#আজল
#সূচনা পর্ব
#Farhana_Yesmin
১.
একেবারে পিওর এ্যারেন্জ ম্যারেজ যেটাকে বলে, সাঁচি আর ফুয়াদের বিয়েটা ঠিক সে রকমটাই হয়েছে । কনে দেখা থেকে শুরু করে এনগেজমেন্ট, গায়ে হলুদ, বিয়ে সবকিছুই সমস্ত আঁচার আনুষ্ঠানিকতা মেনে বেশ জাঁকজমক ভাবে হয়েছে। ছবি তোলা, নাচ-গান, খুনসুটি, জামাইয়ের গেট ধরা, জুতো চুরি এমনকি জামাইয়ের কাছ থেকে বাসর ঘরে ঢোকার টাকা আদায় করা, কোনো আনুষ্ঠানিকতাই বাদ যায়নি এই বিয়েতে। শশুর বাড়ির সব আচার অনুষ্ঠান পালন শেষে কনে সাঁচি এখন বসে আছে বাঁসর ঘরে। প্রিয়তা, ওর একমাত্র ননদ, তার ভাইয়ের রুমে ফুলে সাজানো বিছানায় বসিয়ে গেছে সাঁচিকে।
বসে থেকেই নিজের ঘোমটা টা একটু তুলে পুরো ঘরটাতে চোখ বুলালো সাঁচি। মাঝারি সাইজের রুমটার একপাশে আলমিরা আর বুক সেলফ রাখা, সেই সাথে পাশে একটা আরামদায়ক সোফা। বোঝাই যাচ্ছে বুক সেলফ থেকে বই নিয়ে পড়ার জন্যই সোফাটা রাখা হয়েছে। বেডের পাশে বেশ ইউনিক ডিজাইনের একটা ড্রেসিং টেবিল। সবগুলো ফার্নিচারের নকশা একই রকম ডিজাইনের। লোকটার রুচি আছে বলতে হবে।
সেই সাথে মনটাও ভীষন রকম ভালো। সেটা টের পেয়েছে অনুষ্ঠানের মধ্যেই। না না, তারও মাসখানেক আগে! যখন ফুয়াদের সাথে সাঁচির এনগেজমেন্ট হলো!
মনে মনে হাসলো সাঁচি। অনুষ্ঠানের মধ্যে মাঝে মাঝে আঁড়চোখে দেখেছে লোকটাকে। লম্বা চওড়া বডিতে মায়াকারা মুখ। বেশ ভালোই লেগেছে সাঁচির। অবশ্য লোকটাকে এই প্রথম দেখছে না সে! এর আগে বেশ কয়েকবারই দেখা হয়েছে। প্রথমবার দেখা হয়েছিলো ওদের বাড়িতে, ফুয়াদ ফ্যামিলির সাথে ওকে দেখতে গেছিলো। ওর সাথে টুকটাক কথা বলেছিলো লোকটা। সেদিন ই ভালো লেগে গেছিলো সাঁচির লোকটাকে। তারপর এনগেজমেন্ট, বিয়ের শপিং নানা জায়গায় দেখা হয়েছে দুজনার। যতদিন গেছে স্বল্প ভাষি এই লোকটার প্রতি সাঁচির ভালোলাগা বেড়েই গেছে। অনুষ্ঠানেও খেয়াল করেছে সাঁচি, সবার সাথেই লোকটা বেশ হাসিমুখে সৌজন্যতা দেখিয়েছে। আবার সাঁচির কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা তাও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেছে। সাঁচির বেশ ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। ওর বাড়ির সকলেও খুব খুশি লোকটার উপর। এতো অমায়িক ব্যবহার লোকটার! উফ এতো ‘লোকটা লোকটা’ করছি কেন? ওর নামতো ফুয়াদ-‘ মনে মনে বলে নিজের মাথায় একটা চাঁটি মারলো সাঁচি। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হলো। সাঁচি মাথার ঘোমটা টা ঠিক করে টেঁনে নিয়ে ভালো ভাবে বসলো। কিছুক্ষণ পর দড়জা লক করার শব্দে একটু কেঁপে উঠলো সাঁচি। নার্ভাস ফিল করছে। লোকটা কি আজকেই সব অধিকার নিয়ে নেবে? উল্টাপাল্টা কিছু করবে না তো আবার? যদিও তাকে দেখে মোটেও সেরকম মনে হয়নি। তবুও পুরুষ মানুষ বলে কথা। এদের কি বিশ্বাস! তখনই ফুয়াদ কথা বললো-
” শুনুন, আপনার জন্য খাবার এনেছি। ঐ যে টেবিলে রাখা আছে। আপনি ড্রেস চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন। তারপর আমরা কথা বলবো। ততক্ষণে আমিও ফ্রেস হয়ে নিচ্ছি। ”
সাঁচি অবাক হয়ে ঘোমটা তুলে ফুয়াদের দিকে তাকালো। ভাবলো, ফুয়াদ কি সহজ ভাবে ওর সাথে কথা বললো। লোকটা ওর দিকে কত খেয়াল রাখছে। অথচ ও লোকটাকে নিয়ে আজেবাজে কত কিই না ভাবছিলো? ছি!
ভাবনা থেকে বর্তমানে ফিরলো সাঁচি। আজই লোকটা ওর সাথে প্রথম এতো কথা বললো। এঙ্গেজমেন্টের পর টুকটাক কথা বলেছে, যা প্রয়োজনের বাইরে না। না কখনো ওর সাথে আলাদা করে কথা বলেছে আর না কখনো ফ্লাটিং করার চেস্টা করেছে। একেবারে পিওর জেন্টেলম্যান যাকে বলে ফুয়াদ হচ্ছে সেই ব্যাক্তি। সাঁচির খুব ভালো লাগলো। ফুয়াদের প্রতি ওর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। ফুয়াদ নিজের কাপড় নিয়ে অন্য রুমে যাচ্ছিলো। সাঁচি বললো-
“কোথায় যাচ্ছেন? একটু দাড়ান তো?”
খাট থেকে নেমে এলো সাঁচি। ফুয়াদ একটু অবাক নয়নে সাঁচির দিকে তাকিয়ে আছে। সাঁচি ফুয়াদের সামনে এসে একবার ওর চোখের দিকে তাকালো। নিচু হয়ে ফুয়াদের পা ছুয়ে সালাম করলো। সাঁচির কান্ডে ফুয়াদ ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন একটা মেয়ে বিনা দ্বিধায় পুরোনো একটা রেওয়াজ সম্পন্ন করলো এটা ওর একটু অবিশ্বাস্য লাগছে। সাঁচিকে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না ফুয়াদ। সাঁচিই বললো-
“মন থেকেই করলাম। আপনার আন্তরিক ব্যবহারে আপনার প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ তৈরী হয়েছে এটা তার বহিঃপ্রকাশ মাএ। থ্যাংকু।”
ফুয়াদ খুব সুন্দর করে হাসলো একটু। সে আলমিরা খুলে কিছু একটা হাতে নিয়ে ফেরত আসলো। সাঁচি তাকিয়ে দেখলো ফুয়াদের হাতে সুন্দর একটা বক্স। ফুয়াদ বক্সটা সাঁচির হাতে দিতে দিতে বললো-
“দ্যাখেন তো পচ্ছন্দ হয় কিনা। জিনিসটা পরে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি যেহেতু আমাকে সালাম করে আপনার কর্তব্য করে ফেললেন, এবার তাই আমিও আমার কর্তব্য করে ফেললাম। জিনিসটা যদি আপনার পছন্দ হয় তবে পরে ফেলবেন। আমার ভালো লাগবে। আর হা, আপনি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে অজু করে নেবেন প্লিজ। আমি আধাঘন্টা পরে আসছি। দুজনে একসাথে নামাজ পরবো, কেমন?”
সাঁচি মাথা নাড়লো।
২.
নামাজ পরে উঠে দুজনেই বিছানায় বসলো। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে, যেন বুঝতে পারছে না কিভাবে কথা শুরু করবে। হঠাৎই সাঁচির গলার দিকে নজর গেলো ফুয়াদের। ওর দেয়া পেনডেন্ট টা সাঁচির গলায় ঝুলছে।
” ধন্যবাদ।”
” কি জন্যে?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সাঁচি।
” ওটা পরেছেন বলে!”
গলার দিকে ইশারা করলো ফুয়াদ।
“ওহ! আসলে জিনিস টা খুব সুন্দর। না পরে থাকতে পারলাম না। থ্যাংকস এতো সুন্দর জিনিস উপহার দেওয়ার জন্য।”
” আচ্ছা, আপনার সাথে তো সেভাবে কখনো কথা বলা হয়নি। আজ না হয় আমরা একবারে শুরু থেকে শুরু করি। কি বলেন?”
“হুম, বলুন না! আচ্ছা আমি আগে বলি? আমি সাঁচি রাওনাফ। মাস্টার্স করছি আই ইউ আই থেকে। আমরা দু বোন আর এক ভাই।”
হেসে দিলো ফুয়াদ। সাঁচি একটু লজ্জা পেল।
” আমি ফুয়াদ, মুহতাসিম ফুয়াদ। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে এখন একটা আইটি ফার্মে আছি। আমার একটি আদরের বোন আছে যার বিয়ে হয়ে গেছে তারেক ভাইয়ের সাথে আর আছে বাবা মা। আর আমার খুব আদরের ভাগনি প্রিতি আপনি তো জানেনই। খুব ভালোবাসি ওকে।”
এবার সাঁচিও হেসে দিলো-
” বেশ তো পরিচয় পালা তো শেষ। এবার?”
সাঁচির কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে ফুয়াদ।
” এবার তো অনেক কিছু! আমি আপনার কাছে যাব, একটু আদর টাদর মানে কিসিমিসি করবো। তারপর—”
” এই থামেন থামেন।”
লজ্জায় মুখ ঢাকলো সাঁচি। ফুয়াদ মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছে।
” কি সব বলছেন আপনি!?”
” ওমা, আমি কি বললাম!? আপনিই না বললেন এবার কি?”
” ভারি দুষ্ট তো আপনি? আমি মোটেও ওরকম বলতে চাইনি!”
“হুম, বুঝলাম। একটু দুষ্টুমি করলাম আপনার সাথে। ”
“বাব্বাহ, আপনি আবার দুষ্টুমি ও করতে পারেন?”
“হুম, একটু একটু সবই পারি। আচ্ছা, আপনি খেয়েছেন? খাবারের থালা তো ওভাবেই ঢাকা দেয়া এখনো।”
“না খাইনি। ইচ্ছে হচ্ছে না।”
“কেন? আমি খেয়াল করে দেখেছি আপনি অনুষ্ঠানে ঠিক মতো খাননি। এখন না খেলে রাতে ঠিক মতো ঘুম হবে না। প্লিজ, অল্প হলেও খেয়ে নিন।”
ফুয়াদ উঠে যেয়ে খাবারের প্লেটটা এনে সাঁচির হাতে দিলো। সাঁচি কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো। আসলেও খিদে পেয়েছে ওর।
“আপনিও একটু খান আমার সাথে?”
কথাটা বলেই সাঁচি তাকালো ফুয়াদের দিকে। কিছু একটা ভেবে ফুয়াদ বললো-
“আচ্ছা, আপনি শুরু করুন, আমিও নিচ্ছি। ”
সাঁচি খাওয়া শুরু করলো। ফুয়াদ উঠে গিয়ে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে আসলো। বসলো না সাঁচির সামনে। জানে ও বসে থাকলে খেতে পারবে না মেয়েটা। তাই এটা ওটা করে সময় পার করলো। কিছুক্ষণ পরে সাঁচি ডাকলো-
“শুনছেন? আমার খাওয়া শেষ। এবার আপনি খান।”
ফুয়াদ তাকিয়ে দেখলো প্লেটের প্রায় অর্ধেকের বেশি খাবার পরে আছে। কিছু আর বললো না ফুয়াদ। থাক যতটুকু খেয়েছে খাক। নতুন জায়গা, কমফোর্ট হতে একটু সময় লাগবে হয়তো। ফুয়াদ নিজে একটু খেয়ে রেখে দিলো প্লেটটা।
তারপর সাঁচির দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে ফুয়াদ বললো-
” আমার সাথে বেড শেয়ারে আপত্তি নেই তো?”
মাথা নেড়ে না করলো সাঁচি।
” তবে আপনি ওদিকটায় শুয়ে পরুন। আমি এপাশে শুচ্ছি। দুতিন দিনের পরিশ্রমে শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। আপনিও নিশ্চয়ই ক্লান্ত? ”
“হুম।”
“বাঁতি বন্ধ করলে প্রবলেম হবে? ভয় পাবেন নাতো?”
ফুয়াদ জিজ্ঞেস করলো সাঁচিকে। সাঁচি মাথা নেড়ে না বলে।সাঁচির সম্মতি পেয়ে বাতিটা বন্ধ করে বেডের আরেক পাশে যেয়ে শুয়ে পরলো ফুয়াদ। সাঁচিও শুয়ে পরলো।কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ডাকলো ফুয়াদকে-
” শুনুন, আপনাকে একটা কথা বলি?”
“হুম, বলুন না!”
“আমাকে তুমি করে বলবেন, প্লিজ। আপনার মুখে ‘ আপনি’ শুনতে কেমন যেন লাগে?”
” আচ্ছা,ডাকবো। শুরুতে একটু প্রবলেম হবে বাট পরে ঠিক হয়ে যাবে। এখন ঘুমাই তাহলে, হ্যা! কালকে আবার রিসিপশান। অনেক কাজ। তুমি আবার কিছু মনে করলে নাতো সাঁচি!?”
ফুয়াদের তুমি সম্বোধনে খুব খুশি হলো সাঁচি।
“কি মনে করবো বলুন তো?”
” না মানে, আজ বাসর রাত। আর আমি এমনি শুয়ে পরলাম। তুমি হয়তো অন্য কিছু ভেবেছিলে।”
ফুয়াদের কথা শুনে লজ্জা পেলো সাঁচি-
“দেখুন বাকি সবকিছুর জন্য সারাজীবন পরে আছে। আপনিও আছেন আমিও আছি। এত চিন্তার কিছু নেই।”
” থ্যাংকস। আমি আসলেই অনেক টায়ার্ড। ঘুমাই তাহলে।”
” হুম”
বলে চোখ বন্ধ করলো সাঁচি। ক্লান্ত থাকার কারনে ও নিজেও ঘুমিয়ে গেলো তারাতারি।
৩.
সকালে যখন ঘুম ভাংলো সাঁচির, ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সকাল আটটা বেজে গেছে। নিজেই জিভ কামরালো। এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমালো? পাশে তাকিয়ে দেখলো ফুয়াদ নাই। তার মানে ফুয়াদ আগেই উঠেছে? তবে ওকে ডাক দিলো না কেন? লোকটার তো উচিত ছিলো ওকে ডেকে দেওয়া! সবাই এখন ওকে খারাপ ভাববে না!? নতুন বউ কি কখনো এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায়? মনে মনে ঠোঁট ফুলালো সাঁচি। তখনই দরজায় নক হলো-
” ভাবি? ঘুম ভেঙেছে? আসবো ভিতরে?”
তারাহুরো করে উঠে নিজের গায়ের কাপড়টা ঠিক করে নিয়ে দড়জা খুললো সাঁচি। ওকে দেখে প্রিয়তা মিস্টি একটা হাসি দিলো। সাঁচিও হাসলো-
” সরি, আমার না ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। বুঝতেই পারিনি যে এতো বেলা হয়ে গেছে?”
” আরে ভাবি এতো সরি বলছো কেন? কয়েকদিনের ধকল, এরকম তো হবেই। সো এতো সরি বলতে হবে না। বাট এখন একটু তারাতারি ফ্রেশ হয়ে আসবে কি? আমরা সবাই নাস্তার টেবিলে ওয়েট করছি।”
” আচ্ছা আপু, তুমি আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দাও, আমি চট করে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
“ঠিক আছে। আমি যাই, তুমি এসো তবে।”
গেট চাপিয়ে চলে গেল প্রিয়তা। তারাহুরো করে গোসল দিয়ে কোনো রকমে শাড়ী টা পরে ডাইনিং এ আসলো সাঁচি। ওর শাশুড়ি মা ওকে দেখে এগিয়ে এলেন। ও শাশুড়ি কে সালাম করলো। তারপর শশুরকেও সালাম করলো। ফুয়াদের চাচা, চাচি ছিলো, ওদেরও সালাম করলো সাঁচি। সবাই টেবিলেই বসে ছিল। ফুয়াদ, প্রিয়তার বর, প্রিয়তার পিচ্চি মেয়ে প্রিতি সবাই। সাঁচি খেয়াল করলো ফুয়াদ কোনার দিকের চেয়ারে মাথা নামিয়ে বসে আছে। সামনে নাস্তার প্লেট। প্রিয়তা ফুয়াদের পাশের চেয়ারটাতে সাঁচিকে বসতো বললো। ফুয়াদ মিস্টি হেসে চেয়ার টেনে দিতেই সাঁচি বসে পরলো। নাস্তা খাওয়া শেষ হতেই সাঁচির শশুর বললো-
” সাঁচি মা, আমাদের কে কি তুই একটু চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবি?”
” জী বাবা। এখনি বানাচ্ছি।”
খুশি হলো সাঁচি। ইশ এরা সবাই কত ভালো! ওর দেরি করে ঘুম থেকে ওঠাতে কেউ কিছু বললো না। উল্টো এখন চা খেতে চাচ্ছে ওর হাতের। যেন ও এ বাড়ির ই মেয়ে। খুশিতে কান্না পেয়ে গেল সাঁচির। সবাই এতো ভালো কেন?
ফুয়াদ চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। সাঁচি চা বানিয়ে সবাইকে দিয়ে শেষে ওর আর ফুয়াদের জন্য দু কাপ চা নিয়ে রুমে গেল। দেখলো ফুয়াদ রেডি হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ ফুয়াদের রেডি হওয়া দেখলো। লোকটা বেশ সুন্দর দেখতে। ফর্সা, টল, হ্যান্ডসাম, মাথাভর্তি চুল, মায়াবী চোখ। দেখে আপনাতেই নেশা লেগে যায়। আজ আবার পড়েছে গাড় সবুজ রঙের শার্ট সাথে অফ হোয়াইট গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। সাঁচির চোখ সরতে চাইছে না। তবুও অনেক কষ্টে চোখ সরিয়ে টেবিলে চা রেখে সাঁচি বললো-
” কোথাও যাচ্ছেন নাকি? আমিতো ভাবলাম আপনার সাথে চা খাব একসাথে? ”
” হ্যা একটু বেরুবো। সন্ধ্যায় রিশেপশন এর প্রোগ্রাম না! রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে। একা মানুষ তো, আমারই সবদিকে নজর রাখতে হয়। সমস্যা নেই তোমার সাথে বসেই চা টা খাবো। আর একটা কথা!”
“জ্বী, বলুন?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সাঁচির।
“সকালে তুমি এতো আরাম করে ঘুমাচ্ছিলে যে ডাকতে যেয়েও ডাককে পারিনি। তাই দয়া করে আমায় গাল টাল দিয়ো না। আমার কোনো দোষ নেই।”
মনে মনে ভীষন খুশি হলো সাঁচি। লোকটা এতো কেয়ারিং কেন?
“ধন্যবাদ আপনাকে।”
বলে ফুয়াদের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলো সাঁচি। ফুয়াদের চায়ে চুমুক দেয়া পর্যন্ত ওয়েট করে তাকিয়ে থাকলো ওর মুখের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য।
” চা টা ভালো হয়েছে। শুধু ভালো না অনেক ভালো হয়েছে।”
” সত্যি!!” আনন্দে উচ্ছসিত হলো সাঁচি।
” হুম। তুমিতো ভালোই চা বানাও।”
” ধন্যবাদ। আচ্ছা, একটা কথা বলি?”
” হুম, বলো না?”
” বিয়ে বাড়ি কিন্তু সেরকম ভীড় নেই। আত্বীয় স্বজন কেউ আসেনি?”
“ওহ, এই কথা। আরে সবাই তো ঢাকায় সেটেল্ড তাই কেউ আর থাকেনি। তাছাড়া এই কদিন সবাই ছিলো তো, ওরাও টায়ার্ড। আজ অনুষ্ঠানে আসবে সবাই। আমি যাচ্ছি তাহলে! তুমি বরং একটু রেস্ট নাও। দুপুরে খেয়ে আবার প্রিয়র সাথে পার্লারে যেতে হবে। ঠিক আছে?”
মাথা নাড়লো সাঁচি। ফুয়াদ যাওয়ার পর সাঁচি ওর শাশুড়ির কাছে গেল। সেখানে সবাই মিলে বসে গল্পের আসর বসিয়েছে। সাঁচিও সেই আসরে যোগ দিলো। সবার সাথে গল্প করে সময়টা ভালোই কেটে গেল সাঁচির। শেষে ওর শাশুড়ি মা ওকে নতুন একজোড়া গহনা দিলো আজ রিসিপশনের অনুষ্ঠানে পড়বার জন্য।
শাশুড়ির রুম থেকে বেড়িয়ে এলো সাঁচি। ননদ প্রিয়তাও বেড়িয়ে এলো ওর সাথে। ওকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখাচ্ছিলো আর ফাঁকে ফাঁকে নানান গল্প করছিলো –
” ভাবি, তুমি খুব লাকি, বুঝলে? আমার ভাইটা খুব ভালো। ও কখনো বাবা মায়ের আবাধ্য হয়নি, জানো? নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা কখনো আমাদের উপর চাপায়নি। এই যে, মা তোমায় পচ্ছন্দ করলো আর ও রাজি হয়ে গেল বিনা বাক্যে। আমারই মাঝে মাঝে অবাক লাগে। কোনো ছেলে কখনো এমন হয় এই যুগে!? বলো? তবে ওর মধ্যে কিছু একটা চেন্জ হয়েছে যা সবাই বুঝতে পারে না। ও আগে খুব হাসি তামাসা করতো,খুব প্রান চঞ্চল ছিলো জানো? কিন্তু এখন সেই তুলনায় গম্ভীর ই বলা চলে। এছাড়া ও অসাধারণ একজন মানুষ, একজন অসাধারণ ভাই, একজন অসাধারণ ছেলে, মামা হিসেবে তো ওর কোনো তুলনাই নেই। আশাকরি স্বামী হিসেবেও নিশ্চয়ই অসাধারণ ই হবে? তুমি প্লিজ ওকে মেনে চলো। ওর ব্যপারে কখনো ভুল বুঝো না ভাবি। ভাইকে বোঝার চেস্টা করো। ও একটু চাপা স্বভাবের তো? মনের কথা বলতে চায় না সহজে। তাই বলছি, ওর বন্ধু হওয়ার চেস্টা করো। তাহলে দেখবে সম্পর্কে সবকিছু ইজি হয়ে যাবে!”
প্রিয়তা সাঁচির হাত ধরলো।
“এভাবে বলছো কেন, আপু? উনি তো আমার স্বামীও হয়, তাই না! আমি অবশ্যই চেস্টা করবো, আপু। সবরকম চেষ্টা করবো ওনার সাথে ফ্রেন্ডলি হয়ে মেশার। তুমি চিন্তা করো না।”
মুখে প্রিয়তাকে বললেও সাঁচি মনে মনে খুব ভয় পেলো। ভাবলো সত্যিই এতো ভালো ভাগ্য ওর! ফুয়াদ, ওর পরিবার, সবাই এতো ভালো! সব ভালো এতো সহজে পেয়ে গেল ও! সত্যি সুখি হবে তো সাঁচি? ফুয়াদের আবার কোনো অতীত নেই তো? বাড়ির বড় আদরের মেয়ে সাঁচি। বড় কোমলতায় মানুষ। প্যাঁচঘোচ বোঝে না। সহজ পথে চলে অভ্যাস। সোজা কথা বলতে পচ্ছন্দ করে। তাই এর বাইরে কোনো কিছু তার পক্ষে বোঝা সম্ভব না! ফুয়াদ যদি তার মতো না হয়? তাহলে কিভাবে এডজাস্ট করবে সাঁচি? যদি কোনোরকম প্যাঁচানো ব্যাপার থাকে ফুয়াদের? যদি না মেনে নেওয়ার মতো অতীত থাকে তাহলে কি করবে ও? আর ভাবতে পারে না সাঁচি! আসলে আর ভাবতেই চায় না ও। সত্যি সত্যি যদি সেরকম কিছু থেকে থাকে তাহলে মরেই যাবে সাঁচি? সহ্য করতে পারবে না একেবারেই ?
চলবে—