আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ২

0
1037

আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ২
খাদিজা আরুশি আরু

সবাই ভেতরে চলে যাবার পর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ইরফান তানিয়াকে ডাকলো, বোনের কাছ থেকে কিছু লুকাতে তার ইচ্ছে করছে না তাই ইতস্তত করে বললো,

–তানিয়া…
–বলো।
–ইন্দুতো চলে এসেছে, তাহলে এবার ওর সঙ্গে এ বাড়ির ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলি কি বলো?
–সময় হলে বলবে বললে না তখন?তাছাড়া ও’তো সবে এলো সুতরাং এখন বললে যদি রেগে আবার চলে যায়? তাই এখন বলো না দয়া করে।
–তুমি বুজছো না, ওকে এখন বললেও সমস্যা পরে বললেও! বাড়ির সবার জীবনতো আগের মতো নেই বলো, আসলে আমার ভয়ে আর আনন্দে সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
–আমি সব বুঝতে পারছি ইরফান, শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছি। তাছাড়া ওর মনে কি চলে আমি আগে ওর মুখ দেখে বুঝতে পারলেও এখন পারছি না।
–কিন্তু…
–কোনো কিন্তু নয়, ওরা অনেকক্ষণ হলো ভিতরে গেছে সুতরাং আমাদেরও যাওয়া উচিত।
–হুম,চলো।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার পরপরই মনিরা চৌধুরি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–ইন্দু… কি খাবি বল, আমি তোর পছন্দের সব খাবার বানিয়েছি। এতোটা পথ জার্নি করে আসলি, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।

রায়হান চৌধুরি হাসিহাসি মুখ করে বললেন,

–ইন্দু মা, তুই বই পড়তে খুব ভালোবাসিস তো! আমি তোর পছন্দের অনেক বই আনিয়েছি, সব তোর ঘরে রাখিয়েছি।

ইরফান সোফার হাতলের উপর আয়েশ করে বসে বললো,

–ইন্দু, তুই আমার গান শুনবি না? জানি এখন তুই খুব বড় গায়িকা হয়ে গেছিস কিন্তু তোর ভাইওতো তোর সঙ্গেই গান শিখেছে। তাই ততোটা খারাপ গাই না কিন্তু আমি। কিরে শুনবি? ধরবো একটা গান?

ইন্দু বিরক্ত হয়ে দুহাতে মাথা ধরে সোফায় বসে বললো,

–প্রলয়, সবাইকে থামতে বলবে প্লিজ!আমার অসহ্য লাগছে।
–মামা-মামি, ইফু তোমরা থামো। ইন্দু সবে এলো, ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও।

প্রলয় থামতেই ইন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–বাবা আমি দশ বছর পর এসেছি, তার মানে এটা নয় যে এসেই চলে যাবো। আমি কিছুদিন থাকবো বলেই এসেছি, এতো উত্তেজিত হবার মতো কিছুই হয়নি…

মনিরা চৌধুরি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,

–তুই এ বাড়িতে প্রথম এসেছিস ইন্দু! তোর বাবার খুব সখ ছিলো এ বাড়িতে প্রথম তুই পা রাখবি, কিন্তু তোর জেদের সামনে তোর বাবা অসহায় ছিলো।

মনিরা চৌধুরির প্রতি জমা রাগটা এখনো সম্পূর্ণ গলে যায় নি ইন্দুর, তাই তার প্রতিটি কথায় বেশ বিরক্ত হচ্ছে সে। তবুও নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বললো,

–তোমরা এমন করছো যেনো এই দশ বছরে প্রথম দেখা হলো আমাদের!
আমি আসি নি কিন্তু তোমরা তো আমার কাছে গেছো। দেখাতো হয়েছেই, সুতরাং কেনো এমন করছো!

রায়হান চৌধুরি ইন্দুর রাগটা টের পেয়ে শান্তস্বরে বললেন,

–সন্তান বাড়ি ফিরার আনন্দ তুই নিজে মা না হলে বুঝবি না ইন্দু মা, তোকে ভালোবাসে বলেই সবাই এমনটা করছে।কিন্তু তুই চিন্তা করবি না, তুই যেভাবে চাইবি সেভাবেই সবটা হবে। কোনো জোর নেই তোর উপর মা। তোর মা তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছে, যখন মন চাইবে খেয়ে নিবি। আমি বই আনিয়ে তোর ঘরে রাখিয়েছি, মন চাইলে সেখান থেকে বই নিয়ে পড়বি। তোর ভাই তোর জন্য গান গাইতে চাচ্ছে, মন চাইলে শুনবি, না মন চাইলে শুনবি না। কিরে বুঝলি?
–সরি বাবা, আসলে একটু ক্লান্ত আমি।অনেকটা পথ পার করে এসেছি, বিশ্রামের প্রয়োজন আমার। সরি ভাই… তোমরা কিছু মনে করো না প্লিজ!
–বউমা, ইন্দু মা কে ওর রুমে নিয়ে যাও।
ইন্দু মা, মনে রাখবি কোনো কাজ করতে মন চাইলে কেবল তখনই সে কাজটা করবি, কোনো জোর নেই! অন্যকেউ তোর পাশে না থাকলেও তোর বাবা সেটাই করবে যাতে তুই খুশি থাকবি।
–আচ্ছা বাবা।

ইন্দু চলে যেতেই মনিরা বেগম গটগট করে বললেন,

–কেনো মেয়েটাকে যেতে দিলে? আমি কথা বলছিলাম তো!
–গিন্নী আমি অনেক বছর পর আমার মেয়েকে কাছে পেয়েছি, আমি ইন্দুকে আর হারাতে চাই না। তাই তুমি আগের বারের মতো কোনো বাড়াবাড়ির চেষ্টা করলে আমি ছেড়ে কথা বলবো না ইরফান আমার সঙ্গে চলো, অফিসের কিছু কাজ আছে সেগুলো শেষ করতে হবে। অযথা জামেলা বাড়াতে চাইনা আমি।
–হ্যাঁ বাবা, আমারও আবার বের হতে হবে। চলো আগে তোমার কাজগুলো শেষ করি।

রায়হান চৌধুরি আর ইরফান বেরিয়ে যেতেই প্রলয় মনিরা চৌধুরিকে বললো,

–মামি, আমি তাহলে আজকে যাই।
–প্রলয়, তুই খেয়ে যাবি না?
–আজ না মামি, আসলে মায়ের জন্য মন কেমন করছে। কাজের জন্য অনেকদিন দেখা হয়নি মায়ের সঙ্গে, বাইরে বাইরে ছিলাম তো। তাই আগে বাড়ি যাবো, তারপর ইন্দুর কাজের সিডিউলটাও ঠিক করতে হবে। দম ফালানোর জো নেই,
অন্যদিন এসে খেয়ে যাবো। আজ অনুমতি দাও যাবার!
–আচ্ছা ঠিক আছে যা, সাবধানে যাস… আর তোর মাকে বলিস আমি যাবো সময় করে একদিন।
–আচ্ছা যেও, আমাদের আর কি, সব তো তোমাদেরই!

–ইন্দু দেখ তোর রুম আমি তোর মন মতোই সাজিয়ে রেখেছি, তুই একদিন এভাবে সাজাতে চেয়েছিলি না, তাই!
–তানি!
–কিরে কিছু বলবি?
–এই দশ বছরে তির্থ একবারো আমার খোঁজ করেছিলো?
–না, করে নি! তুই এখনো ওর কথা মনে রেখেছিস? ওকে একটা কালো অতীত মনে করে ভুলে যা ইন্দু, সবাই তোকে কতো ভালোবাসে বলতো। আর ও, ভুল বুঝে চলে গেলো।
–সম্পর্ক ভাঙ্গা আমার পছন্দ নয়, তাছাড়া ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগত। তুই এসবে নিজেকে জড়াস না তানি।

কথাটা শুনেই রাগে গটগট করতে করতে তানিয়া বললো,

–যদি শুধু তোর ভাবি হতাম তাহলে কখনোই জড়াতাম না নিজেকে ইন্দু, তবে আমি তো শুধুই তোর ভাবি নই তোর সব থেকে কাছের বন্ধুও। তাই তোর কষ্ট হয় এমন কাজ করলে আমি বার বার তোকে আটকাবো, বারংবার। ভুলে যা না ইন্দু, ঐ মানুষটা কি তোর জীবনের সব? আমরা কেউ নই?
–তির্থ আমার সেরকম কেউ নয় পিয়ু, কেউ নয়! তবুও আমি ওকে ভুলতে পারছি না, ওর সঙ্গে আমার জীবনের কিছু ভালো স্মৃতি জড়িত। তাই চাইলেই ওকে ভুলা যায় না, ও তো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিলো বল… বন্ধুকে কি ভুলা যায়?
–কেনো ভুলতে পারছিস না, প্রলয় ভাইকে দেখেছিস? ও যে তোকে ভালোবাসে সেটা ওকে দেখেই বুঝা যায়, তাও ও কখনো তোর ওপর নিজের ভালোবাসা চাপিয়ে দেয়নি। এতো বছর নিঃস্বার্থভাবে তোর খেয়াল রেখেছে!
–আমি অবুঝ নই তানি, আমি জানি প্রলয় আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি এখনই কোনো সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছুক নই!
যাই হোক, আমি একটু শুবো। যাবার সময় লাইটটা অফ করে যাস প্লিজ।

তানিয়া জানে এখন ইন্দুকে আর কোনো কথা শুনানো যাবে না, তাই চুপচাপ লাইট অফ করে দরজা আটকে বেরিয়ে গেলো। ইন্দু মেয়েটাই এমন, রাগলে আগুনের গোলা আর ভালোবাসলে প্রেমময়ী। এক চরিত্রে এতো রূপ একালে বড়ই বিরল!

–প্রলয়, চলে যাচ্ছিস?

ইরফানের ডাকে পেছন ফিরে মুচকি হেসে প্রলয় বলে,

–হ্যাঁ যাচ্ছি, কারন এখানে আমার দায়িত্ব শেষ।
–তুই কেনো নিজের সঙ্গে এমন করছিস? তুই তো জানিস ইন্দু তোকে ভালোবাসে না।
–জানি, ইন্দু আমাকে ভালোবাসে না। হয়তো কোনোদিনও ভালোবাসবে না…
আর তুই কি জানিস ইফু, তোর এই ভাই, তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু তোর বোনের কাছ থেকে ভালোবাসা আশাও করে না। তুই’ই বল আমি কোনোদিন বলেছি যে আমি চাই ইন্দু আমায় ভালোবাসুক? বলেছি কখনো? বলিনিতো তাই না, আমি ওকে ভালোবাসি। ওর জন্য কিছু করতে পারলে আমার মনে এক প্রকার তৃপ্তি কাজ করে, তাই আমি ওর খেয়াল রাখি।
–তুই খুব ভালো প্রলয়, কিন্তু তুই ইন্দুর জন্য নিজেতো বাঁচা ছাড়তে পারিস না! নিজের জন্য কিছু কর, তোরও তো কিছু স্বপ্ন আছে, প্রয়োজন আছে। একবার অন্তত ওকে তোর মনের কথাটা বল!
–কে বললো আমি বেঁচে নেই, আমি বেঁচে আছি এবং ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। তুই বল কি ছিলাম আমি? গ্রামের অসহায়, সদ্য পিতৃহারা একটা ছেলে! যার মা কিনা শয্যাশায়ী। হাসপাতালের বাইরে মাকে নিয়ে এর ওর কাছে সাহায্য চাইছিলাম, অসহায়ের মতো ঐ বয়সে পড়াশুনা ফেলে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করার টাকা জোগাড়ের জন্য কাজ খুঁজছিলাম। সেদিন মামা না থাকলে হয়তো কবেই এই ব্যস্ত শহরের জনস্রোতে ভেসে যেতাম, হয়তো আজ মা বলে ডাকার কেউ থাকতো না। অথচ আজ দেখ, আমি উচ্চ শিক্ষিত। ভালো চাকরি করছি। এতো কিছুর বিনিময়ে আমি ইন্দুর খেয়াল রাখার দায়িত্বটা নিতে পারবো না? ওর প্রতি আমার ভালোবাসার চেয়ে দায়িত্বটা যে বড্ড বেশি ইফু। তাছাড়া তুই আমার জন্য কম করেছিস, আমার মতো রাস্তার ছেলেকে বুকে টেনে নিয়েছিস। বন্ধু নয় নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছিস। এটা কি কম?
–তুই আমাদের ভালোবাসাকে দয়া ভাবছিস? তাই নিজের এতো বড় ক্ষতি করে সুদে আসলে সে ঋণ ফিরিয়ে দিতে চাইছিস?
–ইফু ভাই আমার, তুই আমাকে ভুল ভাবছিস। আমি শুধু বললাম যে তোরা আমার জন্য যা করেছিস তার সামনে এটা কিছুই না। আমি ইন্দুর সঙ্গে ছিলাম বলেই তোরা এতোদিন দূরে থেকেও নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছিস! তাছাড়া ভালোবাসার মানুষের সানিধ্যে থাকতে পারার ভাগ্য ক’জন পায় বল!
–ভাই ঠিক কথা বলছে ইরফান, ও যা করেছে ভালোবেসে করেছে। ইন্দুকে ও ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে। দেখো ওর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা একদিন ইন্দুকে বাধ্য করবে ওর কাছে ছুটে আসতে। ওর ভালোবাসাই ইন্দুর মন জয় করবে।

তানিয়ার কথায় ঘুরে দাঁড়ায় প্রলয় আর ইরফান। তার কথা শেষ হতেই ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–তুমি মিথ্যে আশা করছো তানিয়া, ইন্দু ঐ তির্থকে কোনোদিন ভুলবে না।
–তুমি যাই বলো, আমি জানি আমাদের ইন্দু মানুষ চিনতে ভুল করবে না। ও কাচ আর হিরার ভিড়ে আসল হিরাটাই খুঁজে বের করবে, মিলিয়ে নিও।
–দেখা যাবে।

ইরফান আর তানিয়ার কথোপকথন বেশিক্ষণ চললে তা যে তর্কে রূপ নিবে তা বুঝতে পেরে প্রলয় গম্ভীরভাবে বললো,

–না ভুলুক, যদি কখনো তির্থ ফিরে আর ইন্দুবতী ওর কাছে ফিরে যেতে চায় তাহলে আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওকে তির্থের হাতে তুলে দিবো। তির্থের আর ওর বিয়ে দেবো, ওদের যেতে দিবো। অন্যকেউ ওর পাশে না থাকলেও ইন্দুর ভালো বন্ধু হয়ে আমি সারাজীবন ওর পাশে থাকবো, ওর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো আমার উদ্দেশ্য নয়। দেখ, জীবনটা ইন্দুর। সুতরাং সে জীবনে ও কাকে চাইবে সে সিদ্বান্তটাও একমাত্র ওর হবে। অন্য কারো নয়… তোরা তোদের সিদ্বান্ত ওর ওপর চাপানোর চেষ্টা করিস না, তাহলে কিন্তু সবার প্রথমে প্রতিবাদের আওয়াজ আমি তুলবো। আসছি।

প্রলয় যাবার জন্য উদ্ধত হলে পিছু ডাকে ইরফান।

–প্রলয়…!
–ডেকো না… যেতে দাও ভাইকে। তুমি দেখো ইন্দু একদিন ঠিক ওর ভালোবাসা বুঝবে, আর ইন্দু না চাইলে আমরা জোরও করতে পারি না। সত্যিই তো এটা একান্তই ওর জীবন, আমারা বেশি হলে উপদেশ দিতে পারি!
–বুঝবে! আর কবে? টানা দশটা বছর পাশে পাশে থাকার পর বুঝলো না, তাহলে আর কবে বুঝবে তানিয়া?ইন্দু বুঝতে বুঝতে ছেলেটা অনুভূতির অতলে না তলিয়ে যায়! তুমি জানো, সেই প্রথম দিন থেকে ও ইন্দুকে পছন্দ করতো। কখনো মুখ ফুটে কিছু বলেনি, তবে আমি বুঝতাম। ও সব সময় ইন্দুর ভালো চাইতো, কখনো ইন্দুর ক্ষতি হয় এমন কিছু করে নি। একবার ইন্দু সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে খুব কাঁদছিলো! ঐ বয়সে প্রলয় কি সুন্দরভাবে ওকে শান্ত করিয়েছিলো নিজে না দেখলে বুঝবে না। গত দশটা বছরের কথাই ভাবো না, ওর কাছে ছিলো ইন্দু।কখনো ও ইন্দুকে একা ছাড়ে নি, নিজের কাজের পাশাপাশি ইন্দুর প্রতি নিজের দায়িত্ব যথা সম্ভব ঠিকভাবে পালন করে গেছে। বিনিময়ে কিছু নেয়নি, ভাই হিসেবে নিজের বোনকে এমন কারো হাতে তুলে দিতে চাওয়াটা কি আমার অন্যায়?
–না ইরফান, সত্যিই ভাই ইন্দুর জন্য যোগ্য পাত্র।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতোক্ষন সব দেখছিলো ইন্দুবতী, এমন না যে ইন্দু প্রলয়ের ভালোবাসা বুঝে না। কিন্তু তার মনের সবটা জুড়ে যে তির্থে’র বসবাস, এ কথাটা অস্বীকার করার সাধ্য যে তার নেই। কখনে হবে কি না তাও জানা নেই ইন্দুর। হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না! তবে ওর মন খুব করে প্রলয়ের সাফল্য চায়, ও চায় প্রলয় নিজের জন্য বাঁচুক। দায়িত্ব নয় ভালোবাসা নিয়ে বাঁচুক…

মধ্যরাত, সবার চোখে গভীর ঘুম ভর করেছে। কিন্তু ইন্দুর চোখ ঘুম নেই, গত দশ বছরে একটা রাতও শান্তিতে ঘুমাতে পারে নি সে। ঘুমের মধ্যে বারবার তির্থকে মনে করে জেগে উঠেছে, আজও হয়তো একটা নিদ্রাহীন রাত কাটতে যাচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না ইন্দু, তির্থকে সে আজো খুঁজে পেতে চায়। তির্থের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কটাকে ঘষে মেজে ঠিক করতে চায়, কিন্তু তির্থের সঙ্গে যোগাযোগের সব মাধ্যম যে বন্ধ! অন্যদিকে প্রলয়ের জীবনটাও যে সাজাতে হবে, ছেলেটাওতো কম করে নি ইন্দুর জন্য। তাই প্রলয়কে ভুললেও চলে না, প্রলয়কে নিজের জন্য বাঁচতে শেখাতে হবে। অনেকগুলো কাজ করা বাকি, কিন্তু সে কাজগুলোর শুরু কোথা থেকে করা যায় সে বিষয়ে কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না মেয়েটা!

অনেকক্ষন যাবত ফোনটা বাজছে, কিন্তু ধরার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই প্রলয়ের। সারারাত ইন্দুর কাজের সিডিউল গুছিয়ে ছেলেটা ফজর নামাজ পড়ে একটু শুয়েছে, এখন ওঠা মানে সারাটা দিন বরবাদ করা। কিন্তু ফোনটা যে থামার নামই নিচ্ছে না, শেষমেশ না পেরেই উঠে ফোন তুললো প্রলয়। কল রিসিভ করে ফোনের ওপাশের মানুষটার কথা শুনে প্রলয় বললো,

–কখন হলো এতোসব, তোরা কখন জানলি! আগে জানাবি না? আমি এক্ষুণি আসছি।

ফোনটা রেখে কোনোমতে ফ্রেস হয়ে বের হচ্ছিলো প্রলয়, তাকে এতো সকালে বের হতে দেখে তার মা পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করলো,

–কোথায় যাচ্ছিস প্রলয়?

আমেনা বেগম, প্রলয়ের মা। নিজের বলতে এই একজন মানুষই আছে ওর।তাই কষ্ট পেলে মায়ের কোলে মুখ লুকিকে নিরবে চোখের জল ফেলে সে। তবে তাও মায়ের চোখের আড়ালে, ওকে কাঁদতে দেখলে যে ওর মা কষ্ট পাবে!

–কাজ আছে মা, এসে সব বলবো।
–খেয়ে নে তারপর কাজ করবি, বস তুই।
–না মা, একদম বসা যাবে না… আমি আসি।
–আরে বাবা খেয়েতো যাবি! প্রলয়… উফ… কি যে করে ছেলেটা!

তড়িঘড়ি চৌধুরি নিবাসের সদর দরজা পেরিয়ে বসার ঘরে এসে প্রলয় জিজ্ঞেস করলো,

–ইফু, ইন্দু ফিরেছে?
–না রে… আমরা ভাবলাম তোর সঙ্গে গেছে। কিন্তু এখনতো দেখছি তুই কিছুই জানিস না, আমারতো এখন চিন্তা হচ্ছে। মা-বাবাকে দেখ, সকাল থেকে কিছুই খায়নি। ইন্দু ইন্দু করে চোখের জল ফেলছে…
–কার জন্য চিন্তা হচ্ছে ভাই?
–ইন্দু তুমি এসেছো! কোথায় গেছিলে?আমাকে বলোনি কেনো? আমি সঙ্গে যেতাম, তুমিতো কখনো আমাকে ছাড়া একা যাও না। তাহলে আজ হঠাৎ? কোনো দরকারি কাজ ছিলো?

হঠাৎ ইন্দুর গলা পেয়ে তার হাত নিজের হাতে নিয়ে একদমে কথাগুলো বললো প্রলয়। বিরক্ত ভঙ্গিতে প্রলয়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে বললো,

–প্রলয়, আমাকে ছাড়ো। বাড়ির সবার সামনে এ কেমন ব্যবহার, শান্ত হও। গত দশ বছর তোমাকে আমি সব বলেছি, জানিয়ে করেছি কারন তুমি আমার সব কাজের সময় এবং বাকি সব সামলেছো। কাজ ছাড়া গত দশ বছরে আমি কিছুই করিনি, তাই সবটা তোমাকে জানিয়ে করেছি। কিন্তু আমারোতো একটা জীবন আছে বলো! হুম, আমি আমার জীবন নিয়ে গত দশ বছরে ভাবি নি। শুধু নাম কামিয়েছি, কিন্তু আমারও তো একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে তাই না? তাই তুমি সবটায় নিজেকে জড়িয়ো না, আজকে আমি নিজের কাজে গেছিলাম। তাই তোমায় জানাই নি, আর আমার মনে হয় না আমি কোনো ভুল করেছি। কি, করেছি কোনো ভুল?

ইন্দুর ঔদ্ধত্য দেখে ইরফান ধমকে বললো,

–ইন্দু তুই প্রলয়ের সঙ্গে এভাবে কেনো কথা বলছিস বলতো?ও তো তোর ভালো চায়!
–জানি, কিন্তু ভাই আমিতো কচি খুকি নই!আমার ভালো আমি বুঝি, প্রলয় চাইলেও আমার ভালো হবে না চাইলেও আমার ভালো হবে। সুতরাং ওকে আমার কাছে মহৎ প্রমান করার চেষ্টা করিস না প্লিজ!
আচ্ছা থাক সেসব কথা, আসল কথায় আসা যাক। তোমরা বলোতো, তোমরা এই দশ বছরে নিজেদের এ কি অবস্থা করেছো! এটা বাড়ি না মরুভূমি? বাড়িতে একটা বাচ্চা আসছে, কোথায় হই হুল্লোড় করবে তা না। সারাদিন কাজ আর কাজ। যেনো সারা পৃথিবীর কাজের দায়িত্ব তোমাদের কাধে, অদ্ভুত!

ইরফান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

–কি করেছি আমরা?
–ভাই তোর প্রানপ্রিয় ফুটবলের কি হলো?গত দশ বছরে একবারো বল চোখে দেখেছিস? প্রাকটিসে গিয়েছিস? সারাদিন কাজে ডুবে থাকিস, তানিকে সময় অবধি দিস না!
–না মানে তানিয়ার বাসায় বিয়ের চাপ দিচ্ছিলো তাই বাবার অফিসে জয়েন্ট…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here