নিরালায় ভালোবাসি-০৭,০৮
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৭ .
আজ সকালে ইচ্ছের যখন ঘুম ভাঙলো এতো অবাক
হলো যে বলার মতো না। ঘুম হালকা হতেই ও একটু নড়তেই ওর বাম হাতটা কিছুর একটা টানে নীরবের পেটে গিয়ে পড়ল। ইচ্ছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীরব চোখ বুঝেই ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। ঘুম ঘুম স্বরে বলে,
– ” ঘুমো ইচ্ছে। এখনও ছয়টাও বাজেনি। ছয়টা বাজলেই অ্যালার্ম বাজবে।”
হাঁ করে ঘুমন্ত নীরবের দিকে তাকিয়ে রইল ইচ্ছে। ঘুমো মানে কী? ওর তো কতো কাজ। কাজ না করলে যে…., গলা শুকিয়ে গেল ইচ্ছের। গলার ভিতরের দিকটা জ্বলে উঠলো। মাঝে মাঝেই হয় এমন। পড়ে ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যায়। বোধহয় কাল রাতে ঘুমের মধ্যে কাশি হয়েছে। ধীর শুনলে নির্ঘাত রাগ করবে। ইচ্ছে কোনো মতে উঠতে গিয়ে যা বুঝলো, তা হলো নীরবের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। নীরব ওর ডানহাতটা দিয়ে ইচ্ছের হাতটা চেপে ধরে রেখেছে। তার উপর কাত হয়ে বাম হাত দিয়ে ইচ্ছেকে ধরে রেখেছে। যার জন্যে ইচ্ছে নড়তে অবধি পারছে না। কিন্তু নীরবের এতো কাছে, যে ওর যেনো সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আর বারবার ওর চোখটা গিয়ে নীরবের ঘুমন্ত মুখে গিয়েই পড়ছে। কিছুতেই যেনো চোখ সরাতে পারছে না। কিন্তু নীরবের শ্বাস যতবার ইচ্ছের কপালে পড়ছে ইচ্ছে না চাইতেও নড়ে চড়ে উঠছে। যা নীরবকে অনেকটাই ডিস্টার্ব করছে। আর ওর মনে হচ্ছে ইচ্ছে উঠে আবারও হয়তো নীচে গিয়ে পুনরায় একই কাজ করবে তাই এবার ধমক দিয়েই ওকে বলে, ” খবরদার ইচ্ছে, কী করছিস কী। নড়াচড়া কম কর। হয় চুপ করে থাক আর নাহলে ঘুমো। ”
ঘুমের ঘোরে মানুষ যখন রেগে যায় তখন আমাদের একটু ভয় পাওয়াই উচিত। কারণ তাকে সেই মুহূর্তে কোনো ভাবে বিরক্ত করলে সে রেগে গিয়ে যা কিছু করতে পারে। ইচ্ছে যার সঙ্গে পূর্ব পরিচিত। তাই ও চুপ করে নীরবের গলার কাছে মাথাটা মিশিয়ে দেয়। নীরবও শীতের ঠান্ডার মধ্যে ইচ্ছের সংস্পর্শে ওকে নিজের সঙ্গে আরও মিশিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ইচ্ছের চোখে নেমে আসে ঘুম। শান্তির ঘুম। হঠাৎই যেনো মনে হলো আর কোনো বিপদ ওকে ছুঁতে পর্যন্ত পারবে না।
নীরবের দেওয়া অ্যালার্ম সকাল ছয় টায় বাজলেও ঘুম কারোরই ভাঙ্গে না। দুইজনেই পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিল। নীরবের যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রথমেই ওর একটা কথাই মাথায় আসে। শীতকাল এলেই কোনো না কোনো বন্ধু স্টাসাস দিতো, শীতকালে খুব জরুরি একটা বউয়ের দরকার। আর সেটা প্রায় সকলেই কপি পেস্ট মেরে পোস্ট করেই চলতো। ভগবান যদি সেই মুহূর্তে ওদের ইচ্ছে গুলো পূরণ করতো তাহলে হয়তো বিয়ের পাত্র পাত্রী খুঁজতে খুঁজতেই শীত ভয়েই পালিয়ে যেতো।
হেসে উঠলো নীরব। প্রাণখোলা হাসি। এখন ওর মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ভালোই করেছে। নীরবের হাসির শব্দে ইচ্ছের ঘুম ভেংগে যায়। নীরব তো একেই ইচ্ছেকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। তার উপর ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। যার দরুন ওকে একরাশ ভয় ঘিরে ধরে। নিজেকে বিছানার সঙ্গে যেনো মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।
নীরব ওকে ছেড়ে সরে যায়। ইচ্ছের মনের অবস্থা হয়তো কিছুটা হলেও নীরব অনুভব করেছিল। দুজনেই তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। কম করে আটটা বেজে গেছে। একদিকে নীরবের আজ অফিস অপর দিকে ইচ্ছের ভয় করছে। কোনো মেয়ে কি শ্বশুর বাড়িতে সকাল আটটা অবধি ঘুমায় নাকি? বাড়ির বউদের ঘুম ভাঙ্গবে সকলের আগে। এমনটাই তো ইচ্ছে জানে।
নীরবকে দেখে ইচ্ছে বেরিয়ে যেতে গেলে নীরব বারণ করে। দুইজনে একসঙ্গে ব্রাশ করতে থাকে। ইচ্ছে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসতে গেলে হটাৎই সামনের আয়নায় ইচ্ছের দিকে নজর যায় নীরবের। ইচ্ছে ওর দিকে ফিরলেই নীরব ওর গলায় হাত রাখে। পিছিয়ে যায় ইচ্ছে, ভয়ে। ওর ভয় করে, মনে করে নীরব হয়তো ওকে মারবে। কিন্তু হুট করেই নীরব ওর হাত ধরে ওকে সামনে আনে। আবারও গলায় হাত রাখে। গলার কাছে একটা কাটা দাগ হয়ে রয়েছে। কালকে খেয়ালে না পড়লেও আজ হুট করেই দেখতে পেলো। সেই দাগটার পাশে হাত বুলিয়ে বলল,
– ” এটা কিসের দাগ ইচ্ছে। কই আগে তো কোনদিন দেখিনি! কবে থেকে এটা আছে? মনে হচ্ছে কোনো ভাবে তুই আঘাত পেয়েছিস!”
চুপ করে থাকলো ইচ্ছে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নীরবের দিকে। কিন্তু উত্তর দেবার কোনো প্রস্তুতিও ওর মধ্যে দেখা গেলো না।
——————————-
নীরব ইচ্ছের জীবন টা বেশ ভালোই কেটেছে এই দুই সপ্তাহে। প্রতিদিন সকালে ইচ্ছে যদি আগে ঘুম থেকে ওঠে নীরব কীকরে যেনো হুট করেই জেগে গিয়ে ওকে ধমক দিয়ে পড়তে বসিয়ে দেয়। ইচ্ছে পড়ে আর ও ইচ্ছের পাশে বসে ঘুমোয়। নীরবের এর মাঝে এক বদ অভ্যেস ও হয়েছে। বিয়ের আগে নিজের কাজ নিজে করলেও বর্তমানে সামান্য ফোনটা চার্জ দিতে ও সে ভুলে যায়। ইচ্ছেও এখন ইউনিভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছে। আজকে নিয়ে পাঁচ দিন সবে। মাঝে এক দিন যায়নি। রুমা দেবী ও বৌমাকে নিয়ে বেশ আছে। ইচ্ছে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরলে নয় দুজনে টিভি দেখে না হয় টুকটাক কাজ করে। তার সাথে তাথৈ ও রয়েছে।
আজ বিকেলটা একটু অন্যরকম। শীতের বিকেলকে দেখে মনে হবে এখন যেনো ঝড় উঠতে পারে আবার নাও পারে। ইচ্ছে ছাদের চিলেকোঠার বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে এই আবহাওয়াটা অনুভব করছিল। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ও কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাও ঐখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। হুট হাট চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে নীরবের পাগলামো গুলো। তখনই না চাইতেও মুখে হাসি ফুটে উঠছে। এই যেমন আজ সকালেও ও দেখেছিল, ঘুম ভেংগে নীরবের নিষ্পাপ মুখটা। দেখলেই মনে হবে পৃথিবীর সব থেকে শান্ত ছেলেটা বোধহয় এই। ইচ্ছে আরও বেশি অবাক হয় যখন রোজ চোখ খুলে দেখে নীরবের হাত খুব শক্ত করে ওর শাড়ির আঁচলটা চেপে ধরে থাকে। মাঝে মাঝে আবার হাতের আঙ্গুলের সাথে বেঁধেও রাখে।
উপরের গ্রিলে একটা রডের মধ্যে ঝুলে থাকা খাঁচাটায় ইরা মাঝে মধ্যে “পিকু” বলে ডেকে চলেছে। আর ড্যাবড্যাব করে ইচ্ছের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই তো কয়েকদিন আগের কথা, ইচ্ছে এই চিলেকোঠার ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। সময়টা এমনই বিকেলের দিকে। হঠাৎ করেই কেউ ‘ পিকু’ বলে ডাকে। ইচ্ছে নিজের ভুল ভেবে নিজের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আবারও যখন একই কথা শোনে তখন পিছন ফিরে দেখে নীরব একটা কাকাতুয়ার খাঁচা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিস্ময়ে ইচ্ছে ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। নীরব গিয়ে পাখির খাঁচাটা মাথার কাছে রডে রেখে ইচ্ছের কাছে গিয়ে বলে,
– ” বিয়ের রাতে বর বউকে কিছু উপহার দেয়। আমার বিবাহিত সব বন্ধুরা নয় সোনার আংটি আর নাহয় সোনার হার দিয়েছে। কিন্তু আমার সব কিছু ইউনিক তাই তোকে দিলাম এই যে আমাদের ইরাকে। তোর আর আমার নামে এর নাম ‘ ইরা ‘। মনে থাকবে? ”
ইচ্ছে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে ইরার দিকে এগিয়ে যায়। পাখিটা মাঝে মাঝেই খাঁচার দেওয়ালে ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাচ্ছে। ইচ্ছের খুব পছন্দ হয়। ইরা যেখানটায় ঠোকর মারে ইচ্ছে গিয়ে সেই খানে হাত রাখে। ওমনি ইরা আবারও ওখানে ঠোকর মারতে ইচ্ছে ভয়ে হাত সরিয়ে নেয়। ইচ্ছের খুশি দেখে তৃপ্তির হাসি হাসে নীরব। এক পা এক পা করে ইচ্ছের কাছে এগিয়ে গিয়ে খাঁচায় রাখা ইচ্ছের হাতের আঙ্গুলটা ধরে ফাঁকা জায়গা দিয়ে আঙ্গুলটা খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে দেয় নীরব। ভয় পায় ইচ্ছে। ভয়ে ভয়ে নীরবের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু হাতে কামড়ের অনুভব না করে খাঁচার দিকে দেখে। ইরা মাঝে মাঝে ইরার আঙ্গুলে নিজের মাথা ঘষছে। হেসে দেয় ইচ্ছে। নীরব ইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
– ” ইচ্ছে আর ইরার কিন্তু আজ থেকে বন্ধুত্ত্ব হয়ে গেলো। তো দুজনেরই দুটো কাজ। ইরা সবসময় ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখবে। দেখবে আমার বউটা যেনো মুখ ফুলিয়ে না রাখে। আর ইরার বন্ধু ইচ্ছে ইরাকে কথা শেখাবে। নতুন নতুন কথা। মনে থাকবে? ”
ইচ্ছে ঘাড় বেঁকিয়ে নীরবের দিকে তাকালো। পাখিটার কী হলো কে জানে, ‘পিকু’ বলে ইচ্ছের আঙ্গুলে পুনরায় মাথা ঘষলো।
———
– ” এই ইচ্ছে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। নীরব এলেই বেরোতে হবে।”
রুমা দেবীর কথা শুনে ইচ্ছে বাস্তবে ফিরলো। রুমা দেবী নীচ থেকে ডাকছে ওকে। ইরার খাঁচাটা নিয়ে নীচে নেমে গেলো ইচ্ছে। ইরা ওদের ঘরের বারান্দাতেই থাকে। এতক্ষণ দুই বন্ধুতে আকাশ দেখতে এসেছিল।
( চলবে )
নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৮ .
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ইচ্ছে। পরিপাটি হয়ে তৈরি হয়েছে ও। নীরবের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে যাবে ও। নীরব রয়েছে বারান্দায়, বন্ধুদের কল অ্যাটেন্ড করতেই ও এখানে এসেছে। আজ ওর এক বন্ধু ইপশির বাড়িতে আজ যাবে ওরা। ইপসির বাবা মায়ের অ্যানিভার্সারি আজ। যাওয়ার যদি একফোঁটা ইচ্ছেও নীরবের মধ্যে বিদ্যমান না। কিন্তু ওই যে সব বন্ধুরা আজ ওখানে আসবে। তাই ওদেরও যেতে হবে। সেই সকাল থেকে এক এক বন্ধু ফোন করে জ্বালিয়ে চলেছে ওকে। অনেকদিন পর দেখা হবে। নাহলে সবাই যে যার সংসার জীবন, কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। সময় কী কারোর হাতে আছে।
– ” এই ইচ্ছে তোর হয়েছে চল বেরোতে হবে তো…”
থেমে গেল নীরব। ইচ্ছেকে দেখে ভাষা হারিয়ে গেছে। নীল জামদানিতে অপরূপ লাগছে ওকে। তার সঙ্গে সাজ আছে কি বোঝা নীরবের কম্ম না। তবে সিঁথির সিঁদুর ওকে যেনো ইচ্ছের দিকে বেশি আকর্ষণ করছে।
বাঙালি নারী শাড়িতেই সুন্দর। তবে শাড়ি পরিহিতা নারী যদি এক চিলতে সিঁদুরের অধিকারিণী হয়ে থাকে তবে বোধ করি সেই নারী হয় পরিপূর্ণ। হয়ে ওঠে কারোর স্ত্রী; হয় কারোর জীবনের অর্ধাঙ্গিনী।
নীরব যেনো এক ঝলকে থমকে গিয়েছিল। তবে ইচ্ছে ততক্ষনে নীরবের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছে। ও সম্পূর্ণ তৈরি। নীরব ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে বলে গেলো, ” কপালে একটা টিপ পড়ে নে। ” কথাটা বলে নীরব ওখান থেকে পালিয়ে গেল। অনুভূতির সংস্পর্শে এসে তা সামান্যতম অনুভব করে পালিয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই তারাহুরো করে ঘরে ঢুকলো। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও ইচ্ছের টিপ পড়া হয়ে গেছে। না আগে থেকেই ও টিপটা পড়েছিল! মনে করতে পারলো না নীরব। প্রতিদিনের মতো ও আজকেও ইচ্ছেকে টিপ পড়তে বলেছিল। আসলে ও দেখতে চায় এই মেয়েটা আবার আয়না ছাড়া টিপ পড়তে জানে কিনা? ইচ্ছেকে তো ও আগে কোনো দিন টিপ পড়তেই দেখেনি। এই বিয়ের পর নীরব বলতে কেবল ও টিপ পড়ে। কিন্তু নীরবের কোনো দিনই দেখা হয় না ইচ্ছে আয়না না দেখে টিপ পড়ে কিনা।
রুমা দেবীকে বলে নীরব আর ইচ্ছে বেরিয়ে পড়ে। ইপশির বাড়ি ওদের বাড়ি থেকে একটু খানি, এই পাশের পাড়ায়। এইটুকুতে ক্যাব নেওয়া চলে না। ওরা হেঁটেই রওনা দেয়। এমনিতেই আসতে রাত হবে। তার সাথে রাতের শহর দেখা ফ্রি। তাই নীরব মিস করতে চায় না।
ওরা যখন ইপশির বাড়ি পৌঁছায় তখন প্রায় সকলেই এসে গেছে। গেস্ট বলতে ইপশির কিছু বন্ধু বান্ধব আর কিছু রিলেটিভ। নীরব আর ইচ্ছে গিয়ে ইপশির সামনে দাঁড়াতেই ইপশি নীরবকে দেখে লাজুক হাসলো। মনে মনে নীরবকে ও এখনও পছন্দ করে। কিন্তু পাশে ইচ্ছেকে দেখে বেচারী ভয়ে ঢোক গিলল। কোনোমতে কয়েকটা কথা বলেই ইপশি অন্য গেস্টদের কাছে চলে গেল।
ইপশি চলে যেতেই নীরব হেসে দিলো। ফাঁকা একটা চেয়ার দেখে ওখানে বসে পড়লো। ইচ্ছে তখনও পাশে দাঁড়িয়ে। নীরব হাসতে হাসতে বলল,
– ” মনে আছে ইচ্ছে, তুই এই মেয়েকে প্রতিবার কিভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াতি। ”
ইচ্ছে মুচকি হাসলো। এই ইপশি নীরবকে খুব পছন্দ করত। আর নীরব আর সকলের মতো একেও এড়িয়ে চলতো। কিন্তু ইপশির বাড়াবাড়িটা অতিমাত্রায় হয় যখন
ও নীরবের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে ওর মাকে বিয়ের কথা বলে। নীরব প্রচণ্ড রেগে যায়। আর সেই মুহূর্তে ওকে বাঁচায় ইচ্ছে। দুই বন্ধুকে নিয়ে ইচ্ছে গিয়ে ইপশিকে ওর বাড়ির সামনের গলিতে আটকে রাখে। আরশোলা , টিকটিকির ভয় দেখিয়ে ওকে ছেড়ে ছিল সেইদিন। তারপর থেকে ওকে আর নীরবের বাড়ির আসে পাশে দেখা যায়নি। তবে বন্ধুত্ত্ব ছিল।
ইপশি মাঝে মাঝেই ঘাড় বেঁকিয়ে ইচ্ছের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আজ ইচ্ছেকে দেখে অন্য রকম লাগছে ওর। আগের সেই দূরন্ত মেয়েকে ও কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। নাকি ইচ্ছে এতো লোকের ভিড়ে চুপ করে থাকার নাটক করছে। সে যাই হোক এখন ও কাউকে ভয় পায় না। কারন ওর সালমান খানের ডুপ্লিকেট ওর কাছে আছে। কিন্তু রজত এখনও আসেনি। এলেই ও মজা দেখাবে ইচ্ছেকে। অন্তত একটু হলেও সেই দিনের জন্যে বকবে।
ইপশির বাবা, মা নীরবকে দেখে এগিয়ে গেল। ওনারা মেয়ের গুণকীর্তন শুনেছেন নিজের মেয়ের মুখেই। তার মধ্যে এটাও শুনেছেন নীরব বিয়ে করেছে।
– ” এই যে আমার না হওয়া জামাই কেমন আছো তুমি?”
হাসলো নীরব। ইপশির বাবা প্রচুর মজার মানুষ। লোককে উল্টোপাল্টা জোকস বলে তিনি প্রায়শই হাসিয়ে থাকে।
– ” এইতো খুব ভালো, না হওয়া শ্বশুর আঙ্কেল।”
ভদ্রলোক হাসলেন। নীরবের পাশে ইচ্ছেকে দেখে বললেন, ” এই অপ্সরী টা কে বাবা?”
– ” ও আপনার মেয়ের না হওয়া সতীন আঙ্কেল।”
হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। ইপশির মা ওনার স্বামীকে থামিয়ে বললো, ” আহ্, তোমরা দুইজনে থামো তো। দেখো তো তোমাদের আবোল তাবোল কথা বার্তায় মেয়েটা কেমন ভয় পেয়ে গেছে। ”
ভদ্রমহিলা ইচ্ছের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ইচ্ছের মুখটা দুই হাতে ধরে বললো, ” তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো মা?”
ঘাড় নাড়লো ইচ্ছে। ওর কোনো অসুবিধা হয় নি। ভদ্রলোক হাসলেন।
– ” কোনো অসুবিধা হলে বলো মা। আর আমার কথায় কিছু মনে করো না। আমি সবসময় ইয়ার্কির মধ্যেই থাকি। তবে নীরবের কথায় মনে করতে পারো। তুমি বলে এখনও দাঁড়িয়ে আছো। কিন্তু আমার ডলিং তোমার জায়গায় থাকলে আমার মাথার বাকি চুলগুলো সব উঠে যেত। দেখতেই তো পাচ্ছো মাথায় ইয়া বড়ো টাক। ”
ভদ্রমহিলা স্বামীকে মুখ বেকালেন। নীরব হাসতে হাসতে বলল, ” এই সব শেখাবেন না আঙ্কেল, তাহলে আমার মাথার কিউট কিউট চুল গুলো আপনার মত টাকে পরিণত হবে।”
ইচ্ছে হেসে উঠলো। নীরব হাঁ করে ওর দিকে তাকালো। কতদিন পর ইচ্ছের হাসি মুখটা ও দেখলো। শব্দহীন, প্রাণোচ্ছ্বল হাসি।
– ” আচ্ছা তোমরা কথা বলো। আমি আসছি। ”
ভদ্রমহিলা যেতে গেলে ভদ্রলোক ডেকে বলেন,
” আরে ডলিং আমিও যাবো। একা রেখে যেওনা আমায়। বোঝোনা কেনো কুছ কুছ হোতা হ্যায় ডলিং। ”
ভদ্রলোকের মুখে ডলিং শুনে থতমত খায় নীরব। ইচ্ছেকে বলে, ” ডলিং আবার কী? ”
পিছন থেকে সোহেল বলে, ” ডার্লিং। আঙ্কেল আন্টিকে ভালোবেসে ডার্লিং এর পরিবর্তে ডলিং বলে।”
– ” বাহ্, কী দারুণ নাম। আঙ্কেল বলেই পারেন।”
-” তা ঠিক। যা বলতে এলাম। তুই আর বৌদি উপরে চল। ছাদে রিন্তু, মৃণালরা আছে। তুই এসেছিস কি দেখতে এসেছিলাম আমি।”
-” আচ্ছা তুই চল। আমরা আসছি।
সোহেল যেতেই নীরব গিয়ে ইচ্ছের হাত ধরে বললো,
-” চলো ডলিং, তোমাকে একা রেখে যাই কীকরে। বোঝোনা কেনো কুছ কুছ হোতা হ্যায় ডলিং!”
( চলবে )