#চিরেকুটের_শব্দ (৯ শেষ পর্ব)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
অর্থি ভাবি তখন দুপুরের রান্নার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে । তখনই কলিং বেল এর শব্দ কানে আশে। সে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে বাইরে অর্থি দাড়িয়ে। চুপচাপ মুখটা ফ্যাকাশে অন্য মনষ্ক হয়ে দাড়িয়ে আছে। ভাবি একটু বিরক্তি ভাব নিয়ে বললো,
– হটাৎ না জানিয়ে এলে যে?
অর্থি কিছু বলছে না, চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। এর পর চুপচাপ হেটে অর্ণির রুমে চলে গেলো। এখানে আগে সে আর অর্ণি থাকতো এখন শুধু অর্ণি থাকে।
ভাবি হা হয়ে অর্থির পেছন পেছন চলে গেলো।
,
,
বেশ কিছুক্ষন আগে। তখন ভোরের পাখি ডাকছিলো চার দিকে। অর্থিদের রুমের পাশের রুমেই ছিলো অর্ণব। অর্ণব এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো। একটু পর এসে দরজা খুলে ফরহাদ চৌধুরি। তার পরনে একটা শর্ট প্যান্ট।
অর্ণব রুমে ঢুকে দেখে রুমের এক কোনে দুই হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে অর্থি। তবে কাঁদছে না। চুপচাপ বসে আছে।
অর্ণব গিয়ে অর্থিকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য তুলতেই অর্থি অর্ণবের গালে ঠাস ঠাস দুই টা চর মেরে দেয়। অর্ণব কিছু বললো না।
অর্ণব গ্রুত অর্থিকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। যেন বাবা কিছু জানতে না পারে। এর মাঝে রাস্তায় সোজাসুজি ভাবে বলে দিলো র্যেন বাসায় কেউ এই ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে।
অর্ণব আজ অফিসে যায় নি। অর্তির আশে পাশেই আছে। অর্থি একটা বড় চিরেকুট রেখে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে। এর পর সোজা বাসায় চলে গেল।
অর্নব যেন এই দিন টার অপেক্ষায় ছিলো। কারণ অর্থির থেকে অনেক আগেই ডিবোর্স পেপারে সাইন নিয়ে নিয়েছে সে। এখন সবাইকে বলবে, অর্থি তাকে ডিবোর্স দিয়ে নিজে থেকেই চলে গেছে।
,
,
ভাবি তার রুমে আসতেই অর্থি একটা কাগজ এগিয়ে দিলো।
‘কেন চলে এসেছি, তা জানতে এসেছো তাই তো? আমি অর্ণব কে ডিবোর্স দিয়ে এসেছি, বুঝলে?’
ভাবি আর এক মুহুর্তও দাড়ালো না। রুম থেকে বেড়িয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলে নাচছে। তার মা তো এসে তাকে অনেক কথা শুনিয়ে গেলো।
‘কতো কষ্ট করে তোকে বিয়েটা দিয়েছি। আর ওই সংসারেও টিকতে পারলি না? হায়রে কপাল পুড়ি। আর কয়দিন পর আমার ছোট মেয়ের বিয়ে তোর এই খবর ওরা জানলে বিয়েটা হবে? আর কতো জ্বালিয়ে মারবি আমাদের? বলেছিলাম না, সব চুপচাপ সহ্য করে হলেও ওখানে পরে থাকতে। কেন এলি এই বাড়িতে? হায় খোদা কার সাথে আমি এতো বক বক করছি? সারা দিনে কি এই বোবির মুখ দিয়ে একটু কথা বের হবে? যত্তসব ঝামেলা আমার কপালে এসে জুটে।
বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো তিনি। অর্থি চুপচাপ বসে আছে বিছানায়। তবে আজ একটুও কাঁদছেনা। মানুষ কতোটা আঘাত পেলে কাঁদতে পর্যন্ত ভুলে যায়?
দুপুরেও ভাত নিয়ে রুমে ঢুকে অর্থির মা। তখনও কত কথা শুনাচ্ছে। রাগে অর্থি খাবারের প্লেট আছাড় মারতেই তা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর খাবার গুলো ছিটিয়ে পরে চার দিকে।
আচমকাি তার মা এসে একটা চড় বসিয়ে দেয় তার গালে।
– তেজ দেখাস না? এতো কিছু করে আবার গা দিয়ে তেজও বের হয়?
একটু দুরে ছিটকে পরে সে। তবে সে কাঁন্নার পরিবর্তে মায়ের দিকে চেয়ে হাসতে শুরু করলো। মুখে বিরক্তি নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো তার মা। অর্থি এখনও হাসছে।
,
,
বিকেলে আশে পাশের প্রতিবেশিরা তাকে দেখতে চলে এলো। স্বামীকে ডিবোর্স দিয়ে বাপের বাড়িয়ে চলে এসেছে। এই খবর শোনার পর যেন তাকে সবাই এলিয়েন ভাবতে শুরু করেছে। অথবা চিড়িয়া খানার কোনো প্রানি।
এই খবর চলে গেলো অর্ণির হবু শশুর বাড়িতেও। তারা ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে এই বাড়ির মেয়েকে তারা কিছুতেই বৌ করে নিয়ে যাবে না।
এই খবর শোনা মাত্রই অর্থির মা রুমে এসে একটা বেল্ট হাতে তুলে নিলো। তার পর অর্থির রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ইচ্ছে মতো পিটালো তাকে। অর্থির সাদা চামরা ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো। বাড়ির কেউ তাকে বাচাতে এগিয়ে আসছে না। শুধু ভাইয়া বার বার দরজায় লাথি দিচ্ছে, হয়তো দরজা ভেঙে অর্থিকে বাচাবে এই আশায়।
জায়গা জায়গা কেটে রক্ত বের হতে লাগলো অর্থির। কিন্তু অর্থি এখনো হাসছে। যেন এমন সিচুয়েশনে খুব মজা পাচ্ছে সে। ব্যাথায় ফ্লোড়ে লুটিয়ে পরেও হাসছে সে।
,
এতটুকু শুনেই ই. সাঈদ অর্ণবের হাত ধরে টেনে নিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। আর চেচিয়ে বললো,
– আপনার জন্য এই জায়গাটাি প্রাপ্য।
অর্ণব হেসে বললো,
– আরো আছে ওটা শুনবেন না? এই সত্যটা আমার বাবাও জেনে গেলো। এর পর অর্থি প্রেগনেন্সি রিপোর্ট সে দেখে ফেলেছিলো।এর পর সব মিলিয়ে সে হয়তো এটা নিতে না পেরে, রাতেই ঘুমের মাঝে হার্ট এ্যাটাক করেছিলো। আর প্রান্তকেও আমিই মেরেছিলাম। অর্থির প্রতি তার ভালোবাসা জানতে পেরে কেন জানি তার বাইক টা একটা ট্রাকের ধাক্কায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে বাবা, প্রান্ত, আমার অনাগত সন্তান, আমার স্ত্রী চার জনকে খু*ন করেছি আমি।
কিছু না বলে চেয়ারে বসে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলো সাঈদ।
,
,
তখন গভির রাত। অর্থির কাছে কেউ নেই। ভাইয়াকেও মা বলে দিয়েছে অর্থির কাছে আসলে তার মরা মুখ দেখবে। এই মেয়ে এভাবেই মরুক। আর অর্ণি তো নিজে থেকেই আসছে না। হয়তো খুব ঘৃনা করছে তাকে।
ভর দিয়ে উঠে আস্তে আস্তে ওয়াশ রুমে চলে যায় অর্থি। সারা শরির ব্যাথা করছে খুব। ওয়াশ রুমে গিয়ে শরিরের রক্ত গুলো ধুয়ে নিলো সে। কাটা যায়গায় পানি পড়তেই তা জ্বলছে খুব। কিন্তু দাতে দাত চেপে সহ্য করে নিলো অর্থি।
বেড়িয়ে কাপা হাতে একটা লেখা লিখলো।
– আমাকে কখনোই একটু বুঝতে চাওনি তোমরা। সব সময় দুর দুর করেছো। কারণ আমি বোবা। যা তোমাদের সম্মানে লাগে। কিন্তু আমাকে তো সৃষ্টি কর্তাই এমন করে বানিয়েছে তাই না? সৃষ্টি কর্তা খুব সুন্দর জান্নাত বানিয়ে রেখেছে তার বান্দাদের জন্য। আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো সেই জান্নাতে যাওয়ার। কখনো এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ দিতাম না।
শুনেছি সুইসাইড করা মানুষ রা নাকি চির জাহান্নামি। এখন হয়তো বলবে, আমি সব জেনেও কেন সুইসাইড করছি। তার উত্তর আমি দেবো না। শুধু এতটুকুই বলতে চাই, আমার জায়গায় তোমরা হলে এতটুকু পর্যন্ত টিকে থাকতে পারতে না। আমি খুব জোড় করে, নিজের সাথে যুদ্ধ করে এতো দিন বেচে ছিলাম। কিন্তু এখন সেই শক্তিটুকু আর নেই। যাই হোক, আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকবো না। তোমাদের মুক্তি দিয়ে গেলাম। ভালো থেকো তোমরা।
আর সুইসাইড নোট হিসেবেও ছোট্ট একটা লেখা রেখে গেলো।
– আমার সুইসাইডের জন্য কেউ দায়ি নয়। এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে আমি আর বাচতে চাই না। তাই নিজে থেকেই চলে যাচ্ছি সকল প্রিয়জনকে ছেড়ে।
পরদিন সকালে ফ্যান এর সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় অর্থিকে পায় সকলে। নিথর দেহটা নামিয়ে তার পাশে বসে তার ভাই বললো,
– আমি তোকে বাচাতে পারিনি বোন। আমায় ক্ষমা করে দিস। আমার কাছে মায়ের আদেশ বড় নাকি তুই, এটা ভাবতে ভাবতেই সারা রাত পার হয়ে গেলো। আমায় ক্ষমা করে দিস বোন।
অর্থির সুইসাইডের কথা শুনে। অর্ণব রুমের রাখা চিরেকুট টা হাতে নিলো। যা অর্থি রেখে গিয়েছিলো। দেখে দুই পৃষ্টায় অনেক বড় লেখা। খুব জানতে ইচ্ছে করছে অর্থি শেষ চিরেকুটের শব্দে কি লিখে গেছে।
‘আপনাকে কিছু বলার নেই আমার। কারণ বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। জানেন, আমার শৈশব টা কেটেছে খুব বাজে ভাবে। আমার কোনো বন্ধু বান্ধবি ছিলো না। চুপচাপ ঘরের মাঝে বসে থাকতাম সারা দিন। কেউ আমার সাথে কখনো মিশতো না। খুব ছোট থেকেই ফ্যামিলি আত্মিয় স্বজনদের মুখে এটা সেটা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। খুব কাঁদতাম আমি। এর পর আস্তে আস্তে সব মানিয়ে নিতাম।
একজন সাধারণ মানুষ যখন কষ্ট পায়, আর তা কারো সাথে যখন শেয়ার করে, তখন কষ্ট টা কিছুটা হলেও কমে যায়। কিন্তু আমি ছোট থেকে যত কষ্টই পেতাম, তা কখনো কারো সাথে শেয়ার করতে পারতাম না। তখন আরো বেশি কষ্ট হতো আমার।
আশে পাশের মানুষদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম সব সময়। কতো সুন্দর করে কথা বলে সবাই। তখন ভাবতাম ইশ, আমিও যদি ওদের মতো কথা বলতে পারতাম।
জানেন আমি সব সময় ভাবতাম, আমাকে যে যাই বলুক এমন কেউ আমার জীবনে আসবে যে আমায় বুঝবে। অন্যদের মতো খোচা দিয়ে কথা বলবে না। আমি তার সাথে চিরেকুটের শব্দে কথা বলবো। সে আমায় ভালোবাসবে খুব ভালোবাসবে। প্রান্ত নামের এমন একজন কে আমি পেয়েও হারিয়ে ফেলেছি। শুধু ফ্যামিলির দিকে তাকিয়ে কাউকে কিছু বলতে পারিনি। এর পর যখন আপনার সাথে বিয়ে হলো। তখন ভাবলাম, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আমার স্বামীকেই আমি মন প্রান দিয়ে ভালোবাসবো।
হুম আপনাকে খুব ভালোবাসতাম আমি। কিন্তু কখনো তা মুখ ফুটে আপনাকে বলতে পারিনি। কারণ সৃষ্টিকর্তা আমাকে শেষ শক্তি টুকু দেন নি। মাঝে মাঝে কল্পনা করতাম, যদি কখনো সৃষ্টিকর্তা আমাকে এক মিনিটের জন্য হলেও কথা বলার সুজুগ টা দিতো, তাহলে আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরে খুব চিৎকার করে বলতাম, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
কিন্তু আমার সব চিন্তাই ছিলো একটা দির্ঘশ্বাস। গত কাল আপনাকে একটা সু-খবর দিবো বলেছিলাম না, এখন বলি? আপনি বাবা হতে চলেছিলেন। জানিনা এখন আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে? তবে আমি আমার বাচ্চাকে সাথে নিয়েই অনেক দুড়ে চলে যাবো। কারণ এই স্বার্থপর দুনিয়ায় এমন মানুষ রুপি পশুদের হাতে আমি আমার সন্তানকে রেখে যেতে চাই না।
আচ্ছা আপনি কি আমায় একটুও বুঝতে পারেন নি? ওহ্ বুঝবেন কিভাবে যেখানে নিজের ফ্যামিলির মানুষই আমাকে সব সময় মুখের কথায় লাথি উষ্টা মারতো। আমি ছোট থেকেই এমন লাথি উষ্টা খেয়ে বড় হয়েছি। ভেবেছিলাম সবার জীবনেই তো কষ্টের পর সুখ আসে। তেমন আমারও আসবে। কিন্তু তা আর হলো কই? আমি সুখকে ছুতে গেলেই তা দুঃখে পরিনত হয়। আমি আসলে মানুষ না। রাস্তার কোনো ঘৃণিত পশু। হুম সবার ব্যাবহারে নিজেকে তাই মনে হয় আমার। যাই হোক আপনাকে মুক্তি দিয়ে দিলাম। ঈষিতাকে বিয়ে করে নিবেন কেমন? ওই মেয়েটার সাথে এমন করবেন না৷ ভালো থাকবেন, আমি নামক পশু টা আর কখনো আপনাদের সামনে দাড়াবে না। আর কারো মুখ কালো করার কারণ হবে না। ভালো থাকবেন সকলে।
,,,,,,,,,,,সমাপ্ত,,,,,,,,,,