শেষ_ইচ্ছে,পর্ব-০৮ (ঘটনার নিরাবরণ)

0
598

#শেষ_ইচ্ছে,পর্ব-০৮ (ঘটনার নিরাবরণ)
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ

২১।
স্মরণের গানের মাঝে হারিয়ে এতোক্ষণ হীরা অতীতের ভাবনায় ডুব দিয়েছিল। এবার সে স্মরণের গানের উত্তরে সুরেলা কন্ঠে গাইতে লাগলো, গানটির পরের অংশ।

“তুমি না এলে এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান,
তুমি না এলে এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান,
কি করে করি আড়াল মন আজ বেসামাল
তোমারি আশায়.. ভালোবাসায়
চাই মন পালাতে.. কাছে আরো হারাতে..
যদি দাও ভরা ভালোবাসায় যদি খুব আদরে ডাকো আমাকে… কি করে রাখি অভিমান।
তুমি না এলে,এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান।”

স্মরণ মুগ্ধ চোখে হীরার দিকে তাকিয়ে ছিল। গান শেষ হওয়ার পর স্মরণ বলল,
“তুমি গানটি গাইবে আমি তা কল্পনাও করি নি। হীরা, এই একটা আবদার আমি করার আগেই তুমি পূর্ণ করে দিয়েছ। আর তুমি যে এতো সুন্দর করে গান গাইতে পারো, তা আমার জানা ছিল না।”

“জানা ছিল না, তাই জানিয়ে দিয়েছি। আর আমি আজ তোমার কাছে কিছুই গোপন রাখতে চাই না।”

স্মরণ মুচকি হেসে বললো,
“তোমার কন্ঠের প্রেমে পড়ে গেলাম। এতো মায়ায় জড়াচ্ছো, আমার তো তোমাকে ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে করছে না।”

“যেও না। চলো পালিয়ে যায়।”

স্মরণ হেসে বলল,
“এতো সহজ নয়, হীরা। আমার জন্য ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করে ফেললে? আর আমি তো কাপুরুষ নই। পালিয়ে যাওয়া কাপুরুষের লক্ষণ।”

হীরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নদীর জলে হাত ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা স্মরণ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হুম করো।”

“তোমার চুড়ির শব্দ কেন ভালো লাগে না?”

স্মরণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার মা খুব সাজতে পছন্দ করতেন। তিনি শাড়ির সাথে মিলিয়ে চুড়ি কিনতেন। আর বাসায় চুড়ি পরে বসে থাকতেন। আর তুমি তো জানো, আমার বাবা কেমন ছিলেন! একদিন মায়ের সাথে বাবার কোনো একটা ব্যাপারে অনেক ঝগড়া হয়েছিল। আর সেদিন বাবা মায়ের সব চুড়ি, সাজসজ্জার জিনিস আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। মা খুব কেঁদেছিল সেদিন। ভালো লাগার জিনিসগুলো হারিয়ে ফেললে কষ্ট তো লাগবেই, তাই না?”

“উনি কেন এমন করেছিলেন?”

“প্রথমে বুঝি নি, কিন্তু পরে যখন জানতে পারলাম, তখন অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আসলে বাবার অফিসে একটা প্রোগ্রাম হয়েছিল। আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখলাম, মা কাঁদছে। বাবার কথায় বুঝলাম, তার অফিসের সব কলিগদের বউয়ের চেয়ে আমার মাকেই নাকি খুব নগন্য মনে হচ্ছিল। মা নীল শাড়ি পরেছিল, হাতে নীল চুড়ি, ঠোঁটে সেই কটকটে লাল লিপস্টিক। চুলগুলো কোমর অবধি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কি মায়াবী লাগছিল তাকে দেখতে! কিন্তু বাবা মায়ের সেই চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে এতো জোরে ঝাঁকুনি দিয়েছিল যে কিছু চুল বাবার হাতেই চলে এসেছিল। তারপর মায়ের সে কি কান্না! আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! মনে হয়েছিল বাবার ঘাড়ে দজ্জাল এসে ভর করেছে। আজ হয়তো তার হাতে আমরা সবাই মরবো। আর সেই মুহূর্তে মায়ের হাতের চুড়িগুলো টুংটাং শব্দ তুলছিল। যা বাবাকে আরো বেশি হিংস্র করে তুললো। এরপর তিনি এতো শক্ত করে মায়ের হাত দুটি চেপে ধরেছিলেন যে মায়ের দুই হাত কেটে রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল।”

হীরা অবাক হয়ে স্মরণের কথা শুনতে লাগলো।

স্মরণ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কোনো পার্টিতে শাড়ি বা চুড়ি পরা, ঝুমকো ব্যবহার করা, বাবার ভাষ্যে এসব ছিল আনসিভিলাইজড বিহেভিয়ার। তবে গাউন বা ভারী নেকলেস পরে সেদিন যদি মা বাবার সাথে যেতেন তিনি হয়তো সভ্য মানুষদের কাতারে জায়গা পেতেন। আর এতো বড় একটা ঝামেলাও হতো না। আর মায়ের শখের মৃত্যুও ঘটতো না।”

হীরা বলল,
“তুমি তাই আমাকে চুড়ি আর ঝুমকো পরতে বারণ করো?”

“হ্যাঁ, তখন থেকেই আমার এসব জিনিস ভালো লাগতো না। মূলত যেই জিনিসগুলোর জন্য আমার মা কষ্ট পেয়েছিল, সেই জিনিসগুলো আমার চোখের সামনে এলে আমি সহ্য করতে পারি না। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। আর মায়ের কথা মনে পড়লে আমার খুব অস্থির লাগে। এমন অস্থিরতা আমি নিতে পারি না।”

“তাহলে তুমি মেলা থেকে আমার জন্য চুড়ি কেন কিনতে? তোমার কষ্ট হতো না তখন?”

“আমার অস্থিরতার জন্য তোমার ইচ্ছেগুলো তোমার জীবন থেকে কেন হারিয়ে যাবে? আমি চাই না তুমি আমার জন্য নিজেকেই হারিয়ে ফেলো। তাই তোমাকে মনে করিয়ে দেই, তোমার ভালো লাগার মধ্যে আমি মানুষটা ছাড়াও আরো অনেক কিছুই আছে।”

“আমার তো শাড়ি পরতে ভালো লাগে, আর তোমারও তো শাড়ি অপছন্দ না। তাহলে আংকেলের যে শাড়ির প্রতি বিরক্তি ছিল, সেটিতে তোমার অভিযোগ নেই যে!”

“বাবা যেসব পার্টিতে যেতেন ওসব জায়গায় মা শাড়ি পরলে বাবার সমস্যা হতো। কারণ ওখানে খুব আল্ট্রা মর্ডান মহিলারা যেতেন। তাদের জন্য ওয়েস্টার্ন পোশাকটাই কমন ছিল। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে শাড়ি পছন্দ করি।”

স্মরণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমার ইচ্ছে ছিল, আমাদের বিয়ের পর তোমাকে রোজ শাড়ি পরার আবদার করবো।”

এরপর স্মরণ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সব ইচ্ছে কিন্তু পূরণ হয় না।”

হীরা মলিন দৃষ্টিতে স্মরণের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর অনেকক্ষণ নিরবতা বিরাজ করলো তাদের মাঝে। পরিবেশটা একদম মন ছুঁয়ে দেওয়ার মতো। দূর থেকে মাঝিদের গানের সুর ভেসে আসছে। আর সেই পরিবেশে একটা স্থির ভাসমান নৌকায় বসে আছে একদিনের মাঝি ও তার একদিনের গিন্নী। হাওয়ার তাল হীরার সামনে আসা চুলগুলো হালকা উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর স্মরণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হীরার দিকে।

হঠাৎ হীরা বলে উঠল,
“আচ্ছা স্মরণ, আন্টি তো খুব সাজতো। তুমি তো আমাকে কখনো সাজতে বারণ করো নি।”

স্মরণ হেসে বলল,
“তুমি এখনো এসবই ভাবছো।”

হীরা আহ্লাদী সুরে বলল,
“বলো না।”

“মাকে সাজলে অনেক সুন্দর লাগতো। আর হয়তো বাবাও সেটা বুঝেছিল। তাই কখনো বারণ করে নি। বরং মা সাজলে বাবা মায়ের দিকে ক্ষণিকের জন্য হলেও তাকিয়ে থাকতো। আর আমার মা তখন অনেক অনেক খুশি হয়ে যেতেন।”

এরপর হীরা স্মরণের গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে বলল,
“তোমার মতো একটা ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু দেখো, প্রকৃতি কি অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে আমাদের। যেই মায়ের এতো ভালো একটা ছেলে আছে, সেই মা তাকে বড় হতে দেখলো না। যেই প্রেমিকার এতো ভালো একটা প্রেমিক আছে, সে তারই হাত ধরে বাকী জীবনটা পার করতে পারবে না।”

“চিন্তা করো না। এই মনে তুমিই বেঁচে থাকবে। মৃত্যুর পরও আমি হীরাকেই ভালোবাসবো।”

“আমার মনেও তুমিই বেঁচে থাকবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে মৃত্যুর পর তোমাকেই চাইবো। পরের জীবনে যাতে স্মরণ হীরার হয়।”

“আমি তো অনেক পাপ করেছি। এতো সহজে সেই জন্মে তোমাকে পাবো না।”

“আমি তোমার পাপমোচনের অপেক্ষায় থাকবো। শুনেছি, সব পাপ আগুনে ধুয়ে যাওয়ার পর সৃষ্টিকর্তা দয়া করেন। আর তিনি তো জানেন তোমার পরিস্থিতি কেমন ছিল।”

কথাগুলো বলেই হীরা থেমে গেল। এর কিছুক্ষণ পর সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আবার বলে উঠল,
“বিশ্বাস করো, আমি একদম ভালো হয়ে যাবো। শুধু তোমার জন্য আমি এই পৃথিবীর সব বিলাসিতা ত্যাগ করবো। তবুও কি আমাদের মৃত্যুর পর দেখা হবে না? এই পৃথিবীতে তো আমাদের প্রেমকে কেউ গ্রহণ করছে না।”

স্মরণ এবার দৃঢ় কন্ঠেই বলল,
“তুমি চিরকুমারী থেকো না। বিয়ে করে নিও। আর সংসারে মনোযোগী হবে। আমার কথা ভেবে তুমি পাপ করো না।”

হীরা শব্দ করে কেঁদে বলল,
“আমি তোমাকে ভুলতেই পারবো না।”

“এখন মনে হচ্ছে পারবে না। ধীরে ধীরে কিন্তু সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কথা বলতে বলতেই স্মরণ নৌকাটা ঘাটের কাছে ঠেকালো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। স্মরণেরও যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

২২।

হীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি দেখে স্মরণ আর কিছুই বলল না। থাক কাঁদুক আজ। মন ভরে কাঁদুক। কষ্টগুলো চেপে রাখলে দম বন্ধ হয়ে আসবে।
হীরার পা আর চলছে না। ইচ্ছে করছে স্মরণকে আটকে রাখতে। কিন্তু এখন তো কিছুই সম্ভব না। স্মরণ সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সারেন্ডার করে লোকগুলোর সামনে হাত এগিয়ে দিলো। তাদের মধ্যে একজন স্মরণের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
“না পরালেও চলতো।”

স্মরণ পেছন ফিরে হীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“পরিয়ে রাখলে ভালো হবে। ও যদি আমায় খুব শক্ত করে মায়ায় বেঁধে ফেলে, আমি হয়তো আর নিজেকে আটকাতে পারবো না।”

তারপর চুপচাপ স্মরণ ভ্যানে উঠে বসলো। হীরা স্মরণকে আড়াল হয়ে যেতে দেখে দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। সে ভ্যানের সামনে যেতে চাইলে ইউনিফর্মধারী একজন কনস্টবেল তার পথ আটকে বলল,
“সময় শেষ হয়ে গেছে। কয়েদী নম্বর ৪৮ এর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী আপনার সাথে তার আজকের পুরো দিন কাটানোর কথা ছিল। আর এখন সেই সময়টুকু শেষ হয়েছে। আগামীকাল বিকেলে তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। চাইলে লাশ নিতে আসতে পারেন।”

হীরা কথাটি শুনেই কেঁদে উঠলো। শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে। তাদের মধ্যে বৃদ্ধ কনস্টবলটি হীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি একজন খুনি আর ধর্ষকের জন্য নিজের জীবনটা ধ্বংস করে দিও না। এমন একটা ছেলের জন্য তুমি কেন কাঁদছো?”

হীরা চোখের পানি মুছে কঠোর কন্ঠে বলল,
“স্মরণ খুন করে নি, সে একজনকে ন্যায় দিয়েছে। আমার স্মরণ ধর্ষক নয়। তাকে ফাঁসানো হয়েছে।”

তারা হীরার কথা শুনলো না। ভ্যানে উঠে পড়লো।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাই রাস্তার বাতিগুলো একটা একটা জ্বলে উঠল। সাথে মৃদু বাতাস হীরার গায়ে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো। আর হারিয়ে যেতে লাগলো পুলিশ ভ্যানটি।

হীরা ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। ইচ্ছে করছে চেঁচিয়ে বলতে,
“সব মিথ্যে হয়ে যাক। সবকিছু দুঃস্বপ্ন হোক। আমার স্মরণ ফিরে আসুক আমার কাছে। এবার আমি তাকে কোথাও যেতে দেবো না। খুব যত্নের সাথে আগলে রাখবো।”

কিন্তু কেউ শুনতে পেলো না তার আর্তনাদ। এক বিকট চিৎকার দিয়ে হীরা কাঁদতে লাগলো। শব্দ করে কাঁদছে সে। প্রতি মিনিটেই যেন এই কান্না আর শব্দের বেগ দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটাই কথা,
“স্মরণ অপরাধী নয়, সে ফেঁসে গেছে। প্রকৃতি তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here