বিনি সুতোর টান,পর্ব-৬,৭,৮

0
2023

#বিনি সুতোর টান,পর্ব-৬,৭,৮
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬

বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে লাগল। তিনি নম্র গলায় বললেন

“আমার একটা না অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে৷ আর সবাই অনেক ভালো। আমাকে অনেক ভালোবাসে এবং কেয়ারও করে। ”

আমার গলা জড়িয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ভার ভার লাগছে। সেই সাথে রাগের বিস্ফোরণ ঘটল। বেশ রাগ গলায় বললাম

“আপনি আমাকে কোল থেকে নামান। যে ছেলের এতগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে তার কোলে আমি উঠতে পারব না। দেখা গেল রাস্তায় আপনার গার্লফ্রেন্ডরা আন্দোলনে নামবে আর আমাকে কোল থেকে নামিয়ে আছার মারবে। এখন তো আমার পা ভেঙেছে তখন আমার কোমর ভাঙবে। আমাকে নামান তো কোল থেকে… এত বড়ো রিস্ক নিতে পারব না। নিজের কোমরের ভয় আছে আমার।”

তিনি খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলেন। হাসির প্রশস্ততা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

“আমার গার্লফ্রেন্ডগুলো ভালো। আর একটা মানুষের অনেক গুলো গার্লফ্রেন্ড থাকা যাবে না কে বলল? আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ওরা আপনার কোমর ভাঙবে না। সেরকম স্বভাবের ওরা না। সবাই তো আপনার মতো না যে অকাজ করবে বেশি।”

“এতগুলো মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করে আমার কাছে সাধু সাজার চেষ্টা করছেন! বাহ ভালো তো। আবার সবার গুণগাণ গাচ্ছেন। আমার সাথে তুলনা করছেন। আপনাকে আমি কী ভাবতেছিলাম আর আপনি কী! ভাবনা গুলো সবসময় কেন এত ভিন্ন হয়। কেন এত অমসৃণ হয়। ধুর ভালো লাগে না কিছু। আমাকে কোল থেকে নামান তো৷ ”

“কী আজব। গার্লফ্রেন্ড মানে মেয়ে ফ্রেন্ড,। আমার তো অনেক মেয়ে ফ্রেন্ড আছে। আপনি কী মিন করে কথা বলেন আপনিই জানেন। আমার চরিত্র উদ্ধার করে ফেলতেছেন। ভারি আজব মেয়ে তো আপনি। আমাকে কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি। কী বলছেন মাথা ঠিক আছে তো?”

উনার শেষ কথাটা শুনে আমার ধরে প্রাণ আসলো মনে হচ্ছিল। বেশ মিশ্র একটা হাসি দিয়ে বললাম

“আমি কিছু মিন করিনি৷ আপনিই যা’তা ভাবছেন। আপনার ভাবনার দোষ। আমার কোনো দোষ নেই। ”

এর মধ্যেই উনি ধপাশ করে আমাকে গাড়ির সিটে বসিয়ে দিয়ে বললেন

“বাসায় সারাদিন না খেয়ে একটু তো এক্সারসাইজ করতে পারেন। এত ভারী কী বলব। হাত দুটো ব্যথা হয়ে গিয়েছে। আংকেল কোথায় গেল আবার? ”

উনি এবার বাবাকে দৃষ্টি এপাশ ওপাশ করে খুঁজতে লাগলেন। আর আমি উনার কথার জবাবে গোমরা মুখে বললাম

“বললেই তো পারতেন হাতির মতো শরীরটাকে স্লিম ফিট করুন৷ তা না বলে পরোক্ষভাবে লজ্জা দেওয়ার কী আছে? আমি কী এতই মোটা। ৫ ফিট হলেও ওজন ৫০ পার হয়নি। আপনার শক্তি নেই সেটাই বলতে পারতেন। শুধু শুধু আমার ওজনের দোষ দিলেন। আপনার স্বভাব মানুষকে দোষ দেওয়া।”

“আপনি সব বিষয় জটিল করে নিয়ে নেন। এটা আপনার অভ্যাস বুঝা যাচ্ছে। আপনার কথায় কিছু মনে করছি না। যা ইচ্ছা বলতে পারেন। অকাজ করা এটা আপনার নতুন না। যাইহোক ঐ তো আংকেল চলে এসেছে। এখন আর কথা বাড়ালাম না। আংকেলের সামনে কী থেকে কী বলে ফেলেন বলা যায় না। আপনার যা মুখ চলতেই থাকে।”

লক্ষ্য করলাম বাবা চলে এসেছে। বাবাকে দেখে আমি চুপ হয়ে গেলাম। নীল গাড়ি চালানো শুরু করলো। আমরা পেছনের সিটে বসলাম। রাত ভালোই হয়েছে। গাড়ির এসিটা আমার তেমন সহ্য হয় না। নাক চেপে কিছু বলার আগেই গড়গড়িয়ে বমি করে দিলাম। এবার মনে হচ্ছে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে। এমন অবস্থায় পড়তে হবে আশা করিনি। সিনেমায় কত রোমান্টিক সিন হয়। আর আমার ক্ষেত্রেই এত অদ্ভুত সিন কেন হচ্ছে সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল

” কী করলি এটা? আরেকজনের গাড়িতে এভাবে বমি করে দিলি? পলিথিন তো চাইতে পারতি। গাড়িটার তো পুরো বাজে অবস্থা করে দিয়েছিস। ”

আমি কিছু উত্তর দেওয়ার সাহস পাচ্ছি না। নিজের উপর নিজেরেই রাগ হচ্ছে। নীল সামনে থেকে বলে উঠল

“সমস্যা নেই পরিষ্কার করে নেওয়া যাবে। এসিটা মনে হয় উনি সহ্য করতে পারছেন না। আমি এসি বন্ধ করে দিয়েছি। আপনি একটু কষ্ট করে জানালা গুলো খুলে দিন। উনি অসুস্থ উনাকে বকা দিবেন না। এমনিতেই পায়ের ব্যথার কথা বলতে না পারলেও ব্যথা তো কমে যায় নি।”

পায়ের ব্যথার কথা বলতেই যেন আমার ব্যথাটা সুর সুর করে বাড়তে লাগল। এটা কী আমার মনের ব্যথা নাকি পায়ের ব্যথা এখন বুঝতে বেশ মুশকিল হচ্ছে। নীল বেশ শান্ত গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন

“পায়ে কি ব্যথা বেশি করছে?”

আমি মুখ চেপে উত্তর দিলাম

“আগের মতোই।”

এর মধ্যেই গাড়িটা থেমে গেল। নীল গাড়ি থেকে নেমে গেল। পেছনে এসে গাড়িটার দরজাটা খুলে পুনরায় আমায় কোলে তুলল। আমি আস্তে গলায় বললাম

“আমি হেঁটেই যেতে পারব। আমাকে একটু ধরলেই হবে। আমার হাতির মতো শরীরটা আর কোলে নিতে হবে না। আপনার অনেক কষ্ট হবে। আমাকে নামিয়ে দিন ”

তিনি মুচকি হেসে জবাব দিলেন

“এত অভিমান ভালো না। এক্সারসাইজ করতে বলেছি। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আপনি বড্ড বেশি কথা বলেন। এত কথা কেন বলেন তো বলবেন? আপনার মুখের কি নিস্তার নেই? নাকি টেপ রেকর্ডের মতো বক বক করেই যাবেন। নিজেকে একটু সামলান। নিজের মতো করে নিজেকে গুছানো খারাপ না। আর আপাতত আপনার মুখটাকে একটু বন্ধ করুন। ”

উনার কথা শুনে আমার মাথায় রাগে বিস্ফোরণ ঘটতে লাগল। যতই কথা বলছে ততই যেন আমাকেই অপমান করছে। এর মধ্যেই গা টা আরও গুলিয়ে যেতে লাগল। নিজেকে সংযত করতে চেয়েও পারিনি। গড়গড়িয়ে বমি করে দিলাম উনার বুকের উপর। উনি শুধু ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। ভেবেছিলাম কোল থেকে ধপাশ করে ফেলে দিবেন। তিনি তা করেননি। আমাকে ইমারজেন্সি রুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। এদিকে নিজের বমির গন্ধে নিজেরেই গা গুলাতে লাগল। এত বড়ো কম্য করব বুঝতে পারিনি। লজ্জায় গা ঘিন ঘিন করতে লাগল। ভারী গলায় বললাম

“আমি বুঝতে পারিনি। আপনি রেগে যাবেন না। ইচ্ছা করে এমন করিনি।”

তিনি আমাকে ইমারজেন্সি রুমের সিটে বসিয়ে দিয়ে বললেন

“আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি মোটেও রাগ করিনি। কেউ ইচ্ছা করে কারও গায়ে বমি করবে না এটা আমি জানি। আপনি বসুন ডাক্তার এসে আপনার পা এক্স রে করে বাকি চিকিৎসা করবেন। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে এখনই আসতেছি। আর লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এটা স্বাভাবিক বিষয়।”

কথাটা বলে উনি চলে গেলেন। বাবাও আর উনার কথার পর কিছু বললেন না। ডাক্তার এসে পা এক্স রে জানালেন আমার পা টা ভেঙে গিয়েছে প্লাস্টার করতে হবে। একজন ডাক্তার প্লাস্টার করা আরম্ভ করলেন। আমি মনে মনে নীলকে খুঁজতে লাগলাম। একটা মানুষ কতটা হেল্পফুল হলে সে আমার জন্য এতকিছু করে সেটাই ভাবছি। আশে পাশে দৃষ্টি শুধু তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাবাকে কি একবার জিজ্ঞেস করব নীল কোথায়। জিজ্ঞেস করার সাহসও মিলছে না। এদিকে বেশ অস্থির লাগছে আমার। আমার পা ব্যথায় টনটন করলেও নীলের চিন্তায় যেন সে ব্যথা টের পাচ্ছি না। একটা মানুষের চিন্তার যেন তার অনুভূতিগুলোও গ্রাস করে নেয়। আমি খুব ভাবে এটাই অনুভব করতে পারছি যে নীলের চিন্তা মস্তিষ্কে এমনভাবে ঝেঁকে বসেছে যে আমি অন্য কোনো চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছি না। আর এটা যেন আমার অনুভূতিকেও গ্রাস করে নিচ্ছে।

এমন সময় একটা চিৎকারের আওয়াজ আসলো। সাথে নীলও প্রবেশ করল রুমে। কিছুটা ভয়ার্ত চোখে নীলের দিকে তাকালাম। বুকের ভেতরটা যেন আচমকা মোচর মারল নীলকে দেখে।

চলবে?

#বিনি সুতোর টান
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭

নীলের পুরো শার্টটা রক্ত মেখে আছে। আমার বুকটা ধুকধুক করতে লাগল। বেশ নড়েচড়ে বসে জোর গলায় বলে উঠলাম

“আপনার কী হলো? শার্টে রক্তের দাগ কেন? কী হয়েছে আপনার? আর বাইরে কে চিল্লাচ্ছে? আপনি ঠিক আছেন তো?”

কথাটা বলেই বেড থেকে উঠতে লাগলাম। এত অস্থিরতার প্রকাশ হচ্ছে বলে বুঝাতে পারব না। অস্থিরতার রেশ কাটছে না কোনোভাবেই। পাশ থেকে ডাক্তার বলতে লাগলেন

“আপনি থামুন এত নড়াচড়া করলে তো পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। পায়ে প্লাস্টার করতে দিন। এরকম করলে তো চিকিৎসা করা মুশকিল।”

আমার অস্থিরতা দেখে পাশ থেকে নীল বলে উঠলেন

“আপনি শান্ত হোন। আমার কিছু হয়নি। বাইরে একটা এক্সিডেন্টের রোগী এসেছে। সে রোগীকে নামাতে হেল্প করেছি। সেখান থেকে রক্ত লেগেছে। আপনি স্থির হয়ে বসে ডাক্তারকে প্লাস্টার করার সুযোগ দিন। অন্যথায় আমাদের দেরি হবে। বাসায় গিয়ে আমাকে গোসল করতে হবে। কালকে আমার অফিস আছে। এমনিতেও রাত অনেক হয়েছে। ডাক্তারের কাজে বিঘ্ন ঘটাবেন না।”

উনার কথা শুনে পাশ থেকে বাবাও আমাকে ঝারি দিয়ে বলল

“তুই কি স্থির হবি? কখন থেকে কী করতেছিস সব লক্ষ্য করতেছি। অকাজও করিস আবার দুষ্টামিও করিস। তোকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা। আজ রেহেনা বেঁচে থাকলে তোর অবস্থা হত কী সেটাই ভাবছি।”

রেহানা হলো আমার মায়ের নাম। বাবার সবগুলো কথায় মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। বেশ ছোটো থাকা অবস্থায় মা মারা যায়। আমাদের যত্নের ত্রুটি যেন না হয় তাই তিনি নিজেই সংসারের সব দায়িত্ব নেন। এ দায়িত্ব নিতে গিয়ে নিজেও বিয়ে করেন নি। ভেবেছে আমাদের যদি কষ্ট হয়। আমাদের দ্বিতীয় মা যদি আমাদের মেনে নিতে না পারেন তাই নিজেই একাকীত্ব বরণ করে আমাদের মানুষ করেছেন।

এর মধ্যেই প্লাস্টার করা শেষ হলো। ২১ দিন এভাবে আমাকে বাসায় গিয়ে বেড রেস্ট নিতে হবে। বাবা আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নীচে নিয়ে গেল। নীল ডাক্তারের কাছ থেকে সকল পরামর্শ নিয়ে গাড়ির কাছে আসলো। গাড়িতে হালকা স্প্রে মেরে আমাদের বসতে বলল। আমি এবার একটু পাকনামি করলাম। বেশ মৃদু গলায় বললাম

“পেছনের সিটে বসে, আসার সময় আমার কষ্ট হয়েছে। আমি যদি সামনের সিটে বসতে পারতাম ভালো হত। ”

বাবা আমার হাত চাপতে লাগলেন। হুট করে এমন বায়না করা যে মানায় না আমার মতো ধামড়া মেয়েকে উনি সেটা সরাসরি বলতে পারছেন না। আমি বাবার হাতের ইশারা বুঝে চুপ হয়ে গেলাম। তবে নীল আমার কথাটা শুনে সামনের দরজাটা খুলে আমাকে ধরে বলল

“সামনেই বসুন। আপনার অসুবিধা হলে পেছনে বসতে হবে না। আচ্ছা আপনার পায়ে এখন কি ব্যথা লাগছে?”

আমি হালকা হেসে বললাম

“পায়ের কেনো অনুভূতিই অনুভব হচ্ছে না। ব্যথা তো পরের কথা।”

“একুশ দিন এমন একটু লাগবেই। এরপর হাঁটতে পারবেন আশা করি। একটু সাবধানে থাকবেন। আপনি অনেক অস্থির স্বভাবের মেয়ে। একটু স্থির হয়ে চলবেন। ”

বলেই আমাকে গাড়িতে তুলে নিজে গাড়িতে উঠলেন। বাবা পেছনের সিটে বসলেন। আমি নীলের দিকে তাকালাম। আমার সমস্ত আবেগ যেন একত্রিত হলো দুটো চোখে। তার প্রতিটা বিষয় আমি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। কীভাবে ড্রাইভ করছে কীভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মুখের এক্সপ্রেশন সব আমার পর্যবেক্ষণের আওতায় এখন। মনে মনে কল্পনার ছক কষতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম নীলের কাঁধে মাথা রেখে যেতে পারলে কত ভালোই না হত। এ সুযোগ আর সময় কখনও হবে কি’না জানি না। ভাগ্য আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে বলতে পারব না। তবে ভাগ্যের শেষটা যেন পূর্ণতা পায় তাই চাই। নীলকে দেখতে দেখতে ফিসফিস গলায় বললাম

“আপনি কখনও কাউকে ভালোবেসেছিলেন জীবনে?”

নীল বেশ নম্র গলায় বললেন

“বেসেছিলাম এক মহিয়সী নারীকে। সাতটা বছর নিজের করে রাখার পর বুঝতে পারলাম মানুষটা আমার না।”

নীলের মুখটায় কথাটা বলা শেষে কেমন জানি অন্ধকার নেমে আসলো। আমি হতবাক উনার কথা শুনে। কথাটা পুরোপুরি অর্থ আমি বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝতে পেরেছি নীল কাউকে ভালোবাসত আর সে নীলকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। নীলের মতো ছেলেকে ছেড়ে চলে গিয়েছে ভাবতেই বুকে ধলা পাঁকাতে লাগল কী যেন। ভার ভার লাগল বুকটা। বেশ কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলাম। তারপর আবার প্রশ্ন করলাম

“কথাটা বুঝিয়ে বলবেন?”

“এখন বুঝানো সম্ভব না। লম্বা কাহিনি। আরেকদিন কফি খেতে খেতে বলব। সময় করে বলার বিষয়। এ অসময়ে বললে কেবল জটিলতা বাড়বে। ”

“আমি অপেক্ষায় থাকব আপনার গল্প শুনার জন্য। আপনার গল্প শুনে আমি একটা উপন্যাস লিখব। বিরহের উপন্যাস।”

তিনি মুচকি হেসে বললেন

“আপনি কি রাইটার নাকি?”

“উপন্যাস লিখতে কী রাইটার হওয়া লাগে? মাঝে মাঝে কথামালা গুলো সন্নিবেশ হারে সাজিয়েও উপন্যাস লিখা যায়। বই লিখতে না পারি ডায়রিতে তো লিখতে পারব। তখন সে ডায়রিটা আপনাকে দিব। আপনি পড়বেন। কেমন হয়েছে বলবেন। আপনিই নাহয় তখন আমার পাঠক হবেন।”

“এখন আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার রাইটার হওয়ার সম্ভবনা আছে। বাংলা ভাষা বেশ সুন্দর করে আয়ত্ব করে কথা বলতে পারেন। চেষ্টা করলে পারবেন।”

“আপনি বললে চেষ্টা করব। তবে আপনার গল্পটা যে আমাকে শুনতে হবে। ”

“ঐ যে বললাম সময় করে বলব তখন শুনে নিয়েন। এখন সেসব কথায় না যাই। বিরহের বার্তা কানে এসে নতুন করে ঝাঁপটা দিবে। অতীত ভুলে থাকা যায় না। কোনো না কোনো ভাবে তা পেছনে এসে দৌঁড়ায়। দুনিয়াতে সবচেয়ে বড়ো কষ্ট হয়তো অতীত থেকে বাঁচা। পালিয়ে যেখানেই লুকানো হোক না কেন অতীত যেন সামনে এসে তাড়া করবেই। জীবনটা পানসে করতে একটা কালো অতীতেই যথেষ্ঠ। তবুও আমরা মানুষ। বেঁচে থাকি বেঁচে থাকতে হয়৷ নিজের জন্য না হলেও পরিবারের জন্য, মানুষের জন্য। কষ্ট থাকলেও সেটা চাপা দিয়ে হাসতে হয়। কারণ দুনিয়ায় সবাই জাত অভিনেতা অভিনেত্রী।”

“আপনি উনাকে ভালোবাসতেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন

“এখনও বাসি। ”

“বিয়ে করবেন না?”

“সময় হোক বিয়ের তখন করব। কারও জন্য তো জীবন থেমে থাকে না।”

“আমাকে কিন্তু কালকেই কাহিনি বলবেন।”

তিনি হালকা হেসে বললেন

“আপনার পা যেদিন ভালো হবে সেদিন বলব। এত দ্রুত তো আপনাকে কাহিনি বলা যাবে না। একটু সুস্থ হোন। আর আপনি আজকে পুরনো ক্ষতটায় আবার খু্ঁচালেন আমি একটু সেটা স্বাভাবিক করি তারপর বলব।”

“আমরা কী ভালো ফ্রেন্ড হতে পারি না?”

“হয়েই তো গেছেন। তবে ভালো ফ্রেন্ড কিনা জানি না, আমার মতো কম কথা বলা ছেলে আপনার সাথে অনেক কথা বলেছে সুতরাং হয়তো ফ্রেন্ড হয়েই গেছেন। তবে আপনি নিজের যত্ন নিন আগে। আপনি নিজের থেকে মানুষের কথা ভাবেন বেশি৷ মানুষের জীবনে কী হয়েছে কী করবে এসব নিয়ে পড়ে থাকেন বেশি। নিজের চিন্তা করুন।”

কথাটা বলেই পেছনে তাকালেন নীল। তারপর আবার বললেন

“আংকেল হয়তো অনেক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ”

আমি আর কোনো কথা বললাম না। বাইরে থেকে এক ফালি চাঁদের রশ্নি মুখের মধ্যে এসে লেপ্টে গেল নীলের। শুভ্র লাগছে নীলকে। এতটা মায়া মুখ কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। এ মায়ায় ডুব দিয়ে অতলে নিমজ্জিত হয়ে যেতে মন চাচ্ছে৷ চোখদুটো ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। চোখ খুলে নিজেকে এমন জায়গায় আবিষ্কার করে বেশ অবাক লাগছে। এ কোন জায়গায় আমি আছি বুঝতে পারছি না একদম। ছিলাম গাড়িতে এখন আছি রুমে। তবে এটা তো আমার রুম না। আমি কী তাহলে কোনো স্বপ্ন দেখছি?

চলবে?

#বিনি সুতোর টান
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮

আমি কী তাহলে কোনো স্বপ্ন দেখছি? চারপাশ চোখ বুলিয়ে লক্ষ্য করলাম রুমটা বেশ গুছালো আর পরিপাটি করে সাজানো। আমার দৃষ্টি কেবল চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুটা ছন্নছাড়াও লাগছে। এমন সময় নীলের মা আসলেন। তিনি বেশ হাসি মুখ করে বললেন

“সকাল হয়ে গিয়েছে উঠে চা খাও।”

উনার কথা শুনে আমি আরও হতভম্ব হয়ে গেলাম। কখন সকাল হলো টেরেই পেলাম না। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম গাড়িতে এরপর আর কেনো হুঁশ নেই আমার। উনাকে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলাম

“আমি এখন কোথায়?”

উনি মুচকি হেসে জবাব কষলেন

“তুমি আমাদের বাসায়। তোমার বাবা একা সারাদিন বাসায় কাজ করে। তার উপর তোমার যত্ন নেওয়া উনার আরও কষ্ট হয়ে যাবে। পুরুষ মানুষ কী সব পারে নাকি? তাই তোমার বাবাকে বলে তোমাকে আমাদের বাসায় রাখলাম। যাতে করে তোমার সাথে গল্পও করা যায় আর তোমার যত্ন ও নেওয়া যায়। তুমি তো আমার মেয়ের মতো। একা থাকতে আমারও ভালো লাগে না। ঐ দেখো ৮ টা বাজতে না বাজতেই নীল চলে গেল অফিসের দিকে আর আমি সারাদিন একা। নীলের বাবা তো তবুও বাইরে ঘুরে আসে আমি তো তাও পারি না। এই দেখো আমি কথা জুড়ে দিলে আর কথা থামাতে পারি না। তুমি উঠে ফ্রেশ হও। মাজেদাকে পাঠাচ্ছি আমি।”

কথাগুলো গড়গড় করে বলে উনি চলে গেলেন। মাজেদা খালা আমার কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে বলতে লাগলেন

“চলো মামনি তোমারে ধরে ওয়াশ রুমে নিয়ে যাই। তোমারে যে যতন আফা করতাছে মনে হয়তাছে বাড়ির বউ বানাইয়া ফেলব।”

মাজেদা খালার কথাটা শুনে যদিও খুশি লাগছে মনে তবুও মুখে বিরক্তি টেনে বললাম

“খালা এত বেশি কথা কেন বলো তো বলবে? একটু কী চুপ থাকা যায় না? কোথায় থেকে কোথায় যাচ্ছ তুমি। একটু মুখটাকে নিস্তার দাও। সারাদিনেই হাবিজাবি কথার হিরিক ছড়িয়ে বসো।”

মাজেদা খালার আমার কথা গুলো ভালো লাগেনি সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আসলো মুখে। যদিও অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথায় উনি বলে তবে উনার কথা মাঝে মাঝে বিনোদনের জন্য হলেও শ্রবণ করতে ভালো লাগে।

এদিকে আমি ফ্রেশ হয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে হুইল চেয়ারে বসলাম। নীলের মা মাজেদাকে জোরে জোরে ডাকতে ডাকতে বললেন

“মাজেদা আঁচলকে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে এসো তো। নীলের বাবা বড়ো মাছ এনেছে ওর দেখলে ভালো লাগবে। তুই এসে মাছ কাট আর ওকে এদিকে বসা। আমি আর ও বসে মাছ কাটা দেখব। ”

আন্টির কথা শুনে আমি মাজেদা খালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলাম না। তার আগেই হুইল চেয়ার দিয়ে রান্না ঘরের পাশে চলে গেলাম। মাজেদা খালাও তড়িঘড়ি হয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে গেলেন। উপস্থিত হয়েই জুড়ে দিলেন উনার মহাকাব্য।

“আরে আফা এই আর কী মাছ? আমাগোর নদীতে আমার বাপে ধরছিল এক মাছ। আমার বাপ ছিল জাত জেলে। নাম ডাক আছে তার। একটা বিশাল বোয়াল মাছ ধরছিল। ষাইড হাত লম্বা আর চওড়া আছিল চল্লিশ হাত। আমার নিজের চক্ষে দেখছি। কত জায়গা থেকে যে মানুষ আসছে ঐ মাছ দেখতে কী কমু আফা। আমি কইতে গেলে দিন শেষ হয়ে যাইব তবুও কাহিনি শেষ হইব না। হেই মাছ কাটতে ত্রিশ জন মানুষ লাগছিল। এইডা আর কত বড়ো মাছ। আমরা এরচেয়ে কত বড়ো মাছ দেখছি।”

মাজেদার কথার ফুলঝুড়ি উড়তে লাগল। আন্টিও বেশ ধৈর্যের সহিত কথাগুলো শ্রবণ করল কিছুক্ষণ। কিন্তু সে ধৈর্য আর বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বললেন

“মাজেদা থাম এবার। এত কথা কেন বলিস যে তুই। তোরে বললাম মাছটা কাট। তোর বাপ দাদা কী করছে এগুলা বলা বন্ধ কর। কথা বললে বলতেই থাকস।”

মাজেদা খালা এবার কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলতে লাগলেন

“আফায় আমার সব কথায় খালি ব্যাগরা দেন। দেহি একটু ঐমনে যান আমি বসে মাছ কাডি। আচ্ছ আফা এইডা কী মাছ?।”

আন্টি এবার বিরক্তি টেনে বললেন

“তোর বাপ তো জাত জেলে ছিল তোর তো জানার কথা।”

আন্টির উত্তর শুনে আমি ফিক করে হেসে বললাম

“খালা এটা কুড়াল মাছ। সামুদ্রিক মাছ। সমদ্রে পাওয়া যায়।”

খালা আর কথা বাড়ালেন না। মাছটা কুটতে লাগলেন। এদিকে আন্টি মাছ কুটা কিছুক্ষণ দেখে আমাকে হুইল চেয়ার টেনে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে হুইল চেয়ার থামিয়ে বললেন

” এটা হলো নীলের রুম।”

কথাটা শুনতেই আমি এবার মনোযোগ দিয়ে চারপাশে তাকালাম। পুরো ঘরে ছোটো ছোট ইনডোর প্ল্যান্ট দিয়ে সাজানো। রুমে বেশি আসবাপত্র নেই। একটা খাট। খাটের পাশে একটা ছোটো ল্যাম্প। অন্য পাশটায় আলমিরা। তার কিছুদূর বিস্তৃত খালি জায়গা। তারপর বড়ো একটা টেবিল। সেখানে টাওয়ারের মতো থরে থরে সাজানো বই। পুরো ঘরটার আনাচে কানাচে গাছ আর গাছ। বুঝায় যাচ্ছে নীলের গাছের প্রতি এক অদ্ভুত মায়া আছে। এর মধ্যেই আন্টি বলে উঠলেন

“ছেলেটা আমার গাছ অনেক ভালোবাসে। কিন্তু মসিবতে পড়েছি এক জায়গায়। বিয়ে করতে চাই না। আমার এক বান্ধবীর মেয়ে আছে নাম লিনা। ওর কথা নীলকে বলেছিলাম সে রাজি হচ্ছে না। তোমার সাথে নীল কথা বললে লিনার কথা একটু বলো তো মা। মেয়েটা বেশ ভালো। আমার পছন্দ হয়েছে অনেক। নীল সায় দিলেই বিয়ের পর্ব সেড়ে ফেলব।”

আন্টির কথা শুনে ভেতরে ভেতরে হেসে বললাম

“লিনার কথা তো বলবই তবে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য না বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য।”

ভাবনার রেশ বেশি বিস্তৃতি না নিয়ে আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম

“রাজি কেন হয় না। উনার কী কোনো পছন্দ আছে?”

“পছন্দ ছিল। বিয়েও ঠিক করেছিলাম। তারপর যে কী হলো বুঝতে পারিনি। ওরাই বিয়েটা ভেঙে দিল। এরপর নীলের সামনে মেয়েটার নাম নিলে রেগে যায়। আর মেয়ের পরিবারও দূরে সরে যায়। আর যোগাযোগ নেই। আর নীলও এরপর বিয়ের ব্যাপারে কিছু বললে রাজি হয় না। বয়স তো কম হলো না। ৩৬ পার হয়ে ৩৭ এ পা দিচ্ছে। তবুও বিয়েতে রাজি হচ্ছে না।”

নীলের বয়স শুনে অনেকটায় চমকে গেলাম। নীলকে দেখে বুঝা যায় না ৩৭ বছরের কোনো বুড়ো। মনে হয় ২৮ বছরের যুবক। কী অসম্ভব ফিগার সে সাথে উচ্চতার সন্নিবেশ। সবমিলিয়ে নীলকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। আর ব্যক্তিত্বের কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন অনুভব করছি না।

আমি আন্টিকে হাসি মুখে বললাম

“ভাইয়ার সাথে আমার কথা হলে আমি লিনার কথা তুলব।”

ঘড়ির কাটায় ১০ টা। কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসলো। দরজা খোলার পর বুঝলাম বাবা আর নিরা এসেছে। নিরা এসে আমাকে দেখে অনেকক্ষণ হেসেছে। কী ভেবে হেসেছে জানি না। তবে তার হাসিতে কিছুটা রহস্য তো আছেই সেটা অনুধাবন করতে পারছি। বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

“এখানে কোনো সমস্যা হলে বলিস। আর তোর আন্টিকে কিছু লাগলে সরাসরি বলবি।”

আমি মাথা নেড়ে গেলাম। অনেকটা মেঘ না চাইতে জলের মতো। নীলের এত কাছাকাছি থাকতে পারব এটাই তো আমার সৌভাগ্য। সমস্যা তো হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং খুশিতে নাচতে মন চাচ্ছে। নাচতে নচতে এবার কোমরটাও ভেঙে ফেলতে মন চাচ্ছে যাতে করে নীলের বাসায় না বরং নীলের কোলে আজীবনের জন্য থাকতে পারি। নিরা হাসির লিরিক টেনে বলল

“তোকে দেখলেই আমার প্রেমিকা প্রেমিকা লাগে। কেন লাগে জানি না। ”

নিরা দশম শ্রেণীতে পড়ে সবে৷ সবকিছুতেই এ বয়সের মেয়েরা প্রেম খুঁজে বেড়ায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আমি নিরাকে কিছুটা ধমক দিয়ে বললাম

“বেশি পাকনা হয়ে গেছিস। ঝেঁটিয়ে পাকনামি দূর করব।”,

কে শুনে কার কথা। সে তার মতো হাসতে হাসতেই বিদায় নিল। বাবাও কিছুক্ষণ আংকেল আন্টির সাথে গল্প করে চলে গেল।

বেলা বাজে বারোটা। কলিং বেলে আবারও আওয়াজ আসলো। আন্টি গোসল খানায় আংকেল বাইরে। মাজেদা খালা দরজা খুলে আমাকে ডাকতে লাগলেন

” আঁচল মামনি একটু এদিকে আসো তো কে জানি তোমারে চায়।”

আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম কে আমাকে ডাকছে এটা ভেবে। হুইল চেয়ার টেনে দরজার পাশে ছুটে গিয়ে কিছুটা অবাক হলাম। একজন সুন্দরী রমণী দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে আগে দেখেছি বলে মনে হয় না। তবে উনি আমার কাছে কী চায় সেটাই ভাবতে লাগলাম।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here