আজল #পর্ব-আঠারো

0
1134

#আজল
#পর্ব-আঠারো

৩৪.

গাড়িতে বসেই সাঁচিকে ফোন দিলো ফুয়াদ। ফোন দিয়েই যাচ্ছে দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু সাঁচি ফোন ধরছে না। কিছুক্ষণ পরে আবার যখন ডায়াল করলো তখন সাঁচির ফোন বন্ধ পেলো। কি ব্যাপার! ফোন বন্ধ হলো কেন? আর ও ফোন ধরলো না কেন? এমন তো কখনো হয়না? চিন্তিত হলো ফুয়াদ। মাকে ফোন দিলো-
“হ্যালো মা! সাঁচিকে একটু দাও তো। ওকে ফোনে পাচ্ছি না।”
“বউমা তো নাই রে বাবু। কি যেন কাজ আছে বলে বের হইছে সেই সকালে। এখনো তো আসলো না?”
“ওওও! আচ্ছা আমি দেখছি কই আছে ও।”
চিন্তিত হয়ে ফোন কাটলো ফুয়াদ। কোথায় গেলো সাঁচি। রাগ করে একেবারে চলে গেলো নাতো?? ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো ফুয়াদের। ইশ! মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর না! সাঁচি! আর তোমায় কষ্ট পেতে দেবো না। প্লিজ শেষ বারের মতো ক্ষমা করো আমায়। শেষ একটা সুযোগ দিয়ো আমাকে আমার ভুলটা শুধরে নেওয়ার। শেষ একবার….আর বলবোনা… কখনো না… বিরবির করতে করতে আবার ডায়াল করে সাঁচির নাম্বারে। নাহ,বন্ধই আছে। টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ফুয়াদের। মেয়েটার কিছু হলো নাতে? শশুরবাড়িতে একবার ফোন দেবে কি? যদি ওখানে যায়? আর যদি না যায় তাহলে? তাহলে ওরা জিজ্ঞেস করলে কি জবাব দেবে? দেবে কি দেবে না এই দ্বন্দ্বে বেশ অনেকটা সময় কেঁটে গেলো। তারপর সাহস করে ফোনটা দিয়েই দিলো।
“হ্যা, মা। সাঁচি কি ওখানে আছে? অনেকক্ষণ থেকে ট্রাই করছি ওর ফোনে কিন্তু বন্ধ পাচ্ছি। ”
” হ্যা, বাবা। এই ঘন্টাখানেক আগেই এসেছে। ওর গায়ে প্রচন্ড জ্বর। আমি ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছি।”
“ওহ! আচ্ছা মা আমি তাহলে আসছি ওখানে। সাথে ডাক্তার নিয়ে আসছি।”
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো ফুয়াদের।
জামাইয়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে আস্বস্ত হলেন সাঁচির মা। মেয়েকে ঐ রকম জ্বর গায়ে বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে মনে মনে ভয় পেয়েছিলো সাঁচির মা। তিনি ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই জামাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে সাঁচির। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব ঠিকই আছে। তিনি নিশ্চিত মনে রান্নাঘরে গেলেন রান্না করতে। মেয়ে জামাই আসবে, ভালোমন্দ কিছু সামনে না দিলে হবে?

ফুয়াদ ওর এক ডাক্তার বন্ধু কে সাথে নিয়ে আসলো। রুমের দরজা খুলে যখন ফুয়াদ ভেতরে ঢুকলো সাঁচি তখন জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ডাক্তার বন্ধু টি কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে মাথায় পানি দিতে আর কপালে জ্বলপট্টি দিতে বললো। জ্বর একটু কমলে যেন গোসল করে আর কোনো ভাবেই জ্বর যেন মাথায় উঠে না যায়। সাঁচির এমন বেহাল দশা দেখে ফুয়াদ যেন পাগল হয়ে গেলো। ও নিজেই বালতিতে পানি নিয়ে মাথায় ঢালতে লাগলো। চুলগুলো যত্বের সাথে মুছিয়ে দিলো তারপর কপালে পট্টি দিতে থাকলে। তাপ একটু কমতেই সাঁচির জ্ঞান ফিরলো। বিরবির করে কি যেন বলেই যাচ্ছে সাঁচি। ফুয়াদ ওর ঠোঁটের কাছে কান লাগালো কথাগুলো শোনার জন্য।
” ওকে আমি কখনো মাফ করবো না। এতো কষ্ট দিয়েছে আমাকে! এই সাঁচিকে! কিভাবে পারলো? আমি কি ওর সাথে কোনো অন্যায় করেছি কখনো? নিজের ভালোবাসাটাও তো প্রকাশ করতে পারিনি কখনো? নিজে ভালো নাই বা বাসলো আমায় ভালোবাসতে দিতো? আমার কি দোষ? ওর কপালে যদি ওর ভালোবাসা না থাকে তাতে আমার দোষটা কোথায়? বিনা কারনে আমায় অনেক কষ্ট দিয়েছো তুমি? তোমায় মাফ করবো না কখনো? দেখো তুমি?”
সাঁচির কথা শুনে কেঁদে দিলো ফুয়াদ। আসলেই তো, মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। সত্যি সত্যি কি মেয়েটা কখনো মাফ করবে না ওকে?ওর জীবনে ফিরবে না? না…না… এরকম কখনোই হবে না…আমি হতে দেবো না! তোমায় আমি মানিয়েই ছাড়বো সাঁচি! তুমি যেমন কষ্ট পেয়েছো দরকার হলে আমায় ও ওরকম সাজা দিয়ো তবুও আমায় ছেড়ে যেতে দেবো না আর।
বলতে বলতে পরম মমতায় সাঁচির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো ফুয়াদ। অনেকক্ষণ ধরে ফুয়াদকে খেতে ডাকছিলো সাঁচির মা।
“তুমি খেয়ে নাও বাবা, সেই কখন এসেছো? আমি ওর কাছে বসছি।”
“মা, ও তো খায় নাই কিছু। ওকে একটু খাইয়ে দেই আগে। তারপর আমি খাবো।”
মা কিছু বলতে যেয়েও বলেন না। খুশিই হলেন বরং। জামাই মনেহয় মেয়েকে একটু বেশিই ভালোবাসে।
“আচ্ছা, আমি তবে প্লেটে করে খাবার এনে দিচ্ছি। ”
মাথা নাড়লো ফুয়াদ। কিছুক্ষণ পরেই একটা প্লেটে কিছু ভাত আর তরকারি নিয়ে ফিরলো সাঁচির মা। ফুয়াদ ডাকলো সাঁচিকে-
“এই সাঁচি, ওঠো বাবু, একটু খেয়ে নাও!”
“আমি খাবো না আম্মু! বিরক্ত কোরো না তো যাও?”
“আমি আম্মু না, ফুয়াদ। তোমার ফুয়াদ। ”
“আপনি!আপনি কখন এসেছেন? কেন এসেছেন এখানে? আরো কিছু বলতে চান? আরো কোনো অতীত আছে আপনার?”
উঠে বসার চেষ্টা করে সাঁচি। ওকে ধরে বসিয়ে দেয় বালিশে ঠেস দিয়ে। নিজে বসে ওর সামনে।
“এমন বলে না,সোনা। আর কিছুই বলবো না তোমায়। এখন তুমি বলবে আর আমি শুনবো।” ভাতের গ্রাস বাড়িয়ে দেয় সাঁচির দিকে। সাঁচি মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“খাবো না। দয়া দেখাতে এসেছেন? প্লিজ চলে যান, আপনার দয়া আমার চাই না! প্লিজ যান আপনি!”
“ছি, বাবু! আমার কি সে ক্ষমতা আছে? আমি তো বরং বরাবরই তোমার দয়া নিয়েই এসেছি। আজও প্লিজ আমায় দয়া করো একটু, খেয়ে নাও না। ওষুধ খেতে হবে তো?”
” খাবো না বললাম তো?”
“আচ্ছা, আমার যখন জ্বর হয়েছিল, তুমি কি দয়া করে আমার সেবা করেছিলে?”
” উহু, আমি তে ভালোবেসে করেছিলাম?”
“আমিও ভালোবেসেই করছি। প্লিজ খাও, তুমি না খেলে কিন্তু আমিও খাবো না!”
“তবুও খাবো না। আপনি না খেলে আমার কি?”
“আচ্ছা ঠিক আছে যাও, আমি খাবো না কিন্তু তোমায় খেতে হবে।”
বলেই জোর করে সাঁচির মুখে একগ্রাস ভাত তুলে দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে রাখলো। যাতে ভাত ফেলে দিতে না পারে। সাঁচি ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ভাত গিলো নিলো। আবার দিলো, আবার গিললো। দুই লোকমা খেয়েই পানি খেলো সাঁচি, তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই বমি করে ফুয়াদের গা ভাসিয়ে দিলো। ফুয়াদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সাঁচি। এখন সাচির নিজেরই লজ্জা লাগছে। এরকম টা তো করতে চায়নি ও! ফুয়াদ হাসলো একটু
“লজ্জা পাওয়ার কোনো দরকার নেই। জানি, তুৃমি ইচ্ছা করে করোনি। আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি, তোমার ড্রেস চেন্জ করে দেবে। আমি ততক্ষণে গোসল দিয়ে আসি।”
সাঁচি সেভাবেই বসে থাকলো। মাকে ডেকে দিয়ে ফুয়াদ ফ্রেশ হতে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে আবার সাঁচিকে অল্প একটু খাইয়ে দিয়ে সেই প্লেটের বাকিটুকু নিজে খেয়ে নিলো ফুয়াদ। তারপর সাঁচিকে ওষুধ খাইয়ে দিলো। খুব যত্নের সাথে সাঁচিকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা টেনে দিলো, তারপর মাথায় মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-
“ঘুমাও। আমি পাশেই আছি।”
সাঁচি ঘোলা চোখে চেয়ে সব দেখছে।
“যতই করেন, তবুও আপনাকে মাফ করবো না, কিছুতেই না? অনেক কষ্ট দিয়েছেন আমায়।”
“আচ্ছা, করোনা মাফ। এখন ঘুমাও তো! তোমার জ্বর ভালো হোক তখন আমরা এ বিষয়ে কথা বলবো, ওকে?”
বলেই কপালে একটা চুমু দিলো।
সাঁচি চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর ফুয়াদ তা দেখে মুচকি হাসে।

দুইদিন পর সকালের দিকেই সাঁচিকে দেখতে ফুয়াদের বাবা, মা, প্রিয়তা, প্রিতি, তানভীর সবাই এসেছে। সকালের দিকে সাঁচির জ্বর কমেছে একটু। যদিও গত দু’দিন সারারাত জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকেছে প্রচুর, ইচ্ছা মতো কেঁদেছে, ফুয়াদ ওকে সান্তনা দিতে আসলে ফুয়াদকে মেরেওছে। শেষে না পারতে ফুয়াদ ওকে জোর করে জাপটে ধরে শুয়ে ছিলো। শারীরিক দূর্বলতায় ফুয়াদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে শেষে হার মেনে ওভাবেই ঘুমিয়েছে। সকালে সবাইকে একসাথে দেখে খুব খুশি হলো সাঁচি। ওর শাশুড়ীর মা কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। কেঁদে দিলো সাঁচি। এরা সবাই তাকে ভালোবাসে, শুধু যার ভালোবাসার জন্য সে অপেক্ষা করেছে সেই আসেনি। এখন যখন এসেছে, তখন মনে হচ্ছে বাধ্য হয়ে এসেছে। ফুয়াদের কি কখনো ইচ্ছা ছিলো ওকে ভালোবাসার? রেহনুমা যদি সুখে না থাকতো তাহলে কি ফুয়াদ এতো সহজে ফিরতো ওর কাছে? নাকি নিজের গিল্টি ফিলিংস দূর করার জন্য রেহনুমা কে আবার জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো? হিসেব যেন ফুরায় না সাঁচির। ফুয়াদ কি কখনো বুঝবে এই সাঁচিকে? অবহেলার স্বাদ কেমন হয় সেটা কি বুঝে ফুয়াদ? কতবার সুযোগ দিতে চেয়েছে ফুয়াদকে? এখন তো বিশ্বাস টাই নড়বড়ে হয়ে গেছে! মনেহয়, সবকিছু মিথ্যা মায়াজাল। সত্য কোথায় আছে? সাঁচি শাশুড়ীর কোলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে যায়।
“কি রে মা! কি হয়েছে? এতো কাঁদছিস কেন? শরীর তো ভালো হয়ে যাবে? এইজন্য এতো কাঁদতে হয়?”
সাঁচি চুপ করে থাকে।
“আমার ছেলেটা বুঝি তোকে বেশিই জ্বালায়? শুধু দূরে দূরে থাকে? তাই কাঁদছিস?”
বিছানায় উঠে বসে মুখ মোছে সাঁচি-
” না মা এমনিই। আপনারা এসেছেন, খুশি লাগছে খুব।”
তখনি প্রিয়তা মেয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকলো-
“ওহ ভাবি, কি গো তুমি! ভাইয়া এলো, কোথায় ভাইয়ার সাথে সময় কাটাবে তা না জ্বর বাধিয়ে বসলে। কি করে হলো বলোতো?”
প্রিতিকে কোলে বসালো সাঁচি। প্রিয়তার কথা শুনে হাসলো একটু কিছু বললো না।
” ভাবি, সামনে আমার ম্যারেজ ডে, জানো তো?”
মাথা নারে সাঁচি। ভাবছি এবার একটু অন্যভাবে সেলিবেট করবো। তোমায় কিন্তু সাথে থাকতে হবে?”
“অবশ্যই থাকবো। কি করতে চাও বলো?”
প্রিয়তা কিছু বলতে মুখ খুলতেই ফুয়াদ রুমে ঢুকে-
” এই প্রিয়, তোকে তানভীর ডাকছে, যা তো শুনে আয় দেখ কি বলে।”
প্রিয় মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। শাশুড়ী মাও উঠে পরে। ফুয়াদ কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপে-
“বাহ, এই তো জ্বর কমে গেছে। এখন চটপট গোসল সেরে নাও তো। আমরা আজ বাসায় যাবো।”
“আমি যাবে না।”
ফুয়াদ এসে সাচির পাশে বসে, গালে হাত দিয়ে বলে-
” শরীর বেশি খারাপ লাগলে আমরা এখানেই বরং দুদিন থাকি, পরে যাবো।”
“আমি কখনোই যাবো না আর।”
“যেতেই হবে। কেন যাবে না?”
“জোর করবেন আমাকে? কেন জোর করবেন? কোন অধিকারের বলে?”
“তোমাকে ভালোবাসার অধিকারে।”
ফুয়াদের কথা শুনে কিছুক্ষণ হাসলো সাঁচি –
“এতো অভিনয় কি করে করেন বলুন তো! টায়ার্ড লাগে না? আর মানুষ কে বুঝি মানুষ মনে হয় না? আজকে ইচ্ছে হলো ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিলেন আবার কালকে লাথি মারলেন! একই সাথে এতো ক্যারেক্টার কিভাবে প্লে করেন?”
ফুয়াদ অসহায় দৃষ্টিতে সাঁচির দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা অতি দুঃখে পাগল হয়ে গেছে মনেহয়! ফুয়াদ এগিয়ে এলো-
“আমার ভুল হয়ে গেছে সাঁচি। আমায় ক্ষমা করে দাও। এরকম ভাবে বলো না প্লিজ!”
“হুহ,ক্ষমা! আমি যদি আপনার সাথে এরকম করতাম আপনি ক্ষমা করতেন আমায়? খুব এসেছে ক্ষমা চাইতে?”
মুখ ঘুরিয়ে নেয় সাঁচি। ফুয়াদকে তার আজকাল অসহ্য লাগে।
“আমার একটু কাজ আছে, তুমি গোসল সেরে খেয়ে নিয়ো দুপুরে কেমন। আমি সন্ধা নাগাদ চলে আসবো।”
ফুয়াদ যেন সাঁচির কথা শুনতেই পায়নি। ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো। যেন পালাতে পারলে বাঁচে!

সন্ধায় বাড়ি ফিরে ফুয়াদ শুনলো সাঁচি খায়নি দুপুরে। শুনে মৃদু হাসলো, যেন ও জানতো এরকম কিছুই হবে। সাঁচি ঘুমিয়ে ছিলো, ফুয়াদ ফ্রেশ হয়ে সাঁচিকে ডাকলো,ঘুম ঘুম চোখে সাঁচি তাকালো, ফুয়াদ খালি গায়ে ওর দিকে ঝুকে আছে। সাঁচি ধরমর করে উঠে বসলো-
“একি! আপনি খালি গায়ে কেন?”
“কেন ভালো লাগছে না?”
দুষ্ট হাসি দেয় ফুয়াদ।
” মোটেই না, ছি। কাপড় পরুন তাড়াতাড়ি। ”
“আগে তো খুব চাইতে আমায় শার্টলেস দেখতে?”
” এখন চাই না।”
গম্ভীর গলায় উত্তর দেয় সাঁচি। ফুয়াদ আর কথা না বাড়িয়ে একটা গেন্জি পরে নেয়। রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে সাঁচির পাশে বসে-
“খাওনি কেন দুপুরে? ”
“ইচ্ছে হয়নি।”
ভাতের গ্রাস বাড়িয়ে ধরলো ফুয়াদ। সাঁচি মানা না করে খেয়ে নিলো। বেশি অবশ্য খেলো না। ফুয়াদ আর জোর করে না। প্লেট নিয়ে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ করেই দুকাপ কফি নিয়ে ফেরত আসে। মগ দুটো বারান্দায় রেখে এসে সাঁচিকে ডাকে-
” এসো বারান্দায় বসি। তোমার সাথে কথা আছে? ”
সাঁচি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে নামে। মাথাটা ঘুরছে, বসে পরে আবার।
” আমি ধরি?”
” না, আমি পাড়বো।”
বারান্দায় এসে সাঁচির হাতে একটা মগ দেয়। সাঁচি কফিতে চুমুক না দিয়ে ধরে থাকে-
“বলুন,কি বলবেন?”
“আচ্ছা বলোতো, বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত আমি কি কখনো তোমার সাথে কোনোরকম অশোভন আচরণ করেছি?”
“নাহ।”
“তোমার সাথে প্রতারনা করেছি?”
এবার সাঁচি কনফিউজড হয়ে যায়। কি বলবে? পাষ্ট গোপন রাখাও তো এক হিসেবে প্রতারনা। সাঁচি চুপ থাকে। ফুয়াদ শ্বাস ছাড়ে লম্বা-
“দেখো,আমি যদি চাইতাম তাহলে তোমার সাথে সব করতে পারতাম, সব। তুমি কি বাঁধা দিতে? দিতে না! কিন্তু আমি তা করিনি? কেন করিনি? কারন আমি চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কের একটা সুন্দর সুচনা হোক। সময় লাগে লাগুক কিন্তু তুমি আমি যখন একসাথে পথ চলতে শুরু করবো তখন সেই পথচলা যেন অনুকরণীয় না হয়ে অনুসরণীয় হয়! কোনো ধরনের অবিশ্বাস, কপটতা, চতুরতা যেন আমাদের মধ্যে না আসে! তাই আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাই নাই। আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে। নিজের স্বামীর প্রাক্তনের গল্প শুনতে কার ভালো লাগবে? তবুও তুমি শুনেছো, ধৈর্য্য সহকারে শুনেছো। এজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। ”
একটু থেমে দম নেয় ফুয়াদ।
” তুমি কিন্তু বারবার আমার কাছে জানতে চেয়েছো…. তারপরেই আমি বলছি। তার আগে তোমাকে অনেকদিন এভোয়েড করেছি, কষ্ট দিয়েছি। এই কারনে যে,আমার মনে হতো এসব কথা জানলে তুমি ব্যাপারগুলো কিভাবে নেবে? তুমিও যদি ভুল বুঝে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাও? অনেক সাহস জুটিয়ে তোমায় কথাগুলো বলেছিলাম এই ভরসায় যে তুমি অন্তত বুঝবে? বুঝেওছো! এবং বুঝে তুমি যে কাজটা করেছো সেটার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। আসলেই রেহনুমার সাথে আমার দেখা হওয়াটা জরুরি ছিলো। ওর ক্ষমা না পেলে জীবনটা কেমন অভিশপ্ত লাগছিলো। বাচ্চা বয়সে আমি আবেগে ভেসে যেয়ে ওর জীবনে যে ঝড় তুলেছিলাম সেটার জন্য অনুশোচনা হতো সবসময়। তুমি আমাকে সেই ভার থেকে মুক্তি দিলে। ”
“আর যদি রেহনুমা ক্ষমা না করতো তবে কি করতেন? এভাবেই কি ফিরে আসতেন আমার কাছে?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ফুয়াদ, যেন কথা গুলো সাজিয়ে নিচ্ছে নিজের মনে-
“তোমাকে আমি আগেও বলেছি, আমার যদি সেরকম কোনো ইচ্ছা থাকতো তবে আমি তোমাকে বিয়ে করতাম না মোটেও। হ্যা, রেহনুমা যদি ভালো না থাকতো তাহলে হয়তো তোমার কাছে ফিরতে আরো একটু দেরি হতো আমার তবে আমি তোমার কাছেই ফিরতাম এটা শিওর। তার আগে আমি হয়তো রেহনুমার ভালো থাকার জন্য কিছু ব্যাবস্থা করতাম। সেটা করতে যেয়ে হয়তো আমার কিছু সময় নষ্ট হতো ওর পিছনে!”
“হুহ, সময়! বিয়ের নয় দশ মাস পার হয়ে গেছে আর এখন আপনার বোধোদয় হয়েছে? হাসালেন আমায়!”
হঠাৎ সাঁচির হাত দুটো আকরে ধরলো ফুয়াদ-
” আমি তোমার কাছে একটা সেকেন্ড চান্স চাই, সাঁচি! প্লিজ! না করবে না? তুমি আমার জন্য যে কষ্টগুলো সহ্য করেছো সেগুলোকে সুখে রুপান্তর করে তোমায় সুধ সমেত ফেরত দিতে চাই। প্লিজ! প্লিজ!প্লিজ! আমায় ফিরিয়ে দিয়ো না? তুমি যেভাবে থাকতে চাও সেভাবেই থাকে শুধু তোমার ইচ্ছা গুলো পূরন করার অধিকার টুকু আমায় দাও। আমি তোমায় জোর করবো না কোনোদিনও। যেমন তুমি আমায় সময় দিয়েছো তেমনই আমি তোমায় দিলাম অফুরন্ত সময়। যেদিন তুমি নিজে আমায় মাফ করে গ্রহন করবে সেদিন আমি তোমায় নিজের করবো। তার আগে নয়।”
ফুয়াদের এরকম অনুনয় দেখে সাঁচি কাঁদে, কতদিন না জানি এরকম কিছুর অপেক্ষা করেছে সাঁচি। অথচ আজ যখন এরকমটা হচ্ছে তখন মন থেকে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। প্রচন্ড কান্না মনটাকো ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। এটা কি সব কিছু ফিরে পাওয়ার কান্না নাকি প্রিয় পুরুষ নতজানু হচ্ছে তার কাছে সেই কান্না, বোঝে না সাঁচি। তারও যে আজ হেরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে? নিজেকে সমর্পনের ইচ্ছে হচ্ছে? কিন্তু না, এতো তো সহজ নয় সবকিছু? এখনো যে প্রিয় তিনটি ম্যাজিক ওয়ার্ড শোনা হলো না? তাহলে কিভাবে সমর্পিত হতে পারে সে? আরো কিছুদিন তবে নেয়া যাক ভালোবাসার পরীক্ষা। সাঁচি মাথা নেড়ে অস্পষ্ট ভাবে বলে-
“যাও, দিলাম তোমায় সুযোগ, আমায় মানিয়ে দেখাও দেখি???!!!

চলবে—-
Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here