#শেষ_ইচ্ছে,পর্ব-০২
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
৫।
স্মরণ গাড়িতে উঠে বসলো। উদ্দেশ্য সেই চেনা-পরিচিত স্থান। হীরার সাথে আজ তার শেষ দেখা, ভাবতেই গলা জড়িয়ে আসতে লাগলো তার। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে এলো হীরার সেই অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি।
স্মরণ মেয়েদের কান্নাকাটি একদমই সহ্য করতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই মাকে কাঁদতে দেখেছে। কিন্তু মাকে কান্না বন্ধ করতে বলার ক্ষমতাটুকু তার ছিল না। তাই সে মায়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যেতো সেই নদীর তীরে, যেটি স্মরণ আর হীরার প্রেমের সাক্ষী হয়ে আছে। তবে সেই নদীটি স্মরণের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সাক্ষী ছিল।
স্মরণ নদীটির নাম রেখেছে অশ্রু প্রবাহিণী। তার ধারণা এই শহরের বুকে প্রতিটি মানুষের অশ্রুবিন্দু জমে এই নদীর সৃষ্টি হয়েছে। এই নদীর গভীরতা সেই অশ্রুবিন্দুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্টের মতো গভীর।
গাড়ির ঝাঁকুনি খেয়ে বাস্তবে ফিরে এলো স্মরণ। চোখ খুলে সে তার হাত দুটির দিকে তাকালো। কেমন লাল হয়ে আছে এই হাত দুটি, মনে হচ্ছে এই হাত দুটি তার মায়ের হাত। ধীরে ধীরে স্মরণের চোখ দুটিও লাল হয়ে উঠলো। তার মনে পড়ে গেল সেই মৃত দুপুরের গল্পটি।
একটা বাচ্চা ছেলে, যার বয়স মাত্র দশ বছর। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো। প্রতিদিনের মতো সেইদিনও তার ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে। মায়ের ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি দেখে ছেলেটির ঘুম ভাঙার প্রতি কোনো বিরক্তি এলো না। সেও মুচকি হেসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। প্রতিদিনের মতোই মা নিজ হাতে তাকে নাস্তা বানিয়ে খাইয়ে দিলেন। কিন্তু কে জানতো, সেটি তার মায়ের হাতে তার শেষ খাওয়া। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে এসে মেঝেতে মায়ের রক্তাক্ত হাত দুটিই দেখতে পেলো সে। মায়ের মুখটা আর দেখা হলো না।
লোকে বলাবলি করছিলো,
“বাচ্চা ছেলে এভাবে মায়ের লাশ দেখলে ভয় পাবে। মুখটা তো একেবারে থেঁতলে গেছে। কি ভয়ংকর মৃত্যু!”
আঁতকে উঠল ছেলেটি। তার মায়ের সুন্দর মুখটি নষ্ট করে দেওয়ার সাহস কার হয়েছিলো? সেই হাসিমাখা মুখটি দেখলেই তো ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়।
ছেলেটির মনে মায়ের সেই হাত জোড়ায় গেঁথে ছিল শুধু। কিন্তু মায়ের মুখটা তার আর দেখা হলো না। বাচ্চা ছেলেটি তখন মনে মনে ভাবছিলো, সে কেন এতো ছোট হলো? আরেকটু বড় হলে মাকে দেখতে কেউ বারণ করতো না। সবাই তো দেখছে, তাহলে সে কেন দেখবে না? তারা কি জানে না, মাকে দেখার প্রথম অধিকার একমাত্র তার।
কিন্তু সেদিন সে মুখ ফুটে এসব কথা বলতে পারে নি। তখন তার এতো ভাষা জানা ছিল না। তবে এখন অনেক ভাষায় সে জানে। কিন্তু এই ভাষা কেউ বুঝে না। একমাত্র তার প্রেয়সী ছাড়া।
মূলত স্মরণই সেই মৃত দুপুরের সাক্ষী। সেইদিনের সেই ছোট বাচ্চাটি স্মরণই ছিল। স্থির দৃষ্টিতে সে এখন তার হাত দুটির মাঝে তার মায়ের হাত দুটিই দেখতে পাচ্ছে। তাই হাত দুটি খুব রাঙা লাগছে তার।
০৬।
মোঃ আরেয়ান কবির স্মরণ, তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে, তবে তার বাবা জয়নাল কবিরের একমাত্র নয়। তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, মিসেস রোজার ঘরে আরো দু’টো ছেলে আছে। তার মায়ের মৃত্যুর ছয় মাসের মধ্যেই তার বাবা মিসেস রোজাকে বাসায় তুলে আনেন। মিসেস রোজা স্মরণের স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। মাঝে মাঝে স্মরণকে বাসায় এসেও পড়াতেন। জয়নালের সাথে রোজার আগেই থেকেই ভালো সম্পর্ক ছিল। যেটা স্মরণ তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারে। কারণ সম্পর্ক না থাকলে জয়নাল কেন রোজাকে তার গৃহ শিক্ষিকা হিসেবে রেখেছেন, যেখানে স্মরণের মা, তসলিমা বেগম তাকে ভালোভাবেই পড়াতে পারতেন। বরং তিনি শিক্ষিত মহিলা ছিলেন। শুধু ওতোটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। জয়নাল তসলিমার অনুপস্থিতিতে রোজার পাশে বসে তার সাথে ঘনিষ্ঠ সময় কাটিয়েছিলেন, যা স্মরণ খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছিল। তবে মিসেস রোজা স্মরণকে বুঝিয়েছেন, তার বাবার সাথে তার ভালো বন্ধুত্ব আছে। আর বন্ধুরা তো কাছাকাছি আসতেই পারে।
এসব মনে পড়তেই স্মরণ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। মিসেস রোজাকে সে কখনোই মা হিসেবে পরিচয় দেয় নি। বাবার সাথেও তার সম্পর্কটা ধীরে ধীরেই শিথিল হয়ে পড়ে। স্মরণ জানে সেই মৃত দুপুরের সম্পূর্ণ সাক্ষী ছিল তার বাবা। তবে তার বাবার সাথে আরো কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল কি-না তা সে জানে না। কারণ মায়ের মৃত্যুর কোনো প্রমাণ সে পায় নি।
তসলিমার মৃত্যুর পর জয়নাল খুব সুন্দর করেই সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তসলিমা পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলো। আর তাকে খুন করেছে তার প্রেমিক। আর জয়নালের এতোটুকু ক্ষমতা তখনো ছিলো, আর এখনো আছে যে, সে অপরাধ করেও অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয় না। বরং নিরপরাধকে ফাঁসিয়ে দেয়। আর সেই মৃত দুপুরের নিরপরাধ মিথ্যে প্রেমিক ছিল স্মরণের মামা, রফিক হোসেন। সে ছিল তসলিমার ফুফাতো ভাই। যাকে তসলিমা মূলত ভাই হিসেবেই মানতো, আর সেও তসলিমাকে বোন হিসেবেই দেখেছিল। কিন্তু সমাজের সামনে জয়নাল তাদের মিথ্যে প্রেমিক-প্রেমিকা বানিয়ে ফেলেছে।
রফিক হোসেন একজন সাইকায়াট্রিস্ট ছিলেন। আর একমাত্র তিনিই জানতেন তসলিমা স্বামীর নির্যাতনের শিকার। কিন্তু বাকীদের সামনে জয়নাল তসলিমাকে এতো আহ্লাদ করতো, কারো বিশ্বাসই করার উপায় ছিলো না, জয়নাল তার স্ত্রীকে খুন করতে পারে। বরং জয়নাল এই মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার পর, মাঝে মাঝে জয়নালের অনুপস্থিতিতে রফিকের বাসায় আসার কথাটা প্রতিবেশিরাও জোর গলায় বলা শুরু করে দেয়।
পরিশেষে তসলিমা বেগম মৃত্যুর পর একজন নষ্টা নারী হিসেবে প্রমাণিত হয়। আর একজন ভাই প্রমাণিত হয় খুনী হিসেবে। এরপর রফিককে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তাকে রিমান্ডে নেওয়ার পর কি এমন হয়েছিলো যে সে স্বীকার করে নেয় সে-ই তসলিমাকে খুন করেছে?
সেদিন রফিক সবার সামনে বলেছিল, সে তসলিমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে, কিন্তু তসলিমা জয়নালের টাকার লোভের কারণে জয়নালকে ছাড়তে চায় নি। তাই সে রাগের মাথায় তসলিমাকে খুন করেছে।
রফিক হয়তো নিজেই জানতো, সে কেন এমন কথা বলেছে। কিন্তু আর কেউ না জানলেও স্মরণ জানে, কেন রফিক মিথ্যে বলেছে।
আর এরপরই পৃথিবী থেকে মুছে যায় তসলিমার গল্পটি। তারপর রফিকের ফাঁসি হয়ে যায়। সংবাদ শিরোনামে আসে, প্রেমিকের হাতে ব্যবসায়ীর স্ত্রী খুন। তবে এর পেছনের গল্পটা যে কতোটা নৃশংস ছিলো তা আর কেউ জানতে পারলো না। আর এই গল্পের নির্বাক সাক্ষী ছিল স্মরণ। তার হাতেও তো কোনো প্রমাণ নেই। আর বাবার বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। তাই সে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই বাবার বাধ্য ছেলে হয়েই ছিল। আর বাবার বাধ্য সন্তান স্মরণ আজ বাবার জন্যই তার প্রেয়সী হীরার সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করতে যাচ্ছে। অথচ সেই হীরাকে নিয়েই সে কতো স্বপ্ন দেখেছিল। স্মরণ মনে মনে বললো,
“স্বপ্ন দেখেছি তাই হয়তো অপূর্ণ রয়ে গেছে। স্বপ্ন তো স্বপ্নই থেকে যায়। তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা সবার ভাগ্যে থাকে না। আর আমিও সেই স্বপ্ন দেখা এক নিঃস্ব প্রেমিক।”
০৭।
হীরা হাত দুটি প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে নদীর ঘাটে। মৃদুমন্দ হাওয়া তার জীবনের অতীতটা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে হাওয়াকে বললো,
“একটা কথা শুনবি?”
হাওয়া হয়তো উত্তর দিলো,
“তোর কথা শুনার জন্যই তো এসেছি।”
হীরা মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে বলল,
“আচ্ছা, আমি যাকেই ভালোবাসি সে কেন আমাকে ফেলে চলে যায়, বলতে পারবি?”
হাওয়ার কাছে এর উত্তর নেই। উত্তর দিলেও হীরা তা শুনতে পেলো না। কারণ হাওয়া তো কথা বলতে পারে না। কথা তো বলছে তার মন তার সাথেই। কিন্তু মনের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
হীরার চোখে অশ্রু টলমল করে উঠলো। তার মনে পড়ে গেলো সেই কালো অধ্যায়।
হীরার জীবনে স্মরণ তার দ্বিতীয় প্রেম। তবে স্মরণই হয়তো আজীবন তার স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে। কারণ স্মরণকে সে এমন মুহূর্তে কাছে পেয়েছিল, যখন সে একেবারেই নিঃস্ব ছিলো। তার নিঃসঙ্গ জীবনের রঙিন মানুষটিই হলো স্মরণ।
আর হীরার জীবনের কালো অধ্যায়টি মূলত তার প্রথম প্রেমকে ঘিরেই সৃষ্টি। সেই কালো অধ্যায়ের নায়ক ও খলনায়ক উভয়ই ছিল উজান। খুব দীর্ঘও ছিল না সেই প্রেমের গল্পটি। তবে সেই প্রেম অল্প সময়েই হীরাকে উন্মাদ বানিয়ে দিয়েছিল। শুরুটা তার কলেজেই হয়েছিলো, শেষটাও সেখানেই। মাত্র দুই বছরের সম্পর্ক ছিল। তবে এই দু’বছরেই হীরা উন্মাদের মতো উজানকে ভালোবেসেছিলো। এমন নয় যে উজান ভালোবাসতো না। সেও প্রচন্ড ভালোবাসতো হীরাকে। তাদের প্রেমে কিছুই বাদ যায় নি। ভালোবাসা-বাসি প্রচন্ড রকমের ছিল। ক্লাসে পাশাপাশি বসে একে অপরকে দেখে থাকার মাঝেই ডুবে থাকতো দু’জন। ক্লাস শেষে ঘুরতে যাওয়া, গল্প করা, পরস্পরের কাছাকাছি আসা সবকিছুই হীরার প্রথম প্রেম তাকে দিয়েছিলো। আর উজানই তো ছিলো হীরার সেই কালো অধ্যায়ের একমাত্র নায়ক। তবে হুট করে খলনায়ক হয়ে যাওয়ার কারণটা হলো, সব দোষ তো আর প্রকৃতিকে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সেই অপরাধীটা উজানই হয়ে গেলো। সে কিছু না বলে এভাবে হীরাকে ছেড়ে চলে যাবে, সেটা হীরা মানতেই পারছিলো না।
দিনটি ছিল কলেজের শেষ দিন। এরপর শুরু হবে এইচ.এস.সি পরীক্ষা। বিদায় অনুষ্ঠান শেষে শাড়ি পরে এক গাদা ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো হীরা। ফুলগুলো উজানের দেওয়া। লাল শাড়ির সাথে মিলিয়ে টকটকে লাল গোলাপ।
হঠাৎ হীরার আইসক্রিম খাওয়ার ইচ্ছে জাগলো। আর উজান দেরী না করে তার প্রেয়সীর আবদার পূরণের জন্য যেই হীরার হাতটি ছাড়লো আর কখনোই সেই হাতটি ধরতে পারলো না। আর হীরাও স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলো উজানের দিকে। আর অপূর্ণ রয়ে গেলো উজানের প্রতি হীরার করা শেষ আবদারটি। এরপর থেকে হীরা কাউকে কখনোই কোনো আবদার করে নি। আবদার শব্দটি থেকে তার বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। আর উন্মাদ মনটি ধীরে ধীরে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছিল।
এরপর সে আর কাউকেই উন্মাদের মতো ভালোবাসতে পারেনি। হীরার ভালোবাসায় আর কোনো অনুভূতি অবশিষ্ট ছিলো না। হারিয়ে ফেলারও ভয় ছিলো না। যা ছিলো সব বাস্তবিক।
হীরা নদীর পাড়ে বসে তার অতীতের কালো অধ্যায়টি নিয়ে ভাবছে আর মনে মনে বলছে,
“প্রেম তো হারিয়ে যাবেই, এখানে আক্ষেপের কি আছে? আমি প্রেমের মুহূর্তগুলোতে কি পরিমাণ ভালো ছিলাম, সেটিই আমাকে পুরো জীবন বাঁচিয়ে রাখবে। মানুষ মরণশীল, আর মানুষের অনুভূতিও ক্ষণস্থায়ী। আজ তার আমাকে ভালো লাগছে, কাল সে অন্য কারো হয়ে যাবে। আজ সে বেঁচে আছে, কাল হয়তো থাকবে না। তাই তাকে উন্মাদের মতো ভালোবাসার চেয়ে, যদি তাকে ধীরস্থির ভাবে ভালোবাসা যায়, তাহলে কোনো কষ্টই হয়তো থাকবে না। উন্মাদ প্রেমগুলোতে আবেগ বেশি থাকে। প্রিয় মানুষটিকে ছাড়া এক সেকেন্ডও সময় কাটানো যায় না। মিনিটের পর মিনিট তাকে ফোন দেওয়ার মাঝেই সেই আবেগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। পরিশেষে তাকে হারিয়ে ফেলার পর আক্ষেপ করা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। শুধু শুধু এতো কষ্ট পেয়ে কি লাভ? একটাই তো জীবন। তাই ভালোবাসা হওয়া উচিত অনুভূতিহীন। এই অনুভূতিহীন ভালোবাসায় কোনো আবেগ নেই। বরং শান্তি আছে। কাছে থাকার মুহূর্তগুলো যদি শান্তির হয়, তাহলেই তো আমি ভালো থাকবো। সে হয়তো আমার হবে না। তবুও সে যেই মুহূর্তে আমার কাছে থাকবে, আমি সেই মুহূর্তেই শান্তিতে বাঁচবো। তাকে ভালোভাবে বুঝতে শিখবো। তার চোখের ভাষাগুলো পড়ার চেষ্টা করবো। আর কিছু মধুর স্মৃতি নিয়ে আজীবন তাকে হারিয়েও বেঁচে থাকবো। কিন্তু উন্মাদ প্রেমে এসবের সময় থাকে না। তারা কখনোই বাস্তবতার পরিণতি ভাবে না। তারা শুধু ভালোবেসে যায়। তাই তারা কঠোর পরিণতগুলো মেনে নিতে পারে না। আর দিনশেষে হারিয়ে যায়। কিন্তু আমি নিজেকে হারাতে চাই না। আমি স্মরণের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।”
০৮।
হীরা উজানকে হারানোর দিনটির নামকরণ করেছিলো লাল দিন। প্রতি বছর ২৭মার্চ হীরা লাল শাড়ি, লাল ফুল আর কপালে লাল টিপ দিয়ে আয়নার সামনে বসে থাকে। শুধুমাত্র এই একটা দিনই সে উজানকে নিয়ে ভাবে। আর বাকী দিনগুলো জুড়ে শুধু স্মরণ আর স্মরণ। কারণ উজানের কথা মনে পড়লেই তার বুকটা হু হু করে উঠে।
চোখ বন্ধ করে উজানের সেই লাল রঙের পাঞ্জাবির মাঝে লাল রক্তের ছাপগুলো মনে পড়তেই হীরার চোখ ভিজে উঠলো। চোখ খুলে দেখলো এখনো সে একা একাই বসে আছে। স্মরণ এখনো আসে নি। এতোদিন স্মরণকে এভাবেই অপেক্ষা করিয়েছিলো সে। হীরা ভাবছে,
“তাহলে কি কারো জন্য অপেক্ষা করাটা খুব যন্ত্রণার?”
প্রতিদিনের ব্যস্ততার ভীড়ে উজানকে তার একবারো মনে পড়তো না। কিন্তু এখন অলস সময় পার করছে, তাই উজান তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর হয়তো একদিন স্মরণও তার স্মৃতি হয়ে যাবে। আর আজকের এই দিনটিই হয়তো স্মরণের জন্য অবশিষ্ট থাকবে। হীরা সাথে সাথে ফোন বের করলো। তারিখটা দেখে রেকর্ড করা শুরু করলো আজকের এই অপেক্ষমাণ মুহূর্তের অনুভূতিটি।
“নদীর পাড়ে বসে আছি। মিষ্টি বাতাস আমার ছোট ছোট চুলগুলো নাড়িয়ে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে চুল খুলে দিলে হয়তো হাওয়ার তালে এলোকেশী নৃত্যে দেখা যেতো। তবে স্মরণের ইচ্ছের পূর্ণতা দিতেই চুল বাঁধা। আজকের পর হয়তো আমি আর চুলে খোঁপা করবো না। কারণ আমার যে ভালো লাগে না বাঁধা চুল। বাঁধনহারা চুলের মাঝেই এক অদ্ভুত ভালো লাগা আছে। স্মরণ এসব বুঝে না। থাক না বুঝুক, ও আমাকে যতোটুকু বুঝে আর কেউ ততোটুকুও বুঝে না৷ এমনকি উজানও বুঝতো না।
আজ ২রা মার্চ। এখন সময়টা সকাল এগারোটা। আমি এই মুহূর্তে স্মরণের অপেক্ষায় আছি। জানি না, সে আসবে কি আসবে না। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। কারণ সে বলেছিল, আজকের দুপুর, বিকেল আর সন্ধ্যাটা তার নামের হবে৷ সূর্য ডোবার পরই হয়তো সে চলে যাবে৷ কিন্তু মহাশয় এখনো আসছেন না কেন?”
হঠাৎ গাড়ির শব্দশুনে হীরা কথা থামিয়ে দিলো। রেকর্ডটার বন্ধ করে তাড়াতাড়ি তার ভয়েসটি সংরক্ষণ করে, সেটির নাম রাখলো, “স্মরণের অপেক্ষায়।” তারপর হীরা ফোনটি ব্যাগে ঢুকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই স্মরণকে দেখে থমকে গেলো। তার চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে স্মরণের মাঝে।
চলবে-