আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ৩

0
725

আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ৩
খাদিজা আরুশি আরু

–বিয়ের তো সবে পাঁচ বছর হয়েছে ভাই, কিন্তু তুই তো আমি যাবার পরই নিজেকে বদলে ফেলেছিস। সুতরাং দুটো ঘটনাকে গুলিয়ে ফেলিস না, আর আমাকে মিথ্যে বলার সাহস একদম দেখাবি না। তুই জানিস আমি রাগলে কি করতে পারি… আর কালকে কি বললি? গান শোনাবি আমাকে? হাহ, আমি যাবার পর একদিনের জন্য রেয়াজ করেছিস? তোর গান শুনলে আমার কানের পর্দা ফেটে যেতো যদি? কি হলো, কিছু বল…
–না মানে, কাজের চাপে সময় হয়ে ওঠে নি।
–আবার মিথ্যে! চাইলেই পারা যায় ভাই, তুই অফিসে সকাল ন’টায় যাসতো। ভোরে উঠে তুই চাইলেই রেয়াজ করতে পারিস। কিন্তু না, তুই তো সংসারি হয়েছিস। সুতরাং সখ আহ্লাদ থাকতে আছে নাকি তোর!
–ইন্দু আসলে ও খুব ক্লান্ত থাকে, তাই সকাল সকাল উঠতে পারে না।
-এসে গেছেন, রোমিওর জুলিয়েট! ওর কথা বাদই দিলাম, ও না হয় অফিস করে। তাই না হয় সব সখ বাদ দিলো, কিন্তু তুই? তোর তো ছোটো বেলা থেকেই নাচের স্কুল খোলার স্বপ্ন ছিলো, তার কি হলো? গ্রাজুয়েশনের পর বাড়ি বসে আছিস কেনো?
–আমি এই অবস্থায় কি করে!
–বাহানা দিবি না, বাচ্চা তো তোর এখন হবে… তো তার আগে যে এতো বছর গেলো তখন চেষ্টা করিস নি কেনো?
নাকি বিয়ে করেছিস বলে তোর শ্বাশুড়ি তোর পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে? তোকে ঘর বন্ধি করেছে? কিরে বল? এমন কিছু হলে আমি আইনী ব্যবস্থা নেবো!
–কি বলছিস তুই, মা! মা কেনো এমন করবে… মা কিছু করে নি। আসলে সবটা গুছিয়ে উঠতে বছর পার হয়ে গেলো।
–এই নে… এখানে একটা জমির দলিল আছে। তোর বাচ্চাটা হয়ে যাক তার পর এ জমিতে একটা নাচের স্কুল খুলবি। বাড়িতে তোর বাচ্চার খেযাল রাখার অনেক মানুষ আছে, সুতরাং নিজে কিছু করার চেষ্টা কর। তোর বাচ্চা বড় হলে কি বলবে? ওর মা এতো এতো পড়াশোনা করে ঘরে বসে ছিলো! আর হ্যাঁ বাচ্চা হবার পর তুই রোজ সকালে উঠে নাচবি।আর তোর বরকে কাল থেকে সকাল সকাল তুলে দিবি, আমার সঙ্গে গানের রেয়াজ করার জন্য। কারন তোর ওনার আবার আমাকে ছাড়া রেয়াজ করতে ভালো লগে না।
–ইন্দু মা, এসব পরে হবে। চল, আগে খেয়ে নিবি। সকাল সকাল বেরিয়েছিস, খাওয়া হয় নি তো।
–ও তুমি! বাবা বাড়িতে আগের মতো রোজ সকালে পত্রিকা আসে না কেনো? তুমি তো পত্রিকা পড়তে ভালোবাসতে… তাহলে, কেনো এতো পরিবর্তন?
–আমি তো অফিসে থাকি সারাদিন ইন্দু মা, সুতরাং পত্রিকা পড়বে কে! তাই আর কি…
–কেনো? আমার জানামতে এটা তো এ পরিবারের নিয়ম নয়। তাছাড়া সন্ধ্যার পরতো এ বাড়ির কেউ কোনোদিনই বাড়ির বাইরে থাকতো না, পরিবারকে সময় দিতো। তাহলে তোমরা রাত করে বাড়ি ফেরো কেনো? রামু কাকা…

রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে এসে বসার ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে রামু আহ্লাদি স্বরে বললো,

–জ্বী মা জননী… কিছু লাগবে তোমার?
–কাল থেকে যেনো প্রতিদিন এ বাড়িতে পত্রিকা আসে। আর হ্যাঁ, সন্ধ্যা ছ’টার আগে যেনো সবাই বাড়িতে ফিরে আসে। টাকাই সব না, পরিবারকে সময় দেয়াও জরুরি। সবাইকে জানিয়ে দেবে, প্রয়োজনে নোটিশ ছাপিয়ে সবার ঘরের দরজায় স্কচটেপ দিয়ে এঁটে দেবে।
— আমরা সামনেই আছি, জানানোর কি আছে। শুনেছি তো, এসেই শুরু হয়ে গেছে তোর হুমকি ধমকি!

মনিরা চৌধুরির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইন্দু। এ মানুষটা সে নিজে থেকে কথা না বলা পর্যন্ত তাকে খুঁচিয়েই যাবে। তাই নিজের রাগ সংবরণ করে শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

–তুমি রান্নার ক্লাসে যাওনা কেনো মা?
–যার জন্য রান্না শিখতাম সে যখন নেই তখন শিখে কি করবো? তাই বাড়িতেই থাকি, আর মন চায়না যেতে।

শাড়ীর আচলে মুখ গুঁজে কথাটা বললেন মনিরা চৌধুরি। সেদিন উনিই তির্থকে বলেছিলেন ইন্দুর সাফল্যের পথে বাধা না হতে, কারন তিনি জানতেন তির্থকে সঙ্গে না নিয়ে ইন্দু গাইতে চাইবে না। তাই তির্থকেই ইন্দু বিরুদ্ধে করে দেন তিনি, যদিও এ ক’বছরে বেশ অনুতপ্ত হয়েছেন! তার কান্না দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো ইন্দু, প্রসঙ্গ পাল্টাতে হাত তালি দিয়ে বললো,

–বাহ, বাবাহ… বাড়ি ছেড়ে গেলো কে? আমি! এতো বছর সব ছেড়ে ছিলো কে? আমি! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার জীবনে তো কিছুই বদলায় নি, কারন এখানে তো আমি যাবার পর সব দেবদাস হয়ে বসে আছে। আমি এতো বছর পর ফিরেছিলাম আমার পরিবারের জন্য কিন্তু এসে পেয়েছি কয়েক পিস রোবট, জীবন্ত রোবট!
–ভাই তুই ওকে এতোসব বলেছিস?

প্রলয়ের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে তানিয়া কথাটা বলতেই ইন্দু বললো,

–এক মিনিট, এক মিনিট! তোমরা প্রলয়কে এভাবে দেখছো কেনো? কি মনে হচ্ছে,তোমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ তোমাদের এতো বছরের বদলের খবর আমাকে জানিয়েছে? দেন আই এম রিয়েলি ভেরি সরি! কারন প্রলয় আমাকে কখনো কিছুই বলেনি। আর প্রলয়, তোমার সঙ্গেও আমার কিছু কথা আছে। চাইলে সবার সামনেই বলতে পারি তবে আমার মনে হয় তাতে তোমার অস্বস্তি হবে। আর তুমি যানো আমি যথেষ্ট ভালো, সুতরাং যা বলার আমার ঘরেই বলবো।
পাক্কা দশ মিনিট পর আমার রুমে আসবে, মনে রেখো দশ মিনিট মানে কিন্তু দশ মিনিটই।

প্রলয় মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, ইন্দুর ওর সঙ্গে জরুরি কথা আছে এটা যে ভাবনার বাইরে। মনের মধ্যে কোথাও একটা আশা জেগে উঠেছে প্রলয়ের, তবে কি ইন্দুবতী ওর কাছে ধরা দিতে চাচ্ছে!

–যা বাবাহ… এটা মেয়ে না চলতি ট্রেন!এলো, বললো, চলে গেলো। কাউকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না। কিরে ভাই, কি বলবে বলে মনে হয় তোকে? তাও আলাদা করে! কিছু বুঝতে পেরেছিস? কিগো তুমি বুঝেছো?

প্রলয়কে ইন্দু্র ঘরের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গড়গড় করে কথাগুলো বলে দিলো তানিয়া, তার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির ছটা। ইরফান ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

–না তানিয়া।
–আমি কিন্তু ঠিক বুঝেছি।
–কি বুঝেছো তানিয়া?
–কি বুঝেছিস বল না বোন…

প্রলয়ের উৎকন্ঠা দেখে তানিয়া ফিক করে হেসে দিলো, হাসতে হাসতেই বললো,

–বলেছিলাম না, ইন্দু ভাইকে ঠিক বুঝবে… তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লজ্জা না পেয়ে ভেতরে যা তো ভাই।আমার ননদিনী কি বলে গেলো শুনিস নি? দশ মিনিট মানে কিন্তু দশ মিনিটই!
–তুই যা ভাবছিস তা নাও হতে পারে তানিয়া।

ইরফান মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে বললো,

–ঠিক তাই… বোন যে মেয়ে, কখন মাথায় কি ঘুরে কে জানে। সবটা না শুনে শান্তি হচ্ছে না আমার, বরং চিন্তা হচ্ছে। তুই যা তো প্রলয়।
–তোমরা যা’ই বলোনা কেনো আমি বুঝে গেছি ইন্দু কি বলবে! তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ভাই, যা না… যা ভাই, জলদি যা…
–হ্যাঁ যাচ্ছি তো, চিৎকার করিস না।
–দশ মিনিট পেরিয়ে বারো মিনিট হলো প্রলয়, এখনো দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কিসের অপেক্ষা করছো?

ইন্দুর কথাটা তানিয়া শুনে মিটিমিটি হাসছে, হাসতে হাসতেই প্রলয়কে উদ্দেশ্য করে চোখ মারলো। প্রলয় ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকে বললো,

–তুমি একটা মেয়ে ইন্দু, হুট করে তোমার ঘরে ডুকে যাওয়াটা কি ঠিক হতো?
–তোমার ফোনে কোনো ম্যাসেজ এসেছে?
–প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছো কেনো ইন্দু?
–প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছি না, বরং প্রসঙ্গে আসছি।
–আসলে তোমাকে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম, তাই খেয়াল করি নি।
–তাহলে এখন খেয়াল করো, দেখো জলদি।
–তুমি আমার একাউন্টে এতো টাকা কেনো পাঠিয়েছো ইন্দুবতী?

কোনোপ্রকার ভূমিকা ছাড়াই ইন্দু বললো,

–যদিও কাজটা আমার আরো আগে করা উচিত ছিলো, তবুও আগে যখন করি নি তখন না হয় পরেই করলাম।
–কিন্তু… কেনো?
–দেখ প্রলয়, তুমি গত দশটা বছর আমার সঙ্গে এজ এন এসিসট্যান্ট আছো। ওয়ান কাইন্ড অব বডিগার্ড অলসো। অথচ দেখো, কোনো পারিশ্রমিকই নাও নি।
তুমি যে প্রকাশনীতে চাকরি করছো, সেখানে তো তোমাকে বেতন দেয় তাই না?
–হ্যাঁ, কিন্তু তুমি…
–কথা বাড়িয়ো না প্রলয় প্লিজ, তুমি জানো বেশি কথা বলা আমার একদম পছন্দ নয়।

ইন্দুর ব্যবহার কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না প্রলয়, আজ তার ভেতরেও এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তবে সে ঝড়ের কোনো আভাস বাইরে থেকে বুঝা যাচ্ছে না! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রলয় জিজ্ঞেস করলো,

–এই কথাটাই বলার ছিলো ইন্দু? তাহলে এবার আমি আসি?
–আমার কথা শেষ হলে আমি নিজেই বলবো। দাঁড়িয়ে কেনো? বসো। এই কাগজটা নাও, পড়ে পছন্দ হলে সই করে দেবে।
–কিসের কাগজ এটা?
–চুক্তিপত্র! তোমার আর আমার, তুমি আমার অধীনে চাকরি করছো তার প্রমান। ভালো করে পড়ে সই করে দিও…
–পড়তে হবে না, আমার ক্ষতি হবে এমন কোনো চুক্তিপত্র তুমি বানাবে না সে ভরসা আমার তোমার উপর আছে। আমি এখনই সই করে দিচ্ছি…
–ধন্যবাদ। প্রলয় আরেকটা কথা, তুমি তো ভালো লেখো। প্রথম থেকেই বই বের করার সখ ছিলো তোমার! সেই সূত্রে প্রকাশনীতে চাকরিও নিয়েছো, তো তোমার স্বপ্ন পূরণ করছো না কেনো?
–নিজের স্বপ্ন পূরন না করতে পারলেও হাজার হাজার নব লেখকের স্বপ্ন পূরন করার সুযোগ পেয়েছি আমি, এটাইবা কম কিসের?
–তবুও চেষ্টা করতে পারো।
আপাতোতো ঢাকায় থাকবো বুঝলে!সামনে বইমেলা, এবার যাবো ভেবেছি।তুমি যাবে সঙ্গে?
–তুমি চাইলে নিঃশ্চই যাবো। তাছাড়া এমনি এমনি তো বেতন দেবে না তাই না?
কোনো কাজ থাকলে ফোন দিবেন ইন্দু ম্যাডাম, আসছি।

প্রলয়ের কাছ থেকে ম্যাডাম ডাকটা একেবারেই আশা করে নি ইন্দু, কিছুটা অবাক হয়েই বললো,

–ম্যাডাম! তুমি আমাকে ম্যাডাম বলছো প্রলয়? আমরা তো বন্ধুর মতো!
–চাকরি করি বলে বেতন নিলাম, চুক্তিপত্র সই করলাম আর ম্যাডাম বলতে পারবো না? অদ্ভুত…
–উপহাস করছো?
–তোমাকে উপহাস করার আমি কে?তোমার স্তরে পৌঁছাতে আমার হাজার বছর সাধনা করতে হবে!
–হাহ, বাড়ির সবার মতো তুমিও আবেগী কথা বার্তা বলছো…
–না, বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার সামান্য চেষ্টা করছি।

কথাটা বলেভ কোনোদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো প্রলয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিলো তানিয়া, ও ভাবতে পারছে না ইন্দু প্রলয়ের সঙ্গে এমনটা কেনো করলো। আজ এর জবাব সে ইন্দুর কাছে চাইবেই, তাই কিছু না বলেই ইন্দুর ঘরে ডুকে পড়ে তানিয়া। হঠাৎ তানিয়াকে দেখে কিছুটা অবাক হলো ইন্দু, জিজ্ঞেস করলো,

–তানি তুই, কিছু বলবি? এভাবে পদ্ম গোখরার মতো তাকিয়ে আছিস কেনো?কিছু বলার থাকলে বল নতুবা বাদ দে!
–ইন্দু, তুই প্রলয় ভাইয়ের সঙ্গে এমনটা কেনো করলি? তোর কি ওর প্রতি একটুও মায়া হয় নি? ছেলেটা তোকে এতো ভালোবাসে, তোর এতো খেয়াল রাখে আর তুই! নিজের মতো করে ওকে কষ্ট দিচ্ছিস, তুই ওকে টাকার গরম দেখাচ্ছিস!
–না মায়া হয় নি, কারন তুই সত্যটা জানিস না। আর হ্যাঁ, এটা আমার জীবন। আমার যা মন চাইবে আমি করবো, আর তাছাড়া মানুষ যতো পুড়বে ততো খাঁটি স্বর্নতে পরিণত হবে বুঝলি?
–ওকে কষ্ট দেয়ার অধিকার তোকে কে দিলো? আর কি সব বলছিস খাঁটি স্বর্ন ও আসল হিরা…

ইন্দু বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে বললো,

–কেউ অধিকার দেয় নি, আমি নিজে করে নিয়েছি। তুই এখন যা তানি, আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।
–না যাবো না, তুই নিজের আর ওর সঙ্গে এটা করতে পারিস না… বোঝার চেষ্টা কর ইন্দু।
–কি বুঝবো? কেনো বুঝবো? কিছু বুঝতে চাই না আমি, যেতে বললাম তো তোকে।

ইন্দু আর তানিয়ার চেঁচামেচি শুনে নিচ থেকে উপরে উঠে এসেছিলেন মনিরা চৌধুরি। ইন্দুকে তানিয়ার উপর চেঁচাতে দেখে অনেকটা রেগে বললেন,

–ইন্দু, তুই বউমার উপর চেচাচ্চিস কেনো।দেখতে পাচ্ছিস না মেয়েটা অসুস্থ?
–তোমার বউমাকে ভালোভাবে বললাম গেলো না, তাহলে চেঁচাবো না তো কি ধান দুর্বা দিয়ে আরতি করবো?
–বউ মা, চলে এসো। ওর সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই, দিন দিন অসভ্য হচ্ছে!
–কিন্তু মা ইন্দু…
–কোনো কিন্তু নেই, চলোতো তুমি।

১০

প্রলয়ের চেহারা দেখে আমেনা বেগমের বুঝতে বাকি রইলো না যে ছেলের কিছু একটা হয়েছে, অবশ্য সব মা’ই সন্তানের মুখ দেখে তার মনের কষ্টের আভাস পেয়ে যায়। ছাদের এক কোনে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা প্রলয়ের মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন,

–প্রলয়! তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো বাবা? সব ঠিক আছেতো? ইন্দু, ওর কিছু হয়েছে?

মায়ের দিকে তাকালে পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে যায় প্রলয়। নিজেকে সামলে বলে,

–কিছু না মা। জানোতো, আজকে ইন্দু আমাকে আমার জায়গাটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে! ও আমাকে ভালোবাসা তো দূরের কথা বন্ধুও ভাবে না, অবশ্য ওর থেকে ভালোবাসা আমি কখনো আশাও করিনি। তবে বন্ধুত্বটুকুতো চাইতেই পারি বলো, ও আমায় সেটার যোগ্যও মনে করলো না!
–আমিতো তোকে সবসময়ই বলেছি বাবা, ইন্দু তোকে ভালোবাসতে পারে না। ওর জায়গা অনেক উপরে, ও তোর জন্য যা করে দয়া করেই করে। তাছাড়া আমাদের মতো মানুষকে দয়া ছাড়া আর কি’ইবা করবে বল!
–হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছো মা, একদম ঠিক বলেছো। আমি আর আবেগী হবো না, শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববো।

মাকে জড়িয়ে ধরে প্রলয়, যতোই মুখে বলুক আবেগী হবে না ততোই অবাধ্য মন আবেগ আপ্লুত হয়ে যায়। আমেনা বেগম প্রলয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,

–তুই দেখিস বাবা, আমি তোর জন্য ইন্দুর থেকেও ভালো মেয়ে খুঁজে আনবো।
–সেসব কথা থাক না মা, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। তুমি আর আমাকে খাবার জন্য ডেকো না, নিজে খেয়ে ঘুমিয়ে যেও।
–প্রলয়, শুনে যা বাবা…

১১

তানিয়া সেই কখন থেকে পায়চারী করছে, প্রলয়ের প্রতি ইন্দুর এই ব্যবহার মানতে চেয়েও মানতে পারছে না সে। কি করেই বা পারবে, মেয়েটা যে প্রলয়কে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে।

–ইন্দু এটা ঠিক করে নি, ভাই ওকে খুব ভালোবাসে। এই কাজটা খুব বাজে হয়েছে, তুমি ইন্দুকে বোঝাও ইরফান।

অধৈর্য্য তানিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার দু’বাহু ধরে ইরফান বলে,

–তানিয়া, তুমি শান্ত হয়ে বসো তো। এতো ছটফট করো না।
–ইন্দু এটা কেনো করলো বলো তো? ও ভাইকে ভালোবাসে না মানলাম, তাই বলে এভাবে অপমান করবে বলো!
–ইন্দু যা করেছে তার পেছনে নিঃশ্চই কোনো কারন আছে, আমার বোনকে আমি চিনি। কারন ছাড়া ও কিছু করে না, ও সোজা কাজ কখনো করবে না। ও নিঃশ্চই ভেতর ভেতর কিছু একটা ছক কষছে।
–তবুও!
–সব কিছুকে তার আপন গতিতে চলতে দাও তানিয়া, সত্যিই তো এটা ইন্দুর জীবন। আমরা জোর করবার কে! গতবার মা জোর করে কি হলো দেখো নি?
–তুমি হয়তো ঠিক বলেছো, আমি বেশিই ভাবছি।
–হুম এবার ঘুমাও, মনে আছে তো ইন্দু কি বলেছিলো?
–হ্যাঁ, তোমাকে সকাল সকাল তুলে দিতে। ওর সঙ্গে রেয়াজ করার জন্য, পারেও মেয়েটা।

১২

বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে ইন্দু, এই জিনিসটা ওর খুব প্রিয়। রায়হান চৌধুরির ডাকে ঘোর কাটে তার।

–ইন্দু মা…
–বাবা তুমি! কি হয়েছে? কিছু বলবে?
–কতো বড় হয়ে গেছিস তুই, তুই সকালে বললি না যে বাবা তুমি পত্রিকা পড়ো না কেনো? তখন সবার সামনে বলতে পারিনি কারনটা, তবে এখন বলতে বাধা নেই।
তুই যাবার পর আমি পত্রিকা পড়া ছেড়েছি কারন সকাল সকাল চায়ের কাপ আর পত্রিকা হাতে আদুরে গলায় “শুভ সকাল বাবা” বলার জন্য তুই ছিলি না। তোকে মনে করে চোখের জল ফেলিনি এমন দিন নেই, তোকে ভুলে থাকতে নিজের অভ্যাস বদলেছি… নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি, কিন্তু বাবার মনতো! তোকে ভুলতে পারিনি, প্রতিটা মুহুর্তে তুই আমার মনে ছিলি।

গলাটা ধরে আসছে রায়হান সাহেবের।চোখ দিয়ে টপ টপ করে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো তার। ইন্দু বাবার চোখের জল মুছে দিয়ে আদুরে গলায় বললো,

–বাবা,তুমি এভাবে চোখের জল ফেললে আমিও কিন্তু এবার কাঁদবো।
–আচ্ছা এই দেখ চোখে কোনো জল নেই, তবে তুই আজ প্রলয়ের সঙ্গে এমন করলি কেনো?
–বাবা, অন্য কেউ না জানুক তুমি তো জানো তির্থ আমাকে ছেড়েছে মা আর প্রলয়ের জন্য। আর তাছাড়া তুমিও সবার মতো আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো বাবা? তুমি জানো না, তোমার মেয়ে যা করে সবার ভালোর জন্য করে। প্রলয়কে নিজের জীবনে মেনে নেয়া আমার পক্ষে সহজ নয় বাবা, তবুও গত দশ বছরে ও আমার পাশাপাশিই ছিলো। আমি কিছু বলনি, তির্থের ঘটনাটার কারন ও হলেও ব্যপারটা ওর অজান্তেই হয়েছে। তাছাড়া সেদিন ঐ ঘটনাটা না ঘটলে হয়তো আজ আমি এই সফলতা পেতাম না। প্রলয় একটা মিথ্যে আশায় বেঁচে ছিলো, ও আমার জন্য বাঁচছিল। কিন্তু আমি চাই ও নিজের জন্য বাঁচুক, তাই আমি এমনটা করেছি। আমি কি ভুল করেছি বাবা?
–আমার ইন্দু মা ভুল করতেই পারে না!ঘুমোবি না?
–এইতো যাচ্ছিলাম, তুমিও যাও। রাত জেগো না, শুভরাত্রি বাবা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here