লুকোচুরি,পর্বঃ৪

0
604

লুকোচুরি,পর্বঃ৪
খাদিজা আরুশি আরু


আজ জাবেদকে কোর্টে তোলা হয়েছে, কেইসের ফাস্ট হেয়ারিং। আসবে না, আসবে না করেও মনিকা এলো। কোর্টরুমে জাকিয়াকে শান্তভাবে বসে থাকতে দেখে যারপরনাই অবাক হলো সে, চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হাসলো জাকিয়া। মনিকাও ভদ্রতাসূচক হাসি হাসলো। তারা বসেছে দুই সিট দুরত্বে। মনিকা শুরু থেকে তন্ময় আর জাকিয়াকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে, তন্ময়ের দৃষ্টি জাকিয়াতেই নিবদ্ধ। ইশ, পৃথিবী কতো বৈচিত্রময়! একটা পৃথিবী অথচ সেখানে জাবেদ আর তন্ময়, দু’জন দু’মেরুর পুরুষের বাস! কি অদ্ভুত, কি অদ্ভুত…

মনিকার চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও সে জাবেদের থেকে পুরোপুরি দূরে থাকতে পারছে না। মন আর মস্তিষ্কের দ্বন্দে মন বারংবার জিতে যাচ্ছে। এই যে আজ সে কোর্টে এলো, তার তো এখানে আসার কথা ছিলো না অথচ তবুও এলো। জাকিয়ার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবার কথা ছিলো না, তবুও হলো। মনিকার জীবনে যেনো সব না ঘটা ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে! আচ্ছা, কোনোভাবে কি ডিভোর্সটা আটকে যেতে পারে? যদি যায়! তবে কি মনিকা মনে মনে খুশি হবে? উত্তর পায় না মনিকা… একদিকে রাগে, ঘৃণায় তার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে অন্যদিকে জাবেদের জন্য মনটা বড্ড বেশি পুঁড়ছে। মনে হচ্ছে এতো কাছের মানুষটার সঙ্গে এতো কঠিন হওয়া কি ঠিক হচ্ছে? একটুখানি নরম হলে কি হতো! সে তো তার স্বামীই… পরক্ষণেই মনিকার ভেতরকার ক্রোধ সকল মায়ার বাঁধনকে ভস্ম করে দিচ্ছে। এ কোন দোটানায় পড়লো মনিকা!

জাবেদের পরিবারের কেউই আসে নি, কোনোরকম একজন উকিল হায়ার করেই তারা সব দায়মুক্ত হয়েছে। আসামী পক্ষের উকিল বিমর্ষ মুখে একটা পাশে বসে আছে… হয়তো সে’ও জানে যে তার জেতার কোনো সুযোগ নেই। সেলিনা জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, তন্ময় শুরু থেকেই গম্ভীর হয়ে জাকিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, আমার বউটার এতো সাহস কেনো?

বিচারক কোর্ট রুমে প্রবেশ করার পর কোর্টের কার্যক্রম শুরু হলো। প্রথমে কথা বললো আসামী পক্ষের উকিল মৃন্ময়।

-“মি. জাবেদ, আপনি একটু পরিষ্কার করে বলুন তো ঠিক কি ঘটেছিলো…”

জাবেদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলা শুরু করলো,

-“ইউএসএ থাকাকালীন ওদের কোম্পানী থেকে আমার সঙ্গে মেইলের মাধ্যমে কন্টাক্ট করা হয়, সব দিক বিবেচনা করার পর আমার মনে হয় ডিলটা করাই যায়। তাই আমি আগ্রহ প্রকাশ করি। ওদের কোম্পানী থেকে একটা ভিডিও কনফারেন্সের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানেই আমি জাকিয়াকে প্রথমবার দেখি। বলা বাহুল্য, এতো সরল আর নির্ভিক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। প্রথমবারেও জাকিয়ার প্রতি আমার আলাদা টান অনুভূত হয়। আমি ডিলটা করতে রাজি হই কিন্তু কোম্পানী থেকে জানানো হয় ডিলটা করতে হলে আমাকে সশরীরে দেশে এসে কন্টাক পেপারে সাইন করতে হবে। জানি না কেনো, ইউএসএ যাবার পর প্রথমবার দেশে আসার জন্য নিজের মাঝে তাগাদা অনুভব করলাম। আমার স্ত্রী অবশ্য আসতে চাইলো না কারন তার পরিবার ওই দেশে স্যাটেল কিন্তু আমার মায়ের জোরাজোরিতে আমার সঙ্গে মনিকাও আসলো। ভিডিও কনফারেন্সের বিশ দিনের মাথায় আমরা বাংলাদেশে পা রাখলাম। তখন আমি যেনো এক মোহগ্রস্ত মানুষ! আমার এতো বছরের সংসার, আমার পরিবারের সম্মান, আমার স্ত্রী কিছুই মাথায় আসে নি আমার। আমার মাথায় তখন জাকিয়া ঘুরছিলো। কিভাবে ওর মন জয় করা যায়, ওর সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়া যায়… এইতো এসবই!”

এটুকু বলে থামলো জাবেদ, তার উকিল মৃন্ময় তাড়া দিলো…

-“চুপ করে থাকবেন না মি. জাবেদ… তারপর কি হলো?”
-“ওদের কোম্পানীতে আমাকে ওয়েলকাম করতে জাকিয়া এলো, কথায় কথায় আমাদের চোখাচোখি হলো। জাকিয়া মিষ্টি করে হাসলো। ওর হাসিটায় কি ছিলো জানি না, তবে আমি বিভোর হয়ে গেলাম। আমার মন ও মস্তিষ্কে ও ঝেঁকে বসলো। ডিলটা ফাইনাল হবার পর কোম্পানীতে আমার যাতায়াত বাড়লো, জাকিয়ার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হতে লাগলো। বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। একসময় বন্ধুত্ব প্রণয়ের রূপ নিলো। জাকিয়া ওর স্বামীকে ভীষণ ভয় পেতো তাই ও আমার সঙ্গে…”

এ পর্যায়ে সেলিনা বললো,

-“অবজেকশন ইওর অনার… আমার ক্লায়েন্ট আর তার স্বামীর সম্পর্ক বন্ধুর মতো। সেখানে ভয়ের প্রশ্নই আসে না।”

মৃন্ময় বললো,

-“ইওর অনার, আমার প্রতিপক্ষ বন্ধু যদি আমার ক্লায়েন্টকে তার দিকের কথা বলতে না দেয় তাহলে তো কেইসটা একপাক্ষীক মতের ভিত্তিতে হয়ে যাবে। আমার ক্লায়েন্টকে বলার সুযোগ দেয়া হোক…”

বিচারক অর্ডার, অর্ডার বলে, বললো,

-“মি. মৃন্ময় এর কাজ শেষ হলে আপনিও সুযোগ পাবেন মিস সেলিনা। অবজেকশন ওভাররুট…”

মৃন্ময় মাথা নুয়িয়ে সম্মান জানিয়ে বললো,

-“ধন্যবাদ ইওর অনার।”

জাবেদ আবার বলতে শুরু করলো,

-“আমাদের কখনোই ফোনে কথা হতো না। আমাদের কথা হতো কেবল দেখা হলেই… সম্পর্ক হবার পর আমি সর্বদা জাকিয়ার সান্নিধ্য কামনা করতাম তাই ওকে কল করতে চাইতাম। কিন্তু ওর বারন থাকায় সেটা সম্ভব ছিলো না। তাই একদিন আমি ওকে একটা ফোন আর সিমকার্ড উপহার দিলাম। ওর স্বামী যেনো কিছু বুঝতে না পারে তাই ভুল তথ্য দিয়ে একটা ফেইজবুক আইডিও খুলে দিলাম। ওই আইডির মেসেঞ্জারেই আমাদের কথা হতো, তাছাড়া হোয়াটসআ্যাপ বা ইমোতে… আমাদের কখনো ভয়েজ কলে কথা হয় নি, আমরা কথা বলতাম মেসেজে। আমাদের কথা চলাকালীন জাকিয়া কথা বলতো খুব কম, আমিই বেশি বলতাম। ও হুঁ, হ্যাঁ, এসবই বলতো বেশি। ঘটনার দিন ও আমাকে বললো ওর বর বাসায় নেই। আজ ফিরবে না। তাই আমি যেনো ওর বাসায় যাই। একত্রে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা যাবে। ওই প্রস্তুতি নিয়েই আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু ওখানে যাবার পর সব কেমন মুহূর্তে বদলে গেলো! জাকিয়ার পরিবর্তনটা আমি এখনো মেনে নিতে পারছি না… যে জাকিয়াকে আমি ভালোবেসেছি সে জাকিয়া আর এ জাকিয়া যেনো দুটো ভিন্ন মানুষ! আমার এখনো কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না, মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। বিশ্বাস করুন, আমি ওকে জোর করি নি… আমি কেবল ওকে ভালোবেসে নিজের করে নিতে চেয়েছিলাম।”

কথা বলা শেষ করে জাবেদ ডিফেন্স বক্সেই বসে পড়লো, তার দৃষ্টি জাকিয়ার দিকে স্থির। মনিকার দৃষ্টি জাবেদের দৃষ্টিতে নিবদ্ধ, যে মানুষটার ভালোবাসার টানে সে ছুটে এসেছিলো, সে মানুষটাকে চোখের সামনে জাকিয়ার জন্য ভেঙে গুড়িয়ে যেতে দেখে মনিকার মনের মাঝে জাগা শেষ আশার আলোটাও দপ করে নিভে গেলো। সে ধীর পায়ে কোর্ট রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তার চোখ জ্বালা করছে, মনিকা ভেবে পায় না তার সাত বছরের ভালোবাসার কি করে ক্ষণিকের মোহর কাছে হেরে গেলো!

মৃন্ময় বিচারকের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“ইওর অনার, আমার ক্লায়েন্টের কথা আপনি শুনেছেন। মিসেস জাকিয়া সেদিন আমার ক্লায়েন্টকে নিজে তার ফ্লাটে ডেকেছিলেন। আমার ক্লায়েন্টকে ফলস এলিগেশন দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে…”

সেলিনা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, বললো,

-“অবজেকশন ইওর অনার, আমার প্রতিপক্ষ বন্ধু নিজের ক্লায়েন্টের কথার ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তাছাড়া সিদ্ধান্ত দেবার দায়িত্ব আপনার, আমার প্রতিপক্ষ বন্ধুর নয়। আমি মি. জাবেদকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।”

বিচারক বললেন,

-“অনুমতি দেয়া হলো।”
-“ধন্যবাদ।”

জাবেদ এতোক্ষণে নিজেকে সামলে উঠে বসেছে, সেলিনা জাবেদের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করলো,

-“মি. জাবেদ, আমার ক্লায়েন্ট মানে মিসেস জাকিয়ার ফ্লাটে আপনি সেদিন কিভাবে প্রবেশ করেছিলেন? মানে নক করার পর জাকিয়া দরজা খুলেছিলো? নাকি অন্য কোনো উপায়ে?”
-“জাকিয়া আমাকে ওর ফ্লাটের একটা স্পেয়ার কী দিয়েছিলো, আমি ওটা ব্যবহার করে ফ্লাটে প্রবেশ করেছিলাম।”
-“স্পেয়ার কী! স্ট্রেঞ্জ… ইওর অনার, আমি এই কেইসের ইনভেস্টিগেশন অফিসার কুঞ্জকে ডিফেন্স বক্সে ডাকার অনুমতি চাচ্ছি…”
-“অনুমতি দেয়া হলো।”

কুঞ্জ ডিফেন্স বক্সে আসার পর সেলিনা জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনি তো দীর্ঘদিন যাবত মি. তন্ময়ের সঙ্গে কাজ করছেন তাই না?”
-“জ্বী।”
-“মিসেস. জাকিয়াকে কতোদিন যাবত চিনেন?”
-“স্যারের সঙ্গে ওনাদের সম্পর্ক শুরু হবার আগে থেকেই। আসলে ম্যামের সঙ্গে আমাদের পরিচয় একটা কেইসের মাধ্যমে, ম্যামকে ফলস কেইসে ফাসানো হয়েছিলো। কেইসটা সলভ হবার পর ম্যাম আর স্যারের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো হয়ে যায়। সেখান থেকেই বিয়ে…”
-“আপনি বলতে চাইছেন মিসেস জাকিয়া আর মি. তন্ময়ের সম্পর্ক বন্ধুর মতো?”
-“জ্বী।”
-“পয়েন্ট টু বি নোটেট ইওর অনার… সো মি কুঞ্জ, আপনি এবং আপনার টিম তো ঘটনার পর ফ্লাটের তল্লাশি করেছিলেন, কোনো স্পেয়ার কী পাওয়া গিয়েছিলো কি?”
-“সেদিন সন্ধ্যায় তন্ময় স্যারকে ম্যাম কল করে দ্রুত বাসায় যেতে বলে, আসলে সেদিন ম্যাম আর স্যারের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী ছিলো। স্যারও দ্রুত থানা থেকে বেরিয়ে যায়, কিন্তু ফ্লাটে গিয়ে দেখে ওই লোকটা ম্যামের সঙ্গে অসভ্যতা করার চেষ্টা করছে। স্যার তৎক্ষণাত আমাকে কল করে… ঘটনাটায় ম্যাম ঘাবড়ে গিয়েছিলো, স্যার ম্যামকে শান্ত করার সময় মি. জাবেদ ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে আমরা তাকে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করেছি। তবে স্যারের ফ্লাটের দুটো চাবি পেয়েছি আমরা একটা স্যারের ওয়ালেটে ছিলো আর অন্যটা ম্যামের পার্সে। এছাড়া আর কোনো স্পেয়ার কী পাওয়া যায় নি। তাছাড়া ফরেনসিক টেস্টের পর চাবি দু’টোতেও স্যার আর ম্যাম ছাড়া অন্য কারো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় নি।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here