#তিতির পাখির বাসা,পর্ব-২৫,২৬
#জয়া চক্রবর্তী
পর্ব-২৫
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো তিতিরের।
সুদর্শনের হাতের বেড় থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে পা দুটো মেঝেয় নামালো তিতির।
টনটন করে কামড়ে ধরলো ব্যথা।
তিতির টলোমলো পায়ে দরজা খুলে ডাইনিং এ এলো।ফ্রিজ খুলে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস এর বোতল বের করে ঢকঢক করে কিছুটা গলায় ঢাললো।
বাসনের র্যাক থেকে হাত বাড়িয়ে কাচের বাটী আর চামচ নিলো।তারপর দুটো গোলাপ জামুন নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।
রাস্তায় ক্লান্তিহীন মানুষের ঢল।সবাই মন্ডপ আর প্রতিমা সজ্জার আকর্ষণে নিজেদের ঘুম বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে চলেছে এক মন্ডপ থেকে আর এক মন্ডপের দিকে।তাদের উৎসাহ আর উদ্দীপনা সত্যিই প্রশংসনীয়।
তিতিরের শুধু খারাপ লাগছে বাচ্চাদের জন্য।
মা বাবার সখে সামিল হতে তাদেরও হাঁটতে হচ্ছে।
রাত জাগার ঘুষ হিসেবে কারো হাতে বাঁশি,কারো বেলুন,কেউ বাবল ফুঁ দিচ্ছে,কেউবা আইসক্রিম-চিপস-কুড়কুড়ে খাচ্ছে।
তিতির ব্যালকনির একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।বিভিন্ন মানুষ দেখতে দেখতে গোলাপ জামুন কেটে কেটে মুখে তুলতে লাগলো।
গোলাপ জামুনের নরম স্পর্শ আর রসে ভরে যেতে থাকে তিতিরের মুখ।
‘ঘুমোওনি তিতির?ব্যথা কেমন?’,কথা শুনে চমকে তাকাতেই সামনে পাপান।
তিতির উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা।
পাপান নিজে নিজেই বলতে শুরু করলো,’পুজোর রাত গুলো কেউ ঘুমিয়ে কাটায় নাকি!বাবিনদা সত্যিই বেরসিক।নতুন বৌ নিয়ে কোথায় ঠাকুর দেখবে,তা না করে নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে’।
‘হলো বলা?বলা হয়ে গেলে শুতে চলে যাও’,তিতিরের গলার স্বরে,চোখের কাঠিন্যতে কিছু একটা ছিলো,যাতে পাপান আর ওখানে না দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
তিতির পাপানের চলে যাওয়াটা দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে আবার রাস্তায় মনোযোগী হলো।
কৌশিকের ডাকে অনুশ্রী কম্বলটা মাথা অবধি টেনে নিলো।
‘কি হলো অনু উঠে পড়,আরে তিনটে বেজে গেছে তো।গাড়ীও এসে গেছে পনেরো মিনিট হলো।এরপরে গেলে সূর্যোদয় দেখাটা মিস হয়ে যাবে’,কৌশিকের কথায় এবার অনুশ্রী কম্বল থেকে মুখ বের করে বললো,’আমি তো কাল রাতেই জানিয়ে দিয়েছিলাম যাবনা।তারপরেও কেন জ্বালাচ্ছ আমায়?’
কৌশিক বললো,’তাহলে আমিও থেকে যাই তোমার সাথে।ওদের বরং বেরিয়ে যেতে বলি’।
অনুশ্রী বললো,’না না তুমি যাও ওদের সাথে।আমার জন্য হোটেলে বসে,তোমার নিজের বেড়ানো নষ্ট করতে হবেনা।পরে তো ফিরে গিয়ে বলবে,তোমার জন্য এই করা হলোনা, সেই করা হলোনা’।
কৌশিক হেসে ফেললো।তারপর বেড়িয়ে গিয়ে তৃণা,অঞ্জন কে বললো,’আমি আর অনু যাচ্ছিনা।তোমরা বেরিয়ে পড়ো,নাহলে সূর্যোদয়টা মিস করবে’।
তৃণা বললো,’সেকি দাদা তোমরা যাবেনা কেন?সবাই মিলে গেলেই তো ভালো হতো’,কৌশিক হেসে বললো,’দেরী কোরনা অহেতুক।এসে কথা হবে।আমি দেখি একটু চায়ের ব্যবস্থা করা যায় নাকি’।
দেব এবার তাড়া দিয়ে অর্না,পর্না,দীপ কে নিয়ে গাড়ীতে বসলো।
দেখাদেখি তৃণা-অঞ্জন ও ওদের পিছনে গিয়ে গাড়ীতে উঠলো।
অন্ধকারের ভিতরেই সূর্যোদয় দেখাবার আশায় ড্রাইভার ওদের নিয়ে রওনা হলো টাইগার হিলের উদ্দেশ্যে।
নিশ্চিন্ত হয়ে কৌশিক এবার কেয়ারটেকারের রুমের দিকে গেলো।উদ্দেশ্য যদি উনি এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।
কেয়ারটেকার ভদ্রলোকটি বাঙালী।নাম শ্যামল বিশ্বাস।এই দুদিনেই কৌশিকদের সাথে ভালো আলাপ জমে উঠেছে ভদ্রলোকের।
ওনার পরিবার শিলিগুড়িতে থাকে।খুব মিশুকে আর হাসিখুশী মানুষ এই শ্যামল বাবু।
দরজা খটখট করতেই নিজেকে কম্বলে মুড়িয়ে ঘুম চোখে দরজা খুলে বেড়িয়ে আসলেন উনি।কৌশিককে দেখে অবাক হয়ে বললেন,’সেকি আপনাদের গাড়ী আসেনি এখনো!দাঁড়ান আমি ফোন করে দেখছি।এতোক্ষণেতো এসে যাওয়ার কথা ছিলো’।
কৌশিক হেসে বললো,’আপনি ব্যস্ত হবেন না।গাড়ী ঠিক সময়েই এসেছে।আর ওদের নিয়ে রওনাও হয়ে গেছে।গিন্নী যেতে চাইলেন না।তাই আমিও আর গেলাম না’।
শ্যামল বাবু হেসে বললো,’তাই বলুন।আমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম’,কৌশিক বললো,দুঃখিত ঘুম ভাঙাবার জন্য।আসলে এক কাপ চায়ের দরকার ছিলো।যদি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন’।
শ্যামল বাবু বললেন,’আপনি রুমে যান।চায়ের বিষয়টা দেখছি আমি’।
‘কী ব্যাপার অনু? তুমি যে বললে টাইগারহিল যাবেনা।তাহলে রেডি হচ্ছো?ওরা তো তখনই বেড়িয়ে পড়েছে’,কৌশিকের কথায় অনুশ্রী বললো,’আমি এখন মন্ডপে যাব।বিয়ের আগে দুবার পূজোর সময় বাবার সাথে এসেছিলাম।তুমি জানো দার্জিলিং কালিম্পং মিলিয়ে দশ থেকে পনেরোটা পুজো হয়’।
‘সেকি তুমি মন্ডপে যাবে?এই যে বলো,ভিড়ভাট্টা ঠেলে তোমার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ব্যাকা ট্যারা দুর্গা দেখতে ভালো লাগেনা’,কৌশিকের কথা শেষ না হতেই অনুশ্রী বললো,’আরে এখানে ভিড় কোথায়?তাছাড়া পাহাড়ে থিমের পূজো হয়না।সাবেকিয়ানা বজায় রেখেই মায়ের পূজো হয়’।
একটু থেমে বললো,’ইচ্ছে আছে এখানকার নৃপেন্দ্র নারায়ণ বেঙ্গলি হলে যে পুজোটা হয় সেখানে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি টা দেবো’।কৌশিক বললো,’বুঝলাম সব প্ল্যানিং আগে থেকেই করে রেখেছো। যাও ঘুরে এসো’।
অনুশ্রী বললো,’সেকি তুমি যাবেনা?’কৌশিক বললো,’না,তোমার তো একাই যাওয়ার প্ল্যানিং ছিলো।তেমন হলে আমাকে তো জানাতে আগে’।
অনুশ্রী বললো,’ভেবেছিলাম ঘুরতে এসে মন্ডপে পুষ্পাঞ্জলি দিতে যাওয়াটা তোমাদের কারোরই ভালো লাগবে না।তাই আর বলিনি’।
অনুশ্রী একটু থেমে বললো,’আরে চলোই না।গেলে ভালোই লাগবে।কোচবিহারের রাজার নামেই এই নৃপেন্দ্র নারায়ণ হল।তুমি জানো বিবেকানন্দ,সিস্টার নিবেদিতা,আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু এমনকি কে.এল,সায়গল ও পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছিলেন একসময়’।
কৌশিক বললো,’চলো তাহলে ঘুরেই আসি।তবে আসার আগে শ্যামল বাবুকে চায়ের জন্য বলে এসেছিলাম,এখনো তো পাঠালেন না’।
অনুশ্রী অন্যমনস্ক ভাবেই শাড়ীর প্লিট ঠিক করতে করতে বললো,’জানো তোমার বসিরহাটের বৌদি আর পাপান এসেছে বাড়ীতে।কী কান্ড দেখো!এই পূজোর সময়টা আমরা নেই।এখনি ওদের আসতে হলো’।
কৌশিক বললো,’সে আর কী করা যাবে!কেউ আসলে তো তাকে বারন করা যায়না।গলা ধাক্কা দিয়ে বের করেও দেওয়া যায়না’।
অনুশ্রী রেগে বললো,’সেটা কি বললাম আমি?তোমায় কিছু বলাই যায়না।কিছু বললেই একটা ভুলভাল উত্তর।জানোই তো তোমার বৌদির কথাবার্তা বলার ধরণ’।
একটু থেমে বললো,’আমার তো মনে হয় তিতিরকে ও কিছু বলেছে।মেয়েটার গলা শুনে মনে হলো কান্নাকাটি করেছে।এরপর থেকে কোথাও বের হলে তিতির,বাবিনকেও সঙ্গে নেবো’।
কৌশিক হেসে ফেলে বললো,’তাহলে তোমরা একসাথে ঘুরো।আমি থেকে যাব বাড়ীতে।আরে বাড়ী পাহারার ব্যাপার টাও তো দেখতে হবে?’অনুশ্রী বললো,’শুনেছি সিকিউরিটি গার্ড পাওয়া যায় কয়েকদিনের জন্য।আমরা সেই ব্যবস্থাই না হয় করে আসবো এবার থেকে’।
কৌশিক বললো,’এখনো তো চা দিয়ে গেলোনা অনু’।
অনুশ্রী বললো,’চা-চা কোরনা তো।চা খেয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেবে নাকি?তাড়াতাড়ি চলো।
ছেলে মেয়ে গুলো এসে পড়বার আগেই বেড়িয়ে যেতে চাইছি।এসেই আবার নতুন বায়নাক্কা শুরু করবে।মাঝখান দিয়ে আমার পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হবেনা’।
‘আরে দাদা যাচ্ছেন কোথায়? চা রেডি।খেয়ে যান।গ্যাস ফুরিয়ে গিয়েছিলো।সেটার ব্যবস্থা করে তবে চা বানালাম’,শ্যামল বাবুর কথায় কৌশিক বললো,’সেকি আপনি বানালেন নাকি?’
শ্যামল বাবু হেসে বললো,’চুমুক দিয়ে দেখুন।চা টা বেশ ভালোই বানাই আমি।তা ভাবলাম আমার হাতে বানানো চা খাওয়াই আপনাদের’।
কৌশিক বললো,’দেখুন না গিন্নীর বায়নায় মন্ডপে যেতে হচ্ছে পুষ্পাঞ্জলি দিতে।এসে আপনার বানানো চা খাবো’,কৌশিকের কথায় এবার শ্যামলবাবু বললো,”আপনাদের কী আর এখানকার পূজো ভালো লাগবে?’
অনুশ্রী বললো,’না ভালো লাগার কী হলো!এর আগেও দুবার পাহাড়ের পুজো দেখেছি।অঞ্জলি ও দিয়েছি’।
শ্যামল বাবু বললেন,’সেতো আগের কথা।এখন আর পাহাড়ের পূজোয় সেই প্রান নেই।পাহাড়ী আন্দোলনের জেড়ে উমার এখন পাহাড়ে ঢোকার পথ বন্ধ।সমতল থেকেই উমা এখন পাহাড়বাসীদের আশীর্বাদ করে’।
অনুশ্রী চমকে উঠে বললো,’সেকি উমা পাহাড়ে ঢুকতে পারেনা মানে?’,শ্যামল বাবু বললেন,’আসলে ষষ্ঠ তফশিলের ধুয়ো তুলে পাহাড়ে মূর্তিপূজো করা যাবেনা এমনটিই দাবি করা হয়েছে।জানেন কি নেপালি উপজাতিরা মূর্তি পূজোর বিরোধী’?
অনুশ্রী বললো,’তারমানে পাহাড়ে আর মাতৃ বন্দনা হয়না?’,শ্যামল বাবু বললেন,’যে কয়টি জায়গায় পূজো হতো তার অনেক গুলোই বন্ধ হয়ে গেছে।তবে কয়েকটা পূজো এখনো হয়।কিন্তু দেবী সেখানে নিরাকার’।
কৌশিক জিজ্ঞেস করলো,’দেবী নিরাকার মানে?’,শ্যামল বাবু বললেন,’আরে নিরাকার মানে বুঝলেন না?সেখানে আর প্রতিমা পূজা হয়না।ঘট স্থাপন করেই পূজোর ব্যবস্থা হয়’।
একটু থেমে বললো,’কী জানেন আন্দোলনের নামে অর্ধশিক্ষিত মানুষ গুলিকে ক্ষেপিয়ে তুলে রাজনৈতিক মুনাফা লাভের আশাতেই হচ্ছে এসব’,শ্যামল বাবুর কথা শেষ হতে না হতেই অনুশ্রী বললো,’আচ্ছা রাজরাজেশ্বরী হলে ও তো একটা পুজো হতো।এখনো চোখ বুজলে মায়ের ভূবনমোহিনী রূপ চোখে ভাসে’।
‘আচ্ছা আপনারা কি কাগজ পড়েননা নাকি?জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই রাজরাজেশ্বরী হল’,অনুশ্রীর বুক কেঁপে উঠলো শ্যামলবাবুর কথায়।চোখের কোনে টলটল করছে জল।
ব্যাপারটা খেয়াল করে শ্যামলবাবু বললেন,’আপনারা চাইলে আমি ফোন করে গাড়ী বুক করে দিচ্ছি।শিলিগুড়িতে ভালো ভালো পূজো হয়।এখন বেড়িয়ে গেলে বিকেলের মধ্যে মন্ডপ গুলি ঘুরে আবার এখানে পৌঁছে যেতে পারবেন।তা না হলে ঘটেই পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আসুন,আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি’।
অনুশ্রী চোখ মুছে বললো,’না সমতলে আর যাবনা এখন।আপনি বরং এখানেই কোথাও ব্যবস্থা করে দিন। পুষ্পাঞ্জলিটা অন্তত দিয়ে আসি’।
শ্যামলবাবু বললেন,’দেখে নেবেন এই আন্দোলন কিন্তু বেশীদিন টিকবে না।আন্দোলনকারীরা আস্তে আস্তে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।কী জানেন এদের আন্দোলনের কারনে যে বিপুল আর্থিক ক্ষতি পাহাড়ের হলো,তার দায়ভার কিন্তু সম্পূর্ণই নিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে’।
একটু থেমে নিশ্বাস নিয়ে বললো,’এখন সাধারণ মানুষ সেটা বুঝতে পেরে আন্দোলনকারীদের থেকে নিজেরাই সরে যাচ্ছে।জেনে রাখবেন,যে আন্দোলনে সাধারণ মানুষ সরাসরি যুক্ত থাকেনা,পৃথিবীর ইতিহাসে সেই আন্দোলন কখনোই সফল হয়নি বা হয়না’।
শ্যামলবাবুর ঠিক করে দেওয়া জায়গা থেকেই পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে অনুশ্রী আর কৌশিক নিজেদের হাত ধরে ফিরতে ফিরতে দুজনেই উপলব্ধি করলো,ছোটবেলায় ঘোরা সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর নেই পাহাড়ের।
যে কাঠের বাড়ী গুলো খাদের ধারের শোভা ছিলো,প্রোমোটারী লাভের অঙ্ক সেই সৌন্দর্য ধ্বংস করে কংক্রিটের বহুতলে ভরিয়ে দিয়েছে।এই দৃশ্য বড় বেশী বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে কৌশিক-অনুশ্রীর চোখে।(চলবে)
#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-২৬)
#জয়া চক্রবর্তী
ঝমঝম করে হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি।তিতির দেখলো রাস্তায় হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে দর্শনার্থীদের।
প্রত্যেকেই গা বাঁচাতে শেড খুঁজছে।এদিকে বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছে তিতিরও।
তিতিরের মনে হলো নীচে গিয়ে সদর দরজাটা খুলে দিলে,বৃষ্টি থেকে বাঁচবে লোকগুলো।
আসলে সুদর্শনদের সদর দরজার ভেতরের দিকের বেশ কিছুটা অংশ শেডেড।
তিতির খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নীচে নেমে কোলাপসিবল গেটের তালা খুলে বেড়িয়ে কিছুটা হেঁটে গিয়ে সদর দরজার তালাটা খুলে দিলো।
বললো,’আপনারা চাইলে বৃষ্টি থামা অবধি দাঁড়াতে পারেন ভেতরে’।
তিতিরের কথায় ভরসা পেয়ে লোকগুলো ভেতরের দিকে এসে দাঁড়ালো।ধন্যবাদ জানালো তিতিরকে।
তিতির সামান্য হেসে আবার কোলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলো।
ব্যলকনিতে এসে দাঁড়াতেই আবার বৃষ্টির ছাট আসছে গায়ে।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে গিয়ে ব্যথাটা যেন আরো কামড়ে বসেছে তিতিরের হাঁটুতে।
যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ নিয়ে তিতির ব্যলকনি থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
ঘরে ঢুকে নাইট বালব টা নেভালো তিতির।সুদর্শন কুঁকড়ে শুয়ে আছে ঠান্ডায়।
তিতির আলমারি খুলে একটা পাতলা বেডসীট এনে সুদর্শন কে ঢেকে দিলো।
তিতির দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে-পাঁচটা বাজে।জানলার সামনে যেতেই বৃষ্টির ছাট এসে আবার ভিজিয়ে দিলো তিতিরকে। হাত বাড়িয়ে জানালার কপাট বন্ধ করলো।
সুদর্শনের পাশে শুতেই ঘুমের মধ্যেই হাতের বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তিতিরকে।তিতিরও সুদর্শনের বুকের পাশে ঘন হয়ে এলো।সুদর্শনের ঘুম ভেঙে গেলো।
‘সেকি পাখি তুমি তো ভিজে গেছো পুরো।ছাদে গিয়েছিলে নাকি আবার!’,তিতির বললো,হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়াতে ব্যালকনিতে গিয়ে চেয়ার নিয়ে বসেছিলাম।
হঠাৎই বৃষ্টি…..’।
সুদর্শন বললো,’হুম।তা ভেজা নাইটি পড়ে থাকলে যে ঠান্ডা লেগে যাবে পাখি,কথাটা বলেই সুদর্শন উঠে গিয়ে তিতিরের জামাকাপড়ের র্যাক থেকে নাইটি নিয়ে আসলো।
তিতিরের আপত্তি না শুনে নিজেই ভেজা নাইটি ছাড়িয়ে শুকনো নাইটি পড়িয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলো,
‘ব্যথা কেমন পাখি?’সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,’চিন্তা কোরনা ঠিক আছি।তবে একটু ঘুমোতে চাইছি,চোখ জড়িয়ে আসছে’।
সুদর্শন বললো,’আচ্ছা তুমি ঘুমোও,আমি তোমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি’।
‘কিরে বাবিন তোরা কি আজ উঠবিনা বলে ঠিক করলি নাকি দুটিতে মিলে’,কথাটা বলতে বলতে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে জ্যেঠিমা।
সুদর্শন উঠে দরজা ধাক্কা দিতে বারন করবার আগেই জ্যেঠিমার দরজা পিটানোয় তিতিরের ঘুমটা গেলো ভেঙে।
সুদর্শন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো মাত্র সাড়ে- ছ’টা। তিতির বিছানা থেকে নামার উদ্যোগ নিতেই সুদর্শন তিতিরকে বললো,’উঠো না এখন।মাত্র সাড়ে-ছ’টা বাজে।আমি দেখছি গিয়ে’।
সুদর্শন দরজা খুলতেই জ্যেঠিমা একেবারে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন।
সুদর্শনকে বললেন,’কিরে বাবিন কাল সদর দরজাটা বন্ধ করিসনি রাতে?একেবারে হাঁ করে দরজা খোলা।ভাগ্যিস আমি ছিলাম এখানে তাই রক্ষে’।
একটু নিশ্বাস নিয়ে বললেন,’কতগুলো উটকো লোক এসে দাঁড়িয়েছিলো ভিতরে।আমি আচ্ছা মতো শুনিয়ে দিয়ে সবকটাকে বিদায় করে দিয়েছি’।
সুদর্শন বললো,’সেকি!আমি তো দরজা লাগিয়ে ছিলাম নিজে’,জ্যেঠিমা বললেন,’বলছে কি জানিস এই বাড়ীর লোকই নাকি দরজা খুলে ওদের ভিতরে দাঁড়াতে বলেছে’।
তিতির এতোক্ষনে মুখ খুললো,’ঠিকই বলেছেন ওনারা।আমিই দরজা খুলে ওদের ভিতরে এসে দাঁড়াতে বলেছিলাম।প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো।বাচ্চারাও ছিলো ওদের সঙ্গে’।
জ্যেঠিমা বললেন,’মানে তুমি নিজেই এই মহান কাজটা করেছো।তাহলে আর আমার কিছুই বলার থাকেনা’,কথাটা বলেই জ্যেঠিমাএবার সোজা তিতিরদের খাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
তিতিরকে বললেন,’তোমার ব্যথা কেমন আছে?,তারপর তিতিরের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বলতে লাগলেন,’পাপান কে দিয়ে সকালেই ওর বাবাকে ফোন করিয়েছি।বলেছি চালে ডালে একটু ফুটিয়ে নিতে।আমার যেতে দুদিন দেরী হবে’।
সুদর্শন এবার রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো,’সেকি কেন?জ্যেঠুর না শরীর খারাপ?হঠাৎ না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কেন?’
জ্যেঠিমা বললেন,’কাল তিতির পড়ে গিয়ে অমন ব্যথা পেলো,আমি তোদের একা ছেড়ে দিয়ে যাই কি করে!’
জ্যেঠিমার কথা শেষ না হতে হতেই সুদর্শন বললো,’একা কোথায় জ্যেঠিমা!আমি আছিতো।তাছাড়া পাপান ও তো থাকবে।তুমি বরং চলেই যাও।আমি চাইনা জ্যেঠুর কোনরকম অসুবিধা হোক’।
জ্যেঠিমা বললো,’সেকি কথা!আমার তো একটা দায়িত্ব আছে নাকি!’সুদর্শন অনেকভাবে চেষ্টা করলো।কিন্তু জ্যেঠিমা নিজের কথায় অনড়।
অতএব সুদর্শন হাল ছেড়ে টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেলো।
সুদর্শন বেড়িয়ে যেতেই জ্যেঠিমা তিতিরকে বললো,’আমার আবার হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে কাল রাত থেকে।তাই বলে তো আর শুয়ে থাকবার জো নাই আমার’।
তারপর বাঁ-হাত দিয়ে কোমর চেপে ধরে বললেন,’যাই দেখি চা-জলখাবার এর ব্যবস্থা করি গিয়ে।পুজোপার্বনের দিন,না খাইয়ে তো আর রাখতে পারিনা ছেলেদুটোকে’।
তিতির এবার নেমেই পড়লো বিছানা থেকে।হাঁটুটা কেমন টনটন করে কামড়ে ধরলো।
জ্যেঠিমা বললেন,’তুমি আবার কেন উঠছো?’তিতির বললো,’চা জলখাবারের ব্যবস্থা করতে’।
জ্যেঠিমা বললেন,’আরে আমিই তো যাচ্ছিলাম রান্নাঘরে।তা আমার জন্য একটু আদা ফেলে দিও চায়ের জলে।ঘুষঘুষে একটা কাশি হয় সকালে’।
তিতির ব্যথা পা টা টানতে টানতে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে।
তিতিরকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখেই পাপান কোথা থেকে তিতিরের সামনে এসে উদয় হলো।
তিতিরকে বললো,’সেকি তিতির ব্যথা শরীরে আবার কোথায় যাচ্ছ!’ তিতির কোনরকম উত্তর না দিয়ে সোজা নীচের দিকে নেমে গেলো।(চলবে)