বিরহে_মরণ পর্ব-০৯

0
748

#বিরহে_মরণ
পর্ব-০৯
১৫.

আজকাল শান্ত আর এলিটাকে একসাথেই ইউনিভার্সিটি আসতে এবং ফিরতে দেখা যায়। দুজনের বোঝাপড়া বেশ ভাল হলেও শান্ত ঠিক আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। সে সম্পর্কটাকে মন থেকেই মানতে চায়। কিন্তু মাঝে মাঝে একটা ছায়া যেন ঘোরাঘুরি করে। নিশিতার কথা বলা হয়নি এলিটাকে। সে প্রায় বলতে চায় , বলা হয়ে ওঠে না। আজ বলে ফেলবে। ছুটির দিন তবুও ঘুম ভেঙ্গে গেছে শান্তর। অনেক্ষন ধরে বিছানায় গড়াগড়ি করল। বসায় কথা বলতে হবে। ফোনটা হাতে নিতেই এলিটার ম্যাসেজটা দেখলো।
-“ঘুম ভেঙ্গেছে হুতুম পেঁচা।”
-“হমম”
-“শুধু হমম, আর কিছু না?”
-“বাসায় কথা বলবো।”
-“দুপুরে খেয়ে বাহির হব কিন্তু, আর তুমি চলে আস একসাথে খাব।”
-“আচ্ছা আমি চলে আসবো।

মার ফোনে ফোন দেবার পরেও রাত্রিই ফোন ধরল, হড়বড় করে এক সাথে কথা বলা শুরু করল।
-মা তোমার পুত্র ফোন করেছে। আগে প্রতিদিন ফোন করতো এখন বউ পেয়ে আমাদের ভুলে গেছে।
-কি সব বলিস?
-মিথ্যা বলেছি বলো? আগে ফোন করতে না প্রতিদিন?
-এখন অনেক ব্যাস্ত থাকি।
-এই সব বলে লাভ নেই।
-মাকে দে তো। অযথা বকবক।

-কেমন আছো মা?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো বাবা। তোকে নিয়ে যে টেনশন ছিল তা চলে গেছে আর কি লাগে।
-অযথা টেনশন করতে মা।
-এখন বুঝবি না বাবা। নিজের যখন হবে বুঝতে পারবি। এখন তোর বিয়ের অনুষ্ঠান ভালই ভালই হয়ে গেলেই আমার টেনশন শেষ।
-সে তো অনেক দেরি মা। এখন থেকেই এত ভাববার কি আছে।
-এলিটার পরিবারের সবাইকে দাওয়াত করেছি পরের শুক্রবারে। সাথে তোর চাচাদেরও বলেছি।
-তুমি সব কিছুতেই বেশি বেশি কর মা।
-এসব করতে হয় বাবা। তোরা এনগেজমেন্টের ডেট ঠিক করে ফেল। আর সুন্দর একটা আংটি কিনবি।
-কিনবো মা।
-ড্রেস ডিজাইনার তোদের ড্রেস এই সপ্তাহেই দিবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দেব।
-এত কিছু কেন করছ মা। আমার তো এসব ভাল লাগে না।
-পাগল আজকাল সবাই এসব করে।
-আচ্ছা মা গ্রোসারী করতে যাব। এলিটা অপেক্ষা করছে।
-আচ্ছা যা বাবা, সাবধানে থাকিস।

গ্রোসারী শেষ করে বাসায় রেখে তারা দুজনে বাড়ির পাশের পার্কটায় এসে বসলো।
-তোমাকে অনেকদিন থেকে কিছু কথা বলব বলব বলে ভাবছি।
-আমি জানি কি বলবে?
-কি বলবো?
-নিশিতার কথা তো?
-তুমি জানলে কি করে?
-রাত্রি বলেছে। ওরই তো বন্ধু তাইনা?
-তুমি কিছু মনে করছ না?
-মনে করবো কেন। তোমার তো তার সাথে তেমন কিছু ছিল না। আর আমিও তো একজনকে পছন্দ করতাম। পছন্দই বা বলছি কেন? আমাদের প্রায় বছরখানেকের মত রিলেশনও ছিল। কিন্তু পরে জানতে পারলাম সে ড্রাগ এডিক্ট। আমি সরে এসেছিলাম। এখন বল তুমি কি এর জন্য আমাকে রেখে চলে যাবে।
-তা যাব কেন? কিন্তু আমার জীবনে নিশিতার স্থান আমি সত্যি কাউকে দিতে পারবো না।
-এখন কিন্তু আমার সত্যি রাগ লাগছে।
-তাইতো তোমাকে বলতে চাইছিলাম এখনও সময় আছে চিন্তা করে দেখ।
-তার মানে তুমি আমাকে তোমার জীবন থেকে চলে যেতে বলছ?
-সেটা বলিনি। পরে যদি তোমার অন্য কিছু মনে হয়। তখন তো আরো বেশী সমস্যা হয়ে যাবে।
-আমি কি তোমাকে জোর করছি?
-মেয়েরা তো এই সব বিষয়ে অনেক ইনসিকিউরিটি তে ভোগে। তাই বলছি।
-তোমাকে তোমার মন বুঝতে হবে। তুমি আসলে কি চাও। আমার মনে হয়ে আমাদের সম্পর্কটাকে আরও কিছুদিন সময় দেয়া দরকার ছিল। এক কাজ কর। তুমি আসলেই কিছুদিন সময় নাও।
-সত্যি সময় নিতে বলছ?
-সত্যি বলছি। এমন দ্বিধা নিয়ে আসলেই কিছু করা ঠিক হবে না। আমি এখন যাই।

এলিটা চলে যাবার পরও শান্ত কিছুক্ষন একা বসে থাকল। ও কি রাগ করে চলে গেল। বোকার মত কাজ করলো নাকি? কিন্তু কেন সে নিশিতাকে ভুলতে পরে না। সে বাসায় ফিরে এল। কিছুই ভাল লাগছে না। এলিটাকে ফোন করল। ফোনটা বন্ধ। কি আজব মেয়েরে বাবা। ফোন বন্ধ করবার মানে কি? সারা রাত সে কিছুক্ষন পর পর ফোনে চেষ্টা করলো।

রবিবার দিনটা কত সুন্দর কেটেছে গত কয়েক সপ্তাহ। তারা রবিবারে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেডিয়েছে। আজ এলিটার কোনো খবর নেই। সকাল হওয়া মাত্র সে এলিটার বাসায় এসে নক দিল। এলিটা দরজা খুলে ভেতরে চলে গেল।
-এত সকালে?
-ফোন বন্ধ কেন?
-আমার ফোন আমি বন্ধ রেখেছি তাতে তোমার কি?
-টেনশন হয় না? যদি আবার অসুস্হ হয়ে যাও?
-তোমার টেনশন না করলেও চলবে। তুমি তোমার নিশিতার কথা ভাব।
-বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? আমি তো তোমাকে এই কারণেই নিশিতার কথাটা বললাম যেন তুমি আমাকে বুঝতে পার। তা না করে তুমি ব্যাপারটাকে আরও কমপ্লিকেটেড করছ।
-তুমি বল যে তোমার একজনের সাথে বিয়ে ঠিকঠাক আর তাকে তুমি বলছ তুমি একজনকে পছন্দ করতে যাকে তুমি ভুলতে পারবে না যার স্হান কাউকে দিতে পারবে না। তাহলে তার মনের অবস্হাটা কি হবে?
-আমি এত কিছু চিন্তা করে কিছু বলি নি।
-তাহলে এখন চিন্তা কর। সেই সময়টুকু তো তোমাকে দিলাম। ফোন করবার দরকার নেই। আমি ঠিক আছি। এখন যাও।

শান্ত উঠে এসে এলিটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
-এমন কোরো না প্লিজ। আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না। তোমার ফোন বন্ধ আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি।
-তুমি ভাব শান্ত। আমার আসলেই কোনো তাড়াহুড়া নেই। বাসা থেকে চাচ্ছিল বলেই সব এত তাড়াতাড়ি করবার প্লান করতে হয়েছে।
-কি ভাবতে বলছো আমাকে?
-এই যে তুমি আসলে কি চাও?
-আমি কিছু ভাবতে চাই না। আমাকে এভাবে কষ্ট দিও না প্লিজ।
-কিন্তু
-একদম চুপ একটা কথাও বলবে না।
-কেন বলবো না?
-বললে শাস্তি পাবে।
-কিসের শাস্তি?
শান্ত এলিটাকে আর কিছু বলতে দিল না। তার ঠোঁট দুটোকে নিজের ঠোঁটে দিয়ে শুষে নিতে লাগল।

১৬.

কিছু কিছু মানুষের জন্মই হয় শুধু কষ্ট পাবার জন্য। নিশিতার জীবনটাও ঠিক তেমন। ইকবাল এসেছিল তার জীবনে ধূমকেতু হয়ে। তার আকাশে কিছুদিন উজ্জল হয়ে জ্বলে হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। একটা দুর্ঘটনা যে মানুষকে কতটা নিঃস্ব করে দেয় সেটা যার জীবনে ঘটেছে সেই জানে।

সব কিছু পেছনে ফেলে সে সত্যি চলে এসেছিল। দুজনের সংসারও গুছিয়ে নিয়েছিল সুন্দর করে। স্বপ্নের মত কেটে গিয়েছিল কয়েকটা বছর। ইকবাল তাকে নিয়ে ঘুরবে বলে পনেরো দিনের একটা ট্যুর প্লান করে ফেলল। সামনেই তাদের থার্ড এনিভারসারী। আর তার দুজনে যাবে। ড্রাইভ করে ঘুরবে। এত সুন্দর সময় কাটলো দুজনের যেন পুরোটাই স্বপ্ন। ফেরবার পথে দুজনেই ক্লান্ত। নিশিতা ঘুমিয়ে পড়েছিল। অন্য গাড়িচালক স্টপ সাইন মিস করেছিল বোধহয়। পুরো গাড়িটা দুইবার ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে পড়েছিল হাইওয়ে থেকে। তার জ্ঞান ফিরেছিল প্রায় দুই দিন পর। সেও যে বেঁচে যাবে সেটা ডাক্তাররাও ভাবতে পারেনি। অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হল। প্রথম দিকে মনে হত তার সব হাড়ই বোধহয় ভেঙ্গে গেছে। মুখের একপাশটা এখনও কালো দাগ আর কাটাকাটিকে ভরা। হাড় জোড়া লাগবার পর ফিজিও থেরাপি নিতে হয় রেগুলার। এতদিন পরেও একটা পা এখনও অবশ তার। তবে ক্রাচে ভর দিয়ে সে হাঁটা চলা করতে পারে। চাচাতো বোনের বাসায় প্রায় ছয় মাস ধরে আছে। আপা আর দুলাভাই নিজরাই হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছিল। তা না হলে বাবা চাইছিলেন কোনো ভাবে যদি ইকবালের লাশ যে ফ্লাইটে পাঠানো হয়েছে সেটাতেই তাকে পাঠানো যায়। আপা খুব রাগ করেছিল। বলেছিল এভাবে পাঠালে তো ও মরে যাবে রাস্তায়। একটু সুস্থ্য হলেই পাঠিয়ে দেবে।

শেষ পর্যন্ত সামনে মাসের টিকেট কেটেছে সে। এবার দেশে ফেরাবর পালা। কিন্তু দেশে ফিরলে কি সে ভাল থাকবে? কত লোক কত কিছুই না বলবে। শশুর বাড়ির লোকেরা তো অপয়া বলে। আচ্ছা কি এমন হত যদি সেও মরে যেত। এই জীবন বয়ে বেড়ানোর কষ্ট আর সে নিতে পারছে না। এসব চিন্তা করলেই তার ভয় করে। আপা অবশ্য সব সময় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। একজন সইক্রিয়াটিস্ট এর কাছেও যায় সে। বাবা মা এখন প্রতিদিন ফোন করেন। বাবা অনেক কান্নাকাটি করেন। কিন্তু এসব কোনো কিছু আর তাকে স্পর্শ করে না। একটা বিশাল অন্ধকারে সে মাঝে মাঝেই তলিয়ে যেতে থাকে।

বেশিরভাগটা সময় তার ঘরেই কাটে। কিছু করার নেই তেমন। নিজের জন্য না, ইকবালের জন্য সে নামাজ পড়ে, বিভিন্ন আমলও করে। মাঝে মাঝে গল্পের বই পড়ে। আপুর পিচ্চি মেয়েটাও স্কুলে যায়। বাসায় থাকলে এসে টুকটুক করে গল্প করে। ওর কথা শুনলে মন ভাল হয়ে যায়।

বাইরে তার যাওয়া হয়না তেমন শুধু ডাক্তার আর ফিজিও। সিঁড়ির দিয়ে উঠতে নামতে এখনও বেশ কষ্ট হয়। এই কষ্টটা হয়তো থেকে যাবে আজীবন। সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খাবার ঘরে এসে বসলো। এখানের উইনডো দিয়ে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। আকাশটা দেখতে বেশ ভাল লাগে।

-কি করছো আপা?
-এক পরিচিতর এনগেজমেন্ট। এই উইকএন্ডেই। রান্নার কথা তো আগেই বলে রেখেছিল। দেখছিস তো সব মিলিয়ে কত ব্যস্ততা যায়। সাহায্য করবার কেউ থাকলে ভাল হতো।
-তুমি পারো আপা। সারা সপ্তাহ জব কর। নিজের ঘরের কাজ আবার এই রান্না। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া আমি।
-কি যে বলিস। রান্না তো সব সময় করি না । মাঝে মাঝে করতে ভালই লাগে।
-কি করতে হবে বলো। আমি কিছু করে দেই।
-তাহলে তুই আদা আর রসুন আর পেয়াজগুলো ছিলে দে মনা। আর আমি ব্লেনডার দিয়ে যাচ্ছি। ব্লেন্ড করে ফেল। পারবি তো?
-কেন পারবো না? পোগ্রাম কবে?
-কাল সন্ধ্যায়।
-তোমাকে বলেছে?
-বলেছে। মনে হয় না যাব। আর কাল তো তোর ফিজিও আছে।
-তাতে কি আমি ক্যাবে চলে যাব।
-আরে না তোর ভাইয়াকে বলে রেখেছি। তোকে নিয়ে যাবে।
-কেন যে ভাইয়াকে এত যন্ত্রনা দাও। আমার সত্যি খুব খারাপ লাগে।
-বেশি পাকনামি করতে হবে না। আর তো কয়েকটা দিন তারপর তো চলেই যাবি। কি থেকে যে কি হয়ে গেল।
নিশিতার কান্না চলে এল। পেয়াজগুলো নিয়ে কাটতে শুরু করল। সে তো ভুলে থাকতে চায়। কেন যে সবাই মনে করিয়ে দেয়?

চলবে…

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here