“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ১৩

0
769

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
হুট করেই আয়মান এসে বললো,
“ভাইয়া, আমার দুইটা ননদ আছে। একটা আপন আরেকটা ফুপাতো।”
আয়ান ব্রু কুচকে বললো,
“খবরদার, কোনো আত্মীয়ের মাঝে সমন্ধ খুজবি না!”
“হুহ্!”
আয়মান ভেঙচি কেটে চলে গেলো।
আয়ানের চক্রান্তে ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ে শুরু হলো রহিমার ঘটকালি। প্রতিনিয়ত আয়ান নানান বানী তার কানে ঢেলে দিচ্ছে। কিন্তু সায়মার বাবামায়ের কাছে যখনই প্রস্তাব করতে যাবে তখনই সাহস হারিয়ে ফেলে! বলতে যায় বিয়ের ব্যাপারে আর বলে আসে অন্যান্য ব্যাপার! উক্ত মুহুর্তে তার সব গুলিয়ে আসে! জীবনে করেছে না কি ঘটকালি! তারউপর বিবাহিত ছেলেমেয়ের পুনঃবিবাহের ব্যাপার! সাহস আসবে কোথা থেকে!
ওদিকে রুমেলের সাথেও সায়মার বিয়ে দিতে রাজি নয় ফারহানা। কেননা তারা সমবয়সী। কিন্তু বোনের জোরাজুরিতে কিছুটা ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে ফারহানার মাঝে। তিনি নিশ্চিত, তার মেয়ে সেখানে রাজরানী হয়ে থাকবে। শুধুমাত্র বয়সটাই একটু ভাববার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। সায়মার কাছ থেকে মতামত চাওয়া হলে সায়মা পরিষ্কার জানিয়ে দেয় সে রুমেলকে বিয়ে করবে না। একে তো তার সমবয়সী অন্যথায় কাজিন!
এমন কনফিউশানের মাঝে কেটে গেলো আরও চারদিন। এদিকে রহিমার অবস্থা নাজেহাল! ওবাড়িতে গেলে আয়ান তাকে ধাক্কায় আর এবাড়িতে এলে সায়মা। দুই দিকের ধাক্কাধাক্কিতে তার পিষে যাওয়ার অবস্থা! কিন্তু ধাক্কাধাক্কিতে কি হবে! সাহস যে যথাস্থানে আসে না! নাহ! আজ সে মনভরা সাহস নিয়ে এসেছে। আজ তাকে বলতেই হবে। আর ভালো লাগছে না উভয়দিকের চাপ! গত চারদিন ধরে তার ঘুম হচ্ছে না ঠিকমতো! এমন চাপ হজম করতে থাকলে তার মরণ না হলেও মরণব্যাধি হবে সে নিশ্চিত! তাই আজ সে সিরিয়াস মুডে প্রবেশ করলো হক মঞ্জিলে। কলিং বেল বাজালে দরজা খুলে দিলো সায়মা। গত চারদিন যাবত সায়মাই দরজা খুলে দিচ্ছে। যেন তার অপেক্ষাতেই দাড়িয়ে থাকে সে। দরজা খুলে সায়মা মুখে হাসির রেখা টানলেও রহিমা গম্ভীর! সে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মা কই?”
“কেন! কি হয়েছে?”
“হয় নাই কিছু তবে হইবো। আম্মা কই?”
“মা তো নিজের রুমেই আছে। কিন্তু হয়েছে টা কি?”
“খালু ঘরে আছে?”
“না, আজ বাবার দাওয়াত আছে৷”
“খালি আপনের বাবারেই দাওয়াত দেয়! আপনাগো দাওয়াত দেয় না? দাওয়াতে গেলে তো একটাদিন ছুটিতেও থাকতে পারি।”
“তোর ছুটি দরকার হলে নিয়ে নে।”
“না, ছুটি দরকার নাই। তবে আপনাগো দরকারে ছুটি দিলে ছুটি কাটাইতে আরাম লাগে।”
“ভেতরে এসে কথা বল। আর দাওয়াত দিয়েছে আমাদেরও। কিন্তু ছ্যাচড়া দাওয়াত। বাবার বন্ধুর ছেলের সুন্নাতে খাৎনা৷ শুধু বাবাকে, মাকে আর আমাকে দাওয়াত করেছে। আংকেল তো জানতোই ভাইয়া ভাবি এসেছে। তবুও তাদের আবার বাদ রাখলো কেন! তারা কি আলাদা ফ্যামিলির! তাই মা রাগ দেখিয়ে বাবাকে বলেছে দাওয়াতে যাবে না। আমারও প্রোগ্রামে যেতে ভালো লাগে না তারউপর এমন দাওয়াত প্লাস মায়ের রাগ! তাই বাবা একাই গিয়েছে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব রক্ষায়!”
“এতো বড় হিস্টোরি না শুনাইলেই পারতেন। যা এনার্জি সঞ্চয় কইরা আসছি তা শেষই কইরা দিতাছেন! ধরেন!”
রহিমা গম্ভীরমুখে কথাগুলো বলে কিচেনে না গিয়ে সায়মার হাতে পার্স ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো ফারহানার রুমে। সায়মা হতবাক তার কর্মে! যেই মেয়ে এ টু জেড খুটিয়ে খুটিয়ে জানার চেষ্টা করে সে আজ এইটুকু কথায় বিরক্ত! তারউপর কি করে তার হাতে পার্স ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো! কত বড় বেয়াদব! মায়ের সামনে কিছু বলবে না। বেরিয়ে আসুক রুম থেকে। তারপর শিক্ষা দিবে!
সায়মা তার মায়ের রুমের সামনে অপেক্ষা করছে আর রহিমা বাঘী হয়ে রুমে প্রবেশ করতে গেলেও দরজার ওপারে বিড়াল বনে গেছে! মুহুর্তেই মুখের গম্ভীরতা উধাও হয়ে নিচু স্বর ও মিষ্টি কন্ঠের সৃষ্টি হয়েছে। সে সালাম দিলে ফারহানা সালামের জবাব দিলো। অত:পর রহিমা ইতস্তত বোধ করে বললো,
“আম্মা, একখান কথা বলি?”
“কথা বলতে আবার পারমিশন লাগে নাকি তোর! নিষেধ করলেও তো তোর ঠোঁট বিছুর মতো লাফায়!”
“ইছ! ছি ছি ছি! এমন একটা কীটের সাথে তুলনা দিলেন! এই মুখ মন্ডল আর কারে দেখামু! যাইগা!”
“ইশ! কত ঢং! কি বলবি, বলে যা।”
“না মানে কইতাছিলাম কি, আপারে কি এখন বিয়া দিবেন?”
“বিয়ে হচ্ছে আল্লাহর হাতে। এখন আর তখন কি! আল্লাহ যখন হুকুম করবে তখনই হয়ে যাবে৷”
“হু। না মানে, কয়দিন ধইরা বিয়ার আলাপ শুনতাছি যে তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।”
“কেন? বিয়ে নিয়ে হঠাৎ তোর জিজ্ঞাসা কেন?”
“না মানে যদি বিয়া দেওয়ার ইচ্ছা থাকে তো বলমু।”
“মেয়ে মানুষ কি আর সারাজীবন ঘরে রেখে দিবো! বিয়ে তো দিবোই।”
“আপনের বোইন পুতের সাথেই দিবেন?”
“এসব কি কথা! কিসের বোইন পুত! বোনের ছেলে কিংবা ভাগিনা বল।”
“যা-ই হোক। বলেন।”
“বোন তো চাইছেই কিন্তু মেয়ে তো রাজি না! তোর খালুও না করে। তা তুই এসব নিয়ে ভাবছিস কেন?”
“না, মানে যদি পাত্র আপনাগো ঠিক করা না থাকে তবে একটা পাত্রের সন্ধ্যান দিতাম আরকি। পরিচিত ভালো একটা ছেলে আছে৷ যেমন সুদর্শন তেমন বংশ পরিচয়।”
“বাসা কোথায়?”
“ঢাকাতেই।”
“ছেলে কি করে?”
“পড়াশোনা আর ঘুরাঘুরি।”
“কি!”
“না মানে, পড়াশোনা আর চাকরির জন্য ঘুরাঘুরি করতে লাগছে। ভালো চাকরি পাইলে করবো নয়তো ব্যবসা করবো৷ তাছাড়া বাপের ছয় তলা বাড়ি আছে। ভাড়া দিয়াই হাড়ি ভরা, পেট ভরা, মন ভরা, বাড়ি ভরা, ব্যাংক ভরা। তাছাড়াও বড় ভাই কলেজের প্রফেসার! মোটকথা, বিত্তশালী যারে বলে!”
“বুঝলাম। বাবা মা আছে?”
“হু।”
“তা ছেলে যেহেতু পড়াশোনাই শেষ করেনি, তার তো বিয়ের বয়সই হয়নি! এদিকে আমার মেয়ে পড়াশোনা শেষ করতে যাচ্ছে! এমন হলে মানা যায় না। সমবয়সীর কাছে বিয়ে দিবো না। তারউপর বেকার!”
“না, বয়স আছে। তবে কিছু সমস্যার কারণে পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে গেছে। খালি আপনে দেখেন একবার। ছেলে দেখলেই পছন্দ হইয়া যাইবো আমার বিশ্বাস। আর বেকার তো সমস্যা না! বাপের টাকা আছে। চাকরি না পাইলে ব্যবসা ধরবো। সেইটা আর কয়দিনের ব্যাপার! বিয়া ঠিক হইতে হইতে ব্যবস্থা কইরা ফেলবো৷ বউ বাচ্চা ঘরে থাকলে অলস ছেলেপুলেও কর্মঠ হইয়া যায়। এইবার মতামত জানাইয়েন। আপনারা চাইলে আমি পাত্রপক্ষ আসতে বলমু।”
“তোর খালুর সাথে কথা বলে দেখি।”
রহিমা চলে গেলো। বড় একটা আশা নিয়ে বসে আছে তাদের মতামত পাওয়ার জন্য। সায়মা তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য দরজার বাইরে অপেক্ষা করলেও এখন তাকে নিয়ে নাচতে ইচ্ছে করছে সে বিয়ের কথা বলায়। কিন্তু নাচানাচি অপছন্দ বলে তা করলো না।
আবু সালেহ হককে জানালে তিনি পাত্রপক্ষকে আসতে বললেন৷ তারা এসে দেখে যাক৷ পছন্দ হলে বাকিটা পরে দেখা যাবে। কথামতো রহিমা কাইয়ুম ভিলায় পাত্রীর সন্ধ্যান দিলো। বাকিটা ম্যানেজ করলো আয়ান।
দুদিন পর,
আজ আয়ান, তার মা ও রহিমা এসেছে সায়মাদের বাড়িতে। আয়ানের মা ও সায়মার বাবামায়ের মধ্যে কথাবার্তা হলো। আপায়ন করা হলো। অত:পর সায়মাকে সামনে নিয়ে আসা হলো। আয়ান ও সায়মা দুজনের চেহারায়ই আতঙ্কের ছাপ! আর রহিমার প্রচেষ্টা দুজনের গুন গুলো তুলে ধরার মাধ্যমে বিয়ের কথা পাকা করা। কিন্তু প্রথম দেখাতেই ঘটলো বিপত্তি! কথায় কথায় ফারহানা হক জেনে গেলেন তারা সেই বাড়ির লোক যাদের বাড়িতে রহিমা কাজ করে! কথাটা জানার পরই তিনি বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলেন,
“রহিমা, তুই তাদের বাড়িতেই কাজ করিস না?”
“হু আম্মা।”
“তার মানে, এটাই সেই চিরিয়াখানার এক নম্বর বান্দর , যে তোর হাত ফুটো করে দিয়েছে! জেনেশুনে এমন সাংঘাতিক ছেলের সাথে মেয়ে দিবো না।”
অত:পর মারিয়া কাইয়ুমের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভাবি, মনে কষ্ট নিবেন না। রহিমার কাছে প্রায়ই শুনি আপনাদের ব্যাপারে। আপনাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো কিন্তু আপনি তো নিজেই জানেন আপনার ছেলে কতটা সাংঘাতিক। সামান্য কারণে রহিমার হাতের যা অবস্থা করেছে আমি দেখেই হতম্ভিত! আমার মেয়েটা খুবই শান্তশিষ্ট। বিশ্বাস না হলে রহিমার কাছে জেনে নিতে পারেন। তাই আমি আমার মেয়ের জন্য একটা শান্তশিষ্ট ছেলে খুঁজে বিয়ে দিবো।”
মারিয়া কাইয়ুম গেলেন ক্ষেপে!
“মুখ সামলে কথা বলুন। আমার ছেলে কোনদিক থেকে আপনার কাছে বানর মনে হলো। আপনার মেয়ে কি খুবই রূপবতী! যারা বেশি মাত্রায় শান্ত থাকে তাদের ভেতর শয়তান বশত করে। আপনার মেয়ে এমন তো নয় যে ভোলাভালা! কিছু বুঝে না! ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েরা এমন হয় না। সেটা আমাকে বুঝাতে আসবেন না। তারউপর ছেলে আর ছেলের বউ ও তো দেখলাম কেমন! কোথেকে না কোথেকে বিদেশি ধরে এনেছে। অন্যের সম্পর্কে কিছু বলার আগে নিজের দিক দেখুন৷ আয়ান, চলো। আর রহিমা, দ্বিতীয়বার তুই কোনো মেয়ের সন্ধ্যান নিয়ে যাবি তো তোর খবর আছে!”
কথাটা বলার পর আর এক মুহূর্তও বসে নেই! ছেলে যেমনই হোক, অন্যের মুখে নিজের ছেলের সম্পর্কে কটু কথা শুনে মারিয়া কাইয়ুম বড্ড অপমান বোধ করেছেন। তাই তিনি চলে গেছেন ছেলেকে সাথে নিয়ে। তবে যাওয়ার আগে রহিমার দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন তিনি। এদিকে আয়ান রহিমার উপর ৩৬০° তাপমাত্রায় রাগান্বিত! একমুহূর্তে রহিমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো তার! সে যদি আয়ানের নামে এসব না বলতো তাহলে তো আজ এসব কিছু ঘটতো না! আর সায়মা নিরব দর্শক! না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সইতে! এদিকে হক সাহেব ফারহানা হকের উপর সামান্য বিরক্ত প্রকাশ করে মারিয়া কাইয়ুমকে বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মারিয়া কাইয়ুম থেমে নেই। বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। আর ফারহানা হক বড়সড় নিশ্বাস ফেলে বললো,
“কি মানুষরে বাবা! এই মহিলাও কম সাংঘাতিক নয়! যেমন সাংঘাতিক ছেলে তেমন তার মা! রহিমা, আর একদিনও তুই সায়মার জন্য সমন্ধ আনবি না।”
ফারহানা হক হনহনিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে। তার কথাবার্তায় যে মেহমান অপমানিত হয়েছে সেটা বুঝাতে হক সাহেবও ছুটে গেলেন স্ত্রীর পিছু পিছু। এদিকে সায়মা রাগান্বিত গলায় বললো,
“এটা কি করলি তুই! না এসব কিছু বলতি মায়ের কাছে আর না এমন কিছু ঘটতো! এখন তো সব বরবাদ হয়ে গেলো!”
“সবাই খালি আমারে বকেন ক্যা? আমি কি জানতাম নাকি আপনারা আগেই ইয়ে করে বসে আছেন!”
“ধ্যাৎ!”
সায়মা মাথার ঘোমটা ফেলে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আর রহিমা ছোট ছোট কদমে কিচেনে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here