বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ২২,২৩,২৪
আমিরাহ্ রিমঝিম
পর্ব – ২২
নাফিদের সাথে নিয়মিতই কথা হয় রাইসার। প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর মেসেঞ্জারে কল দেয় নাফিদ। পাঁচ সাত মিনিটের বেশি কোনদিনই কথা আগায় না।
চাচার বাসায় আগে কিছুদিন পরপর গেলেও এখন প্রতিদিনই যায়। আধা ঘন্টার জন্যে হলেও যায়। আগে শুধু চাচার বাড়ি ছিলো, এখন তো সেটা ওর শ্বশুড়বাড়িও। গিয়ে দাদীর সাথে গল্প করে, রান্নাও করে মাঝেমধ্যে। কখনো কখনো টুকটাক কাজে হাত লাগায়।
নাফিদ আগের মতোই প্রতি সপ্তাহে আসে। শুক্রবার ভোরে এসে পৌঁছায়, আবার রাতের বাসে ফিরে যায়। শুক্রবার সারাদিন চাচার বাসায়ই কাটে রাইসার, বিকেলবেলা বাসায় আসে।
…….
মেয়েদের কমনরুমে জোহরের নামাজ আদায় করে সবেই পকেট জায়নামাজটা ব্যাগে রেখেছে রাইসা। তখনি কারো ডাক শুনতে পায়।
— রাইসা…
ডাক শুনে পেছনে তাকিয়ে চমকে যায় রাইসা। লাবণ্য হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্ময়ে মুখ দিয়ে কথা বের হয়না রাইসার।
— কেমন আছো?
রাইসা নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে জবাব দেয়-
— আসসালামু আলাইকুম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?
— এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আসলে আমার এক ফ্রেন্ড এখানের স্টুডেন্ট ছিলো তো, ওর কিছু কাগজপত্র তুলতে হবে। আমাকে সাথে করে নিয়ে আসলো। হাহাহা……
লাবন্যর সাথে তাল মিলিয়ে রাইসাও কিছুটা হাসে। লাবন্য আবার প্রশ্ন করে-
— এই তুমি কি দুপুরে লাঞ্চ করেছো?
— হ্যাঁ, খেয়েছি?
— আচ্ছা তাহলে চলো আইস্ক্রিম খেতে খেতে কথা বলি। আমার ফ্রেন্ডের দেরি হবে মনে হচ্ছে।
রাইসাকে এক রকম জোর করেই নিজের সাথে একটা ক্যাফেতে নিয়ে গেলো লাবন্য। দুইজনের জন্য আইসক্রিম অর্ডার করে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলো। রাইসা বুঝতে পারছে না ওর আসলে ব্যাপারটায় কেমন লাগা উচিত। লাবন্যের সাথে দেখাটা কিছুদিন আগে হলেও রাইসা অনেক খুশি হতো। কিন্তু পরিস্থিতিটা এখন আলাদা। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে রাইসার। এমন না যে সে লাবন্যকে দেখতে পারে না, লাবন্যকে সে আগেও পছন্দ করতো এখনো পছন্দ করে, তবুও…
— তোমার সাথে দেখা হয়ে গিয়ে ভালোই হলো। আর কখনো দেখা হবে কি হবে না বলা যায় না। কিছুদিন পরেই অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি আমি।
আইস্ক্রিম খেতে খেতে বলে লাবন্য। রাইসা কৌতুহলি হয়ে তাকায়। লাবন্য হেসে ফেলে রাইসাকে এভাবে তাকাতে দেখে। তারপর হঠাৎ কি মনে হতে জিজ্ঞাসা করে,
— আচ্ছা তোমার কি অবস্থা বলো তো? শুধু তো আমার কথাই বলে গেলাম একনাগাড়ে। বিয়ে শাদী করেছো নাকি?
রাইসা মৃদু কন্ঠে বলে,
—হ্যাঁ
লাবন্য উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। বিয়ের কথাটা সে আন্দাজেই জিজ্ঞাসা করেছিলো। এভাবে তীর ঠিক নিশানায় লেগে যাবে বুঝতে পারেনি। খুশি হয়ে বলে,
— ওয়াও! তাই নাকি? ছেলে কে? নাম কি? পরিচয় করাবেনা?
— নাফিদ।
উত্তরটা দিয়ে রাইসা মাথা নিচু করে ফেলে।
লাবন্যর ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগে যায়। যখন বুঝতে পারে নিমেষেই মুখের হাসিটুকু উধাও হয়ে যায়। হাতের চামচটা আইস্ক্রিমের বাটির উপর রেখে বাইরে তাকিয়ে থাকে। অস্বস্তিকর একটা অবস্থার সৃষ্টি হয় সেখানে।
…….
রাইসাকে ব্যাগ নিয়ে করিডোর দিয়ে হাটতে দেখে তিন্নি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার পাশাপাশি হাটতে শুরু করে। তিন্নিকে নিজের পাশে বুঝতে পেরে রাইসা একবার তাকায়, বলেনা কিছু।
— তোকে আমি সেই কখন থেকে খুজছি। কোথায় ছিলি তুই? মাত্র ভাবছিলাম যে কল দেবো তোকে।
— লাবন্য আপুর সাথে দেখা হয়েছিলো। আপু আইস্ক্রিম খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলো।
— কোন লাবন্য আপু?
তিন্নি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করে। লাবন্য নামের কাউকে সে তো চেনে না, রাইসার কোন আপুর নাম আবার লাবন্য? হঠাৎ খেয়াল হতেই বিস্মিত হয়ে বলে,
— লাবন্য আপু মানে কি লাবন্য….. মানে নাফিদ ভাইয়ের…….
রাইসা উত্তর দেয় না। মলিন মুখে কিছুক্ষণ তিন্নির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার সামনে হাটতে শুরু করে। মনটা ভীষণ খারাপ তার।
…….
রাতের বেলা শুধু শুধুই লাবন্যের আইডিতে গিয়ে ঘুরঘুর করে রাইসা। নিজের হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি দেয়া প্রোফাইল পিকচারে। লাবন্যের চেহারা একটুও বদলায় নি, সেই অনেক বছর আগে যে প্রথমবার দেখেছিলো সেরকমই আছে।
দুপুরের ঘটনাটা এখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রাইসার। ওর বিয়ে আসলে নাফিদের সাথে হয়েছে জেনে প্রথমটায় লাবন্য একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলো। ব্যাপারটা হজম করতে কিছুটা সময় লেগেছিলো, কিন্তু এরপরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছিলো লাবন্য। অন্যদিকে রাইসার হাবভাবেই বুঝা যাচ্ছিলো ও স্বাচ্ছন্দবোধ করছে না। তাই কথা আর বেশিদূর আগায় নি।
নিজের কাজে নিজের উপরই বিরক্ত রাইসা। দুপুরে তার হয়েছিলোটা কি? এমন কেন করলো সে? অপরাধবোধ হচ্ছে খুবই। তার সাথে সম্পর্ক রাখার তো দরকার নেই, তাই বলে এরকম ব্যাবহার করবে নাকি?
ফোনের কন্টাক্টস এ গিয়ে লাবন্যর নম্বর বের করলো রাইসা। নম্বরটা এখনো ফোনে সেভ করা আছে। কল দিলো লাবন্যর নম্বরে।
একবার রিং হতেই লাবন্য কল রিসিভ করলো। হাসিমুখে বললো,
— হ্যালো রাইসা?
— আসসালামু আলাইকুম লাবন্য আপু, কেমন আছেন?
— ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?
এক গাল হেসে জবাব দিলো লাবন্য।
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপু আসলে…. আসলে….
রাইসা দম ফেলে কথা গুছিয়ে নেয় মনে মনে, তারপর আবার বলে-
— দুপুরে আপনার সাথে এরকম আচরণ করা আমার একদমই উচিত হয়নি। আমি খুবই সরি আপু। আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না। নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত আমি।
লাবন্য আবারো হাসে। বলে-
— ঠিক আছে রাইসা। এটা নিয়ে এতো আপসেট হওয়ার কিছু নেই। কিছু মনে করিনি আমি।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বিদায় নিয়ে কল কাটে রাইসা। এবার শান্তি লাগছে।
( চলবে ইনশাআল্লাহ )
বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ২৩
আমিরাহ্ রিমঝিম
মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠতে না উঠতেই নাফিদের ফোন বেজে উঠে। জায়নামাজ ভাজ করে রেখে ফোন হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার।
— আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
— ওয়ালাইকুমুসসালাম। নাফিদ ভাই, আমি ইমদাদ।
— ইমদাদ?
নাফিদ অবাক হয় খুব। ইমদাদ কেন ফোন করেছে? নিজের অবাক ভাব গোপন রেখে প্রশ্ন করে-
— হ্যাঁ ইমদাদ ভালো আছো? হঠাৎ ফোন দিলে যে।
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আসলে আপনাদের একটা স্বর্ণের হার আমাদের দেয়া গয়নাগুলোর সাথে চলে এসেছে। সেজন্যই আসলে। আপনার সাথে কি আগামীকাল সকালে দেখা করা যাবে?
নাফিদের মনে পড়লো ইমদাদের বাসা থেকে দেয়া গয়নাগুলোর সাথে রাইসার বাবার দেয়া একটা হারও তারা নিয়ে গিয়েছিলো। রাইসার সাথে বিয়ের পরদিন কথাটা জেনেছিলো নাফিদ।
— আগামীকাল সকালে ছয়টা-সাতটার দিকে হয়তো গিয়ে পৌঁছাবো আমি, তখন দেখা করতে পারবে।
— ঠিক আছে নাফিদ ভাই, তাহলে সাক্ষাতে বিস্তারিত কথা হবে ইনশাআল্লাহ। আসসালামু আলাইকুম।
— ওয়ালাইকুমুসসালাম।
ইমদাদের সাথে কথা বলার মাঝেই নাফিদের কাছে কল আসছিলো। ইমদাদ কল কাটার পরই আবারো ফোন বেজে ওঠে। নাফিদের অনেক পুরনো এক বন্ধুর ফোন। হাসিমুখে কল রিসিভ করে নাফিদ।
…..
একটু পরপর ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখছে রাইসা। পড়তে বসলেও পড়ার দিকে কোনো মনযোগ নেই, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নাফিদের কলের জন্য। প্রতিদিন এই সময়টাতেই কল দেয় নাফিদ। পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি এদিক সেদিক হয়না কখনো। আজ আধা ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে। অনলাইনেও তো নেই। ঘুমাচ্ছে নাকি? নাকি এখনো ফেরেই নি অফিস থেকে?
রাইসা একবার ভাবে সে নিজেই ফোন দিবে আজকে। আবার ভাবে না থাক, যদি ঘুমিয়ে থাকে? ফোন পাশে রেখে পড়ায় মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু চোখ বারবার ফোনের দিকে চলে যাচ্ছে, একটু পরপর ফোন হাতে নিয়ে চেক করছে নাফিদ অনলাইনে এসেছে কিনা। কিন্তু প্রতিবারই নাফিদকে অফলাইন দেখাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত ঠিক করে আজকে সে নিজেই কল দিবে নাফিদকে।
নিজে থেকে নাফিদকে কল দেয়ার কথা ভাবতেই রাইসার হৃৎপিন্ড যেন দ্বিগুন গতিতে লাফাতে শুরু করলো। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কাপা কাপা হাতে ফোনের কন্টাক্টসে গেলো। নার্ভাস লাগছে খুবই। মনযোগ দিয়ে নাফিদের নম্বর খুঁজতে শুরু করলো।
রাইসার নার্ভাসনেস অবশ্য বেশিক্ষণ রইলো না, কারণ ফোনে সে নাফিদের নম্বর খুঁজেই পেলো না। এতোক্ষণে রাইসার খেয়াল হলো তার ফোনে নাফিদের নম্বর ছিলোই না কখনো।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো রাইসার। ধুর! বিয়ের আগে নাহয় নম্বর ছিলো না, বিয়ের পর তো সেভ করে রাখা উচিত ছিলো। রাইসা একবার ভাবে মায়ের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে আসবে। কিন্তু মায়ের কাছে গিয়ে নাফিদের নম্বর চাওয়ার কথা ভাবতেও লজ্জা লাগছে খুব। নাফিদের কাছেই চাইবে নাকি? নাহ, এই বুদ্ধিও মনমতো হয়না রাইসার।
এক কাজ করলে কেমন হয়? নাফিসা আপুর কাছে তো চাওয়াই যায়।রাইসা এটাই ঠিক করলো। নাফিসার কাছ থেকেই নাফিদের নম্বর নিয়ে রাখবে।
আবারো মেসেঞ্জারে যায় রাইসা। নাফিসাকে মেসেজ দেয়ার আগে আবার চেক করে নাফিদ অনলাইনে আছে কিনা। হ্যাঁ, নাফিদকে এবার অনলাইনে দেখাচ্ছে। রাইসা ফোনের দিকে তাকিয়ে নাফিদের কলের অপেক্ষা করে আর মনে মনে সময় গুনতে থাকে। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড, চার…
চার সেকেন্ড হওয়ার আগেই নাফিদের কল আসে। রাইসা প্রায় সাথে সাথেই কল রিসিভ করে সালাম দেয়।
— আসসালামু আলাইকুম।
নাফিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় কিছুটা। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
— ওয়ালাইকুমুসসালাম। ফোন কি হাতে নিয়েই বসে ছিলি নাকি?
রাইসা লজ্জা পেয়ে যায়। এখন নাফিদকে কিভাবে বলবে যে ও সত্যি ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো, নাফিদের কলের অপেক্ষা করছিলো?
রাইসার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে নাফিদ প্রশ্ন করে,
— পড়তে বসিসনি এখনো?
— হ্যাঁ পড়তে বসেছি তো। আপনি কি ঘুমাচ্ছিলেন?
— না, কেন?
— অন্যদিন তো আরো আগে কল করেন, ভাবলাম আজকে ঘুমিয়ে গিয়েছেন নাকি…
— আমার এক বন্ধুর কল এসেছিলো, তার সাথে কথা বললাম অনেকক্ষণ।
— ওহ আচ্ছা…
তারপর নাফিদ আরো টুকিটাকি অনেক কথা বলে, চাচা-চাচি, রাকিব,রাহিব,রাইসা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করে, রাইসার পড়ালেখা কেমন চলছে জানতে চায়। এগুলোই তাদের দৈনন্দিন কথাবার্তা। তবে আজ সবার খোঁজ খবর নেয়া শেষে আরো একটা কথা জিজ্ঞাসা করে যেটা নাফিদ আগে কখনো করেনি।
— কাল তো ইনশাআল্লাহ বাসায় যাবো। তোর জন্য নিয়ে আসবো কিছু?
রাইসা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
— না, কিছু আনতে হবে না।
— আচ্ছা রাখি তাহলে আজকে?
— শুনুন…
— হ্যাঁ বল?
রাইসা বলবেনা বলবেনা করেও শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলে-
— আপনার নম্বরটা দেয়া যাবে?
— আমার ফোন নম্বর?
— হ্যাঁ।
— আচ্ছা ঠিক আছে। আমি মেসেজে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
কল রাখার পর রাইসা খেয়াল করলো আজকের কল ডিউরেশন তেরো মিনিট সাতাশ সেকেন্ড দেখাচ্ছে। রাইসা নিজেই অবাক হয়ে গেলো। এতোক্ষণ কথা বললো আজকে দুইজন?
নাফিদের মেসেজ থেকে দ্রুত নম্বর নিজের ফোনে সেভ করার পর রাইসার খেয়াল হলো সে তো মায়ের কাছ থেকে অনায়াসেই নম্বর নিতে পারতো। মায়ের ফোন থেকে নম্বর নিয়ে নিজের ফোনে সেভ করে নিতো। মাকেও বলতে হতো না আর নাফিদের কাছেও নম্বর চাইতে হতো না এভাবে। রাইসার মনে প্রশ্ন জাগে, সে কি আগে থেকেই এরকম বোকা নাকি ইদানিং হচ্ছে?
…..
নাফিদ ভালো করেই জানে রাইসা যে আজ ওর কলের জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলো। প্রথম বিয়ে তো আর না এটা নাফিদের! একটা নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত হাতে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে নাফিদ। রাত এগারোটায় বাস।
স্বামী হিসেবে রাইসাকে নিজে থেকে এখনো কিছুই দেয়া হয়নি নাফিদের। তাই ভেবেছিলো এবার কিছু নিয়ে যাবে রাইসার জন্য। কিন্তু এখন এতো তাড়াহুড়ায় কি কিনবে? তারচেয়ে ঢাকায় গিয়েই কিনবে কিছু, ভাবে নাফিদ।
( চলবে ইনশাআল্লাহ )
বৃষ্টি শেষে
পর্ব – ২৪
আমিরাহ্ রিমঝিম
সূর্য পুরোপুরি ওঠেছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না, কারণ আকাশটা বিষন্ন মেঘে ধূসর হয়ে আছে। একদম গাঢ় কালো মেঘ নয়, সাদা তুলোর মতো মেঘও নয়। এমন মেঘ যে দেখে একটা আন্দাজ পাওয়া যায় বেলা বাড়লে বৃষ্টি নামতে পারে, তবে এখনি নয়।
ভোরের নীলচে আভার সাথে আকাশে মেঘের আচ্ছাদনে পরিবেশটা আরো নীলচে লাগছে। সেই সাথে ভোরের বিশুদ্ধতা মিশে মনটা একদম শান্ত হয়ে যায় যেন। চোখ বন্ধ করে সেই প্রশান্তি অনুভব করে নাফিদ। মন থেকে একটা শব্দ উচ্চারিত হলো, “সুবহানাল্লাহ”
বাস থেকে নেমে কাছের একটা মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে ইমদাদের জন্য অপেক্ষা করছে নাফিদ। সাথে আছে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাকপ্যাক, যেটা সবসময় ঢাকা-সিলেট যাতায়াতে নাফিদের সঙ্গে থাকে। রাস্তায় ধীরে ধীরে মানুষজন বাড়ছে। তবে দিনের ব্যস্ততা এখনো শুরু হয়নি।
দূর থেকে ইমদাদকে দেখা যাচ্ছে। বেশ দ্রুতপায়েই হেটে এগিয়ে আসছে। নাফিদ প্রথমে বুঝতে না পারলেও কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো ওটা ইমদাদ। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। একটা স্বর্ণের হার এভাবে শপিং ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে দেখে নাফিদের কিছুটা অবাকই লাগলো।
ইমদাদ এসেই বিনীত হেসে সালাম দিলো।
— আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন ভাই?
— ওয়ালাইকুমুসসালাম, আছি আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ভালো আছো?
ইমদাদের হাসি আরো চওড়া হলো, খুব খুশিমনে জবাব দিলো,
— জ্বী আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন।
পরমুহূর্তেই আবার চেহারা থেকে হাসিটুকু মুছে গিয়ে মুখ মলিন হয়ে গেলো ইমদাদের। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বললো,
— আমার পরিবার আপনাদের সাথে যে আচরণ করেছে, আমার পরিবারের জন্য আপনাদের যা অপমানিত হতে হয়েছে, এরজন্য আসলে কিভাবে ক্ষমা চাইবো আমি জানি না। সম্ভব হলে আমাদেরকে আপনারা ক্ষমা করে দেবেন।
নাফিদ চুপচাপ সব কথা শুনে গেলো। ইমদাদ তখনো মাথা নিচু করে আছে, তাকাচ্ছে না নাফিদের দিকে। মনে হয়না নাফিদ কিছু না বললে মাথা উচু করবে। কিন্তু নাফিদের চিন্তা ভুল প্রমাণিত করে ইমদাদ একটু পরেই মাথা তুললো। মুখে মৃদু সৌজন্য হাসি ফুটিয়ে হাতের ব্যাগটা নাফিদের দিকে এগিয়ে দিলো।
— ভাই, এই যে হারটা।
নাফিদ হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিলো। ইমদাদ আবারো বললো,
— এটা যে আমাদের দেয়া গয়নার সাথে চলে এসেছে তা কেউই তখন খেয়াল করেনি। আমার অর্ধাঙ্গিকে গহনা দেয়ার সময় খেয়াল করা হয় যে এই হার আমাদের বাড়ি থেকে বানানো নয়।
নাফিদের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।
— তুমি বিয়ে করেছো শুনে খুশি হলাম।
ইমদাদ লাজুক হেসে জবাব দিলো-
— জ্বী, সেদিনের এক সপ্তাহ পরেই আমার বিয়ে হয়। মাদ্রাসায় পড়েন উনি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
নাফিদের হাসি আরো চওড়া হলো। মনে মনে খুশি হলো খুব, আবার বেশ মজাও পেলো। ইমদাদের বাসার ইমদাদ বাদে কেউই ইসলাম পালনে গুরুত্ব দেয় না তেমন। এক রাইসা বিয়ের কতগুলো অনুষ্ঠান না করতে চাওয়ায় কত কাহিনী হলো, আর শেষ পর্যন্ত তাদের ছেলে বিয়ে করলো মাদ্রাসার মেয়েকে।
— হ্যাঁ ইনশাআল্লাহ। আর, আমার আসলে এখন যেতে হবে। সারারাত জার্নি করে এসেছি তার উপর এখন আকাশের অবস্থাও খুব একটা ভালো না।
— ঠিক আছে ভাই। সম্ভব হলে ক্ষমা করে দেবেন আমাদের। বাসার সবার পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাইছি আপনাদের কাছে। আর এই কথা আপনার পরিবারে জানাবেন। আপনার চাচার বাসাও জানাবেন।
— জানাবো ইনশাআল্লাহ। আর আমার চাচার বাড়ি এখন আমার শ্বশুড়বাড়িও। রাইসা আমার ওয়াইফ। সেদিন তোমরা যাওয়ার পর রাইসার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।
ইমদাদ প্রথমে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো, তারপর তার চেহারায় খুশির ঝলক ফুটে উঠলো।
— আলহামদুলিল্লাহ, এটাতো খুবই ভালো কথা।
নাফিদ হাসলো একটু। তারপর বললো,
— তা তো অবশ্যই। আর ইমদাদ, সেদিন কি হয়েছে না হয়েছে সেসব নিয়ে এখন কেউ মাথা ঘামায় না। তবে তোমার উপর অন্তত আমার কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগ নেই।
নাফিদ আর ইমদাদ দুইজন হাত মিলালো। নাফিদ গাড়ির জন্য দাড়ালো আর ইমদাদ যেভাবে হনহন করে হেটে এসেছিলো সেভাবেই হনহন করে হেটে চলে গেলো।
( চলবে ইনশাআল্লাহ )