বিরহে_মরণ পর্ব-১০

0
733

#বিরহে_মরণ
পর্ব-১০

১৬.

কিছু কিছু মানুষের জন্মই হয় শুধু কষ্ট পাবার জন্য। নিশিতার জীবনটাও ঠিক তেমন। ইকবাল এসেছিল তার জীবনে ধূমকেতু হয়ে। তার আকাশে কিছুদিন উজ্জল হয়ে জ্বলে হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। একটা দুর্ঘটনা যে মানুষকে কতটা নিঃস্ব করে দেয় সেটা যার জীবনে ঘটেছে সেই জানে।

সব কিছু পেছনে ফেলে সে সত্যি চলে এসেছিল। দুজনের সংসারও গুছিয়ে নিয়েছিল সুন্দর করে। স্বপ্নের মত কেটে গিয়েছিল কয়েকটা বছর। ইকবাল তাকে নিয়ে ঘুরবে বলে পনেরো দিনের একটা ট্যুর প্লান করে ফেলল। সামনেই তাদের থার্ড এনিভারসারী। আর তার দুজনে যাবে। ড্রাইভ করে ঘুরবে। এত সুন্দর সময় কাটলো দুজনের যেন পুরোটাই স্বপ্ন। ফেরবার পথে দুজনেই ক্লান্ত। নিশিতা ঘুমিয়ে পড়েছিল। অন্য গাড়িচালক স্টপ সাইন মিস করেছিল বোধহয়। পুরো গাড়িটা দুইবার ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে পড়েছিল হাইওয়ে থেকে। তার জ্ঞান ফিরেছিল প্রায় দুই দিন পর। সেও যে বেঁচে যাবে সেটা ডাক্তাররাও ভাবতে পারেনি। অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হল। প্রথম দিকে মনে হত তার সব হাড়ই বোধহয় ভেঙ্গে গেছে। মুখের একপাশটা এখনও কালো দাগ আর কাটাকাটিকে ভরা। হাড় জোড়া লাগবার পর ফিজিও থেরাপি নিতে হয় রেগুলার। এতদিন পরেও একটা পা এখনও অবশ তার। তবে ক্রাচে ভর দিয়ে সে হাঁটা চলা করতে পারে। চাচাতো বোনের বাসায় প্রায় ছয় মাস ধরে আছে। আপা আর দুলাভাই নিজরাই হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছিল। তা না হলে বাবা চাইছিলেন কোনো ভাবে যদি ইকবালের লাশ যে ফ্লাইটে পাঠানো হয়েছে সেটাতেই তাকে পাঠানো যায়। আপা খুব রাগ করেছিল। বলেছিল এভাবে পাঠালে তো ও মরে যাবে রাস্তায়। একটু সুস্থ্য হলেই পাঠিয়ে দেবে।

শেষ পর্যন্ত সামনে মাসের টিকেট কেটেছে সে। এবার দেশে ফেরাবর পালা। কিন্তু দেশে ফিরলে কি সে ভাল থাকবে? কত লোক কত কিছুই না বলবে। শশুর বাড়ির লোকেরা তো অপয়া বলে। আচ্ছা কি এমন হত যদি সেও মরে যেত। এই জীবন বয়ে বেড়ানোর কষ্ট আর সে নিতে পারছে না। এসব চিন্তা করলেই তার ভয় করে। আপা অবশ্য সব সময় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। একজন সইক্রিয়াটিস্ট এর কাছেও যায় সে। বাবা মা এখন প্রতিদিন ফোন করেন। বাবা অনেক কান্নাকাটি করেন। কিন্তু এসব কোনো কিছু আর তাকে স্পর্শ করে না। একটা বিশাল অন্ধকারে সে মাঝে মাঝেই তলিয়ে যেতে থাকে।

বেশিরভাগটা সময় তার ঘরেই কাটে। কিছু করার নেই তেমন। নিজের জন্য না, ইকবালের জন্য সে নামাজ পড়ে, বিভিন্ন আমলও করে। মাঝে মাঝে গল্পের বই পড়ে। আপুর পিচ্চি মেয়েটাও স্কুলে যায়। বাসায় থাকলে এসে টুকটুক করে গল্প করে। ওর কথা শুনলে মন ভাল হয়ে যায়।

বাইরে তার যাওয়া হয়না তেমন শুধু ডাক্তার আর ফিজিও। সিঁড়ির দিয়ে উঠতে নামতে এখনও বেশ কষ্ট হয়। এই কষ্টটা হয়তো থেকে যাবে আজীবন। সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খাবার ঘরে এসে বসলো। এখানের উইনডো দিয়ে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। আকাশটা দেখতে বেশ ভাল লাগে।

-কি করছো আপা?
-এক পরিচিতর এনগেজমেন্ট। এই উইকএন্ডেই। রান্নার কথা তো আগেই বলে রেখেছিল। দেখছিস তো সব মিলিয়ে কত ব্যস্ততা যায়। সাহায্য করবার কেউ থাকলে ভাল হতো।
-তুমি পারো আপা। সারা সপ্তাহ জব কর। নিজের ঘরের কাজ আবার এই রান্না। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া আমি।
-কি যে বলিস। রান্না তো সব সময় করি না । মাঝে মাঝে করতে ভালই লাগে।
-কি করতে হবে বলো। আমি কিছু করে দেই।
-তাহলে তুই আদা আর রসুন আর পেয়াজগুলো ছিলে দে মনা। আর আমি ব্লেনডার দিয়ে যাচ্ছি। ব্লেন্ড করে ফেল। পারবি তো?
-কেন পারবো না? পোগ্রাম কবে?
-কাল সন্ধ্যায়।
-তোমাকে বলেছে?
-বলেছে। মনে হয় না যাব। আর কাল তো তোর ফিজিও আছে।
-তাতে কি আমি ক্যাবে চলে যাব।
-আরে না তোর ভাইয়াকে বলে রেখেছি। তোকে নিয়ে যাবে।
-কেন যে ভাইয়াকে এত যন্ত্রনা দাও। আমার সত্যি খুব খারাপ লাগে।
-বেশি পাকনামি করতে হবে না। আর তো কয়েকটা দিন তারপর তো চলেই যাবি। কি থেকে যে কি হয়ে গেল।
নিশিতার কান্না চলে এল। পেয়াজগুলো নিয়ে কাটতে শুরু করল। সে তো ভুলে থাকতে চায়। কেন যে সবাই মনে করিয়ে দেয়?

১৭.

এলিটা শান্তর এনগেজমেন্টের এরেন্জমেন্ট শান্তর বাসাতেই হচ্ছে। গেস্ট তেমন একটা বেশি না। বিশ জনের মত। পরিচিত কয়েকজন মিলে বেশ সুন্দর করে বেলুন আর ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখে গেছে। খাবার আর কেক অর্ডার এলিটা আগেই করে রেখেছে। শান্তর যেয়ে নিয়ে আসবার কথা। গেস্ট আসবার আগেই তাকে খাবার নিয়ে আসতে হবে। শান্ত প্রথমে এলিটাকে আনতে গেল। ওকে তার বাসায় রেখে তারপর সে যাবে।

সেলুনের সামনে গিয়ে এলিটাকে ফোন করল শান্ত। তার একটু পরেই এলিটা বেরিয়ে এল। লেভেন্ডার গাউন পরে একটা বারবি ডল দাড়িয়ে আছে তার সামনে।
-কেমন লাগছে বলোতো?
-কাছে আসো বলছি।
-এখন ঢং করবে না একদম। আমার মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে।
-আচ্ছা ঢং করবো না। তাড়াতাড়ি চল। অনেক কাজ বাকি।

জিপিএস এ দেয়া ঠিকানা দেখে বাড়িটায় খুব সহজেই পৌছে গেল শান্ত। বেশ বড় বাড়ি। আর এলাকাটাও বেশ সুন্দর। ছবির মত সবকিছু সাজানো। সে বেল বাজাতেই মহিলা দরজা খুললেন।
-আসাসালামুয়ালাইকুম আপু।
-ওয়ালাইকুমআসসালাম। তুমি নিশ্চই শান্ত।
-জ্বি আপু।
-এস ভেতরে।

শান্ত লিভিং রুমে গিয়ে বসল।
-কি খাবে বল চা, কফি নাকি ঠান্ডা কিছু?
-কিছু না আপু দেরি হয়ে যাবে। আপনারা কখন আসবেন।
-সরি ভাই, এলিটাকে বোলো একটু সমস্যায় পড়ে গেছি। আসতে পারবো না। তোমাদের জন্য অনেক শুভ কামনা।
-ঠিক আছে আপু। আজ তাহলে উঠি।
-ভাই তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে। খাবার সব প্যাক করা তুমি যদি একটু কষ্ট করে নিয়ে যেতে।
-কোনো সমস্যা নেই আপু আমি আনছি।
শান্ত এক এক করে খাবারের ট্রে গাড়িতে ভরতে লাগলো। মহিমা নিজেও কয়েকটা ট্রে এগিয়ে দিল। তার গাড়ির পাশে আরেকটা গাড়ি কখন নিশব্দে এসে দাড়িয়েছে শান্ত টের পায়নি। সে খাবার ঠিক করে রাখছিল। একটু এদিক ওদিক হলেই পড়ে যেতে পারে।

“মা -বাবা এসেছে” পিচ্চিটা যখন দৌড়ে এল তখন সে ডিকি বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
মহিমা এগিয়ে এসে ততক্ষনে নিশিতাকে সাহায্য করছে গাড়ি থেকে নামতে। শান্ত নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। সে সামনে এগিয়ে গেল। নিশিতা মহিমাকে ধরে দাড়িয়ে ক্রাচটা হাতে নিয়ে দাড়িয়েছে মাত্র।
-তুই?
নিশিতা মাথার কাপড়টা টেনে দেয়।
-আরে আপনি এখানে?
মহিমা বলল,
-চিনিস নাকি? ওনারি তো এনগেজমেন্ট আজ।
-চিনবো না কেন? আমার বান্ধবীর বড় ভাই। অনেক অভিনন্দন। ভাবিকে নিয়ে আসবেন একদিন। আপা আমি যাই। তোমরা কথা বল।
শান্তকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিশিতা চলে গেল। শান্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকলো যতক্ষন ওকে দেখা যায়।
-কিছু মনে কোরো না ভাই। ও আসলে মেন্টালি অনেক আপসেট আর শকড। শরীরও ভাল নেই দেখতেই তো পেলে। বেঁচে আছে এটাই একটা মিরাকেল।
-কি হয়েছিল?
-কার একসিডেন্ট। ইকবাল তো সেখানেই মারা গেছে। ওকে পরে পুলিশ হাসপাতালে আনে। শুভ কাজের সময় তোমাকে এসব কেন বলছি। এলিটাকে নিয়ে এস একদিন।

এলোমেলো ভাবে কিছুক্ষন গাড়ি চালাল সে। তারপর কেকের দোকান থেকে কেক পিক করে ফিরে এল। সবাই এসে গেছে। সে কি করবে? এলিটাকে সব খুলে বলবে?
-যাও কাপড় বদলে আস তাড়াতাড়ি এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
শান্ত রোবটের মত কাপড় বদলাতে গেল। যে যা বলল সে তাই শুনলো। সব কিছু খুব সুন্দর ভাবে হয়ে গেল। সবাই চলেও গেল।
-কি হয়েছে তোমার?
-কিছু না তো?
-মন খারাপ?
-এমনি বাসার জন্য মনটা খারাপ লাগছে। চল তোমাকে দিয়ে আসি।
-চল, আমিও টায়ার্ড অনেক।

বাসায় এসেই সে রাত্রিকে ফোন করল।
-ভাইয়া ছবি কই?
-তুই নিশিতার কথা জানতি?
রাত্রি চুপ করে থাকে।
-কথা বলছিস না কেন?
-হ্যা জানতাম। নাফীস বলেছিল।
-বলিসনি কেন?
-বলে কি হবে? অপয়া একটা। ও আর আমাদের জীবনে নেই ভাইয়া। সবকিছু যেমন চলছে চলতে দাও। ভুলে ছিলে যেমন তেমনই থাকো।
-তুই থামবি। আর একবার যদি ওই কথা উচ্চারণ করেছিস।
-মাথা ঠান্ডা কর। এলিটা বড় ভাল মেয়ে। দেখবে তুমি খুব ভাল থাকবে।
-তোর তো আমাকে বোঝা উচিত ছিল।
-আমি যা ভাল বুঝেছি তাই করেছি।

শান্ত ফোন রেখে দেয়। এত কষ্ট। বুকের ভেতর একটার পর একটা পাহাড় চেপে বসে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। নিশিতা ভাল থাকুক এটাই তো চেয়েছিল। তবে কেন এমন হল?

চলবে…

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here