#সময়_থেকেও_শেষ,পর্ব ৩
লেখাঃ মান্নাত মিম
৮.
চোখ-মুখ ফোলে-ফেঁপে লাল বর্ণ ধারণ করেছে মাবিহার। ফর্সা মুখে এমন লাল আভায় কী যে সুন্দর লাগছে না! নিশাত্যয় যদি সামনে থেকে সেটা দেখার সুযোগ পেত তাহলে নির্ঘাত কয়েক’শ চুমু খেয়ে নিত আর বলত, “তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে রোজ কান্না করাব। যেন তোমার মুখ এমন টমেটোর মতো লাল হয় আর আমি….. থাক আর বললাম না বাকি কথা বিয়ের পরে।”
আনমনে আয়নার দিকে তাকিয়ে এসব ভেবে অশ্রু সজল চোখ নিয়ে হেসে ফেলল মাবিহা। প্রায়ই এমন সব কথা বলত নিশাত্যয় তাকে। মাঝেমধ্যে তাদের মিষ্টি ঝগড়াঝাটি হতো। তখন বেচারি নাক টেনে টেনে কান্না করত। ভিডিয়ো কলে কান্নারত মাবিহাকে দেখে নিশাত্যয় অসভ্য, লজ্জাহীন হয়ে যেত। সেসব নির্লজ্জ কথাবার্তা শুনে মাবিহার তো কান্না বন্ধ হতই, সাথে লজ্জাবনত হয়ে চোখ-মুখ নুইয়ে যেত।
ভালোবাসা অতঃপর প্রণয়। উহুম, তার ক্ষেত্রে তো অন্যটা ভালোবাসা, প্রণয়, ধোঁকা অতঃপর নিঃশেষ হওয়া। মুচকি হাসি দিয়ে হাতে থাকা অতিরিক্ত পাওয়ারের ঘুমের ওষুধগুলো খেয়ে নিলো। এগুলো তার বাবাকে খেতে দিয়েছিল ডাক্তার, রাতে কোনো এক কারণে ঘুম হয় না। তাই রাত্রে ডিনার শেষে একটা করে খেতে বলা হয়েছে। যেহেতু ওষুধের পাওয়ার অনেক হাই। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে মাবিহা, আর মনে করছে নিশাত্যয়ের কথাগুলো। যেগুলো ভালোবাসার মুহূর্ত হিসেবে সে রেখে দিয়েছিল, হয়তো এমন দিন আসবে বলে।
৯.
“বিয়ের দিন তুমি কালো জামদানী শাড়ি পরবে।”
“ধুর এটা কোনো কথা হল! বিয়ে না কি কোনো শোক দিবস যে কালো শাড়ি পরব।”
“তোমাকে আমার কালো শাড়িতে দেখতে অনেক ভালো লাগে সেজন্যই তো বললাম। আর কালো শাড়ির মাধ্যমেই আমাদের সূচনালগ্ন।”
“একবারে বলো না কেন সাদা কাফনের কাপড়-ই পরব?”
“তোর এগুলো কোন ধরনের কথা? আমাকে তো তোর মানুষ বলে মনে হয় না? তোর কাছে তো আমার কোন মূল্যই নেই? তাই আমায় কষ্ট দিয়ে তুই মজা পাস।”
সেদিন ওইসব বলার কারণে ক পরিমাণ যে রেগেছিল নিশাত্যয় বলার বাইরে! তার রাগ ভাঙাতে অনেক বেগ পোহাতে হয়েছিল মাবিহার। দেখ সেই আমার কথাই হলো, সাদা কাফনে মুড়িয়ে তোমার কাছ থেকে বহুদূরে চলে যেতে হবে। চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার, মুখে তবুও হাসি। সেই হাসি উল্লেখ করে সে তার লেখা চিঠিতে লিখে গিয়েছে।
“কষ্টে বুকটা অনেক জ্বলছে, না কি শেষ মূহুর্তে নিশাত্যয়কে দেখতে না পাওয়ায়?”
মাবিহার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো, সাথে চোখের পাতা-ও।
১০.
হাসপাতালের বাইরের বসার জন্য সারিবদ্ধ হয়ে থাকা চেয়ারে বসে অতীতের কথাগুলো ভেবে চলেছিল নিশাত্যয়। কাল রাতেই সে বাংলাদেশে এসেছে, রাত অনেক দেখে মাবিহার বাড়িতে না গিয়ে নিজের বাসায় যায়। সারারাতের জার্নিতে ক্লান্ত শরীর নেতিয়ে পড়েছিল বিধায় ঘুম থেকে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল। তাই বেচারা তড়িঘড়ি করে বিকালের দিকেই রওনা হয়েছিল মাবিহার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারে বাড়ির সবাই হাসপাতালে। হাসপাতালে কেন গিয়েছে? জানতে চাইলে যা বলল তাদের বাড়ির দারোয়ান। তাতে নিশাত্যয়ের দমবন্ধ অবস্থা! সে সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিয়েছিল। সেখান থেকে কোনোরকম শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল। গিয়েও শেষ রক্ষা বোধহয় হলো না। তার অভিমানী! তার উপর অভিমান করে চলে গেছে না ফেরার দেশে। মাবিহার বাবা-মা একবার তাকাল নিশাত্যয়ের দিকে কিছু বলল না লজ্জায়।কেননা, কোন মুখে তার সাথে কথা বলবে। নিজের মেয়ের চাওয়াকে যারা মূল্য দেয় না, তাদের কোনো কথা থাকতে নেই। শুধু নিশাত্যয়ের সামনে মাবিহার দেওয়া চিঠিটা দিলো। নিশাত্যয় চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল,
প্রিয় ভালোবাসা,
তুমি যখন চিঠিটা পাবে তখন হয়তো আমি এ পৃথিবীর থেকে চিরবিদায় নিয়েছি। জানো, শেষ মূহুর্তে না তোমায় অনেক দেখতে মন চেয়েছিল। কী বলো তো, দেখতে হলে তো আমায় বেঁচে থাকতে হতো। কিন্তু ওরা তো তোমার লক্ষীকে অন্যের ঘরে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। জানো আজ না আমার বিয়ে, আমায় সাজানোর জন্য পার্লার থেকে মেয়েদের ডেকে এনেছে। তারা আমাকে সাজাতে চেয়েছিল তবে কী আমি তাদের না করে দিয়েছি। তুমি তো আমায় তোমার মতো করে সাজাতে চেয়েছিলে, তাই আমি বিয়ের দিন নিজ হাতে তোমার মন মতো সেজেছি। দেখো, সেদিনের কথা কিন্তু আজ ফলে গেল। সেদিন তুমি বলেছিলে, আমায় বিয়ের দিন কালো শাড়ি পড়তে, আর আমি বলেছিলাম সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে দিও। দেখলে দু’জনার কথাই আল্লাহ পূরণ করল, তা-ই না। জানি তুমি কাঁদছ। জানো তোমাকে এই বিয়ের খবর দিতে কতো ফোন কল, মেসেজ করেছি। কিন্তু না তোমার মোবাইল বরাবরই বন্ধ আসে। কী করবো একা? খুবই অসহায়, অপারগ লাগত নিজেকে। তুমি ভালো না বাসলে কী হয়েছে, আমি তো ভালোবাসি তোমায়। কীভাবে পারি অন্য কাউকে বিয়ে করে তার বউ হতে? কীভাবে সহ্য করব অন্যের ছোঁয়া নিজের এই শরীরে? যেখানে কথা ছিল ভালোবাসার মানুষের ছোঁয়া পাওয়ার। যদি ভালোবাসার ছোঁয়া নাই-ই পাই, অন্যের ছোঁয়াও লাগতে দিব না শরীরে। একটা কথা কী জানো? শরীর না কি ভালোবাসার’ই এক অংশ। আমি-ও মানি সেটা। সবই তো তোমায় বলি কোনো কথা তোমায় না বলে থাকতে পারি না। দেখ না তাই এই চিঠির মাধ্যমে না বলা কথাগুলোও বলে গেলাম। শুধু একটা প্রশ্ন করব তোমায়। জানি উত্তর পাওয়ার আশায় বেঁচে থাকব না। কেন তুমি আমার কাছ থেকে হঠাৎ করে হারিয়ে গেলে? তুমি তো আমার কাছে সময় চেয়েছিলে, দেখ তোমায় অফুরন্ত সময় দিয়ে গেলাম।
”ভালোবাসা তো হয় সবসময়ই বলা,
এ-তো নয় কোনো ছেলেখেলা,
মনের কোণে রয়ে যায়; অনুভূতিরা ঠাঁই
তোমায় ভালোবাসা ছিলো কি আমার অন্যায়।”
ইতি,
তোমাকে ভালোবাসার মাবিহা।
১১.
নিশাত্যয় চিঠিটা এই নিয়ে কয়েকবার পড়ে ফেলেছে। মাবিহাকে কবর দিয়ে সেখানের এক গাছের নিচে বসে আছে। আর ভাবছে সেদিনের কথা যেদিন তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে ধরে নিয়ে যায়। সে তার কাজে গিয়েছিল, সেখানে হঠাৎ করেই পুলিশ আসে আর কাজের স্থানে থাকা প্রত্যেককে সার্চ করতে শুরু করে। নিশাত্যয় জানতো না যে সেখানে কিছুদিন ধরে অবৈধভাবে ড্রাগস বিক্রি করা হচ্ছিল। পুলিশ সেটা জানতে পেরে হঠাৎই অ্যাকশান নেয়। আর সবাইকে গ্রেফতার করে, যারা এ-কাজে জরিত না তাদেরকে-ও রেহাই দেয়নি। পরে অবশ্য যারা এসবে জরিত না তাদের কিছুদিন রেখে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু শর্ত দিয়েছিল, যার যার দেশে ফিরে যাওয়ার। এত সব ঝামেলায় নিশাত্যয় মাবিহার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। এসব কী কম ছিল যে ওই সময়টাতেই মাবিহার বিয়ে ঠিক হতে হলো! ভেবে হাসতে হাসতে একসময় চিৎকার করে কাঁদতে লাগল নিশাত্যয়। আর বলতে লাগল,
“যেখানে তুমি-ই নেই প্রিয়তমা, সেখানে এই বাঁধাহীন সময়ের কোনো মূল্যই নেই আমার কাছে। তুমিহীন যেন এই সময় থেকেও শেষ।”
সমাপ্ত।