বিরহে_মরণ পর্ব-১১

0
687

#বিরহে_মরণ
পর্ব-১১

১৮.

আজকাল শান্ত আরও বেশী চুপচাপ হয়ে গেছে। ল্যাবের সময়টা তারা এক সাথে থাকলেও তেমন কথা হয় না দুজনের। শুধু মাত্র দায়িত্ব পালন করতে হয় বলেই যেন সে এলিটার সাথে সাথে থাকে।
-আজ রাতে আমি রান্না করব। তুমি চলে এস।
-কিছু বললে?
-বললাম অনেকদিন একসাথে খাওয়া দাওয়া করা হয় না। রাতে চলে এস।
-আজ পারবো না। তোমারও ও তো ডিগ্রী শেষ করতে হবে। এখন একটু মন দিয়ে কাজ কর।
এলিটা নিজের চেয়ারটা শান্তর সামনে নিয়ে বসে।
-তোমার কি হয়েছে? আমাকে তো বলতে পারো?
-কিছু হয়নি।
-কেন মিথ্যা বলছ?
-এখন কথা বলতে ভাল লাগছে না।

এলিটার মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেল। কিন্ত সে কথা বাড়ালো না। নিজের ডেস্কে ফিরে এল। যা হবার হবে। আসলেই নিজের ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত তার। সম্পর্কগুলো এত ভঙ্গুর আজকাল। এই আছে এই নেই।

বিকেলে ল্যাব থেকে বেরিয়ে বাসায় এসেই শান্ত গাড়ি নিয়ে মহিমার বাসায় এল। মহিমা তখন বাসার সামনের লনের ঘাস পরিস্কার করছে। পিচ্চিটা তার বাবার সাথে খেলছে।
-আরে তুমি?
সালাম বিনিময় করার পর মহিমা শান্তকে বাসায় এনে বসালো।
-তুমি একা এলে? এলিটা কোথায়?
-এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। তাই ভাবলাম নিশিতার খোঁজ নিয়ে যাই।
-ও তো চলে গেছে দেশে গত সপ্তাহে।
-এই অবস্হায় কি করে গেল?
-আসলে ওর বাবা মা অনেকদিন থেকেই চাচ্ছিল। আমিই যেতে দিই নি। এখন তো তবুও চলা ফেরা করতে পারে। এখানে বেশীরভাগ সময় একা থাকতো আর ডিপ্রেশনে ভুগতো। দেশে হয়তো ভাল লাগবে।
-আচ্ছা আপু আজ তাহলে আসি।
-বসো একসাথে ডিনার করি। সেদিনও খালি মুখে চলে গেছ।
-আজ না আপু। অবশ্যই আসবো।

বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িটা চালিয়ে একটা নির্জন জায়গা দেখে পার্ক করে। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। সে কেন এতটা সময় নিল? কেনই বা সব জানার পরেও এলিটাকে জানালো না সবকিছু। তাহলে হয়ত আজ সে নিশিতার পাশে থাকতে পারতো।

সুপারভাইজারের সাথে কথা বলতে হবে। আর দেরি করা যাবেনা। দেশে ফিরতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। নিজের কাজটুকু যতটা সম্ভব গুছিয়েও রেখে যেতে হবে।

-তুমি নাকি দেশে যাচ্ছ।
-হ্যা। কে বলল?
-স্যারের কাছে শুনলাম। ভালই হয়েছে চল এক সাথে যাই।
-তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।
-কি?
-নিশিতা অনেক কষ্টে আছে এলিটা। আমি ওর পাশে থাকতে চাই।
-তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর কোথায় পেলে নিশিতাকে?
-তোমার মহিমা আপুর বাসায়। ওনার কাজিন ও।
-ওহ তাহলে এই নিশিতাই তোমার নিশিতা। আগে জানলে আমি কখনও তোমাকে সেখানে পাঠাতাম না।
-পাঠিয়ে ভুল করনি। আল্লাহ নিশ্চই এটাই চেয়েছিলেন।
-ফাল্তু কথা একেবারে বলবে না।
-আমি কিন্তু তোমায় আগেই বলেছিলাম নিশিতার জায়গাটা আমি কাউকে দিতে পারবো না।
-ছিঃ, লজ্জা করছে না এ কথা বলতে? তোমার মত নীচ, ইতরের সাথে কথা বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে।
-এখানে এভাবে সিনক্রিয়েট কোরো না। মাথা ঠান্ডা কর। চল বাইরে কোথাও বসি।
-তোমার সাথে কোথাও বসতে আমার রুচীতে বাঁধবে।
-মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করে দেখোতো? তুমি আমার জায়গায় থাকলে কি করতে? তোমার ভালবাসার মানুষ কষ্টে আছে জেনেও নিজে ভাল থাকবে বলে সব কিছু ইগনোর করতে পারতে?
-আমি এসব ভাবতে চাই না।
-আচ্ছা তুমি তোমার মত করেই না হয় ভাব।
শান্ত বেরিয়ে আসে ল্যাব থেকে। নিজের কথাগুলো বলতে পেরে ভাল লাগছে। এই বোঝা বয়ে বেড়ানো যাচ্ছিল না।

দেশের মাটিত পা রেখেই তার মন ভাল হয়ে গেল। কতদিন পরে পরিচিত শহরে ফিরে এল। এতদিন কি করে ছিল দেশ ছেড়ে। বাসায় এসে দেখলো মায়ের মুখ ভার। মাকে জড়িয়ে ধরল যেয়ে।
-অনেক জার্নি করে এলে নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও। গোসল সেরে নাও। আমি তোমার খাবার দিতে বলছি।
-কি হয়েছ মা?কেন এমন করছ? কি অপরাধ আমার?
-বড় হয়েছ এখন। তোমরা সব তোমাদের সিদ্ধান্তে চলবে। বরং আমি কিছু বললেই তোমার মনে হবে অন্যায় কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি।
-আমি সত্যিই কোনো ভুল করিনি।
-এখন যাও শান্ত। পরে কথা বলবো।
শান্ত নিজের ঘরে আসে। গোসল সেরে এসে শুয়ে পড়ে। নতুন এক পরীক্ষার মাঝে পড়ল বোধহয়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে।

১৯.

পুরোনো বাড়িতে নিশিতাদের পাওয়া গেল না। নিজাম সাহেব নাকি অনেক আগেই বাসা বদলেছিলেন। রাত্রির কাছেই যেতে হবে। ওর কাছে যদি নাফিসের ফোন নাম্বার থাকে। তার বোন এতই রাগ করেছে যে সে দুদিন হল এসেছে তবুও দেখা করতে আসেনি। গাড়ি চালিয়ে সে চাচার বাসায় চলে এল। বেশ কিছুক্ষন বসার পর রাত্রি এল।
-কেন এসেছ?
-তোকে দেখতে।
-তোমার লজ্জা করলো না ভাইয়া। তুমি একটা মেয়ের সাথে এমন করলে।
-জোর করে কি কিছু করা যায়? নাকি ভাল থাকা যায়?
-জোর আবার কি? তাহলে ওর সাথে ঘুরেছ ফিরেছ কেন? কেন স্বপ্ন দেখিয়েছ?
-আমার কিছু করার নেই রে।
-তোমার এইসব কথা শুনতে যে আমার কি অসহ্য লাগছে।
-তোর সাথে কি নিশিতার যোগাযোগ হয়? ওদের নতুন বাড়ির ঠিকানা কি আছে বা নাফিসের ফোন নাম্বার?
-ওহ, তাহলে আমার সাথে দেখা করতে আসনি। নিজের দরকারে এসেছো।
-প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য কর।
-আমি কোনো সাহায্য করতে পারবো না। তুমি চলে যাও।
-কেন এমন করছিস সবাই তোরা?
-আমরা একটা সমাজে বাস করি ভাইয়া। এলিটার পরিবারের কাছে কত ছোট হতে হল আমাদের।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আসি তাহলে।

নিশিতার আগের ফোন নাম্বারটাও যদি খোলা থাকত তবে কিছু একটা করা যেত। কি করবে এখন। নিশিতাদের আগের বাড়িওয়ালা বলেছিল ওরা জিগাতলার দিকে চলে এসেছে
তাই সেখানকার অলি গলিতে খুঁজতে লাগল। যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তার হাতে সময় বেশি নেই। ফিরে যেতে হবে।

শাহানা না পেরে রাত্রিকে ফোন করলেন। ছেলেটার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। সারাদিন কোথায় কোথায় পাগলের মত ঘোরে। মুখ শুখিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।
-কেমন আছ মা?
-আছি। তুই কি আসতে পারবি?
-এখন তো পারবো না।
-তোর কাছে কি ওই মেয়েটার যোগাযোগ নাম্বার আছে?
-তুমি কি সব ভুলে গেলে।
-এসব কোনো কিছুই আমার ছেলের থেকে বেশি না রে মা। তোর কাছে কোন রকম যোগাযোগের রাস্তা থাকলে আমাকে বল। আমি নিজে যাব ওদের বাসায়।
-আচ্ছা আমি দেখি কি করা যায়।

সন্ধ্যার পরে রাত্রি নিজে এল। শাহানা মাগরিবের নামাজ পড়ে দোয়া পড়ছিলেন। রাত্রিকে দেখে উঠে এলেন। কাজের মেয়েটাকে নাস্তা বানাতে বলে এসে খাবার টেবিলে বসে পড়লেন।
-ভাইয়া বাসায় আছে?
-আছে। নাম্বার পেয়েছিস?
-তুমি চিন্তা ভাবনা করে যোগাযোগ করতে চাচ্ছ তো? এক্সিডেন্টের পরে কিন্তু নিশিতার অনেক রকম সমস্যা হয়েছে। সেতুর কাছে শুনেছি। দেশে ফিরে আসার পর একমাত্র সেতুই গিয়েছিল ওর সাথে দেখা করতে।
-আমার ছেলে ভাল থাকলেই আমি খুশি। আমি আর কতদিনই বাঁচবো।
-কিন্তু ও তো কারো সাথে দেখা করতে চায় না মা।
-সেটা শান্ত বুঝবে। তুই যা ওর ঘরে। আমি নাস্তা ওখানেই পাঠাচ্ছি।
-এখন কিছু খাব না মা।

ঘরের দরজায় নক করে রাত্রি ঢুকলো। ঘর অন্ধকার। আলো জ্বালাতেই দেখতে পেল শান্ত বিছানায় শুয়ে। এ কদিনে কি অবস্হা বানিয়েছে নিজের। শান্ত উঠে বসলো।
-কি রে তুই? কি মনে করে?
-মা ডেকেছিল।
-দাড়িয়ে কেন? বস এখানে।
-না বসবো না।
হাত ব্যাগের ভেতর থেকে ভাজ করা কাগজটা বাহির করে সাইড টেবিলে রাখল সে।
-নিশিতার ফোন নাম্বার আর ঠিকানা লেখা আছে। আমি আসি।

কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো শান্ত। সে বিশ্বাস করতে পারছে না কিছুতেই। স্বপ্ন দেখছে না তো। কি করে সম্ভব হল এটা? রাত্রি নিচে নেমে গেছে ততক্ষনে। সে দৌড়ে নেমে এল। মা আর রাত্রি বসে আছে। সে মায়ের পায়ের কাছে বসে কাঁদতে লাগলো। শাহানা ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। কাঁদুক তাতে যদি জমে থাকা কষ্টগুলো কমে।

চলবে…

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here