আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ৬

0
664

আমার গল্পে তুমি,পর্বঃ৬
খাদিজা আরুশি আরু

–নামা বলছি তির্থ, নামা…

ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তির্থ বললো,

–তুই আর বদলালি না রে, কানের পর্দা ফেটে গেলো। উফ…
–কে বললো বদলাইনি? তখনকার ইন্দু আর এখনকার ইন্দুর মাঝে আকাশ পাতাল তফাত।
–তা হয়তো ঠিক, কিন্তু মনটা বদলায়নি যে!

তির্থর দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে ইন্দু জিজ্ঞেস করলো,

–কেনো দেখা করিসনি এতোদিন তির্থ? জানিস, আমি তোকে প্রতিমুহূর্তে মনে করেছি, তোকে মনে করে আমার প্রতিনিয়ত মন খারাপ হয়েছে। সে সময় বয়স কম ছিলো, ভুল বুঝেছিলি… কিন্তু পরবর্তীতে কি তোর কখনো মনে হয় নি যে তুই ভুল ছিলি?
–কোন মুখে দেখা করতাম বলতো? নিজের ভুল বুঝলেও সবসময় সামনে এসে দাঁড়াবার সাহস হয় না।
–গালমন্দ করার সময় খবর ছিলো না? যখন এতো কথা বলতে পারলি একটা সরি বলে সব ঠিক করতে পারলি না কেনো?

তির্থ আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, ইন্দুকে ভুল বোঝার জন্য সে অনুতপ্ত তবে কোনোভাবেই ইন্দুর মুখোমুখি হবার সাহস পাচ্ছিলো না। মাঝে মাঝে সামান্য দুঃখিত বলে যে সমস্যার সমাধান করা যায় তা আমাদের ভয়ের কারনে সমাধান করা হয় না…

–ক্ষমা করে দে আমাকে ইন্দু…
–তা তো অনেক আগেই করে দিয়েছি, আমিতো জানি আমার তির্থ খুব খিটখটে মেজাজের… কিন্তু ওর মনটা ভালো।
–বাসার সবাই কেমন আছে রে?
–এইরে! আমাকে বাসায় ফিরতে হবে, না বলে বের হয়েছিলাম। একটু পৌঁছে দিবি?
মুচকি হাসে তির্থ, তার বন্ধুটা আজও আগের মতোই আছে… একদম মনভুলা!

–গাড়িতে ওঠ।

২০

–ওইতো প্রলয় এসে গেছে… কিরে, ইন্দু কই?
–ইন্দুবতী! ওতো বাড়িতে ছিলো।

প্রলয়ের কথা শুনে তানিয়া চিন্তিত হয়ে বললো,

–কি বলছিস ভাই, ইন্দু তোর সঙ্গে যায়নি?
–না তো!
–তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম খোঁজ নিতে, কিন্তু তুমি শোনো নি। মা জানলে বাড়ি মাথায় তুলবে বুঝতে পারছো সেটা?

ইরফানের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ, তার উপর তানিয়ার কথা শুনে মিনমিন করে বললো,

–এখন অবশ্য আমারও চিন্তা হচ্ছে।
–ওই শোনো গাড়ির আওয়াজ, নিঃশ্চই বাবা এসেছে। কি বলবো এখন বাবাকে, বসে আছো কেনো যাও বাবার কাছে।

তানিয়া ইরফানকে তাড়া দিলো কিন্তু ইরফানকে নড়তে দেখা গেলো না। প্রলয় ইতস্তত করে বললো,

–ইফু-তানিয়া তোরা থাক। আমি মামাকে বুঝিয়ে বলছি, আর খোঁজ দেখছি ইন্দু কোথায় গেলো…
–তাই যা ভাই।

কালো রঙের গাড়ীটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে, গাড়ী থেকে নামার সময় ইন্দু মুচকি হেসে বললো,

–আসছিরে তির্থ।

তির্থ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,

–ভেতরে যেতে বলবিনা ইন্দু?
–নারে তির্থ, সবাই তোকে আর আগের মতো ভালোবাসেনা। গেলে শুধু শুধু কথা শুনতে হবে তোকে, আগে সবটা স্বাভাবিক হোক তারপর না হয় তোকে ডাকবো…
–তানিও আমাকে অপছন্দ করে?

তির্থর গলার স্বরে বিস্ময় স্পষ্ট। তার জানামতে মনিরা তাকে বিশেষ পছন্দ করে না তবে বাড়ির অন্যরা তাকে ভালোবাসে, অবশ্য ভালোবাসতো বললেও ভুল হবে না। তির্থর বিস্ময় বুঝতে পেরে ইন্দু বললো,

–হুম… কি বলতো, ও তো আমাকে তোর থেকে বেশি ভালোবাসে তাই তোর ব্যবহারে ও বেশি কষ্ট পেয়েছিলো।
–হুম, অবশ্য দোষ তো আমারই ছিলো।
–থাক না সেসব কথা তির্থ, জানিস ক’মাস পর তানির কোলজুড়ে একটা পুচকু আসবে। আমাকে পিন্নি বলে ডাকবে সে…
–সত্যি, কতোটা সময় চলে গেলো জীবন থেকে তাই না?
–হ্যাঁ রে, থাক না সেসব কথা।
–আসছি তবে, শুভরাত্রি।

ইন্দুর পাল্টা শুভরাত্রি বলার অপেক্ষা করলো না তির্থ, গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের গন্তব্যে রওনা হলো। যতোক্ষন দেখা যাচ্ছিলো নিঃষ্পলক তাকিয়ে রইলো ইন্দুবতী। আজ তার খুশির দিন, তার জীবনটা আবার আগের মতো সহজ সরল হতে যাচ্ছে।

এতোক্ষন দুর থেকে সবটা দেখছিলো প্রলয়। ইন্দুবতী ওর কোনোদিনও ছিলোনা। তা ও জানে,তবুও মন বলছে ইন্দুবতীর কাছে অধিকার চেয়ে নিতে!নিজের সঙ্গে ওর সত্বাটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে, তবে প্রলয় জানে তা সে কোনোদিনও পারবে না। ইন্দুর বাবার প্রতি ওর যে কৃতজ্ঞতা কাজ করে তার জন্য ও বাঁধা, তবে মনতো বাঁধ মানে না। তাই বারংবার অবাধ্য মন ইন্দুকেকে পেতে চায়। এ মুহুর্তে এখানে থাকলে ও নিজেকে সামলাতে পারবে না, বাড়ি ফিরতে হবে।মায়ের আচলে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে না পাওয়ার কষ্টগুলো বুকেই দাফন করতে হবে!

বাড়ির বাইরে পা বাড়াতেই ইন্দুর মুখোমুখি হয় প্রলয়। প্রলয়কে দেখে ইন্দুই আগ বাড়িয়ে বলে,

–প্রলয় তুমি! বাইরে কেনো? ভেতরে চলো।
–না ইন্দুবতী, আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।আসলে কিছু কাজ আছে…
–আরে প্রলয়… ধুর, কথাও শুনলো না। কি এমন তাড়া আছে মহাশয়ের কে জানে!

বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই তানিয়ার প্রশ্নের তোপে পড়তে হলো ইন্দুকে, তানিয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

–তুই এসেছিস, কোথায় গিয়েছিলি? আর একা কেনো, ভাই কোথায়?
–ও এখনই বেরিয়ে গেলো, বললো কিসব কাজ আছে নাকি। আচ্ছা শোন, আমি কোথায় গেছি তা নিয়ে কথা না বাড়িয়ে রামু কাকাকে বল সবাইকে নাস্তা দিতে… ততোক্ষনে আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি।

তানিয়া আর কথা বাড়ায় না, শান্তস্বরে বলে,

–আচ্ছা যা।
–যাক বাবা বাঁচা গেলো, ইন্দুটা সময়মতো না ফিরলে আজকে মা বাড়ি মাথায় তুলতো বলো।

ইরফানের কথার প্রতিত্তরে তানিয়া বলে,

–যা বলেছো, চলো রামু কাকাকে বলি নাস্তা দিতে।
–তুমি এখানেই বসো তো, আমি বলছি। আর মাকেও ডেকে আনছি…
–আচ্ছা যাও।

ইরফান তানিয়ার দু’বাহু ধরে সোফায় বসিয়ে তার চিবুকে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে,

–তুমি এখন কাজ করা কমাও বুঝলে, নিজের খেয়ালও করো।
–আমার খেয়াল আমি রাখি, এখন যে কাজটা করবে বললে তা করো জলদি নতুবা আমিই করছি।
–ও হ্যাঁ, তোমার কিছু করতে হবে না আমিই যাই।

২১

–বউমা, তুমি একা এখানে বসে যে! বাড়ির বাকিরা কোথায়?

রায়হান সাহেব মাত্রই ঘরে ঠুকেছেন, তার প্রশ্নে মুচকি হাসে তানিয়া। মানুষটাকে তাকে কেনো এতো স্নেহ করে তার কারন জানা নেই তার তবে লোকটাকে সে নিজেও অনেক ভালোবাসে। তানিয়া মুচকি হেসেই বলে,

–বাবা আপনি এসেছেন, মা আর ইন্দু তাদের রুমে। ইরফান ওদেরকেই ডাকতে গেছে। আপনিও কাপড় বদলে নিচে আসুন, সবাই গল্প করতে করতে চা-নাস্তা খাওয়া যাবে।
–তাহলে বরং তাই করছি, তুমি থাকো তাহলে।
–আচ্ছা।

আমেনা বেগম দরজা খুলে প্রলয়কে এ সময় ঘরে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–প্রলয় বাবা, তুই এতো জলদি ফিরে এলি যে!
–কিছু না মা, এমনি…
–এমনি বললে তো চলবে না, তুই আমার দিকে তাকা দেখি…
–মা…

পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় প্রলয়, মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া কি আর অতো সহজ! আমেনা বেগম এগিয়ে এসে প্রলয়ের গালে হাত রেখে বলে,

–কি হয়েছে বলনা বাবা… মায়ের কাছেও লুকাবি?

প্রলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

–তির্থ ফিরে এসেছে মা, তির্থ ফিরে এসেছে… এবার ইন্দুবতীর জীবনে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে…
–প্রলয়!
–হ্যাঁ মা, তির্থ ফিরেছে। জানো মা ইন্দুবতীকে আমি এতোটা খুশি এতো বছরে কোনোদিনও দেখিনি, অথচ আজ ওকে তৃপ্তির হাসি হাসতে দেখেছি। আমি সবসময়উ জানি ইন্দুবতী আমার নয়, তবুও কেনো যেনো আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। বিশ্বাস করো মা, আমি ওর ভালো চাই কিন্তু ওর সুখ যে আমাকে এতোটা আঘাত দিতে পারে তা সত্যিই আমার জানা ছিলো না!

আমেনার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে গেলো, তার ছেলেটার জীবনটায় এতো কষ্ট কেনো কারনটা আজও তার অজানা। সৃষ্টিকর্তাকে সামনে পেলে সে জিজ্ঞেস করতো তার ছেলেটাকেই কেনো এতো কষ্ট পেতে হবে? নিজেকে সামলে প্রলয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

–এটাই নিয়তি বাবা, আমাদের কপালে সুখ নেইরে।
–আমি একা থাকতে চাই মা, আমাকে তুমি রাতে আর ডেকো না।
–প্রলয়…

ইন্দুর বাড়িতে দীর্ঘ দশ বছর পর সবাই বসার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে, যেনো পুরোনো স্মৃতি তাজা করতে সবাই ব্যস্ত।

–ইরফান!
–কি হলো তানিয়া?
–আমার কি মনে হয় যানো, ইন্দু ভেতর ভেতর কিছু একটা করছে। কারন ওকে আমার কেমন অচেনা লাগছে জানো, আর দেখো কতো খুশি খুশি আজকে!
–আরে দুর, ও কি আগের ইন্দু নাকি!নও এখন ওসব দুষ্ট বুদ্ধি নিয়ে ঘুরে না আর।
–তবুও আমার ওকে কেমন যেনো গোলমেলে লাগছে!
–কিরে তোদের প্রেম সবার সামনেও চালু, সবার সামনে অন্তত লজ্জা কর একটু।

ইন্দুর কথায় চোখ পাকিয়ে তাকায় তানিয়া, দাঁত কটমট করে বলে,

–ইন্দু!
–হিহিহি… মজা করছিলাম। জানোতো বাবা আজ রাস্তায় নিশিতার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। মেয়েটা অনেক সুন্দর হয়ে গেছে, তবে আগের মতো মোটু নেই। শুকিয়ে পুরো কাঠ হয়ে গেছে।
–সে কি, তুই কখন বেরিয়েছিলি মা?
–বাবা, দুপুরের পরে বেরিয়েছি। একটু হাঁটবো বলে, এখানে এসে একদম এক্সারসাইজ হচ্ছে না…

মনিরা গটগট করে বললেন,

–বউমাকে নিয়ে গেলেইতো হতো, এ অবস্থায় একটু হাঁটলে ভালো লাগতো। তা কোথায় গিয়েছিলি?
–রবীন্দ্র সরোবর।

রায়হান সাহেব মনিরাকে থামাতে বললেন,

–আহ, গিন্নী… এমন করো কেনো? ও তো এখন বড় হয়েছে।

“যাক বাঁচা গেলো, মা যদি তির্থের কথা জানতো তাহলে তো আবার মা কোনো একটা জামেলা করতো”। বিড়বিড় করে কথাটা বলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ইন্দু। ইন্দুকে একা একা বিড়বিড় করতে দেখে ইরফান বললো,

–ইন্দু… বিড়বিড় করছিস কেনো?
–ভাই, তুই একটা গান কর।

প্রসঙ্গ পাল্টাতেই যে ইন্দু কথাটা বলেছে তা বুঝতে বাকি রইলো না ইরফানের। তাই আস্তে করে বলে,

–না রে, আজ না।
–আচ্ছা।
–আমি ঘরে যাচ্ছি, আমার একটু কাজ আছে।
–ইন্দু, সবেতো সবাই বসলাম…

তানিয়া ইরফানকে থামানঁর জন্য বলে,

–থাক না ইরফান, যেতে দাও ওকে। তুই যা ইন্দু…
–হাহাহা… এতো বছর পরও মেয়ে আমার ডানপিটেই রয়ে গেছে, কখনো এক জায়গায় দু’মিনিট টিকতেই তার কষ্ট হয়!

রায়হান সাহেবের কথায় বসার ঘরের সবাইই হাসে, ইন্দুও উপরে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকায়।

২২

ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে তির্থ, এতো বছরের অপেক্ষা আজ শেষ হলো।তার ইন্দু তাকে ক্ষমা করেছে, এতো বছরের দুরুত্বও সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে নি। বরং এতো বছরের অপেক্ষা তাদের সম্পর্ককে গভীর থেকে গভীরতর বানিয়েছে, তির্থের পুরো জীবন জুড়ে কেবলই ইন্দুর স্মৃতি। তবে মিথ্যে অভিমানে শুধু শুধু মাঝের বছরগুলো নষ্ট হলো। হয়তো এটাই নিয়তি ছিলো…

মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কথা, স্কুলের প্রথম দিন ছিলো সেদিন… মাথার দুদিকে দুটো জুটি জুলানো ফর্সা মতোন একটা মেয়ে ক্লাসে ঢুকলো, এসে বসলো তার পাশে। হাসিহাসি মুখ করে বললো,

–আমি ইন্দুবতী… কিন্তু তুমি আমাকে ইন্দু বলতে পারো, তোমার পরিচয়?

স্কুলের প্রথম দিন, তাই শুরু থেকেই কিছুটা ইতস্তত করছিলো তির্থ। কিন্তু ঐ বয়সেও ইন্দুর এ সহজ আচরনে মুগ্ধ হয়েছিলো সে, তার সব ভয় নিমিশেই যেনো কোথায় গায়েব হয়ে গেলো। তারপর বন্ধুত্ব, স্কুল জীবনটা একত্রে কাটিয়েছে তারা। ইন্দু গান গাইতে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু তির্থ, সে তার পুরোই উল্টো। তবুও ইন্দুর ইচ্ছে রাখতে হারমনিয়াম বাজানো শিখেছিলো সে, ইন্দু সবসময় তির্থকে তার পাশে চাইতো তবে তির্থ বরাবরই বলতো,

–“আমি তোর গানের এপারে নয় ইন্দু, দর্শকের ভিড়ে তোর গানের ওপারেই থাকবো সর্বদা। দেখে নিস…”

তির্থ তার কথা রেখেছে, সে ইন্দুবতীর সাফল্যের পথের সঙ্গী হয়নি। বরং ইন্দুর গানের ওপারে থেকে তার সাফল্য কামনা করেছে। তবে ইদানিং তির্থের মন বড্ড অবাধ্য হয়ে গেছে, বারবার ইন্দুবতীর কাছে ছুটে যেতে চাইছে। কোনো বারন মানছে না, সেদিন তির্থ ইচ্ছে করেই ইন্দুকে যা তা বলেছিলো। কারন সে যে তার ইন্দুর পিছুটানের কারন হতে চায় নি, আজ ইন্দু সফল। তাই আজ ফিরতে কোনো বারন নেই, তাই তির্থের দেশে ফেরা। ইন্দুবতীর গানের ওপারে নয়, তার সান্নিধ্যে থাকতে চায় তির্থ।

ইন্দুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম বলে মনে করে না সে, কারন তেমনটা হলে আজ তার আগের জায়গাটা ফিরে পেতো না। ইন্দুর আগের নাম্বারটা এখনো আছে কিনা তা জানা নেই তির্থের। কারন এ ক’বছরে একবারো কল করে খবর নেয়া হয়ে ওঠে নি, তবে আজ হয়তো একবার চেষ্টা করা যেতে পারে। ফোনের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে তির্থ, সময় দেখতে গিয়ে দেখলো রাত তিনটে! অনেকটা দেরি হয়ে গেছে ভেবে আর ফোন দেয় না। আগে হলে এখনই ফোন দিতো, তবে এখনতো আর আগের মতো অধিকার ফলানো যায় না! ছোট্ট ইন্দুটা যে বড় হয়ে গেছে…

২৩

–তানি, ঘুমাস নি? এখানে একা কি করছিস? ভাই কোথায়?

পানি নিতে রান্নাঘরে আসার পথে তানিয়াকে বসার ঘরে লক্ষ্য করে ইন্দু। ইন্দুর প্রশ্ন শুনে তানিয়া শান্তস্বরে বলে,

–ও ঘুমাচ্ছে রে, তুই জেগে আছিস কেনো? সকালেতো আবার রেয়াজ করবি।
–না আজ আর করবো না, তোর সঙ্গে কথা ছিলো আমার একটু। শুনবি, সময় হবে এখন?
–তুই শুনালেই শুনবো, বল কি বলবি।
–আসলে আজ না…
–এতো সংকোচ করছিস কেনো? তাও আমার সঙ্গে! বলনা কি বলবি, কারও প্রেমে পড়েছিস?
–তানি! উফ, শোন আজ তির্থের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো…

চোখ বন্ধ করে কথাটা বলে দিলো ইন্দুবতী! তানিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য পিট পিট করে চোখ খুললো ইন্দু। তানিয়া চুপ করে আছে, কিছু বলছে না! তাই ইন্দুই মুখ খুললো…

–তানি, কিছুতো বল।
–কি বললো তির্থ?
–ক্ষমা চেয়েছে।
–তুই ক্ষমা করে দিয়েছিস?
–তা তো অনেক আগেই…
–তুই খুশিতো?
–হুম, অনেক! তির্থ ফেরাতে আমি আগের আমি কে ফিরে পেয়েছি।
–ভাইয়ের কি হবে ইন্দু?
–কেনো? প্রলয় যেমন আছে তেমন থাকবে। তাছাড়া আমার আর প্রলয়ের মাঝেতো কিছু নেই…
–সত্যিই কি কিছু নেই ইন্দু? ভাইয়ের চেয়ে তোকে ভালো কে বোঝে বলতো?
–তির্থ বোঝে, খুব ভালো করে বোঝে।
–তির্থ, তির্থ, তির্থ!

বিরক্তি নিয়ে কিছুটা চেঁচিয়ে বললো তানিয়া। তাতে কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে ইন্দু শান্তস্বরে বলে,

–শোন তানি, প্রলয় ওর মতো থাকবে আর আমি আমার মতো। এতো ভাবার কি আছে!
–বয়স তো কম হলো না তোর, মানুষের কিছু চাহিদা থাকে, স্বপ্ন থাকে। এভাবে কতোদিন ইন্দু? ভাই যদি চলে যায় তোর জীবন থেকে, তাহলে কে তোর খেয়াল রাখবে?
–প্রলয় কখনোই আমাকে একা ফেলে যাবে না, আমি জানি।
–এভাবে বেশিদিন থাকা যায়না ইন্দু, ভাই একদিন না একদিন যাবেই।
–অবশ্য সেটাই আমি চাই, প্রলয় এই মিথ্যে বন্ধনটা ভেঙ্গে চলে যাক। বাঁচতে শিখুক। আমার জন্য নয়,ওর নিজের জন্য। যেনো আমি না থাকলেও ও ভালো থাকে তার জন্য!
–তুই চাস ভাই তোর থেকে দুরে চলে যাক!
–হুম চাই তো।
–তুই এভাবে বলতে পারলি?
–হ্যাঁ পারলাম, আমি তো কোনো মিথ্যে বলিনি। যা সত্যি তাই বললাম, আমি চাই ও আমায় ছেড়ে যাক, নিজের জন্য যাক।
নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড় তো তানি, তোরা কেউই আমাকে বুঝবি না…
–ইন্দু…

এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না ইন্দু… “তোমরা কেউ আমায় কোনোদিন বুঝবে না, কোনোদিনও না। আমি যা করি আমার আপনজনদের জন্য করি, আমি স্বার্থপর নই। আমি কাউকে পেছনে পড়ে থাকতে দেবোই না, সবাইকে তাদের প্রাপ্যটা ঠিক বুঝিয়ে দেবো”। নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছে ইন্দুবতী, মেয়েটার মনে যে কি চলছে তা একমাত্র সে’ই জানে।

২৪

–তুই, এখানে! কি চাই তোর?

দরজা খুলে তির্থকে দেখে তানিয়া কিছুটা চেঁচিয়েই কথাটা বললো। তানিয়ার অগ্নিদৃষ্টি দেখে কিছুটা বিব্রতবোধ করছে তির্থ তাই মৃদুস্বরে বলে,

–ইন্দুকে একটু ডেকে দে না রে তানি…
–কেনো?
–বারে, আমি কি তোর কাছে এই প্রথম ইন্দুর খোঁজ করছি নাকি?

তানিয়ার সঙ্গে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে তির্থ কথাটা বুঝতে সময় লাগে না তানিয়ার। তাই দাঁত কটমট করে বলে,

–অতীত আর বর্তমানকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলিস না প্লিজ। আচ্ছা, তুই কেনো ফিরলি তির্থ? কেনো?
–কেনো আবার! ইন্দুকে নিজের মনের কথা জানাতে…
–মনের কথা!
–হ্যাঁ, ইন্দুকে মনে হয় আমি ভালোবাসি।ওর প্রতি অনুভূতিটা খুব বেশি…
–তুই ইন্দুকে যে পরবর্তিতে কষ্ট দিবি না তার নিশ্চয়তা কি?
–তানি, তুই তো আমাকে চিনিস। আমার কথার কখনো নড়চড় হয়না তাও তো জানিস। তবে কেনো রাগ করছিস? এখন কি কান ধরবো?
–কে এসেছে বউমা?

মনিরার গলার স্বর পেয়ে পিছন ফিরে তাকায় তানিয়া। মনিরা দরজার কাছে এগিয়ে এসে তির্থকে দেখে কিছু বলে না, তাকে চুপ থাকতে দেখে তানিয়াই বলে,

–মা…

তানিয়াকে থামিয়ে মনিরা তির্থকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–আরে তুমি! কেনো এসেছো? আমার মেয়ের জীবনে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই, চলে যাও।
–আন্টি, আমি আর আগের মতো নেই।কলকাতার একটা বড় কলেজের প্রফেসর আমি, এবারও কি আমাকে নিজের মেয়ের জীবনে আপনি চাইবেন না?

তির্থর কথাটা কানে যেতেই মনিরা গম্ভীরস্বরে বললেন,

–কি করে চাইবো? বড়দের সঙ্গে দেখা হলে যে পা ছুঁয়ে সালাম করতে হয় সে সহবোধটাওতো তোমার নেই।
–সরি আন্টি।

মনিরা বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করলো তির্থ, মনিরা তার মাথায় হাত দিয়ে বলে,

–থাক বাবা থাক, কতো বড় হয়ে গেছো।
–কি যে বলেন আন্টি!
–বউমা, রামুকে বলো ওকে চা নাস্তা দিতে। কতো দুর থেকে এসেছে বলো তো।
তা বাবা, কলকাতা থেকে কবে এলে?
–এইতো আন্টি এক সপ্তাহ।

কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না তানিয়া, মনিরা বেগমের এরূপ রঙ পাল্টানো তাকেও বেশ চমকে দিচ্ছে। আপনমনেই বললো, “মায়ের হঠাৎ কি হলো! এতোদিন তো তির্থের নাম শুনলেই ভড়কে যেতো আর আজ, কেনো করছে এমন মা! কি চায় উনি”! তানিয়াকে দরজার সামনে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনিরা ডেকে বলে,

–বউমা… ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? চা নাস্তার ব্যবস্থা করো!
–যাচ্ছি মা।

রায়হান চৌধুরি আজ একটু জলদি বাড়ি ফিরেছেন, শরীরটা তার ভালো লাগছে না। বাড়িতে ঠুকেই তির্থকে দেখতে পেয়ে বেশ চমকে ওঠেন তিনি। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

–তুমি! মনিরা একে এখানে বসিয়ে রেখেছো কেনো? চলে যেতে বলো…

রায়হান সাহেব রেগে গেলে মনিরা চৌধুরির নাম ধরে ডাকেন, এখনও তাই করলেন। মনিরা এগিয়ে এসে নিচুস্বরে বলে,

–ওগো তুমি শান্ত হও, তির্থ কতো বছর পর এসেছে বলো তো। তুমি উপরে চলো, আমি বলছি তোমাকে।
–কি বলবে তুমি?
–তুমি চলো না।

ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেন মনিরা চৌধুরি। রায়হান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–তুমি কি বলোতো, ছেলেটা কতো বছর পর এলো!
–তো কি করবো, ওর জন্য আমার মেয়ে কতো কষ্ট পেয়েছে ভুলে গেছো?
–না ভুলিনি, কিন্তু ভেবে দেখো ইন্দু আজও ওকে পছন্দ করে।
–আমি প্রলয়ের সঙ্গে ইন্দুর বিয়ে দেবো, আমার জানা মতে তুমিও তো তাই চাইছো।
–কে বললো, প্রলয়ের কি আছে বলোতো!সেইতো আমাদের দয়ায় আছে, আমার মেয়ের সঙ্গে ওর যায়? তবুও দায়ে পড়ে চেয়েছিলাম, কিন্তু তির্থ যখন ফিরেছে তখন আর কেনো প্রলয়কে মেয়ে জামাই বানাবো!
–মানে!
–মানে, ভেবে দেখো তির্থ অনাথ। তবে তার অঢেল সম্পত্তি, আর বর্তমানে সে কলকাতার একটা কলেজের প্রফেসর।সুতরাং তির্থের সামনে প্রলয় কিছুই না, তির্থের সঙ্গেই ইন্দুর বিয়ে হবে। তুমি আর দ্বিমত করো না তো।

রায়হান সাহেব গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

–ইন্দু কোথায়?
–ও কোনো একটা অনুষ্ঠানে গেছে, প্রধান অতিথি হয়ে।
–ইরফান আর প্রলয়?
–ওরাও সঙ্গে গেছে।
–ওরা ফিরুক, ইন্দু মা যা চাইবে তাই হবে।

২৫

–জানিস তো ভাই আজকে আমার খুব ভালো লেগেছে, কি সম্মানটাই না দেখালো ওরা! আর বাচ্চাদের নাচগুলোও দারুন।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময় হাত নেড়ে কথাগুলো বলছিলো ইন্দু, তার উচ্ছ্বাস দেখে মুচকি হেসে প্রলয় বলে,

–হ্যাঁ ইন্দুবতী যা বলেছো, বাচ্চারা সত্যিই দারুন নেচেছে।
–কিরে ভাই, কিছু বল! সামনে কি দেখছিস?

ইরফানের দৃষ্টি অনুসরন করে সামনে তাকাতেই ইন্দুর গলা দিয়ে আপনা আপনিই বের হয়ে আসে,

–তির্থ, তুই এ বাড়িতে!

ইরফান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ইরফানের শার্টর কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলে,

–তোর সাহস কি করে হয় আমার বাড়িতে আসার? বের হ, বের হ এ বাড়ি থেকে!
–ভাই, তুই কি করছিস… ছাড় তির্থকে! ভাই…

ইরফানের সঙ্গে ইন্দু পারছে না দেখে প্রলয় এগিয়ে এসে ইরফানকে ধরে। ওকে টানতে টানতে বলে,

–ইফু, ছাড় ওকে… ইফু!
–ইরফান…

মনিরা এগিয়ে এসে ঠাস করে ইরফানের গালে জোরে চড় বসিয়ে দেয়, তারপর চেঁচিয়ে বলে,

–কি করছিস কি এসব? আমি তোকে ছোট থেকে এ শিক্ষা দিয়েছি?
–মা, তুমি একে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছো কেনো? আর এই অসভ্যটার জন্য আমাকে মারলে!
–তির্থ বাবা, তুমি আজ যাও। আমি তোমাকে মতামত জানাবো কেমন।
–জ্বী আন্টি, আসসালামুলাইকুম।

তির্থ বেরিয়ে যেতেই মনিরা আবার চেঁচিয়ে বললো,

–তোর সমস্যা কি ইরফান? তুই জানিস তির্থ কতো বড় চাকরি করে! ওর সঙ্গে বিয়ে হলে ইন্দু অনেক সুখে থাকবে। তাছাড়া ইন্দুতো তির্থকে ভালোবাসে। কিরে প্রলয় তাইতো?

প্রশ্নটা শুনে প্রলয়ের এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে কানে কালা হলো না কেনো, কোনোমতে নিজেকে সামলে বললো,

–হুম।

আর কিছু বললো না প্রলয়, পেছন ফিরে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। কথায় আছে ছেলেদের কাঁদতে নেই, তবে ছেলেরাও কাঁদে। খুব কষ্ট পেলে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে নিরবে কাঁদে, প্রলয়ও তাই করবে আজ। এতোদিন তবুও একটা আশা ছিলো তবে আজ সব শেষ!

২৬

দেখতে দেখতে স্কুলের পুণঃমিলনী অনুষ্ঠান চলে এলো। ইন্দু, ইরফান, তানিয়া, প্রলয় একসঙ্গেই এসেছে।

–ইন্দু, প্রলয় তোরা থাক আমি আর তানিয়া সবার সঙ্গে দেখা করে আসি।
–আচ্ছা ভাই।

তানিয়া আর ইরফান আলাদা হতেই প্রলয় ইন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,

–তির্থ এলো না?
–এখনো আসেনি, তবে আসবে। কেনো বলো তো?
–তুমি তির্থকে বিয়ে করবে?
–না করা উচিত বুঝি?
–না, তা না…
–তবে কি?
–তবে… না, কিছু না।
–তা আমার তো একটা হিল্লে হলো, তুমি কবে বিয়ে করবে?
–দায়িত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাই, তারপর নিজের জীবন গুছাবো। জীবনটা গুছানোর পর কাওকে না কাওকে পেয়েই যাবো।
–ওইতো তির্থ আসছে।

আঙ্গুল তুলে সামনে ইশারা করলো ইন্দু, প্রলয়ও সেদিকে তাকালো। তির্থ কাছে চলে আসার পর মুচকি হেসে বললো,

–হায়, তির্থ।
–হায়… ইন্দু আমার তোর সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কিছু কথা আছে, চলনা আমার সঙ্গে। এক্সকিউজ আস প্রলয়, প্লিজ।

তির্থ যে প্রলয়ের সঙ্গ পছন্দ করছে তা বুঝতে বাকি রইলো না প্রলয়ের তাই মুচকি হেসে বললো,

–ইয়া, সিউর।

তির্থ-ইন্দুবতী চলে যাচ্ছে, ইন্দুর হাত তির্থের হাতে আবদ্ধ। আর সেদিকে প্রলয়ের দৃষ্টি স্থির, যতোক্ষন দেখা যাচ্ছিলো ততোক্ষন ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো প্রলয়। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো সে! এ যেনো এক নতুন জীবন পেলো প্রলয়, নতুন করে নিজের জন্য বাঁচার মানে খুঁজে পেলো… ইন্দুহীনা জীবন না জানি তাকে কি দিবে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here