“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ৭

0
1033

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
হক মঞ্জিলে এসে রহিমা দেখতে পেল সায়েম ইশতিয়াক তার বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি এসে পড়েছে! কিন্তু বাড়িটা কোলাহলের পরিবর্তে নিত্যদিনের চেয়েও বেশি নিরব। বাচ্চার কান্নাকাটির শব্দ নেই। বাড়িতে প্রবেশ করে শুধুমাত্র সায়মাকে দেখতে পেয়েছে। আর সায়মা তাকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে শুরুতেই চুপ থাকতে বলে দিয়েছে। সায়মার ইশারায় রহিমা আন্দাজ করতে পেরেছে যে বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে! রহিমা হক সাহেবের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো আবু সালেহ হক গম্ভীরভাবে খাটে বসে আছেন। আর সোফায় ইশতিয়াক অপরাধী মনোভাবে ব্যথিত হয়ে বাবার সামনে বসে আছে। সে জানতো তার বাবা-মা বিদেশিনী মেনে নিবে না। তাই লুকিয়ে ছিলো এতোদিন। কিন্তু সত্য যে চাপা না থেকে সামনে বেরিয়েই আসে। তাছাড়া পরিবারের কাছে সে-ই বা লুকিয়ে থাকবে কতদিন!
রহিমা কিচেনের দিকে এগিয়ে দেখলো ফারহানা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। আর সায়মা ঘুরেফিরে এই কাজ সেই কাজ করে যাচ্ছে! রহিমা হাতের পার্স রেখে সায়মার রুমে এসে ফিসফিস করে বললো,
“আপা, সবাই এমন নিরব কেন?”
সায়মা স্বাভাবিক গলায় বললো,
“ভাইয়া এসেছে দেখিসনি?”
“হুম। কিন্তু এতে তো খুশি হওয়ার কথা!”
“ভাইয়া বিয়ে করে যে লুকিয়েছে তা জানিস না?”
“ওহ্! বুঝছি! ভাই আসছে তো বউ বাচ্চা সাথে নিয়া আসে নাই?”
“এসেছে।”
“দেখলাম না তো!”
“রুমে আছে। যা, দেখে আয়।”
রহিমা তড়িঘড়ি করে ইশতিয়াকের রুমের দিকে এলো। দরজা একটুখানি ফাঁক করা। রহিমা ঠেলে আরেকটু ফাঁক করে উঁকি দিতেই দেখলো, খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক বিদেশিনী। পড়নে তাতের শাড়ি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বাংলাদেশি তাঁত। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা! দেহের আকৃতি ও চেহারা লম্বাটে! রহিমার মতোই শুকনো স্বাস্থ্য। তবে বিদেশিনীর উচ্চতার তুলনায় আরেকটু মোটাতাজা হলে স্বাস্থ্য সুন্দর দেখাতো। রহিমাকে উঁকি দিতে দেখে বিদেশিনী মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“ভেতরে এসো।”
রহিমা দাত বের করে হেসে দরজা পুরোটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
“আপনে বাংলা কথা বলতে জানেন?”
“হ্যাঁ।”
এদিকে বিদেশিনীর জবাবের আগেই রহিমার মুখ হা হয়ে গেছে! কারণ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেয়েছে সামনে রাখা বড় দোলনায় দুই বাচ্চা! শান্তশিষ্ট ভাবে ঘুমাচ্ছে! রহিমা বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে গেছে ধবধবে ফর্সা বাচ্চাদের দেখে! এতো ফর্সা বাচ্চা হয়, এই প্রথম দেখা!
এদিকে বিদেশিনী বললো,
“তোমার নাম কি?”
“হু?”
“তোমার নাম কি?”
“রহিমা।”
“নাইস নেম।”
“মানে কি?”
“সুন্দর নাম।”
“ওহ্! থ্যাঙ্কিউ। আপনের নাম কি?”
“এলেন ইশতিয়াক।”
রহিমা পেছনে একবার দেখে আবার বিদেশিনীর উদ্দেশ্যে বললো,
” কই! আসে নাই তো ইশতিয়াক ভাই।”
“না, আসেনি। বাবার রুমে আছে।”
“তাইলে..তাহলে আপনে যে বললেন এলেন ইশতিয়াক!”
“আমার নাম বলেছি।”
এলেন এর কথা বুঝতে না পারায় রহিমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। গলাটাও যেন শুকনো লাগছে। সে আরেকবার বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে এলেনের উদ্দেশ্যে বললো,
“আচ্ছা, আমি যাই।”
এলেন মাথা সামান্য হেলিয়ে সম্মতি দিলো। রহিমা আবার দরজা চাপিয়ে রেখে দ্রুত পায়ে সায়মার রুমে চলে এলো। সায়মা মেঝেতে বসে খাটে হেলান দিয়ে ফ্যানের বাতাসে চুল শোকাচ্ছে। রহিমা এসেই হাপিয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বললো,
“আপা, এই গ্লাস দিয়াই খাই। আবার ধুইয়া দিয়া যামু।”
কথাটা বলে সায়মার জবাবের অপেক্ষা না করে এক নিশ্বাসে পুরো গ্লাসের পানি ঢকঢক করে গিলে ফেললো। অত:পর সায়মার কাছে এসে মেঝেতে বসে পড়লো। সায়মা আশ্চর্য হয়ে এতোক্ষণ যাবত তার কান্ড দেখছিলো। আর এখন জিজ্ঞেস করলো,
“এমন করছিস কেন? কি হয়েছে তোর?”
“আপা গো আপা! এই বিদেশি বেডি দেখি ধবধবে সাদা! এত্তো সাদা মানুষ খালি টিভিতেই দেখতাম আর ভাবতাম মেকাপের বদলে আটা মারছে! আজ দেখি সত্যি সত্যিই আছে! আর বাচ্চাগুলা দেখি দুধের মতো সাদা! যেন দুধের সর লাগায় রাখছে চামড়ায়! তা-ও একটা না, দুই দুইট্টা! যেন বিদেশি বিলাইর বাচ্চা! ওইযে, টিভির মধ্যে সাদা সাদা লোমে ভরা তুলতুলে দেখায় যে!”
রহিমার কথায় সায়মা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই রহিমা চুপ হয়ে গেলো! তার এই ভাষা বড্ড বিরক্তিকর! রহিমা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আবার বললো,
“আপা, তাগো শরীরে কি টিকটিকির মতো সাদা রক্ত?”
এবার সায়মা ধমকে উঠে বললো,
“দূর হো আমার চোখের সামনে থেকে। দূর হো!”
“আরে আপা, রাগেন ক্যা? না জানলে জানায় দিবেন না?”
“না জানাবো না। আর একটা কথাও উচ্চারণ করবি না তুই। বের হ রুম থেকে!”
“আপা..”
“চুপ। একদম চুপ। যেতে বলেছি।”
রহিমা মনে মনে ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে গেলো। গম্ভীরমুখে আজ সকল কাজকর্ম করে গেলো। তবে এলেনকে রুম থেকে বের হতে দেখেনি। বাড়ির বাকি সদস্যদেরও তেমন কথাবার্তা বলতে শুনেনি। বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে কান্না করলে সায়মা গিয়েছিলো পাশে। এলেনের খাবারও রুমে দিয়ে এসেছে সায়মা নিজে।
বিকেলে সায়মা রহিমাকে ডাকলো ছাদে যাওয়ার জন্য। রহিমা হাতে ঝাড়ু নিয়ে ছাদে এলো। প্রথমে ছাদ ঝাড়ু দিলো, পরে সায়মার সাথে গাছে পানি দিতে লাগলো। এমন উল্টাপাল্টা কথা বলার কারণে সায়মা কিছুক্ষণ তাকে জ্ঞান দিলো। অত:পর সায়মার নানান জিজ্ঞাসায় রহিমার মুড ঠিক হলো। কথায় কথায় সে-ও জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলো, এলেন খ্রিস্টধর্মের অনুসারী ছিলো। ইশতিয়াকের সাথে পরিচিত হওয়ার পর সে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছে। অত:পর তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আবু সালেহ হকের রাগ সেখানে, তাদের না জানিয়ে কেন বিয়ে করলো সে! আর বিয়ের পরও কিভাবে এতোদিন লুকিয়ে রাখতে পারলো! আজ বাচ্চা নিয়ে হাজির হওয়ার জন্য সে তার পরিবারকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো!
রহিমা আরও জানলো যে, সায়মার ভালো লেগেছে তার ভাবিকে। ফারহানা হকও নারাজ নয় তবে সালেহ হক স্বাভাবিক হলেই তিনিও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারবেন নতুবা এমন গম্ভীরই থাকবেন!
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে মায়ের ওষুধ কিনে নিয়ে গেলো রহিমা। অত:পর নিজেদের জন্য রান্নাবান্না তাকেই করতে হলো। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে মনে হলো আয়ানের দেওয়া গিফটের কথা! সে পার্স থেকে বক্সটা বের করে বিছানায় রাখলো। খুলতে গিয়েও একটা অজানা ভয় কাজ করলো মনে! এই ভয়ের কারণ, আয়ান খুবই দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে। তাই তার উপর বিশ্বাসের অভাব আছে! বলা তো যায় না, যদি আবার ইঁদুরের বাচ্চা কিংবা সাপের বাচ্চা ই ভরে দেয় বক্সে! রহিমা বক্সটা বিছানা থেকে মাটিতে নামিয়ে রাখলো। অত:পর একটা মোটা লাঠি এনে পাশে রাখলো। তা দেখে কারিমা বললো,
“এইটা কি বুবু? আর লাঠি দিয়া কি করবা?”
“অপারেশন সার্চলাইট।”
“কিহ!”
“কিছুনা। খালি তাকাইয়া দেখ।”
রহিমা আরও একটা লাঠি এবং চুলার পাশ থেকে বটি নিয়ে এলো। লাঠিটা কারিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“আমি এহন বাক্স খুলমু। তুই লাঠি নিয়া প্রস্তুত থাক। যদি দেখিস সাপ বের হইছে তো সাথে সাথে লাঠি চালান দিবি।”
রহিমার কথায় কারিমা চমকে উঠে লাঠি ফেলে দিয়ে বললো,
“ও মা! সাপ! আমি পারতাম না!”
রহিমা লাঠি তুলে আবার তার হাতে দিয়ে বললো,
“আরে ভুতির বাচ্চা, সাপ না। লাঠি ধর। আমি বলছি যদি বের হয় তাইলে উড়াধুরা মাইর শুরু করবি।”
“এইটা কইত্তে আনছো তুমি?”
“একজনে গিফট করছে।”
“এতো সুন্দর প্যাকেটের ভিতর সাপ থাকবো নি! গিফটে তো ভালা জিনিস থাকে!”
“কথা কম! শান্তিতে অপারেশন করতে দে।”
কারিমা ভেংচি কেটে মনে মনে বললো,
“হুহ্! হেয় সারাদিন বকবক করে আর আমি একটু কইলেই বলে কথা কম!”
কারিমার হাতে লাঠি ধরিয়ে রহিমা প্রায় তিন ফুট দূরে থেকে হাত বাড়িয়ে বটি দিয়ে আস্তে আস্তে বাক্সটা কাটতে লাগলো আর বিড়বিড় করে “আল্লাহু আকবার” জপতে লাগলো। উপরের আবরন কেটে ভেতরের আবরণও কেটে যাচ্ছে! কাটছে তো কাটছেই কিন্তু শক্ত কিছু উপলব্ধি করতে পারছে না! বটি কেমন যেন আঠালো হয়ে গেলো! যেন আর চলছে না। রহিমা আরও জোরে জোরে পোচ দিতে লাগলো। এক পর্যায়ে প্যাকেট দুই খন্ড! কিন্তু কিছুই বেরিয়ে এলো না! রহিমা প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখলো সাবান! এবার হাতেই পুরো প্যাকেট চিড়ে সাবানের দুই খন্ড একত্রিত করে দেখলো “১ নং পঁচা সাবান”!
এতো সুন্দর গিফট বক্সে ১ নং পঁচা সাবান দেখে কারিমা লাঠি ফেলে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে! আর রহিমা রেগে আগুন!
“ব্যাটা আয়না! তুই যেহেতু সাবানই গিফট দিবি তো একটা লাক্স সাবানই দিতি! এতো ফ্যাশন মারাইয়া পঁচা সাবান ভরতে গেলি ক্যা বাক্সে! গিফট বক্সের ইজ্জতটাই তো শেষ কইরা দিলি!”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here