“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ১০

0
1027

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
আয়ান রহিমাকে টেনে তাদের ঘর থেকে কিছুটা সামনের দিকে নিয়ে এলো। এখান থেকে তাদের ঘরের এক কোনা দেখা যায়। আয়ান রহিমার হাত ছেড়ে বললো,
“ইতুর কি হয়েছে?”
“ইতু! ইতু আবার কেডা!”
“সায়মা। সায়মার কি হয়েছে?”
“আমি জানতাম! জানতাম আপনে লুইচ্চামি করেন! সত্য বললেই তো দোষ আমার! আপার পেছনে যে আপনে লাগছেন সেইটাও আমি জানি। আর সুন্দরী মাইয়া দেখলেই যে পিছনে পইড়া লাইজ্ঞা থাকেন সেইটাও আমি.. ”
“কানের নিচে একটা দিবো ফাজিল কোথাকার! আমি তোকে কি জিজ্ঞেস করছি আর তুই আমাকে কি জবাব দিচ্ছিস!”
“ক্যা? আপনে জিগাইবেনই ক্যা আর আমার কানের নিচেই দিবেন ক্যা!”
“জিজ্ঞেস করেছি জানার জন্য। আর কানের নিচে দিবো অতিরিক্ত কথা বলার জন্য। চুপচাপ বল এবার।”
“না, কইতাম না কিছু। আপনারে বলমু ক্যা!”
আয়ানের প্রচুর রাগ হচ্ছে। তবুও সে রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখে শান্ত গলায় বললো,
“আমাকে যা ভাবার, ভাব। কিন্তু আমি সায়মার পেছনে নতুন লাগিনি। আর না অন্য মেয়ের পেছনে লেগেছি! তুই তাকে চেনার পূর্বেই আমি তাকে চিনি। আর সায়মা আমার বিয়ে করা বউ। বুঝতে পেরেছিস? তুই তাদের বাসায় কাজে যাওয়ার পূর্বেই আমরা বিবাহিত। আর আমার বলার কারণেই তুই তাদের বাসায় কাজে নিযুক্ত হতে পেরেছিস। তার প্রয়োজন ছিলো না কোনো এসিস্ট্যান্ট। কিন্তু তার মায়ের ভয় ছিলো তাকে নিয়ে। বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলো না। তখন তোর অতিরিক্ত কাজের প্রয়োজন পড়ায় আমিই তোর সন্ধান দিয়েছি। আর সায়মা কৌশলে তার মাকে বলেছে তোর কথা। এবং তার মা তোকেই সিলেক্ট করেছে।”
রহিমা স্তব্ধ আয়ানের কথায়! এ কি শুনছে সে! মুহুর্তেই যেন তার মনে ও চেহারায় বিষন্নতা নেমে এসেছে! তার মুখে আর কোনো শব্দ নেই! ড্যাবড্যাব করে শুধু তাকিয়ে আছে আয়ানের চেহারায়! আয়ান একটু থেমে আবার বলতে লাগলো।
“জীবনে প্রেম কয়টা করেছি তা তো আমি নিজেও জানি না! আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো আবার সেই গার্লফ্রেন্ডের বয়ফ্রেন্ডও থাকতো! আর আমি প্রেম করতাম তেমন মেয়ে দেখেই যে পূর্বে প্রেম করে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন থাকবে। যাতে আমার প্রেম প্রেম যন্ত্রণা না হয়। কিন্তু সায়মার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি কখনো! তার প্রতি আমার আক্রোশ ইউনিক ছিলো। যা পূর্বে কারো ক্ষেত্রে কখনোই এমনটা অনুভব করিনি। যখন প্রথম পরিচয় তখন সায়মা আমাকে পাত্তা দিতো না। এমনকি কোনো ছেলের সাথেই কথা বলতে দেখা যেতো না। চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। পরবর্তীতে আমার পাগলামোতে সে পটে গেছে। তবে অন্যদের মতো লেলিয়ে পড়েনি। আমাকে আলাদা একটা শাসনে রাখতো সবসময়। তার সেই শাসনকেই আমার কাছে প্রেম বলে মনে হয়েছে। এরপর আর কোনো মেয়ের দিকে আমার দৃষ্টি স্থির হয়নি। তবে সায়মা আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে আজেবাজে কথা বলেছে একবার। এরপর আবার আমি তার কাজিনকে নিয়ে সন্দেহজনক কথা বলেছিলাম। যার ফলে সম্পর্কে কেমন একটা বিচ্ছেদের আভাস পেয়েছিলাম। আর দুজনেই কষ্ট পেয়েছি। সেটাই আমার প্রথম কষ্ট ছিলো কোনো মেয়ের জন্য। তারপর আরেক পাগলামো। একদিন ভার্সিটিতে ক্লাস শেষে সায়মাকে কিছু না জানিয়ে হাত ধরে টেনে কাজী অফিস নিয়ে যাই। সায়মা তখন কোনো জিজ্ঞাসাও করেনি। আমি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছি আর সে চুপচাপ গিয়েছে আমার সাথে। কাজী অফিস এসে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। সায়মা চাইছিলো না এভাবে বিয়ে করতে। কিন্তু একে অপরের উপর সন্দেহে দিন কাটাতে আমিও পারছিলাম না। সায়মাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে নিয়েছি। নিঃসন্দেহে দিন কাটানোর জন্য তারও তখন সেটাই ঠিক মনে হয়েছিলো। ব্যাস হয়ে গেছে বিয়ে। আর আমাদের অবস্থান যার যার বাড়িতে। কিছুদিন আগে আবার ঝগড়া হয়েছিলো। এটা সাংসারিক ঝগড়া। দোষ আশি ভাগ আমার ছিলো৷ আমি চেষ্টা করতাম তার সাথে কথা বলতে কিন্তু সে আমার প্রতি রেগে ছিলো। আমাকে শাস্তি দিতে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে। তারপর যেদিন তোর হাতে চারটা ছিদ্র করলাম সেদিন দুপুরে সে নিজ থেকে আমাকে কল করে আবারও ঝগড়া করেছে। ভয়ংকর ঝগড়া! আর সেই ভয়ংকর ঝগড়ার ফলে আমাদের পূর্বের ঝগড়া মিটমাট হয়ে গেছে। রেগে হোক আর যেভাবেই হোক, কথা বলার সুযোগ হয়েছে আর তাতে মানিয়ে নিতে পেরেছি। এতোদিন তো একটু কথা বলার সুযোগই খুজছিলাম। আর তোর কারণেই সেটা হয়ে গেছে। তাই গিফট দিয়েছি তোকে।”
রহিমাকে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়ান বললো,
“বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? মিথ্যে বলছি না আমি। সুযোগ হলে সায়মার কাছেই জিজ্ঞেস করিস।”
রহিমা বিস্ময়ের সাথে বললো,
“সংসার না করেই সাংসারিক ঝগড়া!”
“হ্যাঁ। যতদিন না একত্রে থাকছি ততদিন ফোনে আমাদের সংসার। ইলেক্ট্রনিক সংসার। বুঝলি? আর এখন যা বললাম কেউ যেন তা না জানে। এখন তুই আমাকে বল সায়মার কি হয়েছে?”
“কই! কিছু হয়নাই তো! সন্ধ্যায় আসার সময়ও আপারে ভালোই দেইখা আসলাম!”
“কিছু না হলে আজ দুপুর থেকে আমার ফোন রিসিভ করছে না কেন!”
“আপার কাজিনরা আইছিলো, মজাটজা করছে তাই হয়তো ফোন রিসিভ করতে পারে নাই।”
“তার কাজিনরা কি এখনো আছে?”
“না, বিকালে চইলা গেছে।”
“তাহলে এখনো রিসিভ করছে না কেন! ইভেন, ফোন সুইচ অফ!”
“আমি ক্যামনে বলমু! ফোনে সমস্যা হইবো হয়তো।”
“একটু আগে আমি তার বাসার কাছ থেকেও ঘুরে এলাম। তার রুমের লাইট অফ। সে সুস্থ থাকলে এতো তারাতাড়ি তার রুমের লাইট অফ হয় না। দশটার পর ঘুমাতে যায়। তুই সত্যিই তাকে ভালো দেখে এসেছিস তো?”
“হু।”
আয়ান চিন্তিত হয়ে নিশ্বাস ফেললো এবং বললো,
“আচ্ছা যা। সরি তোকে এতো রাতে বিরক্ত করার জন্য। আর শোন, কাল সকালে আগে সায়মার সাথে দেখা করে আসবি। পরে আমাদের বাসায় যাবি। আমি টাকা দিয়ে যাই, রিকশা দিয়ে যাবি।”
আয়ান পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে টাকা নিচ্ছে। আর রহিমা খুব মনযোগ দিয়ে আয়ানকে দেখলো। আয়ানের মুখভঙ্গি আজ সত্যিই অদ্ভুত! সত্যিই তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে! অন্যদিনের মতো বাদড়ামোটা আজ চেহারায় অনুপস্থিত! সত্যিটা কি তাকে বলে দেওয়া উচিত! না, সায়মা নিষেধ করেছে কাউকে কিছু জানাতে। তাছাড়া জানলে যদি আয়ান আবার সায়মার উপর সন্দেহ আনে!
আয়ান কিছু টাকা রহিমার হাতে দিয়ে বললো,
“ঘরে যা। আর মনে করে আগে সায়মার কাছে যাবি।”
আয়ান নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো আর রহিমা ঘরের দিকে ধীর পায়ে হাটতে লাগলো। বিষয়টা লুকিয়ে নিজের কাছেই ভালো লাগছে না৷ বারবার মনে হচ্ছে আয়ানকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। ওই রুমেল তো সাংঘাতিক বাজে ছেলে! যদি আবার কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে! সে কি এখন আয়ানকে সত্যিটা জানিয়ে দিবে? হয়তো এতে আয়ান একটা ভালো সমাধান করতে পারবে।
রহিমা ঝটপট পেছনে ফিরে আর আয়ানকে দেখতে পেল না! সে দৌড়ে সেই পথে গেলো। বাড়ির পথের সরু রাস্তা থেকে বেরিয়ে মোটা রাস্তায় আয়ানকে পেয়ে গেলো। সে “ছোট ভাইজান” বলে হাক ছাড়লো। আয়ান পেছনে ফিরে তাকালো। পাশ দিয়ে যাওয়া লোকজনও তাকিয়ে আছে রহিমার দিকে। কাকে ডাকছে তারা বুঝতে পারেনি। আয়ানকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তারা বুঝে নিয়েছে আয়ানকেই ডাকছে। রহিমা আয়ানকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ধীর পায়ে আবার সরু রাস্তায় প্রবেশ করলো। আয়ান দ্রুত পায়েই এসেছে। রহিমার কাছে এসে বললো,
“ডাকলি কেন?”
“আসলে, আপার মন খারাপ। তাই হয়তো আপনের সাথে কথা বলতে চায় না।”
“মন খারাপ কেন?”
রহিমা সম্পূর্ণ ঘটনা জানিয়ে দিলো আয়ানকে৷ আয়ান রেগে থাপ্পড় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে বললো,
“এখন কানের নিচে লাগাই একটা! মিথ্যে বললি কেন তখন!”
রহিমা বিড়বিড় করে বললো,
“আপায় কাউরে জানাইতে নিষেধ করছিলো। তাই আপনারেও জানাই নাই।”
“তো এখন জানালি কেন?”
“ওই ব্যাটা বড় বদমাইশ! তাই ভাবলাম আপনে হয়তো এর একটা বিহিত করতে পারবেন।”
“এখন কি তার কাজিনরা কেউ বাসায় আছে?”
“না।”
“কাল সকালে তোকে সায়মার কাছে যেতে হবে না। দুপুরেই যাবি। আর যেকোনো ভাবে তাকে মানিয়ে বাসা থেকে বের হবি। গ্রিনল্যান্ড পার্কে যাবি৷ তাও বিকেলের আগে অর্থাৎ দুপুরেই। কিভাবে যাবি আমি জানি না। সেটা কেবল তুই জানবি। নতুবা তোর কপাল খারাপ! আর শোন, আমি বলেছি বা উক্ত ঘটনা আমি জেনেছি এসব কিছুই যেন সায়মা না জানতে পারে। আর আমার সাথে দেখা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তুই আমাকে নিয়ে তার সাথে কোনো কথাই বলবি না। জাস্ট দুপুরের মধ্যে তোদের দুজনকে আমি গ্রিনল্যান্ডে দেখতে চাই। যা, ঘরে যা।”
এমন হুমকিতে রহিমা হতবাক! করতে এলো উপকার আর দিয়ে গেলো হুমকি! তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ান রাগান্বিত গলায় বললো,
“যা!”
রহিমা বারবার পিছু ফিরতে ফিরতে নিজের ঘরে চলে এলো। এতোক্ষণ পর্যন্ত আয়ান সেখানেই দাড়িয়ে ছিলো। রহিমা ঘরের ভেতর প্রবেশ করলে আয়ান উক্ত স্থান ত্যাগ করলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here