“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ১৬

0
969

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
হক মঞ্জিলে রান্নাবান্না ও নাস্তা করে এবাড়িতে কাজে আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো রহিমার৷ নিত্যদিনের মতো আজও লাল মিয়ার মুখে ছিলো গান! ইদানীং এ যেন তার নেশা হয়ে দাড়িয়েছে। তা-ও গানের কি স্টাইল! যেন ছ্যাকা খেয়ে নেশা হিসেবে গান ধরেছে!
এদিকে কাজে দেরিতে আসায় পিংকির রাগারাগির সম্মুখীন হলো রহিমা! দোষ নিজের হওয়ায় চুপচাপ সহ্য করে নিলো। নতুবা আলাপির মা গোলাপিকে জিলাপি বানিয়ে দিতো! হ্যাঁ, রহিমা বাবুর নতুন নাম রেখেছে আলাপি। কারণ বাবুটা সারাক্ষণই কান্নাকাটি আর ঘ্যানঘ্যান করে! কিন্তু গোলাপিকে যেমন মনে মনে উচ্চারণ করে, আলাপিকেও ঠিক মনে মনেই উচ্চারণ করে সে।
আজ আর হক মঞ্জিলে যায়নি রহিমা। কারণ সায়মা আয়ানের সাথে ভার্সিটি যাবে। সেখান থেকে ঘুরতে যাবে। আর বাকি সদস্যরা দুপুরের পর বাড়ি ফিরবে। রহিমা আজ দুপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে এলো। মা একা আছে ঘরে সকালে পান্তাভাত খেয়েছিলো এরপর আর কিছু খায়নি! ঘরে পা দিলেই কারিমার প্রতি অতিরিক্ত মাত্রায় রাগ হয়! অসুস্থ মাকে সে পান্তা ভাত খায়িয়ে রাখলো কিভাবে! সে নাকি আবার দোকান থেকে পরটা এনে খেয়েছে! তবুও পারেনি ক’টা ভাত রান্না করতে! এখন ঘরে নেই বিধায় বেঁচে গেছে। নতুবা রহিমা কষিয়ে কয়েক ঘা লাগাতো! মেয়ে মানুষ, এতো বেখেয়ালি কেন থাকবে! সংসারের কাজগুলো টুকটাক করতে পারে না! হাড়িপাতিলও মাজেনি! স্কুলে চলে গেছে। নিজের রূপচর্চা নিয়ে পড়ে থাকতে পারে কিন্তু সংসারের কাজে না! যা চাইছে প্রায় সাধ্যমতো সবটাই পূরণ করার চেষ্টা করছে রহিমা। তবুও মেয়েটার একটু খেয়াল নেই মা বোনের প্রতি!
সেই সকালে নাকি বেরিয়েছে এখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তবুও কারিমার ফেরার খবর নেই। সারাদিন রহিমা বকাঝকা করতে করতে কাজকর্ম সারলেও এখন কিছুটা চিন্তা এসে ভীড় জমেছে মাথায়! মাগরিবের আযান পড়লো, রহিমা নামাজ পড়লো। কারিমা এখনও আসছে না! রহিমা তার মাকে একা ঘরে বসিয়ে রেখে সে টর্চ হাতে বেরিয়ে গেলো। কারিমার সহপাঠী পাশের বাড়ির লিমার কাছে এসে জানতে পারলো লিমা আজ স্কুলে যায়নি। তাই কিছু জানে না। তারপর কিছুদূরে আরও একজনের কাছে গেলো। তার কাছে গিয়ে জানতে পারলো দুপুরে কারিমা টিফিন টাইমে পালিয়ে জামশেদ নামের একটি ছেলের সাথে গাড়িতে উঠে গেছে। কোথায় গেছে তা আর জানে না সে। আর কয়েকমাস যাবত জামশেদের সাথে কারিমা প্রেম নামক সম্পর্কে জড়িয়েছে৷ প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সে ঘুরতে যায় তার সাথে। আজ তা প্রকাশ করে দিলো কারিমার বান্ধবী রত্না। রহিমার মাথায় যেন রক্ত জমে গেলো এসব শুনে! ছেলেটাকে চেনে সে। কিন্তু তার বোনটা যে এমন তা জানা ছিলো না! আজ তার কাছে পরিষ্কার, দিনরাত পড়াশোনার জন্য নয়! বরং জামশেদের সাথেই ফোনে খুচুরখুচুর চলতো!
কারিমার খোঁজে রহিমা দেরি না করে ছুটে গেলো জামশেদের বাড়িতে। হ্যাঁ কারিমা এখানেই আছে৷ কিন্তু যা দেখলো আর কারিমার মুখে যা শুনলো, তা প্রত্যাশিত ছিলো না কভু! কারিমা পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে জামশেদকে। জামশেদের ব্যাকগ্রাউন্ড তাদের থেকেও খারাপ হওয়ায় কারিমা জানতো তার সাথে বিয়ে দিবে না রহিমা ও তার মা। তাই সে পালিয়ে এসেছে। সে এখন থেকে তার শ্বশুর বাড়িতেই থাকবে। তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেন জবরদস্তি না করে রহিমা!
কারিমা কথাগুলো বলেছিলো তার শ্বাশুড়ির পেছনে দাড়িয়ে। কেননা রহিমার সম্মুখীন হওয়ার সাহস ছিলো না তার মাঝে। কিন্তু রহিমা তাকে এমনি এমনি রেখে আসেনি৷ রেগেমেগে ঘরে ঢুকে পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে পিটিয়ে এসেছে। আর বলে এসেছে যেন কোনদিনও মনে না করে তার মা কিংবা বোন বেঁচে আছে!
বাড়ি ফিরে মায়ের কোলে মাথা রেখে আজ খুব কেঁদেছে রহিমা! বোনটাকে অনেক ভালোবাসতো। যা আবদার করতো তাই পূরণ করার চেষ্টা করতো। আর বকাঝকা কি এমনি এমনি করতো! তার ভালোর জন্যই তো একটু শাসনে রাখতো! নিজে না খেয়ে মা বোনের খাওয়ার কথা ভাবতো। নিজে মুর্খ থেকে বোনকে শিক্ষিত বানানোর উদ্দেশ্যে স্কুলে পাঠাতো। এই দিলো তার প্রতিদান! জগৎ এতো নিষ্ঠুর কেন!
তার অসুস্থ মা ও বিভিন্ন গালিগালাজ করলেন কারিমাকে। ছেলেমেয়ের দেয়া কষ্টে ডুকরে কেঁদেছেনও তিনি। আর মাঝরাতে শুরু হলো বুক ব্যাথা! সহ্য করতে পারছেন না তিনি! রহিমা তার মায়ের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেছে! পানি পান করালো, মাথায় পানি দিলো, ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে রাখলো৷ কিন্তু তাতে কি আর ব্যাথা সাড়বে! কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না রহিমার! সে ছুটে গেলো পাশের ঘরের কাকার কাছে। কাকা বললো হসপিটালে নিয়ে যেতে৷ কিন্তু রহিমার একার পক্ষে কি তা সম্ভব! তাছাড়া কাকার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছে তিনি যাবেন না তাদের একটু সাহায্য করতে। তাই আর বললোই না কাকাকে। তবে কাকার ফোনটা চেয়ে নিলো একটা কল করার জন্য। এই মুহূর্তে আয়ান ছাড়া আর কারও কথা মাথায় আসেনি। সে তার পার্স থেকে নোটপ্যাড খুঁজে আয়ানের নম্বরে ডায়াল করলো। প্রথমবার রিসিভ না হলেও দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো আর ঘুমঘুম কণ্ঠ ভেসে এলো। রহিমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মায়ের অবস্থার কথা বললে আয়ান বললো সে আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আয়ান তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে বন্ধুর বাইকে করে চলে এলো রহিমার বাড়ি৷ অত:পর সি এন জি রিজার্ভ করে নিয়ে গেলো হসপিটাল। আসার পূর্বে রহিমা তার মাটির ব্যাংকটা হাতে নিয়েছিলো জমানো টাকা নেওয়ার জন্য। কিন্তু দেখতে পেল মাটির ব্যাংকের উপর সাদা টেপ লাগানো! রহিমা টেপ টেনে তুলে ফেলতেই দেখলো ব্যাংক তিন টুকরো! আর টাকা নেই! আছে শুধু কাচা পয়সাগুলো! বুঝতে বাকি নেই এই অপ্রত্যাশিত কাজটাও কারিমা ই করেছে! নতুবা কেউ টাকা চুরি করে এতোটা সযত্নে টেপ লাগিয়ে ব্যাংক ঠিকমতো রেখে দিবে না। আলমারিতে কারিমার জামাকাপড়ও নেই! বাড়ি থেকে সকল বন্দোবস্ত করেই বেরিয়েছে সকালে! আর সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে! যার ফলে পার্সে রাখা দুতিনশো টাকা নিয়েই তাকে হসপিটাল আসতে হয়েছে। এখানে এসে জানতে পারলো ছোটখাটো স্ট্রোক হয়েছে তার মায়ের। যার ট্রিটমেন্টে কয়েক হাজার টাকা লাগবে যা এখন রহিমার কাছে নেই!
আয়ান তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“টাকা আছে কিছু?”
রহিমা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,
“ডাক্তারকে বলেন মা রে মাইরা ফালাইতে।”
আয়ান দাতে দাত চেপে বললো,
“চুপ! কি বলছিস এসব!”
রহিমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,
“কি কইতাম আর! এছাড়া আর কোনো উপায় আছে! দিনরাইত পরিশ্রম কইরা সাত আট হাজারের মতো টাকা জমা রাখছিলাম। মেতরনী সাত সকালে সব লুট কইরা নিয়া এক মেতর ব্যাডার লগে পালায় গিয়া বিয়া বইছে!”
“কে? তোর ওই বোন?”
রহিমা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” জবাব দিলে আয়ান বললো,
“কান্না করিস না। তুই শান্ত হ। দেখি, কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কি না!”
আয়ান নিজের পকেটে হাত দিয়ে দেখলো পাঁচ ছয়শোর মতো আছে। অত:পর তার বন্ধুর কাছে থেই দুই হাজার টাকা নিয়ে ভর্তি করালো রহিমার মাকে। বাকি খরচ পড়বে ওষুধপত্র আর কেবিন ভাড়ায়। সকালে বাবার কাছ থেকে নিয়েও ব্যবস্থা করা যাবে।
সকাল হওয়া পর্যন্ত তিনজন অপেক্ষা করলো এখানে। অন্ধকার কাটিয়ে আলো ফুটতেই আয়ানের বন্ধু চলে গেলো। ঘুম থেকে উঠে আয়ানের সাথে কথা বলে সায়মা জানতে পারলো রহিমার মায়ের খবর। আর সে খবর পাওয়া মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে ছুটে এলো হসপিটাল। কিন্তু এখানে এসে রহিমাকে পায়নি সে। আয়ানকে বসিয়ে রেখে একটা কাজে গেছে রহিমা। সায়মা আয়ানের সাথেই কথাবার্তা বলছে।
এদিকে রহিমা এসেছে কারিমার বাড়িতে। সাতসকালে চুলের মুঠি ধরে ইচ্ছেমতো মেরে পাঁচ হাজার টাকা উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পেরেছে। বাকিটা নাকি গতকাল খরচ করে ফেলেছে। বউকে বাঁচাতে জামশেদ রহিমাকে ধাক্কা মেরেছিলো। তখন রহিমা ছিটকে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেয়েছে। তবে পুলিশের ভয় দেখিয়ে টাকা উদ্ধার করে ছেড়েছে। টাকা নিয়ে হসপিটাল এসে সায়মাকে দেখতে পেল রহিমা। আজ সে সত্যিই উপলব্ধি করতে পারছে এরা দুজন আসলে তার বন্ধু। খুব কাছের ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিত্তশালী হলেও এরা তার মতো একজন গরিবের বন্ধু! যে কিনা মাঝ রাতেই ছুটে আসে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে আর যে কিনা ঘুম থেকে জেগে খবর পেয়েই ছুটে আসে তার কাছে!
সায়মা রহিমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো। কান্নাকাটি করতে নিষেধ করলো। আর মুখ দিয়ে যেন আজেবাজে কথা উচ্চারণ না করে সে বিষয়ে সতর্ক করলো। রহিমা আয়ানের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বললো,
“বোন নামক কলঙ্কিনীর সাথে যুদ্ধ কইরা এগুলো ফিরাইয়া আনতে পারছি। আপনের বন্ধুর টাকা শোধ কইরা দিয়েন। আর বাকিটা ওষুধে হইবো না?”
“বন্ধুর টাকা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আর বাকিটা মেবি এতেই হয়ে যাবে। টেনশন করিস না।”
সায়মা বললো,
“তোর হাত কাটলো কিভাবে?”
“ওইযে, কইলাম না! যুদ্ধ করছি।”
“তোর মতো মেয়ে প্রতি ঘরে ঘরে জন্ম নেক৷ আর তোর বোনের মতো মেয়ে পৃথিবী জুড়ে আর একটাও জন্ম না নেক। চল আমার সাথে। ড্রেসিং করিয়ে নিয়ে আসি। অনেকটা কেটে গেছে। নতুবা ইনফেকশন হয়ে যাবে।”
রহিমার হাতের কাটা ড্রেসিং করিয়ে আনলে তারা ওয়েটিং রুমে বসে আছে। রাহিমার চেহারাটা একদমই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে৷ আনমনা হয়ে বসে আছে সে। কি ভাবছে কে জানে!
সায়মা আয়ানের উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বললো,
“একটা ভালো ছেলে দেখে রহিমার বিয়ে দিয়ে দাও। ক’দিন এভাবে একা একা লড়াই করে যাবে জীবনের সাথে! দেখো, একটা ভালো পাত্র খুজে পাও কি না।”
আয়ান নিরবে মাথা সামান্য ঝুলিয়ে সম্মতি দিলো যে, সে চেষ্টা করবে।
অত:পর আয়ান চলে গেলো আর সায়মা রহিমার সাথে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর কাইয়ুম সাহেব এসেছেন। মাস শেষ হওয়ার দুদিন আগেই বেতন দিয়ে গেছেন। তবে তিনি বেশ কয়েকবার সায়মার দিকে তাকিয়েছিলেন। সায়মা তাকে দেখে প্রথমেই সালাম দিয়েছিলো। আর রহিমার কাছে তিনি জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন রহিমা তাদের বাড়িতে কাজ করার পাশাপাশি যে বাড়িতে কাজ করে সেই বাড়ির মেয়ে। তিনিও বুঝে গেছেন আয়ান ও তার মা তাকেই দেখতে গিয়েছে আর আয়ানের পছন্দ হয়েছে এই মেয়েকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here