“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ১৪

0
774

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
কাইয়ুম ভিলায় প্রবেশ করতে রহিমার বুক ধুকপুক করছে। গতকাল যা হয়েছে তার উপর সবাই ক্ষেপে আছে! আজ যদি আক্রমণ করে বসে তখন কি হবে! তাকে কি আর এ বাড়িতে কাজে রাখবে!
ধুর! না রাখলে নাই! যা পাওনা আছে তা নিয়া বিদায় হবে। এ বাড়ি থেকে কাজের ছুটি পেলেই তার শান্তি। হোক অন্যত্র বেতন কম। তবুও মনের শান্তি বড় শান্তি। এখানে থাকা মানেই ঝামেলায় জড়িয়ে থাকা। ভালো লাগে না আর ঝামেলা!
ভাবতে ভাবতে প্রবেশ করেই ফেললো বাড়িতে। মারিয়া তাকে সেসব বিষয়ে কিছুই বলেনি। তবে মুখখানা গম্ভীর। রহিমা চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। আয়ানকে বাড়িতে দেখতে পায়নি আজ। কাইয়ুম সাহেবও নেই বাড়িতে। আয়মান পরশুদিন চলে গেছে। এখন শুধু সায়ান, পিংকি আর মারিয়া কাইয়ুম বাড়িতে। সকালের নাস্তার জন্য রুটি আর সবজি ভাজি করে নিয়েছে মারিয়া। তাই রহিমাকে রান্নার কাজে হাত লাগাতে হলো না। সে ঘর ঝাড়ু দিতে লাগলো। আয়ানের রুম ঝাড়ু দিতে এলে দেখলো বিছানা এলোমেলো। সে বিছানা ঠিক করে ঝাড়ু দিতে লাগলো। খাটের তলায় ঝাড়ু লাগতেই শব্দ হলো কিছুর। রহিমা ঝাড়ু দিয়ে বের করে এনে দেখলো একটা টিনের বোতল! ক্যাপ খোলাই আছে। এটা কিসের বোতল তা বুঝতে নাকের কাছে নিলেই বিশ্রি গন্ধ অনুভব করতে পারলো! রহিমা বোতলের উপর বড় অক্ষরে লেখা মুখুস্ত করে নিলো। পরক্ষণে বোতল যথাস্থানে রেখে দিলো। সারাদিন কাজ করলো আর অক্ষরগুলো মনে মনে যপতে লাগলো মুখুস্ত থাকার জন্য। পরক্ষণে দুপুরে চলে এলো হক মঞ্জিলে। আসার সময় মারিয়া তেজি কন্ঠে বলে দিলেন তাদের ব্যাপারে কোনো কথাবার্তা যেন বাইরে প্রকাশ না করে!
কিন্তু আয়ানের ব্যাপারটা তো সে জানাবেই সায়মাকে! এবাড়ি আজ জনশূন্য! বেশ কিছুক্ষণ কলিং বেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিলো সায়মা৷ রহিমা ভেতরে প্রবেশ করেই বললো,
“আম্মা বাড়িতে নাই?”
“না।”
“কই গেছে?”
“মামা বাড়িতে গেছে।”
“ভাবিও?”
“হ্যাঁ। সবাই।”
“আপনে যান নাই ক্যা?”
“তোর ছুটি কাটাতে হলে চলে যা তুই।”
“না, যাইতাম না। মামা বাড়িত কোনো প্রোগ্রাম আছে? সবাই গেলো যে!”
“প্রোগ্রাম আর কি! ওই বদমাইশ উঠেপড়ে লেগেছে! আর তার পক্ষপাতি হয়ে এখন মামা খালা সবাই। এসব ব্যাপার নিয়ে বলতেই বাবা মাকে ডেকেছে মামা। আর ভাইয়া বউ বাচ্চা নিয়ে দেশে এসেছে সেই উদ্দেশ্যে ছোটখাটো আয়োজনও আছে।”
“ওহ্! আচ্ছা!”
রহিমা কিচেনে যেতে লাগলে সায়মা বললো,
“আজ ওদিকে কোনো কাজ নেই। বাসায় না গেলে চল আড্ডা দেই আর টিভি দেখি।”
অত:পর ড্রয়িং রুমে তারা বাংলা নাটক দেখতে শুরু করলো। দুজন টিভি দেখে হাসতে হাসতে অস্থির! টিভি দেখায় জমে গিয়ে আয়ানের ব্যাপারটা ভুলেই গেছে রহিমা। সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখনো ফিরেনি সায়মার বাড়ির লোকজন। ফারহানা কল করে জিজ্ঞেস করলো রহিমা চলে গেছে নাকি। উত্তরে না জানালে তিনি বললেন তাদের আসতে একটু দেরি হবে। আর ইশতিয়াক আর এলেন থেকে যাবে মামা বাড়ি। অনেকদিন হলো মামা বাড়ি বেড়ায় না সে। তাই মামা মামি জোর করে রেখে দিতে চাইছেন তাদের। কিন্তু সায়মাকে বাড়িতে রেখে যাওয়ায় মিস্টার ও মিসেস হক চলে আসবেন। রহিমা যেন একটু অপেক্ষা করে৷ অর্থাৎ সায়মাকে একা রেখে না যায়। পরে তারা বাড়ি ফিরে এলে সায়মার বাবা রহিমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবেন নতুবা রহিমা চাইলে আজ থেকে যাবে।
কল কেটে দিলে সায়মা রহিমাকে থেকে যাওয়ার জন্য বললো। কিন্তু তেমন জোর দিলো না। কারণ ওদিকে তার মা অসুস্থ। যদি প্রয়োজন হয়! তবে রহিমাকে রেখে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশিত হলো সায়মার মাঝে। রহিমার ইচ্ছে করছে সায়মার ইচ্ছা পূরণ করতে। কেননা সায়মা একবার তাকে রিকুয়েষ্ট করেছে থাকার জন্য। সায়মার কাছে কারিমার ফোনের নম্বর আছে। রহিমা কল করলো ওদিকের খবর নেওয়ার জন্য। কারিমাকে বললো,
“মায়ের শরীরটা কি ভালো?”
“হু।”
“আমার আসতে দেরি হইবো। রান্নাবান্না বসায় দে। ভাত রান্না কর সাথে আলুর ভর্তা আর ডাল। মা রে জোর কইরা খাওয়াইছ। আর ওষুধ খাওয়াতে ভুলিস না। তার আগে যদি আমি ফিরি তো ফিরলাম ই। আর না ফিরলে না-ও ফিরতে পারি। পরে জানামু। প্রয়োজন পড়লে ফোন দিস।”
“আইচ্ছা।”
কল কেটে দিলো রহিমা। সায়মা বললো,
“প্রতিদিন কি ডাল আর আলুর ভর্তাই খেয়ে থাকিস?”
“গরিব মানুষ। গরিবের খাবার আর কি হইবো আপা! ডালই হইলো গরিবের মাংস।”
“তাই বলে মাছ মাংস একদমই না?”
“আরে, হ। খাই মাঝে মাঝে।”
অত:পর তারা দুজন এদিকে রান্নার ব্যবস্থা করতে লাগলো। সারাদিনে এ পর্যন্ত মনে না পড়লেও এখন হুট করেই রহিমার মনে হয়ে গেলো আয়ানের কথা! রহিমা ইতস্তত বোধ করে বললো,
“আপা, ‘বি ই এ আর’ এ কি হয়?”
“বি ই এ আর! বিয়ার।”
“বিয়ার কি?”
“ভাল্লুক।”
“বোতলের ভেতর ভাল্লুক থাকে!”
“মানে?”
“একটা টিনের বোতলের উপর লেখা ছিলো।”
“তাহলে সেটা ভাল্লুক নয়। মাদক দ্রব্য।”
“মাদক! ভাইজান মাদক সেবন করে! ইছ! কি বিশ্রী গন্ধ! আল্লাহ!”
“ভাইজান মানে!”
“একটা কথা বলি। রাগ কইরেন না। আপনে ভাইজানের বউ তাই বলতাছি আপনার কাছে। সকালে ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়া খাটের নিচ থেকে বোতল পাইছি৷ নাকের কাছে নিতেই নাড়িভুড়ি উল্টায় গেছে! পরে জিনিসটা কি তা জানার জন্য সারাদিন অক্ষর গুলা মুখুস্ত করছি। একবার চাইছিলাম গোলাপি ভাবির কাছে জানি। কিন্তু যেই বাজে গন্ধ, যদি খারাপ কিছু হয়! তাইলে তো ভাবি আবার খোচাইয়া খোচাইয়া ঘটনা বাইর কইরা ছাড়বো যে আমি এইটা কই দেখছি আর পড়ছি। তাই আর জিজ্ঞেস করি নাই।”
“আয়ানের রুমে পাওয়া বোতল থেকে তুই সত্যিই এই লেখাটা পড়েছিস?”
“কইলাম না, সারাদিন মুখুস্ত করছি!”
সায়মা আয়ানকে কল করতে যাচ্ছিলো। পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে সে তার মায়ের কাছে কল করলো।
“মা, তোমরা রওনা দিয়েছো?”
“না, কিছুক্ষণের মধ্যেই দিবো।”
“কতদিন পর গেলে, মামারা যেহেতু বলছে থেকে যাও সেখানেই। রহিমা আছে আমার সাথে।”
“না। তোকে একা রেখে থাকবো নাকি। তুই এলে তো আর এতো টেনশন হতো না।”
“এতো টেনশন করো না তো। খালামনিরা যেহেতু আছে তুমিও থেকে যাও। বাবাকেও আসতে হবে না। তাছাড়া আমি একা না। রহিমা আছে আমার সাথে। এছাড়াও তোমাদের মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে। ভয় পায় না একা থাকতে।”
“হু! তোর বাবাকে বললে এখন রাগ করেই চলে যাবেন। বিকেলে বলছিলো আমাকে থাকতে আর তিনি চলে যাবেন।”
“ধুর! বাবার কাছে ফোন দাও। আমি বুঝিয়ে বলি। তুমিও এসো না, বাবাকেও আসতে দিও না। এক রাতেরই তো ব্যাপার।”
অত:পর সায়মা তার বাবাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করালো। তার বাবা তাকে ও রহিমাকে সবদিক থেকে সতর্ক করে দিলেন। এরপর আয়ানের কাছে কল করলো সায়মা। আয়ান ফোন রিসিভ করছে না। সে জেদ করে ফোন রেখে দিলো। চুপচাপ রান্না করতে লাগলো সে। চোখে অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে। রহিমা জিজ্ঞেস করলো,
“আপা, আপনে কাঁদেন ক্যা!”
“রহিমা, এটা নাড়া দে তো। আমি আসছি।”
সায়মা চলে গেলো। রহিমা তরকারি নাড়তে লাগলো। নিজেকে শান্ত করে হাতমুখ ধুয়ে প্রায় দশ মিনিট পর সায়মা আবার কিচেনে এলো। এক প্যাকেট নুডলস রান্নার ব্যবস্থা করলো সে। রান্না শেষ করে সন্ধ্যায় টিভি দেখতে দেখতে তারা দুজন নুডলস খেলো। রহিমা আবার কারিমার কাছে কল করে বলে দিলো সে আজ ফিরবে না। তাছাড়া মায়ের সাথেও কথা বললো।
ইশার নামাজ পড়ে দুজনেই ডিনার সাড়লো। খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে আয়ানের কল এসেছিলো। সায়মা রিসিভ করেনি। আয়ান একের পর এক কল করে যাচ্ছে। সায়মা ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে। সুইচ অফ করে দিতো কিন্তু মা বাবা একটু পরপর কল করছে বিধায় সুইচ অফ করেনি।
আয়ান বুঝতে পেরেছে সে রাগ করেছে৷ তাই বারবার কল করার পাশাপাশি সে এস এম এস করলো, “সরি। আব্বুর সাথে মাগরিবের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম মসজিদে। তখন যে সাইলেন্ট করেছিলাম আর নরমাল করতে মনে নেই। কারণ নামাজের পর আব্বুর সাথে জরুরী মিটিং করতে বসেছিলাম আমাদের বিয়ের ব্যাপারে। তারপর আবার আব্বুর সাথে ইশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে ফ্রেন্ডের সাথে দেখা। বেশি না, অল্প একটু আড্ডা দিয়েছিলাম। তারা আমাকে ছাড়তেই চাইছিলো না তাই ইতুপাখিটার সাথে কথা বলতে পারিনি। এখন তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম আমার ইতুপাখিটা কল করেছে আমাকে! রিসিভ করো না গো একবার।”
মেসেজ দেওয়ার প্রায় বিশ মিনিট পর সায়মা সিন করেছে। তার পূর্বে ফোন হাতে নেয়নি। এর আগে ফোন হাতে নিয়ে শুধু কল লিস্ট চেক করে দেখেছিলো তার বাবা মা কল দিয়েছে কি-না! এখন মেসেজ পড়ার পর সে কল দিলো। সাথে সাথেই রিসিভ হলো। বুঝতে বাকি নেই আয়ান ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো। রিসিভ করেই আয়ান বলতে লাগলো,
“সরি ইতুপাখি। আমি তোমাকে কত্ত ভালোবাসি তা কি তুমি জানো না! শুধু একটু ভুলই তো করে ফেলি। বেশি কিছু তো না। তুমি তো জানোই, কত কষ্ট হয় যখন তোমার একটা কল মিসড হয়ে যায়।”
আয়ানের এই ন্যাকামো কথা সায়মার বিরক্ত লাগছে আর রহিমার প্রাণ জ্বালা করছে! ভুলের প্রায়শ্চিত্তে মনে মনে বলছে,
এই জীবনে আর কোনোদিন সে বড় লোকের প্রেমে পড়বে না। তাদের যে গোপনে বউ থাকে সেটা কি তার জানা ছিলো! কতই না পছন্দ করতো ছেলেটাকে! সে বকলে খারাপ লাগতো কিন্তু কখনো তাকে উল্টো বকা দিতো না। সে কখনো কখনো আঘাত করতো, তবে ব্যাথা লাগলেও কষ্ট লাগতো না! তার সকল দুষ্টুমি সহ্য করে নিতো হাস্যকর ভাবে। কখনো খারাপ লাগেনি তার দুষ্টুমি। তখন খুব ভালো লাগলেও এখন মন খুব কাঁদে সেই দুষ্টুমি মনে হলে। এখন আর সহ্য হয় না তার কথাবার্তা। তখন প্রেমের দৃষ্টিতে জবাব দিলেও এখন বাধ্য হয়ে জবাব দেয়! মাঝে মাঝে প্রাণ জ্বালা করে তাদের স্বামী-স্ত্রীর অগোছালো দুষ্ট মিষ্টি সংসার দেখলে!
এদিকে আয়ানকে থামিয়ে সায়মা বললো,
“এখন কোথায় আছো তুমি?”
“রাস্তায়।”
“এই মুহুর্তে আমার বাসায় এসো।”
“হা হা হা বউ কি রান্না করে বসে আছে আমার জন্য যে এতো জরুরী তলব!”
“ফাজলামো রাখো আর এই মুহুর্তে এসো। নতুবা খুব খারাপ হবে!”
“কি বলছো এসব! তোমার বাবা আর ভাই আমাকে ঝাঝড়া করে ফেলবে।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না। এখন আসতে বলেছি তো আসবে। বাসায় কেউ নেই। তারাতাড়ি এসো। দশ মিনিটের মধ্যে আসবে। নতুবা আমি এই রাতে বেরিয়ে যাবো তোমার বাসার উদ্দেশ্যে।”
কথাটা বলেই কল কেটে দিলো সায়মা। শেষ কথায় সায়মার গলা ধাধিয়ে এসেছে যা স্বাভাবিক মনে হয়নি আয়ানের কাছে। কল ব্যাক করলেও রিসিভ হলো না। তাই সে দ্রুতই রওনা হলো সায়মার বাড়ির উদ্দেশ্যে। দশ বারো মিনিটের মধ্যেই সে হাজির।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here