“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ৯
(নূর নাফিসা)
.
.
রহিমা ফ্ল্যাটে এসে একের পর এক কাজকর্ম করেই যাচ্ছে। কখনো বাবুদের কাপড়চোপড় ধুয়ে দিচ্ছে, কখনো সায়মার কাজিনদের রান্নার কাজ এগিয়ে দিচ্ছে আবার কখনো থালাবাটি মেজে গুছিয়ে রাখছে টেবিলে।
কিছুক্ষণ পর সায়মা ছাদ থেকে নেমে এসেছে। কিন্তু কাজিনদের কাছে না গিয়ে সে নিজের রুমে চলে গেছে৷ কাজিনদের মধ্যে একজন তাকে ডাকতে গেলে শুরু হলো হইচই! মেয়েটি চেচিয়ে খালামনি বলে ডাকতে লাগলো ফারহানা হককে। যার ফলে সায়মার মা সহ বাকিরা ভীড় জমিয়েছে সায়মার রুমে। রহিমা এসে দেখলো সায়মার এক গাল লাল হয়ে আছে। লম্বা লম্বা নখের আঁচড় পড়েছে বেশ কয়েকটা! যা ফুলে স্পষ্ট দৃশ্যমান! রক্তও বের হয়ে আসছে! সায়মার চোখও ভেজা ভেজা! কি হয়েছে তা ফারহানা জিজ্ঞেস করলে সায়মা উত্তর দিলো এলার্জি! কিন্তু কারোই বিশ্বাস হয়নি তার কথা! কারণ এলার্জি হলে শুধুমাত্র এক গালের এই অবস্থা হবে কেন! আর তো কোথাও এমন ক্ষত দেখা যাচ্ছে না! তাছাড়া সায়মা ই বা কাদবে কেন! একেকজন এক এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে কিন্তু সায়মা বারবার বলেই যাচ্ছে তার কিছু হয়নি! এলার্জির কারণে চুলকে গালের এই অবস্থা করেছে। তবুও কেউ বিশ্বাস না করে জানার চেষ্টা করছিলো বিধায় সায়মা রেগে সবাইকে ধাক্কিয়ে রুম থেকে বের করে দিয়েছে৷ তার মামাতো বোন পরে স্যাভলন আর তুলা নিয়ে এসে ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিয়েছে। রহিমা ছিলো আজ নিরব দর্শক! কেননা সে তো জানতোই সবটা! ইচ্ছে করছিলো সবার সামনে বলে দেক রুমেলের দুশ্চরিত্রতা! কিন্তু সায়মার নিষেধাজ্ঞা থাকায় বললো না সে।
দুপুরে খাওয়ার সময় সায়মা রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে একসাথে খাওয়ার জন্য। মনের ভেতর যা-ই থাকুক, সবাই মিলে যেই মজাটা করতে যাচ্ছিলো সেটা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। এদিকে বাকিরা রুমেলকে খুজছিলো। কল করে ফোন বন্ধ পাচ্ছে। সুযোগ বুঝে সায়মা জানিয়ে দিলো সে ছাদে যাওয়ার সময় রুমেল তার কাছে বলে তারাহুরো করে বেরিয়ে গেছে যে তার জরুরি কাজ আছে। তাই আর তাদের সাথে থাকতে পারছে না। বাকিরা সায়মার কথা বিশ্বাস করে নিলো। কেউ কেউ রহস্যময়ভাবেও ভাবতে লাগলো হঠাৎ সায়মার এই অবস্থা আর রুমেলের চলে যাওয়া। তবে সেটা মনের ভেতর চাপা পড়ে রইলো।
এমনিতে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার সংখ্যা ছয়টি। কিন্তু আজ একসাথে খেতে বসেছে বারো জন। রুমেল থাকলে তেরো জন হতো। বাকি আসনের ব্যবস্থা করেছে বিভিন্ন রুমে থাকা চেয়ার টুল দ্বারা। ড্রেসিং টেবিলের টুলটাও বাদ রাখেনি তারা! আরেকজন সোফা সেটের ছোট টি টেবিল উঠিয়ে এনেছে বসার জন্য। সবাইকে একসাথে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে বিধায় বাবুদের দোলনা উঠিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে এনে রাখা হয়েছে। কেননা বাবুরা জেগে আছে। আর পাশে কাউকে না পেলে কান্না করে। এখানে তাদের কথাবার্তা শুনলে আর কান্না করবে না।
সায়মা খাওয়ার সময় বেশ কিছুক্ষণ মেয়ের গালের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন আবু সালেহ হক। তার চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটা ছোট থেকেই খুব জিদ্দি। এমনিতে চুপচাপ থাকলেও রেগে গেলে কি করে সে নিজেই জানে না! অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে। নতুবা এভাবে নিজের গাল চিড়ে ফেলে কেউ!
খাওয়ার ফাঁকে হঠাৎই বাবার দিকে নজর পড়তেই সায়মা দৃষ্টি নামিয়ে বিষন্নতার সাথে প্লেটে তাকালো। অত:পর মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজের প্লেট হাতে নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে বাবার কাছে এসে দাড়ালো। এবং বাবার সামনে প্লেট ধরে বললো,
“কোনটা নিবে? নাও।”
আবু সালেহ হক নিশব্দে হেসে অর্ধেক খাওয়া চিকেন শর্মাটা তুলে নিজের প্লেটে নিলেন এবং নিজের প্লেটের আস্ত চিকেন শর্মাটা মেয়ের প্লেটে তুলে দিলেন। সায়মা হাসতে হাসতে নিজের চেয়ারে এসে বসলো। বাকিরা “ওয়াও” বলে অভ্যর্থনা জানালো। আর এলেন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো বাবা মেয়ের কান্ডে! পরক্ষণে ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে মুখে মুচকি হাসি দেখতে পেয়েছে। সায়মা নিজের চেয়ারে বসতেই ইশতিয়াক হাত বাড়িয়ে বাবার দেওয়া শর্মা থেকে অর্ধেক নিয়ে নিলো। সায়মা ব্রু কুচকে ছোটখাটো ধমক দিলো,
“ভাইয়া!”
আর ইশতিয়াক হাসিমুখে বললো,
“তুই একা খাবি কেন! আমার ভাগ আমি ছেড়ে দিবো নাকি!”
এদিকে আবার সায়মার মামাতো ভাই প্লেট থেকে চিকেন ফ্রাই তুলে নিয়ে নিজের খাওয়া ফ্রাইয়ের হাড্ডি সায়মাকে দিলো! সায়মা রেগে সেই হাড্ডি মামাতো ভাইয়ের শরীরে ঢিল মারলো! এবং বাটি থেকে আরেকটা ফ্রাই নিজের প্লেটে নিলো। এভাবেই কাড়াকাড়ি করে সকলের খাওয়া শেষ হলো। হক সাহেব থাকতে তারা তেমন কাড়াকাড়ি করেনি কিন্তু তিনি খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার পর কোলাহল সৃষ্টি হলো! ইশতিয়াকও পিছিয়ে নেই কোলাহলে! ফারহানা হক শুধু ধমকে যাচ্ছিলেন তাদের। আর রহিমা খেতে খেতে ফারহানা হককে থামিয়ে রাখছিলো। করুক না, প্রতিদিন তো আর করছে না এমন হইচই! আজকের দিনটা এলেন সহ সকলেরই ভালো লাগলো খুব।
বিকেলে কাজিনরা সবাই নিজ গন্তব্যে চলে গেলো। বাড়িটা আবারও নিরব হয়ে গেলো। এখন কোলাহল বলতে মাঝে মাঝে দুই বাচ্চার কান্নার শব্দ।
সন্ধ্যা হতেই রহিমা বাসায় চলে এলো। নিত্যদিনের মতো আজও কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘরে! মা দরজা খুলে দিয়েছে। আর চুলার পাশে বড়ি আর আলু দেখতে পেল। অসুস্থ শরীর নিয়ে মা কাটছিলো নিশ্চয়ই। বাড়িতে পা রাখতেই রহিমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো কারিমার উপর। কোনো কাজকর্মে হাত লাগাতে চায় না মেয়েটা! সারাদিন ফোনে খুচুরখুচুর, বই নিয়ে বসে থাকা আর রূপচর্চায় মগ্ন থাকা। এগুলো কি এই গরিবের ঘরে মানায়! নিজের অবস্থানটা কোথায়, সেটা কেন বুঝতে চায় না সে! সেখানেই রহিমার রাগ! আজ ঘরে এসে দেখলো এই সন্ধ্যা বেলা কারিমা দুই চোখে শসা রেখে মুখে ডাল বাটা লাগিয়ে বসে আছে! খাওয়ার জন্য ডাল হয়না আর সে রূপে লাগিয়ে ডাল নষ্ট করে যাচ্ছে! যা দেখে রহিমার মেজাজ চরম বিগড়ে গেলো! সে তার মাথায় বেশ কয়েকটা ঠুসি দিয়ে বকতে লাগলো!
ঠুসি ও বকা খেয়ে কারিমা দ্রুত মুখ ধুয়ে এলো। মুখে ডাল লাগিয়েছিলো বিকেলে। পরক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ায় আর মুখ ধোয়া হয়নি! আর ধরা পড়ে গেছে রহিমার কাছে! এখন ঠুসি খেয়ে তার ঘুম ভাঙলো।
আজ আর রান্না করতে হলো না রহিমাকে। কারণ সায়মা তার পরিবারের জন্য কিছু খাবার দিয়ে দিয়েছে। তাই অর্ধেক ছিলে রাখা আলু তুলে রেখে দিলো। পরিবারের সাথে সাহেবি খাবার খেতে ভালোই লাগলো রহিমার। তারা দুজন হাতে খেলেও কারিমা সাহেবি খাবারে সাহেবি যন্ত্র ব্যবহার করলো। ঝং ধরে যাওয়া ছুড়িটা খুজে কোনোমত ধুয়ে আনলো আর সাথে একটা কাটা চামচ নিলো। অত:পর দুই হাতের দুই যন্ত্র দ্বারা কেটেকুটে খেয়েছে। যদিও রহিমার বিরক্ত লাগছিলো তার আচরণ তবুও কিছু বললো না। বোনের যেহেতু শখ হয়েছে এভাবে খাওয়ার তো খাক।
রাতের বেলা দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই রহিমা চমকে উঠলো। আয়ানের দেওয়া ঘড়িটায় সময় দেখলো দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। এ সময় কে আসতে পারে! আবারও ঠকঠক শব্দ হলে রহিমা কর্কশ গলায় বললো,
“কেডা রে?”
ওপাশ থেকে জবাব এলো,
“দরজা খুল।”
কারিমা ও তার মা সজাগই আছে। রহিমা বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বললো,
“দরজা খুলতাম ক্যা? কেডা আপনে?”
“আমি।”
“আমি কেডা?”
“দরজা খুলে দেখ।”
রহিমা হাতে বটি নিয়ে বললো,
“না, খুলতাম না।”
“আরে রহিমা! আমি আয়ান।”
“কোন আয়ান?”
এবার দরজায় ধুপধাপ শব্দ হয়ে তেজি কন্ঠে উচ্চারিত হলো,
“দরজা না খুললে দেখবি কিভাবে যে কোন আয়ান!”
“ওই মিয়া ওই! ধমকান ক্যা? কারিমা, লাঠি হাতে নিয়া খাড়া।”
ঘরের কোনা থেকে কারিমা দ্রুত মোটা লাঠি হাতে নিলো। অত:পর ভেতর থেকে দরজা খুলতেই আয়ান মুখ বরাবর বটি দেখতে পেল এবং চমকে উঠে দুকদম পিছিয়ে এলো।
রহিমা আয়ানকে দেখে ব্রু কুচকে বললো,
“আপনে!”
“হ্যাঁ, আমি। বটি নামা!”
রহিমা বটি না নামিয়েই বললো,
“আপনে এতো রাতে আইছেন ক্যা?”
“প্রয়োজন আছে বিধায় এসেছি। বটি নামা আগে।”
রহিমা বটি নামিয়ে নিলো। ভেতর থেকে লাঠি হাতে কারিমা উঁকি দিয়ে বললো,
“বুবু, বেডার মাথায় বারি দিমু?”
আয়ান বিস্মিত আর রহিমা জবাবে বললো,
“না। হাতে নিয়া খাড়ায় থাক।”
রহিমা আয়ানকে ভেতরে পর্যন্ত আসতে বললো না। হোক সে যে কোনো পরিচিত বা আত্মীয়। রাতের বেলা ঘরে তিনটা মেয়ে মানুষ, সেখানে কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে দিবে না সে। আয়ান দরজার বাইরে দাড়িয়েই রহিমার উদ্দেশ্যে বললো,
“তোর মা কেমন আছে?”
“ভালোই আছে। আপনে আইছেন ক্যা, সেইটা কন।”
“বাইরে আয় একটু।”
“না, বাইরে যাইতাম না। এখানে দাড়াইয়াই বলেন।”
অনেক সহ্য করা হয়েছে রহিমার বর্তমান আচরণ। আর সহ্য করতে পারছে না আয়ান। তাই সে খপ করেই রহিমার হাত ধরে টেনে প্রথমে বটি ঘরে ছুড়ে ফেললো অত:পর রহিমাকে হেচকা টানে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। রহিমা হাত ছুটানোর চেষ্টায় বলতে লাগলো,
“আরে! করছেন টা কি! হাত ছাড়েন! হাত ছাড়েন! নইলে আমি চিৎকার করমু।”
“একটা শব্দ করে দেখ, দাত ফেলে দিবো।”
ওদিকে কারিমা লাঠি হাতে দরজার কাছে এসে বললো,
“বুবু, চিৎকার কইরা লোকজন ডাকমু? বেডার মাথায় বারি দিমু?”
আয়ান পেছনে ফিরে ধমকে বললো,
“এই মেয়ে! একটা শব্দ করলে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো। চুপচাপ ঘুমা গিয়ে!”