একান্নবর্তী #প্রথম

0
1203

#একান্নবর্তী
#প্রথম
#শম্পাশম্পি চক্রবর্তী

” রামু এই রামু উঠোন টা এখনো ঝাঁটা দিলি না। বেলা আট টা বাজতে চললো। এখনি বড়,মেজো,সেজো সব বাবু ‘রা বের হবে অফিসে। বাসি উঠোন পেরিয়ে অফিসে বের হলে অমঙ্গল হবে যে।” চক্রবর্তী বাড়ির মেজো গিন্নি পরমা। বয়স চল্লিশের মতো হবে। রোজ এমনি চিৎকার চেঁচামেচি করে সারা পাড়াকে জানিয়ে উঠোন পরিষ্কারের জন্য রামু কে নানা ভাবে হেনস্থা করে। বছর কুড়ি ‘র রামু ও হয়েছে তেমনি বেয়াদপ। মেজো গিন্নির কথাগুলি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অপর কান দিয়ে বার করে বরং চক্রবর্তী বাড়ির পেছনের ভাঙা পাঁচিলটাতে হেলান দিয়ে একটি বিড়ি ধরিয়ে তাতে দীর্ঘ সুখটান দিয়ে আপনমনে বির বির করে ওঠে” এই এক মহিলা মাইরি কোনো সময় চিৎকার ছাড়া কথা বলে না। কর্ তুই যতো পারিস চিৎকার কর্ আমি যখন মনে করবো তখন ঝাঁটা দেবো। সব সময় কাজ,কাজ আর কাজ।”

বাড়ির পেছনের শিউলি গাছ থেকে সেই মুহূর্তে শিউলি ফুল তুলছিল বা বললে ভালো হবে মাটিতে পড়ে থাকা শিউলি ফুল কুড়িয়ে একটি সাজিতে ভরছিল রাই। আচমকা রামু কে ওইখানে দেখে বেশ উচ্চস্বরে বলে উঠল ” কাকিমনি দেখে যাও রামু দাদা এখানে দাঁড়িয়ে কেমন বিড়ি ফুঁকছে। তুমি যে ডেকে যাচ্ছো কানেই নিচ্ছে না। ”

” দেখো রাই দিদি দিনে একবার কী দু’বার বিড়ি খাই। তার জন্য তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারো না। তাছাড়া কোন্ কাজ টা আমি ফাঁকি দি ই গো? রোজ মেজো মা ‘র হয়েছে উঠোন ঝাঁটা দাও অতো বড় উঠোন ঝাঁটা দিতে গিয়ে আমার হাত কনিয়ে যায় সেটা তোমরা কেউ কী বোঝো?” হেসে লুটোপুটি খায় ষোলো বছরের তরুণী রাই। বলে ওঠে ” সত্যি রামু দাদা তুই ভয় পাস বটে মেজো কাকিমনি কে।”

থমকালো রাই। দীর্ঘ তিরিশ বছর আগের এক টুকরো স্মৃতি মনে পড়ে গেল হঠাত্ করেই এই রায় ডাঙার প্রায় তিনশো বছর আগের পুরনো চক্রবর্তী বাড়ির পিছনের দিকের শিউলি গাছটার সামনে এসে দাঁড়াতে। কতো শত স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই বাড়ির উঠোন,দালান,বৈঠকখানা, জুড়ে। । এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে একান্নবর্তী পরিবারের সেই সংসারটার মানচিত্র। যার কেন্দ্রে ছিল রাইয়ের মা অর্থাত্ চক্রবর্তী বাড়ির বড় বৌ মায়া।

” চলো রাই বাড়ির ভেতরটা যাই। তোমাদের সেই উঠোন ,সাবেকি আমলের ঘর গুলো একবার দেখি।” সৌরভের কন্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে পেল রাই। নিচু কন্ঠস্বরে বলে উঠল” চলো তবে ছোড় দা বা বড় দা ওরা বলছিল ঘর গুলোর অবস্থা এখন শোচনীয় । যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে আমাদের সাবধানে ঢুকতে হবে। ” ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সৌরভ বলে ওঠে ” চলোই না দেখি গিয়ে । যখন এতো বছর বাদে নিজের জন্মভিটেয় এলে সবটুকু না দেখে গেলে চলে? এরপর তো আর কিছুই দেখতে পাবে না বিশাল একটা ফ্ল্যাট বাড়ি ছাড়া ।

সৌরভের পেছন পেছন শুকনো পাতার ওপর অদ্ভুত মিষ্টি একটা খসখসে শব্দ তুলে যখন বাড়ির সামনের দিকের বড় কাঠের সদর দরজারটার সামনে এসে দাঁড়াল রাই সৌরভ বলে উঠল ” তুমি দাঁড়াও আমি ভেতরে আগে যাই। এ সব পুরনো বাড়ির আনাচে কানাচে সাপ বা ওই জাতীয় সরীসৃপ লুকিয়ে থাকে। ” রাই দাঁড়াল । সৌরভ বাড়ির সদর দরজার পাল্লা দুটো ঠেলে ভেতরে ঢোকার আগেই একটা সরু গাছের ডাল কুড়িয়ে নিল । যদি আচমকা আক্রমণ করে তখন সামান্যতম প্রোটেকশন নিতে পারবে এই ভেবে।

” এসো রাই কোথাও কিছু দেখছি না কেবল বুনো গাছপালাতে ভর্তি। উঠোনটা নামেই উঠোন মনে হচ্ছে যেন বাগান।”
চক্রবর্তী বাড়ির উঠোন।
এতো বছর বাদে আচমকা উঠোনটাতে পা দিতেই বিশাল চারচৌকো উঠোনটা যেন কেঁদে উঠল। মনে পড়ে গেল পিসতুতো,খুড়তুতো দিদি বা ভাইদের যেমন রাঙা দি,সেজ দি,মনা দি,তিতলি,পাপান আর সে রাই কতো যে কুমির ডাঙা খেলার কথা। আজ স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে হয় টুকরো টুকরো ঘটনার জলছবিতে। ওই যে যখন ছোট্ কাকু বিয়ে করে আনলো ছোটো কাকিমনি কে মাস টা ফাল্গুন হবে এই উঠোনেই রাখা হয়েছিল মস্তবড় একটা শিল। তার ওপর দাঁড়াতে বলা হয়েছিল কাকিমনি কে। একটা পাথরের তৈরী বড় আকারের পাত্রে দুধের মধ্যে আলতা মিশিয়ে কাকিমনি কে বলা হয়েছিল ওর ভেতরে বাঁ পা আগে রাখতে তারপর ডান পা রেখে আস্তে আস্তে সাদা লাল পেড়ে বিছানো শাড়িটার ওপর দিয়ে হেঁটে আসতে। কাকিমনি ভুল করে ডান পা পাথরের পাত্রে রাখলে রে রে করে ছুটে এসেছিল ছোটো পিসি ঠাকুমা। বলে উঠেছিল” এতো বড় ধারি মেয়ে এটাও জানো না দুধে আলতা তে প্রথমে বাঁ পা দিতে হয়। অবশ্য তোমাদের নিচু জাতের ঘরে এসব মনে হয় রীতি রেওয়াজ নেই।

বলা যায় ছোট্ কাকা ই প্রথম এই চক্রবর্তী বাড়ির পুরনো প্রথা ভেঙে সকলের সম্পূর্ণ অমতে গিয়ে নিজের পছন্দ মতো মেয়ে বিয়ে করেছিল জাতের বিচার না করে।
তাতে মা ,ঠাকুমা,মেজো,সেজো,কাকিমনি রা তো বটেই আশেপাশে সব আত্মীয় স্বজনেরাই ক্রুদ্ধ হয়েছিল। চক্রবর্তী বাড়িতে বিশ্বাস বাড়ির মেয়ে ঢুকবে? ছিঃ ছিঃ এ ও মানতে হবে?”

” কী হলো রাই এসো । চলো ওই ঘরগুলো একবার ঘুরে ঘুরে দেখি। রাই সৌরভের পদাঙ্ক অনুসরণ করলো। রান্না ঘর সমেত পরপর ন’টি ঘর যেগুলির কোনোটার ই দরজা নেই বা জানলা কিছুই নেই হয়তো চোরে খুলে নিয়ে পালিয়ে গেছে। সেই সবকটি ঘর এক এক করে ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে একটি ঘরের সামনে এসে আপনা থেকেই রাইয়ের গতিপথ শ্লথ হলো। ঘরটা যে এক সময় বড় আপন ছিলো । আপন ছিলো ছোটো বোন শিউলির জন্য।
একটা বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ছোট বোনটার উদ্দেশ্যে ।

শিউলি আর তার মধ্যে বয়সের তফাত্ কতো ? মাত্র কয়েক সেকেন্ড । তারা যমজ। সে যেমন শান্ত শিউলি তেমনি দুরন্ত। সারাদিন বাড়িটাকে হৈ হৈ করে মাতিয়ে রাখতো। সবার চোখের মণি শিউলি ছিল না বরং সকলের বিরক্তির কারণ। আসলে সে যেমন ফর্সা শিউলি তেমনি কালো। ঠাকুমা ডাকতো পেত্নি বলে। মেজো,সেজো কাকিমনি ‘রা সকলেই মা কে বল্ তো ” দিদি তোমার যখন পেটে দুটিতে আসে একজন মনে হয় পূর্ণিমা’তে অপরজন অমাবস্যাতে আসে। দু’জনে তারপর শলা পরামর্শ করে একসাথে পৃথিবীর আলো দেখে। নইলে এমন ফর্সার সাথে এমন কালো বের হয়?” মা যে মনে মনে এই কথাগুলি শুনে কষ্ট পেত না তা নয় খুব পেত আর তার রাগটা গিয়ে পড়তো শিউলির ওপর। হাসিখুশি মেয়েটাকে অকারণে দু চার ঘা পিঠে বসিয়ে দিয়ে মা বলতো ” কালো পেত্নি, আমার পেটেতেই তোকে আসতে হলো? মরতে পারিস না হারামজাদী?”
তাতে অবশ্য শিউলির কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এমন গালিগালাজ মায়ের কাছে রোজ সে খেত। আর রোজই মার খেয়ে এক ছুটে দৌড়ে যেতো ঠাকুমার ঘরে। ঠাকুমা যে আর সকল নাতি নাতনির থেকে ওই পেত্নিটাকেই যে বড্ড ভালো বাসতো।

#ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here