#শেষ_ইচ্ছে,পর্ব-০৪
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
১২।
মায়া আর ভালোবাসার মাঝে এক বিস্তর পার্থক্য আছে। মায়া হলো এক প্রকার শক্তি, যেই শক্তির জোরে কারো প্রতি ক্ষোভ থাকলেও তাকে ঘৃণা করা যায় না। অন্যদিকে ভালোবাসার মৃত্যু হয়ে যায় কিছু মিথ্যে মোহ বা ভুলের কারণে। হীরার মনে হয়তো স্মরণের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে মায়াটায় বেশি। নয়তো আজ যেখানে স্মরণকে ঘৃণা করা উচিত, সেখানে হীরা স্মরণের পাশে বসে নদীর স্থির জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ স্মরণ হীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে একটা কথা কখনোই বলি নি।”
হীরা স্মরণের মুখের দিকে তাকালো। কিন্তু মুখে কিছুই বললো না।
স্মরণ বলল,
“আমার ফুল কখনোই পছন্দ ছিল না।”
হীরা মনে মনে হাসলো। তারপর স্মরণের একটি হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে বলল,
“আমি তোমার চোখ দেখেই বুঝেছিলাম। কিন্তু তুমি কখনো আমাকে বারণ করো নি। তাই আমিও ফুলের মায়া ছাড়তে পারি নি।”
“তুমি জানতে চাইবে না, কেন আমি ফুল অপছন্দ করি?”
হীরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আর স্মরণ বলতে শুরু করলো, কিছু না বলা কথা।
স্মরণের মা তসলিমা বেগমের বাগান করার খুব শখ ছিল। আর তাই তিনি তার জমানো টাকা দিয়ে বিলাসদ্রব্য না কিনে, ফুলের চারা কিনতেন। আর সেই জমানো টাকায় একদিন পুরো বারান্দা ও ছাদ ছেয়ে গিয়েছিল তার কেনা ফুলগাছে।
স্মরণের মায়ের রুমের বারান্দায় কাঞ্চন আর সাদা ও লাল জবা গাছের সারি। ছাদের এক কোণে কামিনী আর করবী ফুলের মেলা। আর স্মরণের রুমের বারান্দায় ছিলো বাহারী রঙের ডায়ান্থাস আর হলুদ অলকানন্দা ফুলের গাছ। মূলত অলকানন্দা ফুলগুলো স্মরণের খুব বেশি পছন্দের ছিল। আর সেখান থেকেই তার হলুদ রঙের প্রতি ঝোঁকটা বেড়েছিল।
কিন্তু জয়নাল কবির এসব মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন বারান্দায় আর্টিফিশিয়াল সামগ্রী থাকুক, তা হোক ফুল বা অন্যকিছু।
যেহেতু বারান্দায় গাছ ছিল, সেহেতু টবে থাকা ছিদ্রপথ গলে কাদা মাটি বেরিয়ে পড়তো, আর তাতে বারান্দা নোংরা হয়ে যেতো। আর অদক্ষ তসলিমা বেগমের ফুল গাছের প্রতি ঝোঁক থাকলেও, তিনি সব কিছু একসাথে সামলাতে পারতেন না। আর তাই মাঝে মাঝেই বারান্দায় পা রাখা যেতো না বালির জন্য।
জয়নাল কবির যে বারান্দায় বসে একটু চা খাবেন, সেই জায়গাটাও ছিলো না। এমনকি বাগানের পরিচর্যা করতে গিয়ে তসলিমার হাতে-পায়েও মাটি লেগে যেতো। আর তখন জয়নালের মুখের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাবটাও হাসিমুখেই সহ্য করতেন তসলিমা।
জয়নালের অনেকবার বলার পরও যখন তসলিমা ফুলগাছের নেশা ছাড়তে পারেন নি। তখনই জয়নাল এমন একটা কাজ করে বসেন, যা তসলিমা কখনোই ভাবতে পারেন নি।
অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো স্মরণ। মাথা নিচু করে বসে রইলো। হীরা স্মরণের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তারপর? কি করেছিলেন তিনি?”
স্মরণ ফুঁপিয়ে উঠলো। কাঁপা হাতে হীরার হাত দুটি শক্ত করে ধরে বললো,
“আমি কিছুই করতে পারি নি আমার মায়ের জন্য। আমি আমার চোখের সামনে রাতদিন মাকে মরতে দেখেছি। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারি নি।”
হীরা স্মরণের মাথাটা নিজের কোলে রেখে বলল,
“তুমি তখন ছোট ছিলে, স্মরণ।”
“ছোট ছিলাম না, ভীতু ছিলাম আমি। আজকাল ছোট বাচ্চাদেরও কতো সাহস! আর আমার তখন অনেক বুদ্ধি হয়েছিলো। সব বুঝতাম আমি। কিন্তু ভয়ে এগিয়ে যেতে পারি নি।”
হীরা বললো,
“আংকেল কি ফুল গাছগুলো ফেলে দিয়েছিলো? টব ভেঙে দিয়েছিলো? আচ্ছা, আন্টি খুব কষ্ট পেয়েছিল, তাই না?”
স্মরণ হীরার কোল থেকে মাথা তুলে হীরার চোখের দিকে তাকালো। তারপর হীরার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“এমন কিছু করলেও হয়তো আমার ওতোটা কষ্ট হতো না।”
“তাহলে কি করেছিলো?”
স্মরণ এবার আকাশের দিকে তাকালো আর চোখ বন্ধ করেই অতীতের সেই ভয়ংকর দিনটিতে ডুব দিলো।
১৩।
জয়নাল কবির অফিস থেকে ফিরে এসেই সেদিন এক কাপ চা দেওয়ার জন্য তসলিমা বেগমকে ডাক দিয়েছেন। স্বামীর কন্ঠ শুনে তসলিমা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মলিন কাপড়ে জয়নালের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার শ্যামবর্ণ হাতে কাঁদা মাটি শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। তার ওড়নার ফাঁকে ফাঁকে ঝরা পাতার স্থান হয়েছে। ঘামে তার পুরো জামা ভিজে গেছে। আর শরীর থেকে ভেজা মাটির গন্ধ ছড়াচ্ছে।
জয়নাল মুহূর্তেই অগ্নি দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। আর তসলিমা স্বামীর মুখশ্রী দেখে ভীত কণ্ঠে বললেন,
“আমি এক মিনিটের মধ্যে কাপড় পালটে আসছি।”
তসলিমা একেবারে গোসল করে, পরিপাটি হয়েই রান্নাঘরে ঢুকলেন। চা চুলাতে বসিয়েছেন মাত্র, তখনই জয়নাল চেঁচিয়ে বললেন,
“কি রে, তোকে চা দিতে বলেছি কখন? সারাদিন তুই শুধু ওই গাছগুলোর সামনেই বসে থাকিস৷ তোকে আমি বিয়ে করেছি কেন রে?”
স্মরণ বাবার চেঁচামেচি শুনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো, বাবা সামনের সোফায় বসে তার মাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।
জয়নাল এবার রাগী কন্ঠে বললেন,
“এক মিনিটের মধ্যেই চা আনবি, নয়তো সবকটা টব আমি ডাস্টবিনে ফেলে আসবো।”
তসলিমা কথাটি শুনে ভয় পেয়ে জয়নালের কাছে এসে বললেন,
“তুমি আরেকটু অপেক্ষা করবে? চা তো মাত্র দিয়েছি। এখনো রং খুলে নি।”
জয়নাল কথাটি শুনেই হাতে থাকা ম্যাগাজিনটা তসলিমার মুখে ছুঁড়ে মারলেন। তসলিমা কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই জয়নাল তার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
“তোর কথামতো আমি বসে থাকবো? আমার তোর মতো সময় হাতে নেই। কাজ ছাড়া বসে থাকি না আমি।”
তসলিমা ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। স্বামীর চোখে তিনি বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসাও দেখলেন না। সেখানে শুধু চাহিদা আর চাহিদা। আর এতো বছর তো সেই চাহিদায় মিটিয়ে এসেছেন। স্বামীর ভালোবাসা তো কখনোই তার ভাগ্যে জুটে নি।
তসলিমা এবার রান্নাঘরে ফিরে এসে চা বানিয়ে নিয়ে এলেন। জয়নাল চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ভয়ংকর দৃষ্টি নিয়ে তসলিমার দিকে তাকালেন। আর মুহূর্তেই চায়ের কাপটা ছুঁড়ে মারলেন তসলিমার দিকে। গরম চা পায়ের উপর এসে পড়তেই তিনি ‘ওহ আল্লাহ’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। আর স্মরণ এসব দেখে ভয়ে তাড়াতাড়ি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।
জয়নাল রেগেমেগে ছুটে গেলেন বারান্দায়। আর সেখান থেকে কিছু টব তুলে এনে তসলিমা সামনে রাখলেন। তসলিমা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,
“পরের বার আর এমন হবে না। আরেকটা সুযোগ দাও। প্লিজ।”
জয়নাল তসলিমার কথা কানে তুললেন না। তিনি তসলিমার চুলের মুঠি ধরে তাকে মেঝেতে বসিয়ে দিলেন। আর সেখানেই বসিয়ে জোর করে প্রতিটা গাছের পাতা আর ফুল ছিঁড়ে তাকে জোর করে খাইয়ে দিলেন। আর স্মরণ পর্দার আড়ালে নির্বাক দাঁড়িয়ে তার মাকে দেখতে লাগলো।
তসলিমা তার গাছগুলোকে বাচ্চাদের মতোই ভালোবাসতেন। কিন্তু আজ সেই মা তার বাচ্চাগুলোর ভক্ষকে পরিণত হলো।
জয়নাল তসলিমার চুল ছেড়ে দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতেই বললেন,
“আগামী এক সপ্তাহ তোর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। খেতে ইচ্ছে করলে তোর এই গাছগুলো খাবি।”
জয়নাল চলে যাওয়ার পর স্মরণ মায়ের কাছে ছুটে এলো। আর তসলিমা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“বাবা, তুই তোর বাবার মতো হবি না কিন্তু। অন্যের ভালো থাকার ছোট ছোট কারণগুলো কেঁড়ে নিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। আমি চাই আমার ছেলে সুস্থ ও ভালো মানুষ হোক।”
স্মরণ সেদিন মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল। তার মনে সেদিনই ক্ষোভ জমে গিয়েছিল ফুল গাছের উপর। তার ধারণা এই ফুলের প্রতি ভালোবাসার কারণেই তার মাকে এতো কষ্ট পেতে হয়েছে। কেন মা এতো ফুল ভালোবাসে? কি প্রয়োজন ফুল গাছ নিয়ে ব্যস্ত থাকার? বাবার কথামতো চললে কি বাবা মাকে মারতো?
আর এরপর থেকেই স্মরণ ফুল পছন্দ করতো না। তবে মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের হাতে লাগানো গাছগুলো ফেলে দেওয়ার মতো দুঃসাহস তার ছিলো না। তাই বাকী সবকটা গাছই সে তার নানার বাড়িতে দিয়ে আসে।
স্মরণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হীরা স্মরণের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“ফুল হলো বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত। ফুলকে সৌভাগ্য, আনন্দ, ভালোবাসা আর সুস্বাস্থ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। যারা ফুলের বাগান করতে ভালোবাসে, আর সেই বাগানে সময় দেয়, তাদের মনের অনেক কষ্ট সেই রঙিন গাছগুলো দেখলে কমে যায়।”
স্মরণ বললো,
“বাবা যেহেতু পছন্দ করতো না…”
স্মরণকে থামিয়ে দিয়ে হীরা বললো,
“কেন নারীরা তার ভালো থাকাগুলো কোনো পুরুষের সন্তুষ্টির জন্য বিসর্জন দেবে? কেন পুরুষ পারে না নারীদের পছন্দের মূল্য দিতে? আজ যদি তিনি স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বাগান বিলাস করতেন, তাহলেই হয়ে উঠতেন যোগ্য পুরুষ। এখন তিনি কাপুরুষ।”
“আমিও কি তাহলে কাপুরুষ?”
“তুমি কাপুরুষ হলে কি আমার হাতে বেলী ফুলের মালা পড়িয়ে দিতে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে ফুচকা খেতে? আমার পাগলামো গুলোর সঙ্গী হতে পারতে? পারতে না।”
“তুমি না এলে আমি কখনোই ভালো থাকতাম না। হয়তো আমার অশান্তিপূর্ণ জীবনটাতে একটু রঙ যোগ করতেই তোমার জন্ম।”
হীরা মুচকি হেসে বললো,
“আর আমার অপূর্ণ জীবনকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্যই তোমার জন্ম।”
চলবে-