বিরহে_মরণ পর্ব-০৬

0
586

#বিরহে_মরণ
পর্ব-০৬
১১.

অনুষ্ঠানে না বলতে বলতেও বেশ ভালই লোক হয়েছে। দুইপক্ষের লোক মিলিয়ে প্রায় একশজন। নিশিতা অনেকক্ষন ধরেই একা বসে। ফটোগ্রাফার মেয়েটা অনেক কাহিনী করে ছবি তুলে গেল। কোনো মানে হয় না এসবের। ইকবালকে এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছে। তার বন্ধুদের সাথে বেশ হেসে হেসে গল্প করছে। সে রাত্রিকে আসতে বলেছিল। কিন্তু রাত্রি বলে দিয়েছে সে আসবে না। অনেক রাগ করল তার সাথে। সে তো ইচ্ছে করে কিছু করেনি। ইকবাল পাশে এসে ধপ করে বসে পড়ল।
-কি ভাবছেন বেগম সাহেবা?
-বেগম সাহেবা মানে?
-মানে হচ্ছে আপনি আমার বউ। তাই আর কি.. একা একা তো অনেক ছবি তুলে ফেললেন। আসে দুজনে মিলে কিছু তুলি। নাকি সেটাতেও আপত্তি। শেষে সবাই মনে করবে আমরা একা একা বিয়ে করেছি।
নিশিতা হাসবে না হাসবে না বলেও হেসে ফেলল।
-বাহ হাসলে তো তোমাকে অনেক সুন্দর দেখায়। অবশ্য আজকে তোমাকে রাজেন্দ্রানীর মত লাগছে। এত স্নিগ্ধ বউ আমি কখনও দেখিনি।

দুজনের ছবি তোলা শেষ হতেই ইকবাল মেহমানদের সাথে কথা বলতে চলে গেল।
-আপু ধর তোর গিফ্ট।
একগুচ্ছ সাদা লিলি। সাথে একটা জুয়েলারি বক্স।
-কে দিল রে?
-শান্ত ভাইয়া।
-কোথায় উনি?
-চলে গেল তো।
-আমাকে বললি না কেন?
-তখন তো তুই দুলাভাইয়ের সাথে ছবি তুলতেছিলি। আর উনি আসতে চাননি।
নাফীস চলে গেল। সে জুয়েলারি বক্সটা খুললো। একজোড়া নুপুর। তার নীচে একটা চিঠি।
“ অনেক আগে কিনেছিলাম তোর জন্য। দেয়া হয়ে ওঠেনি। আজ না দিলে হয়তো আর দিতে পারতাম না। রাত্রিকে আসতে বলেছিলাম। ও আসলো না। তাই আমাকেই আসতে হল। নতুন জীবন অনেক অনেক সুন্দর হোক।”

-বাহ সাদা লিলি? কে দিল?
ইকবালের কথায় সে চমকে উঠলো। চিরকুটটা মুঠিবন্ধ করে ফেলল।
-আমার একজন পরিচিত পাঠিয়েছে।
-নুপুরগুলো তো অনেক সুন্দর। তাইতো আমার তো একদম নুপুর কেনার কথা মনে হয়নি। পরে ফেল। ওহ, তুমি কি করে পরবে? দাও আমি পরিয়ে দেই।
-আপনার কি মাথা খারাপ? এত মানুষের সামনে লজ্জা করবে না?
-লজ্জা করবে কেন? আমার বিবিজানকেই তো পরাবো। দাঁড়াও ফটোগ্রাফারকে ডাকি। একটা সুন্দর মুহূর্ত আটকে ফেলা যাবে।

এই লোকটাকে তো কোনোভাবেই কোনো কিছুতেই আটকানো যায় না। নুপুর পরিয়েই ছাড়লো। সবার সে কি হাসাহাসি।

বিদায়ের সময় বাবা মায়ের কান্না দেখে নিশিতার কেন জানি কোনো কান্না এল না। কেন জানি তার মনে হতে লাগলো সে মুক্তি পাচ্ছে। তার ভাগ্যে কি আছে সে জানে না তবে লোকটাকে আর যাই হোক তার বাবার মত মনে হচ্ছে না। নাফীসেকে ডেকে সে শুধু লিলিগুলো গাড়িতে তুলে দিতে বলল।

অনেক্ষন ধরেই এই ঘরটায় একা সে। ঘরটা খুব ছিমছাম। খুব সুন্দর করে সাজানো। শুধু সাদা রঙ্গের ফুলে। কেউ আসছে না দেখে নিশিতা নিজেই মেকাপ তুলে ফেলল। গোসল সেরে এসে দেখলো তার শাশুড়ী মা খাবার নিয়ে এসেছেন। সে গিয়ে উনার পাশে বসলো।
-তুমি খেয়ে নাও মা। বাইরে এত লোকের মধ্যে আরাম করে খেতে পারবে না। আমি একটু পরে ময়না কে পাঠিয়ে দেব।
-আপনারা খেয়েছেন?
-আগে মেহমানদের বিদায় দিয়ে নেই। তুমি খেয়ে রেস্ট নাও। ইকবাল তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে ছাদে। আমি একটু পরেই ডেকে পাঠাচ্ছি।

নিশিতা কাপড়গুলো গুছিয়ে রেখে গয়নাগুলো রাখার জন্য কাবার্ড খুললো। একপাশ খালি করে রাখা। একটা নীল খাম আর একটা আংটির বক্স। একটা ডায়ামন্ডের ইটারনিটি রিং। সে বক্স বন্ধ করলো। খামটা খুললো,

“আমায় দিও একটুখানি ছুঁয়ে,
আমায় দিও একটুখানি মন।
এ জনমের জন্ম-মৃত্যু জানে,
তুমি মানেই আমার সমর্পণ।”

সব আবার আগের মত করে রেখে। গয়নাগগুলো রেখে দিয়ে বিছানায় এসে বসলো। খেতে যদিও ইচ্ছা করছে না তবুও একটু খেয়ে নিল। খাবারের ট্রে টেবিলে রেখে দিয়ে ঘরের লাগোয়া বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালো। তার কি করা উচিত? মাথায় কিছু আসছে না।

-কি বিবিজান বারান্দায় কেন?
ইকবাল পাশে এসে দাঁড়ালো।
-এমনি বাইরে বেশ ভাল লাগছিল।
-এত গরমে কারো ভাল লাগে? ভেতরে চলো।
ইকবাল তার হাতটা ধরে ঘরে নিয়ে এল। ছোট্ট একটা ক্যারিঅন লাগেজ এনে রাখলো তার সামনে।
-দুই দিনের মত জামা কাপড় আর জরুরী জিনিস গুছিয়ে ফেল। আমরা কাল সকালেই কক্সবাজার যাব। আমার হাতে এবার বেশী সময় নেই। তা না হলে আরও অনেক সময় নিয়ে অন্যকোথাও যেতাম।
-কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে যাওয়া কি ঠিক হবে? বাসার সবাইকে বলা উচিত না?
-সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমার বাসায় সবাই জানে। আর কাল তুমি তোমার বাসায় ফোন করে দিও। আমি যাই গোসল করে ফেলি। যে গরম পড়েছে। পুরো সেদ্ধ হয়ে গেলাম।

এমন কত সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তার জন্য কে জানে? কিন্তু সে তো এসব কিছু চায়নি।

-এখনও বসে আছো? কি এত ভাবো সবসময়?
নিশিতা তাড়াতাড়ি করে কিছু কাপড় ভরতে থাকে।
-আরে এভাবে কিছু করবার দরকার নেই। তুমি তোমার মত সময় নাও। গুছানো হয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে উঠতে হবে। আমি এলার্মে দিয়ে রাখছি।
ময়নাকে ডেকে এনে বিছানা আর মেঝেতে পড়ে থাকা ফুলগুলো পরিস্কার করিয়ে নিল ইকবাল। তারপর শুয়ে পড়লো।
-ওকে ডাকলেন কেন? আমাকে বললেই তো হত?
-আমার কি মাথা খারাপ! নতুন বউকে দিয়ে আমি ঘর পরিস্কার করাবো। হয়েছে তোমার?
-জ্বি।
-তাহলে আলোটা নিভিয়ে দাও প্লিজ। আলো জ্বললে আমার ঘুম হয়না।
নিশিতা আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে বসতেই ইকবাল লাফিয়ে উঠলো।
-এইরে একদম ভুলে গেছি।
-কি ভুলে গেছেন?
সে কাবার্ড খুলে আংটির বাক্সটির নিয়ে পাশে এসে বসলো। নিশিতার হাতটা টেনে নিয়ে আংটিটা পরিয়ে দিল।
-আমার সব কিছু নিশ্চই তোমার বেশি বেশি মনে হচ্ছে?
-না তো।
-আমাকে কি তোমার বোকা বোকা মনে হয়। শুধু নিজের যা ভাল লাগে করি। নিজের ইচ্ছেগুলো তোমার উপর চাপিয়ে দেই। আসলে কি জানো আমি জানি আমাকে তোমার পছন্দ নয়। যাকে পছন্দ তাকেও আমি আজ দেখেছি। নুপুরটা তো তিনিই দিয়ে গেলেন নাফিসকে। উনি কিন্তু সত্যি তোমাকে ভালোবাসেন। আমরা গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত দাড়িয়ে ছিলেন। তুমি চাইলে কিন্তু তার কাছেও চলে যেতে পার। আমি কাউকে জোর করে আটকে রাখতে চাই না।
নিশিতা কাঁদতে লাগলো। ইকবাল নিশিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
-এই পাগল মেয়ে কাঁদছ কেন? তুমি কি বুঝতে পারো না আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি? তুমি এভাবে কাঁদলে কি আমার ভালো লাগবে? কান্না বন্ধ কর। যাও হাতমুখ ধুয়ে আস।

পরের দিন সকালে তাড়াহুড়া লেগে গেল। ইকবালের বোন ডেকে না দিলে তারা উঠতেই পারতো না। কক্সবাজারে এসে নিশিতার মনটা খুব ভাল হয়ে গেল। তার আগে কখনও কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি নানুবাড়ি আর দাদুবাড়ি ছাড়া। বাবা এসব ঘুরতে যাওয়া পছন্দ করতেন না। আর রিসোর্টা এত সুন্দর। সকালের নাস্তা করে তারা দুজনে সাগরপাড়ে হাটাহাটি করলো কিছুক্ষন। আকাশ পরিস্কার বলেই হয়তো রোদের তাপ অনেক বেশি।
-তুমি সানবার্ন লোশন লাগিয়েছিলে?
-না তো।
-চল চল চামড়া পুড়ে যাবে তো।
-আরে কিছু হবে না।
-কিছু হবে কিনা সে ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণাই নেই। বিকেলে আসবো। এখন চল।
খাওয়া দাওয়া সেরে তারা দুজনে এসে তারা তাদের ঘরের সাথের বারান্দায় বসে থাকলো কিছুক্ষন।
-তোমাকে রেখে যেতে কিন্তু আমার খুব কষ্ট হবে।
-কোথায় যাবেন?
-কোথায় যাব মানে। পরের সপ্তাহে তো আমাকে ফিরে যেতে হবে। এর মধ্যেই ভুলে গেছ।
-ওহ তাইতো। তাহলে থেকে যান।
-সত্যি বলছ থাকতে?
-না তো। আমার জন্য আপনার কেরিয়ার নষ্ট করবেন কেন। এতদিন কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন। আর তো কিছু দিন।
-তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না বল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি চলে গেলেই তুমি তার কাছে চলে যাবে।
নিশিতা চুপ করে থাকে। আসলেই কি শান্তর কাছে ফিরে যাবার কোনো পথ খোলা আছে?
-কি ভাবছো?
-কিছু না।
-আমি তোমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে। যা ভাল মনে হবে করবেন।
নিশিতা ঘরে এসে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বাহির করল লাগেজ থেকে। হাতমুখ ধুয়ে এসে শুয়ে পড়লো। কদিন খুব ধকল গেছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আচ্ছা লোকটা কই গেল? এখনও এল না তো। ঘুমিয়ে গেল সে।
ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলো ইকবাল তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। কখন এল? আর সে বুঝতেই পারলো না? আস্তে করে ইকবালের হাতটা সরিয়ে দিয়ে সে বাইরে এল। সুর্য ডুববে হয়তো আর কিছুক্ষনের মাঝে। এত সুন্দর মায়াময় পরিবেশ। সে দৌড়ে ঘরে এল।
-এইযে ওঠেন।
-কি হয়েছে?
-ওঠেন তো তাড়াতাড়ি।

ইকবাল কোন রকমে উঠে এল। আকাশ জুড়ে কমলা রং। অদ্ভুত ভাললাগায় ছেয়ে গেল মন। সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে দাড়িয়ে রইলো দুজনে। নিশিতাকে কাছে টেনে নিল সে। দুই হাতে নিশিতার মুখটা তুলে ধরলো। নিশিতা শক্ত হয়ে গেল সাথে সাথে। ইকবাল ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর হাতটা ধরল।
-আমি চাইলেই জোর করে অনেক কিছু করতে পারি। কিন্তু আমি তা করবো না। আমি চাই তুমি আমাকে আমার মত করে ভালবেসে আমার কাছে আস। ততদিন আমি অপেক্ষা করবো।

চলবে…..

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here