।মেয়েটিও কান্না বন্ধ করে গলা জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিলো।তিতির আন্দাজে বুঝলো লোকটি মেয়েটির বাবা।

তিতিরের নিজের বাবা,জ্যেঠুর কথা মনে পড়ে গেলো।
অনেক বড় বয়েস অবধি তিতির ওদের কোলে,পিঠে চড়েছে।

প্রত্যেকবার পূজো এলেই তিতিরের বাবা নিয়ম করে পঞ্চমীর দিন,একটা বসন্ত মালতী,একটা পন্ডস স্নো,একটা গুড়ো ফেস পাউডার, আর একটা হেয়ারব্যান্ড কিনে আনতেন তিতিরের জন্য।

তিতিরের দাদা প্রতিবারই রাগ দেখিয়ে আড়ালে তিতিরকে বলতো,’বাবা তোকে বেশী ভালোবাসে’।
এই বেশী ভালোবাসার বিষয়টা তিতিরের গর্বের কারনও ছিলো।

তিতির বলতো,’আরে আমি তো শুধু হেয়ারব্যান্ডটা নেবো।বাকীগুলো তুই নিয়ে নিস’।

তিতির তখন নিয়ম করে পুতুলের বিয়ে দিতো,জন্মদিন পালন করতো।তিতিরের বড়মার ওপর দায়িত্ব থাকতো খাবারের।

একবার তিতির নিজের মেয়ে পুতুলের বিয়ের খাট,তোশক,লেপ,বালিশের দায়িত্ব দিয়েছিলো জ্যেঠুকে।

তিতিরের জ্যেঠুও অফিস থেকে ফিরে সময় বের করে নিজের হাতে খুব সুন্দর করে লেপ,তোশক,বালিশ,কোলবালিশ বানিয়ে দিয়েছিলেন তিতিরকে।
এমনকি অর্ডার দিয়ে খাট ও বানিয়ে দিয়েছিলেন।

তিতির অবশ্য মেয়ের বিয়ে দিয়েও সব জিনিস নিজের জিম্মাতেই রেখেছিলো।

নিজের মেয়ে পুতুলকে শ্বশুর বাড়ীতে না পাঠিয়ে তিন্নির ছেলে পুতুলকেই ঘর জামাই করেছিলো।

যদিও এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই তিন্নি কান্নাকাটি করে নিজের ছেলে পুতুল নিয়ে গিয়েছিলো ঘরে।

কত কথাই আজ মনে পড়ছে তিতিরের।
ইচ্ছে করছে একছুটে বাড়ী চলে যায়।
সেই ছোট্টটি হয়ে সবার আদর খায়।

‘তিতির তুমি ছাদে?আমি তো সারা বাড়ী তোমায় তন্নতন্ন করে খুঁজে আসলাম’,বিরক্ত হলেও মুখে হাসি টেনে বললো,’কিছু কি বলবে পাপান?’

‘ওই মা বলছিলো,কাল সকালেই ফিরতে হবে মাকে।যদি খাওয়ারটা বেড়ে দিতে,খেয়ে শুয়ে পড়তে পারত’।

তিতির বললো,’তুমি যাও আমি আসছি’।

সুদর্শন কলিংবেল বাজাতেই পাপান গিয়ে দরজা খুলে দিলো।

সুদর্শন পাপানকে দেখে অবাক সঙ্গে খুশীও।
‘কখন এলি পাপান?কতদিন পর দেখছি তোকে।কেমন আছিস?বিয়ের সময় আসলি না কেন তোরা?তারপরেও তো কোন যোগাযোগ নেই’।

পাপান হেসে বললো,’বিকেলবেলা এসেছি বাবিনদা।মা ও এসেছে সাথে।তোমার বিয়ের সময় আমার শিলিগুড়িতে চাকরীর ইন্টার্ভিউ পড়েছিলো,বাবার ও শরীর ভালো নেই।তাই আমাদের কারোরই আর আসা হয়নি বিয়েতে’।

‘আচ্ছা ফোন তো করে জানাতে পারতিস না আসবার কারন।সেটাও জানাসনি।
তারপর তোর চাকরীর কি খবর?কিছু হলো?’

বাবিনের কথায় পাপান বললো,’হ্যাঁ দাদা পেয়েছি চাকরী।দশমীর পরেই জয়েনিং ডেট।তোমাদের বাড়ী থেকে আমার যাতায়াতটা সুবিধার হবে।
তাই মা চাইছিলো যতদিন না কোয়ার্টার পাই বা ফ্ল্যাট কিনবার মতো উপযুক্ত না হই, ততদিন তোমাদের এখান থেকেই অফিস করি’।

‘বাহঃ এতো খুব ভালো খবর।তোর অফিসটা ঠিক কোথায় বলতো?’,কথা বলতে বলতেই বাবিনকে ডাইনিং এ আনে পাপান’।

তিতির রান্নাঘরে রুটির ঝামেলা মিটিয়ে ডাইনিং এ ওদের খাবার বাড়ছিলো।
সুদর্শন একটা মিষ্টির প্যাকেট ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো,’কেমন আছো জ্যেঠিমা?’

‘আর কেমন থাকবো এই বয়েসে!ওই কেটে যাচ্ছে তবু রক্ত পড়ছে না এই আর কি!’,বলেই নিজের কথায় নিজেই খানিকটা হেসে নিলেন জ্যেঠিমা।

তারপর বললেন,’পাপানকে রাখতে এলাম তোদের বাড়ীতে।ওর অফিস এখান থেকে কাছে হবে তাই।আমি কাল সকালেই ফিরে যাব।তোর জ্যেঠুর শরীরটা তেমন ভালো নেই বুঝলি’।

‘পাখি জ্যেঠিমারা এসেছেন জানিয়ে একটা ফোন তো করতে পারতে’,বাবিনের কথার উত্তর জ্যেঠিমাই দিলেন,
‘ও ফোন করতে চেয়েছিলো।আমিই বারন করেছি’।

জ্যেঠিমার কথায় বাবিন বললো,’এ তোমার ভারি অন্যায় জ্যেঠিমা।ফোন করতে বারন করলে কেন?পাখি ফোন করে দিলে আমিও তোমাদের আড্ডায় সামিল হতে পারতাম’।

‘আড্ডা আর কই হলো!বাড়ী খাঁ খাঁ করছে।তার ওপর তোর পাখি তো তখন থেকে শুধু খাওয়ারের ব্যবস্থাই করে গেলো’।
তা কি বানিয়েছো এটা বউমা?’

তিতির বললো,’বীটের সবজি।আসলে ঘরে কিছু ছিলোনা।।আর আপনি ও বাবিনকে ফোন করতে মানা করে দিলেন।তবে খেয়ে দেখুন মনে হয় গরম রুটি দিয়ে খারাপ লাগবে না’।

‘সেকি তুমি বাবিনকে নাম ধরে ডাকো নাকি!এটা তো ঠিক নয়’,জ্যেঠিমার কথায় হেসে বললো তিতির,’হ্যাঁ নাম ধরেই তো ডাকি।নাহলে কি বলে ডাকতাম?’

জ্যেঠিমা বললেন,’স্বামীর নাম মুখে নিতে নেই।তুমি না হয় শিখে আসোনি বাপের বাড়ীর থেকে।কিন্তু অনু,তৃণা?তারা কি করছিলো,তারা কী শেখাতে পারেনি তোমায়?’

একটু থেমে নিশ্বাস নিয়ে বললেন,’স্বামীকে বলতে হয়,অমুকের দাদা,আপনাদের ছেলে,তমুকের কাকা এসব বুঝলে?’,তিতির বললো,’কেন কোন কনফিউশন আছে এই ব্যাপারে?’

জ্যেঠিমা বললো,’কিসের কনফিউশন?’

তিতির বললো,’এই যে বাবিন আপনাদের ছেলে বা অমুক তমুকের দাদা বা কাকা!নাকি ভুলে যান আপনারা সম্পর্ক গুলি!মানে আমি বলতে চাইছি আমাকে বাবিনের কথা বলতে হলে বারবার করে আপনাদের সম্পর্কগুলো কেন মনে করাতে হবে?’

‘তুমি তো খুব তর্কবাগীশ মেয়ে।অনু, তৃণা কী করে তোমায় নিয়ে সংসার করছে কে জানে!’

জ্যেঠিমার কথায় তিতির হেসে বললো,’অতো চাপ নেবেননা জ্যেঠিমা।খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে নিন’।

বাবিন বললো,’কিভাবে কথা বলছো তুমি পাখি!আমরা এই ভাবে বড়দের মুখে মুখে কথা বলিনা।ক্ষমা চেয়ে নাও’।

সুদর্শনের গম্ভীর গলায় তিতিরের কান্না পেয়ে গেলেও তিতির কিন্তু চোখের জল বাইরে আসতে দিলোনা।চুপচাপ পাপানের খাওয়ার বেড়ে এগিয়ে দিলো পাপানের দিকে।

তারপর মুখে মিথ্যে হাসির প্রলেপ টেনে বললো,’ক্ষমা করবেন জ্যেঠিমা।আপনার বাবিন মিষ্টি এনেছে।দিয়ে গেলাম,খেয়ে নেবেন’।আপনার কথাটার ওপর যেন ইচ্ছা করেই জোড় দিয়ে বললো তিতির।

তারপর বাবিনের দিকে তাকিয়ে বললো,’পাপানের দাদা তুমি কী খেয়ে এসেছো?না খেতে দেবো?’

তিতিরের বলার ধরনে হাসি পেয়ে গেলো বাবিনের।মজা করে নিজেও বললো,’পাপানের বৌদি আমায় নিয়ে একদম চিন্তা কোরনা।আমি খেয়েই এসেছি’।

‘আমি কিন্তু তিতিরকে বৌদি বলে ডাকতে পারবো না।তিতির বয়সে অনেক ছোট আমার থেকে’,পাপানের কথা শেষ না হতে হতেই ওর মা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো।
‘একি অলক্ষুণে কথারে পাপান!সম্পর্কে যখন বৌদি তখন বৌদি বলেই ডাকবে ওকে’।

তিতির ওখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা ড্রয়িংরুমে চলে আসলো।জ্যেঠিমা সোফায় পা তুলে বসেছিলেন।
কুশন গুলোকেও নীচে ফেলে দিয়েছেন।

তিতির ব্যস্ত হাতে সোফার ওয়াড় টানটান করলো।নীচে পড়ে থাকা কুশন গুলোর ওয়াড় খুলে ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে আসলো।

পাশের দেওয়াল আলমারি থেকে ফ্রেশ ওয়ার বের করে কুশন গুলোতে পরিয়ে সোফায় সাজিয়ে দিয়ে সোজা ছাদে চলে গেলো।

ছাদে এসে এতোক্ষনে তিতিরের থমকে যাওয়া চোখের জল মোম গাল গড়িয়ে ঝড়তে লাগলো।

তিতির রাস্তার দিকে মনোযোগী হতে চাইলো।কিন্তু সুদর্শনের কথাটা তিতিরের কানে বাজছে,”কিভাবে কথা বলছো তুমি পাখি!আমরা এই ভাবে বড়দের মুখে মুখে কথা বলিনা।ক্ষমা চেয়ে নাও।”

তিতিরদের বাড়ীতে স্বাধীন মতামত দেওয়ার আধিকার ছোট বড় সকলেরই ছিলো।তিতিরের বাবা বলতেন,”ছোটদের থেকেও অনেক কিছু শিখবার থাকে”।

‘কী হলো পাখি না খেয়ে ছাদে উড়ে এলে যে বড়ো!’,কথাটা বলেই সুদর্শন তিতিরের পিঠে হাত রাখলো।তিতির এক ঝটকায় সুদর্শনের হাত পিঠ থেকে সরিয়ে দিলো। সুদর্শন তিতিরকে দুহাত দিয়ে বুকে টানতে চাইলো।

তিতির সুদর্শনের হাত থেকে জোড় করে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌঁড়ে নীচের দিকে নামতে যেতেই পা শ্লিপ করে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি গড়িয়ে নীচে পড়লো।

তিতিরের পড়ার আওয়াজে জ্যেঠিমা সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালো।
পাপান অর্ধেক সিঁড়ি উঠে তিতিরকে ধরতে গেলো,কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তেই
সুদর্শন তিতিরকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাকী সিঁড়ি গুলো নামিয়ে এনে নিজেদের ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিলো।

দরজাটা ভিতর থেকে টেনে বন্ধ করে তিতিরের কাছে এলো।
‘কোথায় লেগেছে পাখি আমায় বলো’,কথাটা বলেই সুদর্শনের চোখ পড়লো তিতিরের হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে।শাখা বেড়ে গেছে হাতের।

সুদর্শন দৌড়ে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে আসলো।তুলো বেটাডিন সলিউশনে ভিজিয়ে কেটে যাওয়া জায়গা মুছিয়ে দিলো।তারপর তুলো দিয়ে অয়েনমেন্ট লাগিয়ে গজ বেঁধে দিলো।

তিতিরের চোখ দিয়ে তখনো জল গড়িয়ে পড়ছে।
‘কেন এমন করছো পাখি?আমি দোষ করেছি।তোমাকে ওই ভাবে সবার সামনে বলাটা আমার ঠিক হয়নি।
কিন্তু তা বলে এই ভাবে তুমি নিজেকে শাস্তি দেবে?’

তিতির সুদর্শনের হাত সরিয়ে খাট থেকে নীচে নামতে চাইলো।কিন্তু হাঁটু ধরে বসে পড়লো।সুদর্শন তিতিরের হাত সরিয়ে জোর করে পা উন্মুক্ত করতেই দেখলো পুরো মালাইচাকিটাই নীল হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে।

সুদর্শন দরজাটা টেনে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফের প্যাড আনতে গেলো।

বাইরে থেকেই কানে এলো জ্যেঠিমার গলা,’দেখিস পাপান এই মেয়ে নিয়ে বাবিন বেশীদিন সংসার করতে পারবে না।মেয়েরা হবে লক্ষ্মীমন্ত,ধীর চলন।এই মেয়ে ছোটাছুটি করে এখনি শাখা বেড়ে ফেলেছে।সিঁড়িতে শাখার টুকরো গুলো কেমন ছড়িয়ে পড়ে আছে দেখেছিস?’

একটু থেমে বললো,’আর বাবিনকে দেখেছিস,বউ পেয়ে কেমন ভ্যাড়াকান্ত হয়ে গেছে।সকলের চোখের সামনে দিয়ে,একেবারে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ঘরে গিয়ে দোর দিলো’।

বাবিন কথাগুলোর কোন উত্তর না দিয়েই ঘরে ঢুকে ফ্রিজ খুলে বরফের প্যাড বের করে নিলো।
তারপর পাপানকে বললো,’পাপান দোতালায় মশা নেই।তবু শোয়ার আগে অল আউট জ্বালিয়ে নিস’।

তিতিরের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো।
তিতির হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে হেলো বলতেই অপর প্রান্তের গলা শুনে তাড়াতাড়ি নিজের চোখদুটো মুছে নিলো।তারপর যতটা সম্ভব নর্মাল গলা করে কথা শুরু করলো।ফোনটা তিতিরের মামনির।

অনুশ্রী ওদের খবর নিতে গিয়ে জানতে পারে সুদর্শনের বসিরহাটের জ্যেঠিমা আর পাপান এসেছে।খবরটা শুনেই অনুশ্রীর কপালে হাল্কা ভাঁজ।

অনুশ্রী বললো,’তিতির একটা কথা বলে রাখছি,বসিরহাটের দিদির কথাবার্তা তেমন ভালো নয়।তুমি কিন্তু কোন কথাই মনে লাগিও না।ওরা চলে গেলে পারলে বাবিনকে নিয়ে দুদিনের জন্য বাপের বাড়ী ঘুরে এসো’।

মামনির কথা শুনে তিতিরের চোখ দিয়ে আবার জল গড়াতে থাকলো।
তবু তিতির কিছুই বুঝতে দিলোনা।শুধু ছোট্ট করে বললো,’মিস ইউ’।

তিতির ফোনটা রাখতেই সুদর্শন বরফের প্যাড নিয়ে দরজা খুলে ভিতরে আসলো।

বললো,’ভাবছি পাপানতো এর আগেও এখানে এসে থেকেছে।আমি রানা রেস্টুরেন্টে বলে যাব তিনবেলা করে ওর খাবার দিয়ে যেতে।আমরা দুদিন বরং তোমার বাড়ী থেকে ঘুরে আসি’।

তিতির কোন উত্তর দিলোনা।

সুদর্শন তিতিরের নীল মালাইচাকিতে বরফের প্যাড লাগাতেই তিতির উঠে বসলো।হাত বাড়িয়ে প্যাডটা নিতে চাইলো নিজে লাগাবে বলে।

সুদর্শন জোড় করে তিতিরকে শুইয়ে দিলো।
গম্ভীর গলায় বললো,’এবার বকবো কিন্তু।আমাকে বরফ সেঁকটা দিতে দাও’।

অনেকক্ষণ সময় ধরে তিতিরকে বরফসেঁক করছিলো সুদর্শন।

তিতির কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।

সুদর্শন ঘুমের মধ্যেই তিতিরের মালাইচাকিতে থম্বোফোব জেল লাগিয়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলো।

টাওয়াল ভিজেয়ে এনে মুখ মুছিয়ে দিলো।তারপর তিতিরকে জড়িয়ে ধরে নিজেও চলে গেলো ঘুমের দেশে।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here