তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_১৬,১৭

0
678

#তোর_অপেক্ষায়,পর্ব_১৬,১৭
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৬

পাক্কা চারদিন নানু বাড়ির বেড়ানো শেষে আজ নিজ বাড়িতে পা রাখলাম সকলে।সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে রওনা দিয়েছি এখন প্রায় আটটা বাজতে চলল।বাসায় ঢুকতেই মনে হলো কত যুগ যেন এখানে ছিলাম না।
বড়মা তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে আসলেন আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে।আমি কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে এলাম রুমে।কাঁধের ব্যাগ ছুড়ে ফেলে ধপ করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।আহ্ আমার বিছানা না জানি কত মিস করেছে আমায়।তখনই বারান্দা থেকে পরিচিত ডাক শুনতে পেয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম।ছুটে এলাম বারান্দায়। ওইতো আমার চিনি মিনি।এতদিন ওদের বড়মা’র উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছিলাম।আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।অবলা পাখিদুটো বোধ হয় আমার কথা ভেবে ভেবে দানাপানি মুখে তুলেনি।

‘ হ্যালো চিনি, হ্যালো মিনি! আমি এসে গেছি!তোদের সাথে কত কথা বলার বাকি আছে জানিস!নানু বাড়িতে অনেক কিছু ঘটে গেছে।তোরা কি শুনতে চাস?’

চিনি মিনি লম্ফঝম্প শুরু করল।ওদের এই প্রতিক্রিয়া আমি হ্যাঁ বোধক উত্তর ধরে নিয়ে বলতে শুরু করলাম,

‘ দুর্জয় ভাইয়াকে চিনিস তো!যিনি তোদেরকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। লোকটা আমাকে তাঁর মনের কথা জানিয়েছে গতকাল বিকেলে।’

এটুকু বলতে গিয়ে লজ্জায় মরি মরি অবস্থা আমার।মনে হচ্ছে আমার সামনেই দুর্জয় ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন আর হাসছেন মুচকি মুচকি।ওই লোক তো দেখি আমায় পুরো দিওয়ানা বানিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে।আমি কি হেলুসিনেশন দেখা শুরু করেছি নাকি?
চিনি মিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে আমাকে।বোধহয় এরপরের কথাগুলো শোনার অপেক্ষায় আছে।

‘ আসলে কি বল্ তো উনাকে আমারও বেশ ভালো লাগে কিন্তু তাও উত্তর জানাতে পারিনি।এত জলদি কিভাবে জানাই বল! তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই।আগে উনাকে একটু যাচাই-বাছাই করে নিই তারপর না হয়..হিহিহি। ঠিক করেছি না?’

পাখিদুটো এখন চুপচাপ। তারমানে আমার সিদ্ধান্ত ওদের পছন্দ হয়নি?
এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ পেতে রুমে উঁকি দিলাম।জেরিন আপু এসেছে।আমাকে দেখতে পেয়ে বলল,
‘ কি করছো পূর্ণী?আরে বাহ্ পাখি দুটো দারুণ তো!কবে কিনলে?’

‘ এইতো কিছুদিন হবে।তুমি আজ আর বাসায় যেও না আপু।রাতটা থেকে যাও।’

‘ থাকব তো। আমি ভেবেছিলাম দুর্জয় ভাইয়াকে বলব আমাকে পৌঁছে দিতে কিন্তু আন্টিরা আমাকে যেতে দিল না।’

আমি মাথা নেড়ে মৃদু হাসলাম।প্রায়ই খেয়াল করি জেরিন আপু দুর্জয় ভাইয়াকে নিয়ে একটু বেশিই মেতে থাকেন।কারণটা কি?আপু কি ভাইয়ার প্রতি দুর্বল?কিন্তু জেরিন আপু তো দুর্জয় ভাইয়ার দুচোখের বিষ।আমার মস্তিষ্ক বলছে এসবের পেছনে গোপন কোনো ঘটনা আছে।সুযোগ এবং সময় বুঝে দুর্জয় ভাইয়াকে একদিন জিজ্ঞেস করে ফেলব।

_______________________________

ক্লাস শেষে ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি রিকশার জন্য। কিন্তু রিকশার দেখা নেই।প্রায় পনেরো মিনিট ধরে এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে। এজন্য যতটুকু না বিরক্ত লাগছে তারচেয়েও মাথা গরম হচ্ছে আমার থেকে কিছু দূরে বাইকে বসে থাকা তিনটে ছেলেকে দেখে।সেই কখন থেকে আমার উপর চোখ ঘুরিয়ে যাচ্ছে। পোশাক আশাক দেখে তো ভালো ঘরের ছেলে মনে হয় কিন্তু আমার উপর এভাবে নজরদারি করছে কেনো!ছেলেগুলো ভদ্রলোক সেজে আবার ছিনতাই করার মতলব করছে নাতো!ছিনতাইয়ের কথা মনে হতেই কাঁধের ব্যাগটাকে চেপে ধরলাম।ব্যাগে মোটামুটি অনেকগুলো টাকা যত্নে রাখা আছে।আমার জমানো টাকা হারালে আমি উন্মাদ হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খাব।

আমার ভয়সূচক চিন্তায় চিড় ধরিয়ে পরিচিত একটি গাড়ি ফুল স্পিডে এসে থামল বাইকে বসা ছেলেগুলোর সামনে।এটা তো দুর্জয় ভাইয়ার গাড়ি।
দুর্জয় ভাইয়াকে দেখে ছেলে তিনোটার মুখে বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠল।উনারা পরস্পর হ্যান্ডশেক করে হালকা হাগ করলেন।আচ্ছা এই ব্যাপার তাহলে।বাউণ্ডুলে ছেলেগুলো উনার দোস্ত!

ছেলেদের বিদায় দিয়ে দুর্জয় ভাইয়া এবার আমার দিকে ফিরলেন।চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে আঙুলের ইশারায় ডাকলেন আমাকে।এহ্ ভাব এমন যেন কোনো সিনেমার হিরো শ্যুটিং করার জন্য ল্যান্ড করেছে।তবে এটা মানতেই হবে উনি হিরো হোক আর ভিলেন হোক উনাকে দেখলে এখনো আমার গলা শুকিয়ে আসে।উনার সামনে যাওয়া মানেই উনার বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ আমাকে অস্থির করে তুলবে।
গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেলাম গাড়ির কাছে।অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আপনি এখানে যে?কোনো দরকার ছিল?’

দুর্জয় ভাইয়া নিজের চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে বললেন,
‘ জ্বি।হবু বউকে নিতে এসেছি।’

হবু বউ শব্দ দুটো শুনে নিম্নমাত্রার শক খেলাম।এই ব্যক্তি সামনে থাকলে আমাকে সবসময় ছোট থেকে বড় মানের শক এবং ভিমড়ি খেতে হবেই হবে এটা আমি ভুলে যাই।শক খাওয়ার সাথে সাথে আবার কানদুটো গরম হয়ে উঠেছে।হবু বউ কথাটা কি উনি আমাকেই বললেন?

ঢোক গিলে বললাম,
‘ কি আশ্চর্য এখানে কে আপনার হবু বউ?’

‘ কেনো?তোর কোনো আপত্তি আছে আমার হবু বউ হতে?’

‘ আমার তো বয়েই গেছে আপনার বউ হতে।’

আমি মুখ ঝামটা দিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম।উনার সাথে কথা বলা মানে কথার প্যাঁচে জড়িয়ে পড়া।
দুর্জয় ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,
‘ আমি কিন্তু হবু বউ বলেছিলাম।তুই তো একধাপ এগিয়ে গেছিস!’

আমি চোখমুখ খিঁচে চুপ করে রইলাম।একবারো ফিরে তাকাচ্ছি না উনার দিকে।জানি তাকালেই উনার মোহনীয় হাসি ঘায়েল করে ফেলবে আমায়।তবে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারলাম না।মাথায় একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জন্ম হতেই দুর্জয় ভাইয়াকে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলাম,

‘ তখনের ছেলেগুলো তো আপনার বন্ধু তাই না!আপনি জানেন আপনি আসার আগে ওরা আমার দিকে বারবার সন্দেহজনক চোখে তাকাচ্ছিল!সত্যি করে বলুন তো এরা আপনার কেমন বন্ধু? ‘

‘ যখন রাজনীতি করতাম তখনকার বন্ধু এরা।আমিই ওদের বলেছিলাম ভার্সিটিতে তোর উপর সর্বক্ষণ নজর রাখতে তাই ওভাবে তাকাচ্ছিল।’

আমি এবার তেতে উঠলাম।
‘ এসব ঠিক নয় ভাইয়া! আমি কোনো ক্রিমিনাল যে আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রাখবেন?আর যাই হোক এটা কিন্তু ঠিক করছেন না।আমার একটা স্বাধীনতা আছে তাই না!আমি তো আর ছোট বাচ্চা নই যে আমাকে রাস্তাঘাটে দেখে দেখে রাখতে হবে।’

‘ প্রথমত আমার সামনে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবি না।দ্বিতীয়ত আমি কি ঠিক করছি না করছি সেটা আমাকে বুঝতে দে।আর কি যেন বললি স্বাধীনতা! যতদিন তোকে আমার নিজের করে না পাচ্ছি ততদিন স্বাধীনতা শব্দটা ভুলে থাক।তোর এই স্বাধীনতার জন্য আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।গট ইট?’

দুর্জয় ভাইয়ার ধমক শুনে চুপসে গেলাম।আস্ত জল্লাদ একটা।আমি একটু জোর গলায় কথা বলতে গেলেই হুঙ্কার দিয়ে উঠে।আমি কি ভুল কিছু বলেছি?অনার্সে পড়ুয়া একজন মেয়ের পেছনে নজরদারি করার জন্য লোক ফিট করে রাখবে এটা কেমন কথা?আর কথাই বলব না এই লোকের সাথে। আমার মান-মর্যাদা বলতে কিছু নেই নাকি!বাকি রইল ভাইয়া ডাক! ভাইয়াকে ভাইয়া না বলে কি বোন বলে ডাকব?অবশ্য এই ভাইয়া নামক জল্লাদ টাই তো আমাকে বউ বানানোর জন্য ওত পেতে আছে।হাহ্ তিনি তো আর জানেন না আমি এত সহজে উনার জালে ধরা দিচ্ছি না।আমাকে পেতে হলে উনাকে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হবে যে।

দুর্জয় ভাইয়ার গাড়ি আমার বাড়ির রাস্তা ছেড়ে অন্যদিকে মোড় নিতে সচকিত হয়ে উঠলাম।বলা কওয়া ছাড়া এই লোক আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়ার ফন্দি আঁটছে।উনার ভাব-গতিক তো ঠিক লাগছে না।প্রপোজ করেছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে?আমার স্বাধীনতা হরণ করে এখন আমার উপর খবরদারী করার প্ল্যান।দেখতে হ্যান্ডসাম বলে উনাকে একটু ভালো লাগে তাই কোনো প্রতিবাদ করি না হুহ্ নাহলে দেখিয়ে দিতাম আমার গলায় কত জোর।

আপাতত গলার জোর নিয়ে না ভেবে দুর্জয় ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এই যে মিস্টার ডিজে! আমাকে আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জানতে পারি কি?এটুকু অন্তত জানি এটা আমার বাড়ির রাস্তা না। ‘

দুর্জয় ভাইয়া প্রচন্ড শব্দে ব্রেক কষলেন।আচমকা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।ভাগ্যিস রাস্তায় তেমন যানবাহন ছিল না নাহলে বড়সড় এক্সিডেন্ট হয়ে যেত।
দুর্জয় ভাইয়া অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বলে উঠলেন,

‘ কি বললি তুই?ডিজে?’

আমি এবার সোজা হয়ে বসলাম।মনে মনে দমফাটা হাসি পাচ্ছে। ডিজে নাম শুনে ঝটকা খেয়েছে বুঝতেই পারছি।একদম ঠিক হয়েছে।সবসময় আমি কেনো ঝটকা খাব উনাকেও খেতে হবে।
হাসি চেপে বললাম,

‘ আপনিই তখন বললেন আপনার সামনে যেন ভাইয়া বলে না ডাকি।তো এখন নাম ধরে ডাকলে ভালো শোনায় না।তাই হঠাৎ ডিজে নামটা মাথায় চলে এল।ইংরেজিতে Durjoy কে সংক্ষিপ্ত করলে Dj হয়ে যায়।পছন্দ হয়নি নাম?’

দুর্জয় ভাইয়া কিছুক্ষণ মুখ ভার করে তাকিয়ে থেকে হেসে দিলেন।আমার মাথায় আস্তে চাটি মেরে বললেন,

‘ এসব নাম তোর মাথাতেই আসবে।’

আমি আড়চোখে দুর্জয় ভাইয়ার হাসি দেখছি।মানুষটাকে হাসলে সুন্দর লাগে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি খালামণিদের বাড়ির বিশাল গেইটের সামনে থামল।আমি চুপচাপ ভাইয়ার পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলাম।উনাদের বাড়িতে কি জন্য নিয়ে এসেছে সেটা তো ভেতরে গেলেই জানা যাবে।

ড্রয়িংরুমে যেতেই দারুণ চমক খেলাম।ইমন ভাইয়া,সুহানা আপু,ফারাজ এবং অহনা আপু সোফায় একসাথে বসে জমিয়ে গল্প করছে।তাঁদের সাথে আরো দুজন অচেনা ব্যক্তি।
আপুরা আমাকে দেখতে পেয়ে খুশিতে চিল্লিয়ে বলে উঠল,
‘ যাক বাবা আমাদের গ্রুপের বাকি দুজনও এসে গেল।’

এতক্ষণে আমি কাহিনী বুঝতে পারলাম।আজ বোধহয় খালামণি ভাইবোন সকলকে লাঞ্চে ইনভাইট করেছে।আমি খালামণির সাথে দেখা করে আপুদের কাছে গিয়ে বসলাম।দুর্জয় ভাইয়া অচেনা অতিথি দুজনের সাথে কথা বলে দোতলায় চলে গেলেন।
অতিথি দুজনের মধ্যে একজন আমাকে হেসে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন আছো পূর্ণতা?’

আমি সৌজন্যের সাথে উত্তর দিলাম,
‘ জ্বি ভালো।আপনি কেমন?’

‘ আমি তো ভাল।আমাকে চিনতে পারোনি তাই না!আমি তুষার।দুর্জয়ের কাজিন।আপন না হলেও দুজন ছোট থেকে একই স্কুল, ভার্সিটিতে পড়েছি।আর এ হচ্ছে নীলাশা আমার ওয়াইফ।’

আমি এবার তুষার ভাইয়ার পাশে বসে থাকা অতিমাত্রার সুন্দরী মেয়েটির দিকে নজর দিলাম।
মেয়েটিও আমাকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করল।আগেই বুঝতে পেরেছিলাম ওরা দুজন দম্পতি। বেশ মানিয়েছে ওদের।তুষার ভাইয়া দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনি তাঁর স্ত্রী!

চলবে…

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৭

দুর্জয় ভাইয়াদের বাড়িটা যেমন সুন্দর তেমনি ছাদটাও আধুনিক ধাঁচের। ছোটখাটো একটা খেলার মাঠ বললেও মানাবে।ছাদের কিনারা জুড়ে টবে লাগানো বিভিন্ন জাতের ফুলগাছ।মাঝখানে ছাউনির নিচে গোল টেবিল ঘিরে আছে চার-পাঁচটা চেয়ার।বর্তমানে সেই চেয়ারে বসে বিকেলের হাওয়া খাচ্ছি। আমার পাশে তুষার ভাইয়ার ওয়াইফ নীলাশা বসে আছে।মেয়েটা আমার বয়সী তবুও তুষার ভাইয়ার স্ত্রী হিসেবে ভাবী ডাকতে যাওয়াতে সাফ মানা করে দিয়েছে।খুব মিশুক এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার ওর। সহজেই মিশে গেছে আমার সাথে।
আমাদের থেকে কিছুটা দূরে সুহানা আপু এবং অহনা আপু রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।ছাদের অন্য কোণায় তুষার ভাইয়া এবং দুর্জয় ভাইয়া।দুজনের হাতে দুটো ঠান্ডা পেপসির ক্যান।উনারাও হাত নেড়ে নেড়ে আড্ডায় ব্যস্ত। তাঁদের দুজনকে দেখতে একদম পার্ফেক্ট লাগছে।দুজনের সেইম হাইট,সেইম বডি এমনকি কথা বলার স্টাইলও এক।দূর থেকে দেখলে হঠাৎ ভাই বললেও ভূল হবে না।তবে অনেকক্ষণ থেকেই খেয়াল করছি তুষার ভাইয়া কথা বলার মাঝেও নীলাশার দিকে দুষ্টুমি ভরা চাহনি দিচ্ছেন আর নীলাশা বেচারি আমার সামনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে।ভালোই লাগছে ওদের এই লুকোচুরি দেখতে।তবে আমি জানি মিস্টার দুর্জয়ও ওখান থেকে আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। আমি একবারের জন্যও তাকাচ্ছি না উনার দিকে।ভদ্র শয়তান একটা।

আমি নীলাশাকে টিপ্পনী কেটে বললাম,
‘ বাহ্ ভাইয়া তো দেখি চোখে হারায় তোমাকে।তোমার উপর থেকে নজর সরাচ্ছে না এক মুহূর্তের জন্যও!’

নীলাশা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ আমার ক্ষেত্রে এসব তো পুরনো কাহিনী পূর্ণতা।তোমার কথা বলো এবার।আমি কিন্তু সব জানি। দুর্জয় ভাইয়া তো তোমার প্রেমে মাতোয়ারা। দুনিয়া একদিকে আর তুমি একদিকে।’

আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসলাম।
মুচকি হেসে বললাম,
‘ ছাই! কে বলেছে এসব আজগুবি কথা!’

‘ আজগুবি বুঝি?আমার বরের সাথে কিন্তু দুর্জয় ভাইয়ার মাছে ভাতে সম্পর্ক! সব খবরই পাই আমি।আর তোমার লজ্জামাখা চেহারাই জানান দিচ্ছে দুর্জয় ভাইয়াকে নিয়ে তোমার মনে কি চলে!’

নীলাশা কথায় আমার গালদুটো গরম হয়ে উঠল।কি জ্বালারে বাবা!
এমন সময় খালামণি ট্রে তে করে সবার জন্য পায়েস নিয়ে আসলো।মনে মনে খালামণিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম নাহলে নীলাশার কারণে আজ আমার হার্টফেইল হয়ে যেত।
খালামণি সকলকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘ তাড়াতাড়ি গরম গরম খেয়ে নে।আমার হাতের স্পেশাল পায়েস ঠান্ডা হলে কোনো স্বাদ পাবি না।’

অমনি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল পায়েসের উপর।খালামণির হাতের জাদু সম্পর্কে আরো আগে থেকেই অবগত আমি।তাই নিঃসন্দেহে বলতে পারি আজ দুপুরের আইটেমগুলোর মত এই পায়েসের স্বাদও মুখে লেগে থাকবে।
প্লেট হাতে নিয়ে এক চামচ তুলতে যাব ঠিক তখনই দুর্জয় ভাইয়া এসে খপ করে আমার হাত ধরে ফেললেন।আমি বিস্ময় নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি এখন আমার খাওয়া দাওয়ার উপরও কতৃত্ব ফলাতে আসবেন?
তুষার ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড দুর্জয়! ওকে আটকাচ্ছিস কেনো?’

দুর্জয় ভাইয়া খালামণির দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ পায়েসে বাদাম আছে মা।আর বাদামে এলার্জি। পূর্ণতা খাবে না এটা।’

আমি অবাক হয়ে রইলাম।আমার যে এলার্জির সমস্যা আছে তা কিছুসময়ের জন্য ভুলেই গেছিলাম।কিন্তু দুর্জয় ভাইয়া এই খবর কিকরে জানলো?
খালামণি অসহায় মুখ করে বলল,
‘ দেখেছিস কি ভুলো মনের আমি।আমার ভুলের কারণে এখন একটা অঘটন ঘটে যেত।তুই দাঁড়া পূর্ণতা আমি তোর জন্য ঝটপট অন্যকিছু বানিয়ে আনছি।’

খালামণি দুঃখী দুঃখী চেহারা নিয়ে চলে গেল।আমি দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকাতে উনি চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলেন,

‘ গাড়িতে তখন কি বলেছিলি তুই বাচ্চা না,তোর স্বাধীনতা আছে।যে মেয়ে নিজের খেয়াল রাখতে জানে না তাঁর আবার স্বাধীনতা? ‘

আমি মুখ ফুলিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।সবার সামনে আমাকে এমন করে না ধমকালেও তো পারতো!এমনিতে সবসময় আমার ইজ্জতের ফালুদা করে ছাড়ে আর এখন তুষার ভাইয়া এবং নীলশার সামনেও ডাবল ফালুদা বানিয়ে দিল।
তুষার ভাইয়া দুর্জয় ভাইয়ার পিঠ চাপড়ে হেসে হেসে বললেন,

‘ প্রেমিকার সামনে কেয়ারিং রূপ এবং ভিলেন রূপ দুটোই একসঙ্গে দেখাচ্ছিস যে?দেখ্ পূর্ণতার মন খারাপ হয়ে গেছে।’

‘ প্রেমিকা এমন অবুঝ শিশু হলে ডাবল রোলে আসতেই হয়।আমার কিচ্ছু করার নেই।’

এটা বলে দুর্জয় ভাইয়া পায়েসের প্লেট থেকে গপগপিয়ে খাওয়া শুরু করলেন।কত্ত বড় খারাপ লোক আমাকে শিশু বলছে!আর যাই হোক এটা অন্তত মানা যায় না।উনার অপমান মার্কা কথা শুনে মন তো চাইছে ছাদ থেকে লাফিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে দেই নয়তো উনাকে দুটো ঘুষি মেরে চেহারার বিকৃতি ঘটিয়ে দেই।এতকিছুর মাঝেও সুহানা আপু এবং অহনা আপুর দিকে নজর দিলাম।ওরা এখন নিজেদের প্লেট নিয়ে আবার হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাই এদিককার কথা শুনতে পায়নি।নাহলে সব বুঝে ফেলত।

.

সন্ধ্যায় বাড়ি যাওয়ার নাম করতে খালামণি চোখ পাকিয়ে আমাদের ধমক দিলেন।আমার এবং সুহানা আপুর ক্লাস, ইমন ভাইয়ার অফিসের বাহানা দিয়েও বিশেষ কোনো লাভ হলো না।খালামণির কড়া নির্দেশ আজ রাত থেকে যেতে হবে।অগত্যা আমরাও মেনে নিলাম।অন্যদিকে তুষার ভাইয়া এবং নীলাশা সন্ধ্যার আগেই চলে গেছেন।
আমি এখন বসে আছি অহনা আপুর রুমে।আপুর বইয়ের সেল্ফে বিভিন্ন রকমের উপন্যাসের বই।সেখান থেকেই একটা থ্রিলার বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি।খালামণি কিছুক্ষণ আগে ডিনার করার জন্য ডাকাডাকি করে গেছে কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র খিদে নেই এই কথাটা খালামণিকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বিদায় দিয়েছি।খালামণির জায়গায় মা থাকলে এটা কখনোই করতে পারতাম না।মা আমার টুঁটি চেপে ধরে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে বসাতো।
বইয়ের পৃষ্ঠায় এতই ডুবে ছিলাম যে হঠাৎ সশব্দে রুমের দরজা খোলার আওয়াজে কেঁপে উঠলাম।মাথা তুলে দেখি দুর্জয় ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন।উনাকে দেখে ঢোক গিললাম আমি।উনার কারণে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে শ্বাস ফেলার ফুসরত নেই আমার।এখন আবার কেনো হানা দিয়েছেন কে জানে?

দুর্জয় ভাইয়া গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ ভাত খেতে যাচ্ছিস না কেনো?’

আমি এবার বই বন্ধ করে বিরক্তি নিয়ে তাকালাম উনার দিকে।সবকিছু নিয়ে আমার উপর জোর-জবরদস্তি না করলে তো উনার পেটের খাবার হজম হয় সেটা আমি ভুলেই যাই।কিন্তু এই মুহূর্তে আমি উনার একটা কথাও মানব না দেখি কি করতে পারে!
বিছানায় আরেকটু আয়েশ করে হেলান দিয়ে বললাম,

‘ আমি তো খালামণিকে বলে দিয়েছি আমি খাব না।ভালো লাগছে না।’

তুষার ভাইয়া শান্ত কন্ঠে বললেন,

‘ খাওয়ার সাথে ভালো লাগা না লাগার কি সম্পর্ক?নিজের বাড়িতে থাকলে এমন ত্যাড়ামি করতে পারতিস?খালামণি তোকে থাপড়িয়ে থাপড়িয়ে খাওয়াতো।

‘এখন তো মা নেই।তাই ভয় নেই।দয়া করে আপনি যান এখন।আমি বই পড়ব।’

‘ মা নেই তো কি হয়েছে তোর বর তো আছে।বর হয়ে থাপড়াতে পারবো না তবে থাপ্পড়ের চেয়েও বড় ডোজ আছে।’

এটা বলেই দুর্জয় ভাইয়া আচমকা আমাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলেন।আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্য। যখন বুঝতে পারলাম মাটি থেকে কয়েক হাত উপরে দুর্জয় ভাইয়ার কোলে তখন হাত-পা ছুড়তে শুরু করলাম।কিন্তু এতে উনার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।আমাকে জাপটে ধরে হেঁটে চলেছেন।চাপা গর্জন করতে করতে বললাম,

‘ কি হচ্ছে এসব!নামান।কেউ দেখলে মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে।প্লিজ!’

দুর্জয় ভাইয়া ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিলেন,
‘ ধুলোয় মিশবে না কাদায় মিশবে সেটা তোর আগে ভাবা উচিত ছিল।এভাবে কাটা মুরগির মত হাত-পা না ছুড়ে শান্ত হয়ে আমার গলা ধরে থাক নয়তো সিড়িতে পড়ে গিয়ে বডির কলকব্জা ভাঙবি।’

‘ মাফ করুন আর হবে না এমন।নামিয়ে দিন আমায়।আমি হেঁটে যেতে পারব।আমি ভাত খাব।’

আমার কাঁদকাঁদ কথা শুনে দুর্জয় ভাইয়া নামিয়ে দিলেন।শয়তানি হাসি দিয়ে বললেন,
‘ আমি যখন যা বলব সেটা তোকে বিনাবাক্য ব্যয়ে মানতে হবে।নাহলে….’

আমি হাত তুলে উনাকে থামিয়ে দিলাম।রাগে ফুসফুস করে বললাম,
‘ বুঝেছি।এটাও বুঝেছি যে আপনি কতবড় বজ্জাত।আপনার হাড়ে হাড়ে বজ্জাতের জীবাণু।’

দুর্জয় ভাইয়া একপলক সরু চোখে তাকিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লেন।
মুখ ভেঙচিয়ে সিড়ি দিয়ে আমিও নেমে এলাম।টেবিলে ইমন ভাইয়া এবং আপুরা একসাথে ডিনার করছে।খালামণি আমাকে দেখে বলল,
‘ পূর্ণী খিদে পেয়েছে বুঝি?তখন এত করে ডাকলাম এলি না!খেতে কারো ভালো লাগে না এমন বাহানা প্রথম শুনলাম।’

‘ এখন প্রচুর খিদে পেয়েছে খালামণি।খেতে দাও।’

শুকনো মুখে উত্তর দিলাম।খালামণিকে যদি একবার তাঁর গুনধর ছেলের কাহিনী শুনাতে পারতাম যে ভাত খাওয়ার জন্য আমাকে কিভাবে ডাকাতের মত তুলে এনেছে।
ড্রয়িংরুম এবং ডাইনিং রুম বরাবর হওয়ার কারণে আমি খেতে বসেও দুর্জয় ভাইয়াকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ল্যাপটপে এমনভাবে মনযোগ দিয়ে রেখেছেন যেন কাজ করতে করতে ইহজগৎ উল্টিয়ে ফেলছেন।
এরমধ্যে খালামণি উনাকে খাওয়ার জন্য কয়েকবার ডেকেছেন উনি পরে খাবেন বলে চুপ করে গেলেন।
কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে মনে মনে বললাম,
‘ভিলেন নাম্বার ওয়ান!না খেয়ে থাক তুই।’

অল্প করে ভাত নিয়েছি বলে সবার আগে আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেল।যেই উঠতে যাব অমনি খালামণি সবার জন্য বিশাল বিশাল গ্লাস ভর্তি করে দুধ নিয়ে হাসিমুখে হাজির হলেন।এটা দেখে হতাশায় ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আজ খাওয়া নিয়ে আমার উপর এত টর্চার হচ্ছে কেনো?এখন দুধ খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।খালামণিকে আস্তে করে বললাম,

‘ আমি আর কিচ্ছু খেতে পারব না খালামণি।বুঝার চেষ্টা করো পেটে আর এক কনাও জায়গা অবশিষ্ট নেই।’

খালামণি কপট ধমকের সুরে বললেন,
‘ সবাই খেতে পারলে তুই পারবি না কেনো রে?তুই কিন্তু ভাত কম খেয়েছিস দেখেছি আমি।’

‘ আমার তো ভাত খেতেই ইচ্ছে করছিল না তবুও তো খেয়েছি নাকি!এখন আবার দুধ খাওয়ার জন্য জোর করছো.….’

কথা সম্পূর্ণ করার আগেই আমার চোখ সোফার দিকে চলে গেল।জ্বলন্ত দুটো চোখ সকলের অলক্ষ্যে আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে খালামণির আদেশ পালন করার জন্য। উফ্ যন্ত্রণার শেষ নেই।কিভাবে হিংস্র দৃষ্টিতে দেখছে আমায় যেন এক্ষুনি এই গ্লাস খালি না করলে আমাকে কুরবানি দিয়ে দেবে।
দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গ্লাস তুলে একচুমুক দিলাম আর সাথে সাথেই মনে হলো মুখের ভেতরটা পুড়ে ছাই।

‘ আঃ! শেষ আমি।আমার জিভ শেষ।’

আমার চিৎকারে আপুরা নিজেদের খাওয়া থামিয়ে হা করে তাকিয়ে রইল।ইমন ভাইয়া ধমকে উঠে বলল,

‘ আশ্চর্য মেয়ে তো তুই! এত গরম গ্লাস আমি ধরতেই পারছি না আর তুই মুখে দিয়ে দিলি?ধ্যান কই থাকে তোর?জিভ বেশি পুড়েছে?’

খালামণি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল,
‘ আস্তে খা মা। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।’

আমি অসহায়ের মত একবার এর দিকে একবার ওর দিকে দেখছি।দুঃখে কষ্টে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।সব হয়েছে ওই লোকটার জন্য। ওইরকম রাগী রাগী ভাবে তাকাচ্ছিল এজন্যই তো ভয় পেয়ে আমি গরম দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ফেলেছি।
আমার অসহায়ত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়ে দুর্জয় ভাইয়া সোফা থেকে বলে উঠলেন,

‘ মা ও গরম দুধ খাওয়ার উপযুক্ত না।ফ্রিজ থেকে দুয়েক টুকরা বরফ এনে ছেড়ে দাও গ্লাসে।’

এই কথা শুনে ইমন ভাইয়া হেসে হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল।আপুরা মুখ ঢেকে হাসছে।শুধু আমি থমথমে মুখে দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here